অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-৪০

0
3068

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-৪০|

ইভানের ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে সকালটা পাড় করে ধারা। ধারা প্রতিবারের মত ইভানের ভালোবাসার ছোঁয়ায় লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে। তা দেখে ইভান ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে।

সকাল-সকাল ধারার আব্বাজান সবাইকে তাড়া দিয়ে তৈরি হতে বলেছে। তার কথা এখান থেকে ঢাকা যেতে মেলা সময় লাগবে। সে চাচ্ছে সন্ধ্যা নামার আগেই সে যেন সবাইকে নিয়ে বিয়াই বাড়ি পৌঁছে যেতে পারে। তাঁর কথামতো বাড়ির মেয়ে বউ রা তৈরি হচ্ছে। মিতা বেগম গতকাল রাতেই ওদের জন্য চারটে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। নতুন বউকে নিয়ে যেন কোন ঝামেলা ছাড়াই তারা দ্রুত আসতে পারে। গাড়িগুলো বাজারের পাশেই স্কুলের মাঠে রাখা আছে। সবাই তৈরি হয়ে একসাথে সেখানে যাবে। ধারার আব্বাজান গ্রামের যে সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করেছে তার সাথে বেয়াই বাড়ি যাওয়ার জন্য তারা সবাই স্কুলের মাঠে একত্রিত হবে। জোনাকির বাপের বাড়ির লোকজন গতকাল বিকেলে খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেছে। জোনাকির বাবা অসুস্থ থাকায় তাদের আর যাওয়া হচ্ছে না। ধারার নানা, নানু বড় মামার তিন সন্তান। বড় মেয়ে মিনু তারপর ছেলে মিজান তারপর ছোট মেয়ে মনি। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বিধায় সে বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেনি। ছোট মামার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে লতা এবং ছোট মেয়ে পাতা। শাহেদা বানুর পরিবার থেকেও কিছু লোক যাবে। এরা সকলেই যাচ্ছে ধারার শ্বশুরবাড়িতে। ইভান সে তৈরি হয় তার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বাইরের উঠানে চেয়ার পেতে বসে সবার জন্য অপেক্ষা করছে। ইভান এদিকে আসার সময় দেখে এসেছে জোনাকি ভাবি আর ধারার আম্মা মিলে ধারা কে তৈরি করাচ্ছে। ধারার চাচি জানের বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসতে পারেনি তাদের বাড়িতে কী সমস্যার জন্য, তবে তারা জানিয়েছে পরে এসে জামাই দেখে যাবে। অভি আর হাবিব ও ওদের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে এসে ইভানের পাশে বসে। হাবিব ইভানের বাড়ি থেকে তার কর্মস্থলে ফিরে যাবে। ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল হাবিব, সে ছুটি ও এখন শেষের দিকে প্রায়। সিলেট শহরের নামকরা অফিসে চাকরি করে সে। অভি সেও ইভানের বাড়ি থেকে নিজের ম্যাচে ফিরে যাবে। এই বিয়ে বিয়ে করে অনেকগুলো ক্লাস মিস গেছে ওর। এখন গিয়ে ক্লাস এটেন্ড না করলে মহামুসিবত পড়বে ও। সামনেই ওর পরীক্ষা। ভালো রেজাল্ট করতে না পারলে তো এতো লেখা পড়ার কোনো মূল্য থাকবে না। এইসব নিয়ে টুকটাক কথা বলছেন দুই ভাই ইভানের সাথে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে সম্রাটের সঙ্গে ইভানের কথা হয়। তখন কথায় কথায় জানতে পারে মিতা বেগম ঢাকা ফিরে যাওয়ার সময় ইভান কে বলছে, সে তার বৌমার বাড়িতে আসতে চাইলে রাস্তায় নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাই সে চাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এদিকে রাস্তাঘাট ঠিক করাতে। মিতা বেগমের শ্বশুরের একজন বন্ধু ছিল তাদের পরিবারের সবাই রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাছাড়া তার স্বামী এবং শ্বশুর তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সবাই কমবেশি মন্ত্রী মিনিস্টার এর সঙ্গে ওঠাবসা আছে। জুয়েল লাবিদ ওদের তো দুই একজন মন্ত্রীর সঙ্গে খুব গলায় গলায় ভাব। তাই রাস্তার সমস্যাটা নিয়ে খুব একটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না কাউকে। এদিকটা মিতা বেগম সামলে নিতে পারবে। এসব কথা শুনে সম্রাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক এতদিনে তাহলে ওদের গ্ৰামে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগবে।

