#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-৩৩|
ধারা রুমে এসেছে অনেকক্ষণ হলো। কমপক্ষে পনের বিশ মিনিট হলো বিছানার পাশে দাড়িয়ে আছে ধারা। সাহস হচ্ছে না ইভান কে ডাকতে তার। না জানি গতকাল রাতের তার ওমন নির্লজ্জের মতো কাজের জন্য তাকে কি নাকি ভেবে বসে আছে। সে কথা ভেবে ধারার গাল লালচে হতে শুরু করে। ওদিকে বেলা বাড়ছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর চলবে না। ধারা ধীরে পা বাড়ায়। একদম ইভানের মাথার কাছে বিছানায় পাশে দাঁড়ায়। তেমন নিশ্চিন্তে আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। ইশ! দেখতে কি সুন্দর লাগছে। ধারার একদম ইচ্ছে করছে না এই ইভান নামের ছেলেটা ঘুম ভাঙ্গাতে। ওদিকে যে আবার মেহমান আসতে শুরু করেছে। না, না আর দেরি করা যাবে না একে দ্রুত ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে। মুহূর্তেই চিন্তা মহাসমুদ্রে পরে ধারা। কী বলে সম্মোধন করে ডাকবে একে? ভাইয়া? ছিঃ ছিঃ কেউ নিজের স্বামীকে ভাইয়া বলে ডাকে না কী। তাহলে? জামাই? ইশ! লজ্জা, লজ্জা। লোকে শুনলে কী বলবে! ধারার ভাবনার সমাপ্তি ঘটে ইভানের নড়ে চড়ে ওঠায়। ধারা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মিহি গলায় বলল,
‘ শুনছেন! বেলা তো অনেক হলো এবার উঠুন ঘুম থেকে। বাইরে আব্বাজান, চাচা জান, ভাইয়ারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। একসঙ্গে নাস্তা করবে বলে। এই যে শুনছেন আপনি?’
না, কোন হেলদোল নেই। সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। ধারা পড়েছে মহা মুসিবতে। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেও সংকোচ বোধ করছে। গতকাল রাতে তার ওমন নির্লজ্জের মতো কাজের জন্য কি ভেবে বসে আছে তা একমাত্র খোদা-ই তালাই জানে। এখন যদি আবার গায়ে হাত দেয়। না না থাক বাবা দরকার নেই। ধারা গলা পরিষ্কার করে আবার বলল,
‘ এই যে আপনি কি শুনছেন আমার কথা?’
ধারা না পেরে ধীরে বিছানায় বসে। উফ চুলগুলো কী সিল্কি তার। ইচ্ছে করছে হাত বুলিয়ে এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিতে। ধারা এমন নির্লজ্জ মার্কা ইচ্ছের জন্য নিজেই নিজেকে ভয়ঙ্কর রকম গালি দিচ্ছে। এই কথা যদি এই লোকটা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তাহলে তার আর লজ্জার শেষ থাকবে না। ধারার ভাবনা ছেদ হয় কারো স্পর্শ পেয়ে। হঠাৎ করে ধারা কে টেনে নিয়ে নিজের সাথে শুইয়ে দেয় ইভান। সে ঘুম কন্ঠে বলল,
‘ কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
মুহুর্তেই ধারার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কিভাবে কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বিস্ময় হয়ে মাথার উপরে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই না দেখলো লোকটা গভীর ঘুমে মগ্ন! এরমধ্যে কীভাবে কী হয়ে গেছে। ধারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ইভানের ঠোঁট জোড়া ধারার কপালে স্পর্শ পায়। তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে নেয় ধারা। শরীরের কাঁপছে ধারার। ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে! তীব্র অনুভূতি শিকার সে। বুকের ধুক! ধুক শব্দটার তীব্রভাবে হচ্ছে। এতটাই তীব্র ভাবে হচ্ছে সেই শব্দ তার বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। পরপরই স্পর্শ পায় ইভান নামের ছেলেটা। সে অনুভব করলো ইভান নামের ছেলেটা তার ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে তাকে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরছে। তার কানে মোলায়েম আওয়াজ এলো,
‘ কথা বলছো না কেনো?’
ঠোঁট জোড়া কপাল থেকে দূরে সরলে, দ্রুত চোখ খুলে ধারা। চোখ খুলতেই ইভানের চোখে চোখ আটকে যায় ধারার। এক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কী দেখছে তার চোখে সে? কত সময় পেরিয়ে গেছে সেদিন খেয়াল নেই কারো। বাইরে শোরগোলের শব্দে ধারা ঘোর কাটে। ইভানের থেকে দূরে সরতে চাইলেন। ইভান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধারা কে। এক হাত দিয়ে ধরার ভেজা চুলগুলো মুখের উপর দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ধীর গলায় বলল,
‘ কাল মনে হয়েছিল তোমাকে বোধহয় লাল শাড়িতে সব থেকে বেশি মানাবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল, একদম ভুল। টকটকে গোলাপি রঙের শাড়িতে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে করছে সারাদিন তোমাকে আমার চোখের সামনে বসিয়ে দুচোখ ভরে দেখতেই থাকি। কিন্তু আফসোস, আজ তোমাদের বাড়িতে মেহমান আসবে। স্পেশালি আমাকে দেখতে। তাদের বাড়ির মেয়ের হাসবেন্ড কেমন হয়েছে তা দেখতে। এসব কথা কাল রাতে তোমার বাবা আমাকে বলছে। তুমি জানো তোমার ভেজা চুলে তোমাকে কী স্নিগ্ধ লাগছে!’
এইটুকু বলে থামে ইভান। এদিকে ধারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইভান আবারও বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,
‘ আচ্ছা, তুমি কি বাই এনি চান্স আমাকে মেরে ফেলারও প্ল্যান করেছো?’