ধারার আম্মা ধারা কে পই পই করে বলে দিয়েছে, ধারা যেন গাড়িতে জামাইয়ের পাশে বসে। জামাই বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন যা বলে তা যেন ধারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। যারা নিমন্ত্রিত ছিল এবং বাড়ির লোকজন সবাই মিলে তিনটে বাড়িতে ঠিকভাবে বসেছে। বাকি আছে শুধু ধারা আর ইভান। ধারা ইভানের সাথে একা যাবে ভাবে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ইভান ধারার ভয় কমানোর জন্য চেয়েছিল ওর মামাতো শালিকাদের মধ্যে কেউ একজন এসে ওদের সঙ্গে বসুক। কিন্তু ধারার দাদি আম্মা একথায় তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তিনি ইভানকে মৃদু স্বরে বলেন, সবাই যখন একবার বসেই পড়েছে তোমরা না হয় দুজনে একসাথে এসো নাত জামাই। ইভান বিনা বাক্যে তার দাদী শাশুড়ির কথা মেনে নেয়।

এদিকে জুয়েল লাবিদ রুমি ঢাকা ওদের বাড়িতে না গিয়ে সোজা মিতা বেগমের সঙ্গে তার বাড়ীতে চলে আসে। জুয়েল তার বউয়ের ভয়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু মিতা বেগমে লামিয়া কে আর লামিয়ার বাবা কে ফোন করে তাদের বাড়ি আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। রুমি বাপের বাড়ির কেউ এই মুহূর্তে বাড়িতে নেই। রুমির ফুপির ছোট মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে সবাই পাড়ি জমিয়েছে সিঙ্গাপুরে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ। ধারা দের গাড়িতে পিনপিনে নীরবতা। ধারা অসস্থি, ভয়, লজ্জা সব মিলিয়ে ইভানের সঙ্গে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে ইভান ধারার দিকে খেয়াল না দিয়ে মনে মনে কিছু একটা প্ল্যান করতে ব্যস্ত। মনে মনে প্ল্যান‌ করে আনমনে হাসে ইভান। ধারা এক নজর ইভানের হাসির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় সে। সে দৃশ্য ইভানের চোখের আড়াল হলো না। ইভান আর ধারা গাড়ীর পিছনের সিটে বসেছে, সামনে ড্রাইভার গাড়ী ড্রাইভ করছে। ইভান একটু একটু করে এগিয়ে ধারার একদম কাছে দিয়ে গা ঘেঁষে বসে। ধারা একটু নড়েচড়ে উঠে ইভানের দিকে তাকায়। ইভান এমনভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন সে কিছুই জানেনা। ধারা ইভানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ আপনি এমন করছেন কেন বলুন তো? সকালে আমাকে ওতক্ষণ জ্বালানোর পরও আপনার মনের শান্তি মেটেনি? এখন আবার শুরু করতে চাচ্ছেন আপনি ওসব। গাড়িতে যে আমরা দুজন ছাড়া আরো মানুষ আছে সেদিকে খেয়াল আছে আপনার?’

ধারা কথা শেষ হলে ইভান আস্তে করে ধারার দিকে ঘোরে। ঠিক তখনি ঘটে সর্বনাশ। ধারার ঠোঁট স্থান পায় ইভানের গালে। মুহুর্তে ই চমকে ওঠে দুজনেই। হঠাৎ করে এমন ঘটনা ঘটবে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ইভান সে চোখ বড় বড় করে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। আলতো করে চোখ ফেলে দেখছে তাকে। ইভানের এমন দিশেহারা চেহারা দেখে ধারা শুকনো গলায় ঢোক গিলে। না জানি এই লোকটা তাকে এখন কী করে বসে। ধারা এসব চিন্তা করে ইভানের দিকে আবার তাকানোর আগের শীতল হাতের স্পর্শ পায় ধারার কোমরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাঁচকা টানে সে ইভানের কোলে বসে পড়ে। যখন ধারা বুঝতে পারে সে ইভানের কোলে সেই মুহূর্তে ধারা ওর হাত-পা দিয়ে ছোড়াছুড়ি করতে করতে ধীর গলায় বলল,

‘ কী করছেন কী ছাড়ুন আপনি আমায়। সামনে একজন বসে গাড়ি চালাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল আছে আপনার। আপনার এসব আচরণ দেখে তিনি কী ভাববেন?’

ইভান ধারা কে শক্ত করে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আমি তো অন্য কারো বউকে আমার কোলে বসাই নি। আমার নিজের একমাত্র বউ কে তো আমার কোলে বসিয়েছি। এতে অন্যায়ের কিছু নেই। যা করেছি একদম বেশ করেছি। তুমি আর একবার
পটর পটর করলে এই ড্রাইভার এর সামনে কিন্তু আমি তোমাকে চুমু খেয়ে বসবো। তখন কিন্তু তুমি আবার আমাকে দোষ দিতে পারবে না। তাই বলছি চুমু খেতে না চাইলে চুপচাপ আমার কোলে বসে থাকো।’

ব্যাস, ধারা একদম চুপ। চুপ করে বসে আছে ইভানের কোলে। ইভানের বুকে মাথা রেখে আলতো চোখে মাথা উঁচু করে ইভানের দিকে তাকায়।

দুপুরের পর গাড়িগুলো থামায় রাস্তার পাশে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। একে একে সবাই রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে। ধারা রা এখানো গাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। ধারা ইভানের বুকে মাথা রেখে বসে থাকা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ইভান ও ওকে আর ঘুম থেকে তুলেনি। গাড়ি থামার খানিক পরে ইভান ধারা কে ডেকে ঘুম থেকে তুলে। ধারা ইভানের বুকে নিজেকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে দ্রুত সরে যায় ইভানের কাছ থেকে। তা দেখে ইভান হাসে।

ধারা রেস্টুরেন্টে আর ইভানের কাছে বসেনি। জোনাকি ভাবি আর মামাতো বোনদের সঙ্গে বসেছে ধারা। ইভান কে ধারার আব্বাজান ডাকে তার টেবিলে নিয়ে বসিয়েছে। জোনাকি ধারার চোখ মুখ ফোলা দেখে একবার ভেবেছিলো জিজ্ঞেস করবে পরে আবার কী ভেবে চুপ হয়ে যায়। টুকটাক কথাবার্তা মধ্যে দিয়ে খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ করে সবাই।

সন্ধ্যা হওয়ায় আগেই ইভানদের বাড়ির সামনে তিনটা গাড়ি থামে। একে একে গাড়ি থেকে ধারার বাড়ির সকলে নামতে শুরু করে। সবার চোখ ছানাবড়া। তারা যা ভেবেছিল তার থেকেও অধিক বড়লোক ধারার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তাদের বাড়ির মেয়ে এই বাড়ির আদরের ছোট বউ এই ভেবেই ভিতরে ভিতরে খুশিতে পুলকিত হয়ে উঠছে সবাই। মিতা বেগম, রুমি, লাবিদ, জুয়েল, সালমা সবাই তাদের সমাদরে আপ্যায়ন করে। হল রুমে বসার পরে সালমা আর রুমি তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। মিতা বেগম ধারার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ ভাইজান আমার ছেলে আর ছেলের বউ কোথায়? আপনাদের সাথে ই তো ওদের এসে পরার কথা।’

ধারার আব্বাজান চিন্তার সুরে বলল,

‘ সেটা নিয়েই আমি চিন্তা করছি আপা। এতক্ষণে ওদের এসে পড়ার কথা। কিন্তু….

এইটুকু বলে থেমে যায় ধারার আব্বাজান। জুয়েল তাদের আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘ আরে চিন্তা করো না হয়তো জ্যামে আটকে পড়েছে ওদের গাড়িটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা চলে আসবে।’

জুয়েলের কথা শেষ হতে না হতেই বাড়ির বাইরে গাড়ির শব্দ পায়। লাবিদ কান খাড়া করে শুনে বলল,

‘ ওই যে আম্মু এসে গেছে তোমার আদরের ছোট ছেলে। সালমা আন্টি যাও গিয়ে দরজা খোলো তোমার বাবু চলে এসেছে।’

মিতা বেগম রুমি আর সালমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ বরণ ডালার সবকিছু রেডি তো।’

রুমি ছোট করে বলল,

‘ হ্যাঁ আম্মু আমি সবকিছু গুছিয়ে রেখেছি। এখন শুধু তুমি ওদের বরণ করে ঘরে তুলবে ব্যাস।’