মুহূর্তের ধারার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। টানা কাজল পরা এমন বড় বড় চোখ দেখে ইভান দিশেহারা। ইভান আর কালবিলম্ব না করে ধারার চোখের দুই পাতায় চুমু দেয়। ধারার কাঁপা কাঁপি স্পষ্ট দেখার মত। ধারার নিঃশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। সে কী মারবে ইভান কে? ইভান ই তো মেরে ফেলতে চাইছে। ধারা আর নিতে না পেরে ছোট করে বলল,
‘ আ… আমি ক… কখন আ… আপনাকে মা… মারতে চাইলাম?’
ধারা কাঁপা কাঁপা গলায় কোন মতে প্রশ্ন করল ইভান কে। ইভান সে ভাবলেশহীন ভাবে ধারার খোলা চুল নিজের এক আঙ্গুলের পেছাতে পেছাতে বলল,
‘ মারতে চাওনি বলছো? কিন্তু তুমি যে আমাকে মারার প্ল্যান করে বসে আছো। এমনিতেই তোমার জন্য দিশেহারা আমি। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য আমি হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। আর তুমি আমার দিকে না তাকিয়ে নিষ্ঠুরের মত বারংবার চলে যাও। তার উপরে তোমার এই ভেজা চুল, টুকটুকে গোলাপি রঙের শাড়ি পরে আমার সামনে আসা। এই সব কিছু আমাকে দিশেহারা করে। তোমাকে এমন অবস্থায় দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। হার্ট বিট বেড়ে যায়। এতগুলো রোগ তুমি আমার ভিতর সৃষ্টি করো। তারপরও বলবে তুমি আমাকে মারার প্ল্যান করো নি?’
ধারা আলতো চোখে ইভানের দিকে তাকায়। সে কি বলেছে সবই তার মাথার উপর দিয়ে গেছে। এত ছোট মাথায় এত কঠিন কঠিন কথা কি আর ঢুকে। ধারা ধীর গলায় বলল,
‘ কি বলছেন আপনি এগুলো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। দিশেহারা, ভেজা চুলে, শাড়ি, দম বন্ধ হয়ে আসা, রোগের সৃষ্টি এসব কী বলছেন আপনি?’
ইভান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে। তার বউ যে অতিরিক্ত ছোট মেয়ে। একদম পিচ্চি। তার কী এসব কথা বোঝার এখন বয়স হয়েছে? উঁহু না। তাকে তার পিচ্চি বউ কে নিজের মতো করে গড়ে নিতে হবে। ইভান মিষ্টি হেসে বলল,
‘ তুমি তো এখনো অনেক পিচ্চি তাই এসব কথা বুঝবে না। যেদিন পূর্ণাঙ্গরূপে বড় হয়ে যাবে সেদিন এসব কথা অনুভব করতে পারবে।’
ধারা কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ এই যে শুনুন আমি মোটেও পিচ্চি নই। ক্লাস এইট এর পরীক্ষা দিয়েছি আমি এবার ক্লাস নাইনে উঠবো। সুতরাং আমাকে একদম পিচ্চি বলবেন না।’
ইভান হাসে। শব্দ করে হাসে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বলল,
‘ কে বললো তুমি পিচ্চি? তুমি তো ইয়া বড় হয়ে গেছে।’
এইটুকু বলে ইভান আবারও হাসে। ধারা সে তো ইভান কী বললো কিছুই শুনতে পায়নি। ইভানের বুকে দুহাত দিয়ে ভর করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ধারা। উফ! কী সুন্দর হাসি। হাসি দেখেই ধারা ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে না কী? বাম গালের মাঝ বরাবর একটা ছোট একটা টোল পড়ে। তা ছেলেটার হাসির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়। স্পর্শ পায় ধারা। ভাবনা শেষ করে তাকায়। ইভান ধারার নাক ডান হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে বলল,
‘ কী গো আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছো কেনো? আমার কিন্তু তোমার এমন চাওনি দেখা লজ্জা করছে। আমার এই লজ্জার কোথায় রাখবো।’
ইভানের এমন কথা শুনে ধারা লাফ দিয়ে ইভানের বুকের উপর থেকে উঠে পড়ে। কী সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা। এই ছেলের না কী আবার লজ্জাও করে? ধারা দাঁড়িয়ে নিজের শাড়ি ঠিক করে নেয়। মাথা উপর থেকে শাড়ির আঁচল পড়ে গেছে। দাদি আম্মা মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে। ঘোমটা টেনে দেওয়ার সময় বারবার বলে দিয়েছে,
‘ আজ বাড়িতে প্রচুর মেহমান আসবে। নতুন বউ তুই। আজ তোর শাশুড়ি আর ভাশুর আসবে। আজ যেনো তোর মাথায় কাপড় থাকে। এক মুহুর্তের জন্য কাপড় না সরে তোর মাথা থেকে।’
ধারা মাথায় তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ বেলা তো অনেক হলো এবার উঠুন বিছানা দেখে। বাইরে আব্বাজান, চাচা জান, ভাইয়ারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। একসঙ্গে নাস্তা করবে বলে। নিন তাড়াতাড়ি উঠুন আমি বিছানা গুছিয়ে নেই।’
ইভান বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে দুষ্টুমি হেসে বলল,
‘ আমার আর নাস্তা করা দরকার নেই। সকাল সকাল স্পেশাল ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেছে। তাতেই আমার সারাদিন পেট ভরা থাকবে।’
ধারা গাল লজ্জায় লাল করে বিড়বিড় করে বলল,
‘ অসভ্য, নির্লজ্জ কোথাকার।’
চলবে….