সালমা এসে মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে খানিকটা উত্তেজিত সুরে বলল,

‘ আপা বাবু আপনাকে বাড়ির বাইরে যেতে বলেছে। না হলে সে বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকবেনা বলে দিয়েছে।’

মিতা বেগম বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুমির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ বৌমা তুমি বরণডালা নিয়ে এসো। আমি ওদিকে গিয়ে দেখি ওর আবার কী হয়েছে।’

মিতা বেগমর পিছন পিছন একে একে সবাই উঠে আসে। মিতা বেগম দরজার কাছে এসে দাঁড়ানোর আগেই ইভান মৃদু চিৎকার করে বলল,

‘ আম্মু প্লিজ তুমি ওখানে দাঁড়াও, এখানে আসার দরকার নেই।’

লাবিদ ওর আম্মুর পাশ দিয়ে হেঁটে এসে ইভানের সামনে এসে বলল,

‘ কী রে তোর আবার কী হয়েছে? আর ধারা কোথায়?’

এরমধ্যে রুমি এসে বরণডালা মিতা বেগমের হাতে দিয়ে ইভানের কাছে এসে বলল,

‘ তোরা তিন ভাই এক একটা ড্রামাবাজ। দেখি সর আমি ধারা কে নিয়ে যাই। আমার মনে হয় ধারা গাড়িতে আছে।’

ইভান রুমিকে বাধা দিয়ে বলল,

‘ আমি থাকতে তুমি কষ্ট করবে কেন ভাবি? আমি নিয়ে যাচ্ছি আমার বউকে।’

ইভান হেঁটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকেই ধারা কে পাঁজাকোলে করে কোলে তুলে নেয়। মুহুর্তেই রুমি মুখ হা করে বলল,

‘ ও মাই গড।’

ধারা কে একদম নতুন বউয়ের মত সাজানো হয়েছে। লাল টুকটুকে শাড়ি গয়নাগাটি সবকিছু দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছে ধারা কে। ধারার পরিবার ও ওর দিকে হা করে তাকিয়ে ওকে দেখছে। ইভান ওকে নতুন রূপে সাজিয়ে এনেছে। ধারা লজ্জায় কারো দিকে তাকাতে না পেরে দুহাত দিয়ে ইভানের গলা পেঁচিয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইভান ধারার দিকে এক নজর তাঁকিয়ে পরে রুমির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ধারা আমার বউ ওকে তো আর যেন তেন ভাবে গৃহ প্রবেশ করাতে পারি না। ওর গৃহপ্রবেশ হবে সবার থেকে আলাদা।’

লাবিদ হেসে দিয়ে বলল,

‘ হইছে এবার বলেন আম্মু অনেকক্ষণ ধরে হাতে বরণডালা নিয়ে বসে আছে।’

ইভান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় লাবিদের কাথায়। ধারা কে কোলে নিয়ে হেঁটে এসে দরজার সামনে দাঁড়ায় ইভান। মিতা বেগম হাসিমুখে বরণ করে ঘরে তুলে ওদের। ধারার আব্বাজানের বুকটা খুশিতে ভরে উঠেছে। তার মেয়েটা ভবিষ্যতে সুখে থাকবে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইভান ধারা কে সোফায় বসিয়ে ওর থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। মিতা বেগম ধারার পাশে বসে ওর সঙ্গে টুকটাক ভালো মন্দ কথা বলছে। হঠাৎ কী মনে করে রুমি বলল,

‘ আম্মু তোমার ছোট ছেলে তো ধারা কে একদম নতুন বউ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। তা সে নতুন বর সাজে নি কেন? তাহলে তো ষোল কলা পূর্ণ হয়ে যেতো।’

রুমির কথা শুনে ইভান লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলল,

‘ যাহ আমার লজ্জা করেনা বুঝি।’

ইভানের কথা বলার ধরন দেখেই সবাই হা হা করে হেসে দেয়। ধারা চোখ বড় বড় করে ইভানের দিকে তাকায়। এই ছেলের নাকি লজ্জা ও আছে সেটা তাকে বিশ্বাস করতে হবে? মিতা বেগম হাসি থামিয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ এতদুর জার্নি করে এসেছো জানি ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। আরেকটু সময় অপেক্ষা করো। আমাদের পরিচিত একজনের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেবো। তারপরে তুমি ইভানের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিও। আর তোমার বড় জা এবং তার পরিবার আসতে আসতে রাত আটটা নয়টা বাজবে। তোমরা বস আমিও দিক থেকে দেখে আসিস সালমা কতদূর কী করলো।’

মিতা বেগম উঠে গেলে। ধারার ভাবি এবং মামাতো বোনেরা ওকে জেঁকে ধরে। ধারার রূপের প্রশংসা সবাই পঞ্চমুখ। ইভান কখন ওকে এই ভাবে সাজিয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। ইভান ও পাশের সোফায় বসে সম্রাট, হাবিব আর অভির সঙ্গে কথা বলছে। হঠাৎ লাবিদের ফোন আসায় সে উঠে চলে যায় মাঝখান দিয়ে। তা দেখে জোনাকি কিছু মনে করে ধারা কে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ তোর ফোন কোথায় রে? জান্নাত তোকে ফোনে না পেলে আমাকে ফোন করেছিল। তখন আমি গাড়িতে ছিলাম বিধায় ভালো করে কথা বলতে পারিনি। কথা বারবার কেটে কেটে আসছিল। তবে এটুকু শুনতে পেয়েছি আজ নাকি তোদের রেজাল্ট দিয়েছে?’

ধারা শুকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,

‘ হ্যাঁ।’

হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ একজন গম্ভীর গলায় বলল,

‘ রোল নাম্বার আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বার বল আমাকে তাড়াতাড়ি।’

ধারা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ইভান দাঁড়িয়েছে তার পিছনে। শুকনো গলায় আবারো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় রোল নাম্বার আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বার বলে দেয় ধারা। ইভান সে মোবাইলের স্ক্রিনে ফটফট করে কী সব জানো লিখছে। কয়েক মুহুর্ত পরে সে জোরে চিৎকার করে বলল,

‘ আম্মু! আম্মু, কোথায় তুমি?’

হঠাৎ ইভানের এমন চিৎকার শুনে সবাই ঘাবড়ে যায়। ধারার ভয়ে হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। না জানি সে ফেল করে বসল কিনা? তাহলে তো আর শ্বশুর বাড়ির সামনে তার আর কোন মান সম্মান থাকলো না। এরমধ্যে মিতা বেগম এসে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ কী হয়েছে এভাবে চিৎকার করছিস কেন?’

ইভান একনজরে ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আম্মু তুমি কী জানো আজ আমার ছোট ছেলের বউয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে?’

মিতা বেগম অবাক গলায় বলল,

‘ সে কী কই না তো আমি তো কিছু জানিনা? তা বৌমার রেজাল্ট কী?’

ইভান মৃদু হেসে বলল,

‘ তোমার বৌমা সে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে।’

মিতা বেগম খুশি হয়ে বলল,

‘ সত্যি?’

ইভান সে তার ফোনের স্ক্রিনে ধারার রেজাল্ট তার আম্মু কে দেখায়। মিতা বেগম খুশি হয়ে ধারা কে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। ধারার খুশি দেখে কে? ওর তো ইচ্ছে করছে এখনই এখানে নাচতে শুরু করতে। প্রথমে কী ভয়টা না পেয়েছিলো বেচারী। রুমি এসে ধারার এক পাশে বসে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার রেজাল্টের কথা শুনে। আমার আর তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে ভালো রেজাল্ট করার জন্য কিন্তু গিফট পাওনা রইল তোমার। দোয়া করি তোমার ভবিষ্যত যেনো খুব সুন্দর হয়। আচ্ছা এরপরে তোমার প্ল্যান কী? কী বিষয় নিয়ে পড়বে তুমি সাইন্স আর্টস না কী কমার্স?’

ধারা মৃদু স্বরে বলল,

‘ আমার তিনো ভাইয়া কমার্স নিয়ে পড়েছে। তাই ভাবছি আমিও কমার্স নিয়ে পড়বো।’

মিতা বেগম ধারার কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,

‘ কমার্স নিয়ে কী ব্যবসা করবে? আমাদের বাড়িতে ব্যবসায়ী লোকের অভাব নেই বৌমা। তোমার শ্বশুর মানে ইভানের বাবা আর আর আমি চাইতাম আমাদের তিন ছেলের মধ্যে যে কোন একজন ডাক্তার হোক। কিন্তু আমার তিন ছেলেকে দেখো দুজনেই তাদের খানদানি ব্যবসায়ী ঢুকে পড়েছে। আর ছোটটা সে তার ইচ্ছামত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। তোমার শ্বশুর বাবা তোমার দাদা শশুরের নামে একটা হসপিটাল তৈরি করেছে। আমরা চেয়েছিলাম ওই হসপিটাল এর দায়িত্বে আমাদের পরিবারের কেউ থাকুক। কিন্তু দেখো আমাদের সেই হসপিটাল এখন অন্যের সাহায্যে পরিচালনা করতে হয়। আমি তোমাকে জোর করছি না তোমার যদি ইচ্ছে হয় তাহলে তুমি ডাক্তারি নিয়ে পড়তে পারো। তুমি ডাক্তার হলে হসপিটালের দায়িত্বে আমাদের পরিবার থেকে অন্তত কেউ থাকবে।’

ধারা মাথা নিচু করে এতক্ষণ সবকিছু শুনেছে। এখন ওর কী করা উচিত তাও নিজেও বুঝতে পারছে না। খুব ইচ্ছে করছে তার শাশুড়ি মাকে প্রতিশ্রুতি দিতে সে পারবে ডাক্তার হতে আবার অন্যদিকে ভয় মনে বাসা বাঁধছে। ডাক্তারি পড়া তো আর সহজ কথা নয়। এমন কত গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া ছাত্র ছাত্রী ডাক্তারিতে চান্স পায়না। সেখানে ও চান্স পাবে কী না তার নিশ্চয়তা নেই। সেখানেও আগে থেকে কিভাবে প্রতিশ্রুতি দেবে ওর শাশুড়ি মাকে?

সন্ধার পরেও অনেক্ষণ হল রুমে বসে সবাই হাসি ঠাট্টা করে। ধারা কে সাথে নিয়ে সবাই স্টাইলে দিয়ে ছবি তুলছে। ধারা সোফায়র এক পাশে দাঁড়িয়ে রুমির সঙ্গে যখন ছবি তুলছিল তখন কোথা থেকে একটা লোকে এসে ধারার বাম হাত টেনে ধরে। ধারা ভয় পেয়ে ঘাবড়ে যায় এমন আচরণে। ধারা লোকটাঊ কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে কিন্তু তার শক্ত হাতের সঙ্গে পেরে উঠছে না। ধারা ইভানের দিকে তাকায়। সে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। লোকটা চোখের ইশারায় ইভানকে কিছু বুঝালে ইভান মৃদু চোখে সম্মতি জানায়। এরমধ্যে ধারার শাশুড়ি মানে মিতা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটাকে দেখে মৃদু স্বরে বলল,

‘ সবুজ ভাইয়া আপনি এখন এসেছেন? আর আপনার জন্য নতুন বৌমা কখন থেকে অপেক্ষা করছে?’

সবুজ মিতা বেগমের দেখে ধারার হাত ছেড়ে দিয়ে হেসে বলল,

‘ আর বলেন না ভাবি আপনাদের এখানে আসবো বলে বেরোবো তখনই আবার একটা ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে।’

মিতা বেগম সবুজের কথার উত্তর না দিয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ বৌমা ইনি তোমার সবুজ আঙ্কেল? তোমার শ্বশুর বাবার খুব ছোটবেলার বন্ধু তিনি। পেশায় তিনি একজন ডক্টর। আমাদের হসপিটাল টা এখন তার দায়িত্বেই আছে।’

ধারা মৃদু স্বরে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম।’

ডক্টর সবুজ হাসিমুখে বলল,

‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আসলে মা তুমি আমার এমন ব্যবহারের কিছু মনে করো না। আমি তোমার হাতের আঙ্গুলের মাপ নিতে চেয়েছিলাম। তোমাদের বিয়ে উপলক্ষে আমি তোমাদের দুজনকে আংটি উপহার দিতে চেয়েছিলাম।’

ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসি মুখে বলল,

‘ না, না আঙ্কেল আমি কিছু মনে করিনি।’

ডক্টর সবুজ ধারার কথা শুনে হেসে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ বিয়ে তো করে ফেলেছো এখন আর কী বিদেশে পাড়ি জমাবে, নাকি দেশেই সেটেল হয়ে যাবে?’

ইভান ধারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ চারদিন পরে আমার ফ্লাইট আঙ্কেল!’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here