#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-৫৪|
ধারা মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। ইহিতা হল রুমে বসে কার্টুন দেখছে টিভিতে। ইভান রুমে বসে ফোনে জরুরী কথা বলছে। বেচারা খুব ব্যস্ত। বিডিতে ফিরবে বলে সমস্ত কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। অফিস থেকে ফিরেও এখনো কাজ করে যাচ্ছে। ধারা রান্না করার মাঝে সিঁড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে ইভান সিঁড়ি দিয়ে নামছে। ইভান এক নজর রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে হল রুমে ইহিতার কাছে চলে যায়। বেশ কিছু সময় পরে কেউ ধারার কোমর জড়িয়ে ধরে, ধারার কাঁধে তার চিবুক রাখে। ধারা জানে এমন অদ্ভুত কাজ একমাত্র তার সঙ্গে ইভান করতে পারে। ধারা মুচকি হেসে বলল,
‘ কী হয়েছে সাহেবের?’
ইভান ধারার গালে মুখ ঘসে বলল,
‘ টায়ার্ড লাগছে কাজ করতে করতে।’
ধারা অভিযোগের সুরে বলল,
‘ নিজেকে কষ্ট দিয়ে এত কাজ করতে কে বলেছে তোমাকে? যাও রুমে যাও গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও।’
ইভান ধারার পেট আর গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ উঁহু, যাবো না। এইভাবে থাকলে আমার সব ক্লান্তি চলে যাবে। তুমি তোমার কাজে মন দেও। আমাকে আমার কাজে মন দিতে দেও।’
ধারা ইভানের কথা শুনে মুচকি হেসে রান্নার কাজে মন দেয়। ইভান সে নিজের মত ধারা কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
ধারার রান্না শেষ করে মৃদু স্বরে বলল,
‘ রান্না করা তো শেষ এবার তো ছাড়ো আমাকে। আর কতক্ষন এভাবে আমাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে থাকবে?’
ইভান ধারা কে ছেড়ে দিয়ে ধারার সামনে এসে ওর দুই কাঁধে দুই হাত দিয়ে বলল,
‘ সারা জীবন এই ভাবে তোমাকে আমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবো। কেনো? কোন সমস্যা আছে তোমার?’
ধারা ইভানের পেটে হালকা চিমটি কেটে হেসে বলল,
‘ আজ্ঞে না সাহেব। কিন্তু আপনি না চাইলেও এখন আমাকে আপনার ছাড়তে হবে। রান্না করে ঘেমে একাকার হয়ে আমার শরীরের অবস্থা দেখেছেন? এখন আমাকে শাওয়ার নিতে হবে। দেখি সরুন।’
ইভান ব্যথা পাবার অভিনয় করে বলল,
‘ বিল্লু রানী নামটা একদম তোমার জন্য ঠিক আছে। একদম পারফেক্ট নাম তোমার জন্য। খালি কথায় কথায় আমাকে খামচি দিবে, কামড় দিবে না হলে চিমটি কেটে দিবে।’
ধারা ইভানের কথা শুনে ভেংচি কেটে বলল,
‘ হয়েছে তোমাকে আর আমার নামে প্রশংসা করতে হবে না! এখন ছাড়ো আমাকে।’
ইভান ধারা কে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা শোনো খাওয়া দাওয়ার পরে রেডি হয়ে নিও। ফ্লাইট এর টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে। চার-পাঁচদিন পরেই আমাদের ফ্লাইট। আমরা কিন্তু আমাদের যাওয়ার কথা ভাইয়া ভাবি দের কিছু জানাবো না। একদম ডিরেক্ট গিয়ে সারপ্রাইজ দেবো। শুক্রবার আমরা পৌঁছে যাব বিডিতে। যা যা শপিং করার আছে খাওয়া দাওয়ার পরে আমরা সেগুলো গিয়ে শপিং করে আসবো।’
ধারা চিন্তিত গলায় বলল,
‘ এই কয়টা দিনের মধ্যে আমি কী করবো? আমাদের লাগেজ গোছানো হয়নি। তার উপরে এখনও সবার জন্য শপিং করা বাকি।’
ইভান মৃদু স্বরে বলল,
‘ শুধু শুধু চিন্তা করছো কেন? আমি তো আছি আমি সব সামলে নেব।’
ধারা ধীর গলায় বলল,
‘ তুমি মেয়ের কাছে গিয়ে বসো। আমি ততক্ষণে শাওয়ার নিয়ে আসছি।’
ধারা আর কিছু না বলে ওখান থেকে চলে যায়। ইভান গিয়ে ইহিতার পাশে বসে দুষ্টুমি শুরু করে দেয়।
মাঝে রাতে ধারার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশ ফিরে দেখে ইভান বিছানায় নেই। ইভান বরাবর ধারা কে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে তার ঘুম হয় না। অন্যপাশের তাদের মেয়ে। মাঝখানে ধারা ঘুমায়। ধারা ঘুম ঘুম চোখে উঠে বিছানায় বসে আশেপাশে তাকায়। ইভান সোফার ওখানে বসে কী যেন করছে। ধারা আঁকাবাঁকা পায়ে গিয়ে ইভানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে ধারা ইভান কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ তুমি না ঘুমিয়ে এগুলো নিয়ে পড়েছে কেন? আমি পরে এগুলো গুছিয়ে নিতে পারতাম তো।’
ইভান হাত কাজ রেখে ঘুরে ধারা দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমার কী মনে হয় আমি তোমার কাছে তোমাকে সাহায্য করছি? কক্ষনো না। আমার ঘুম আসছিলো না তাই আমি ভাবলাম আমার আর আমার মেয়ের জামা কাপড়গুলো বরং আমি গুছিয়ে নেই। না হলে তোমার যে ভুলোমন পরে দেখা যাবে তুমি আমার এবং আমার মেয়ের সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় গুলো রেখে বাকি সব গুছিয়ে নেবে। কিন্তু আমি থাকবে তা কখনও হবেনা। আমি আমার এবং আমার মেয়ের জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়েছি তুমি তোমারটা গুছিয়ে নিয়ো।’
ইভানের কথা শুনে ধারা হেসে দিয়ে ইভান কে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ তুমি কী জীবনেও শোধরাবে না? আমাকে সাহায্য করছো বললে কী হয়? না। তা কখনো বলবে না ঘুরিয়ে পেচিয়ে উল্টো কথা বলবে।’
ইভান মুখ বাঁকা করে বলল,
‘ আমার বয়ে গেছে তোমাকে হেল্প করতে।’
ধারা আর কিছু না বলে ইভানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। ধারা জানে এই মানুষটা কখনো সত্যি কথা স্বীকার করবে না। সব কাজে মানুষটা তাঁকে হেল্প করবে কিন্তু এমন একটা ভাব ধরবো যেন সে তাকে হেল্প করেনি। সে নিজেকে হেল্প করেছে। অবশ্য ধারা এইসব খুনসুটিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
একটু আগে ধারা দের ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। ধারা ইহিতা কে কোলে নিয়েছে। ইভান লাগেজ নিয়ে হাঁটছে। এয়ারপোর্টের বাইরে রাখা সারি সরি ট্যাক্সি রাখা। ইভান সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে বউ মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়ে। ট্যাক্সিতে উঠে ইভান ইহিতা কে তার কোলে নিয়ে জানলা দিয়ে এটা ওটা দেখিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আর ইহিতা কৌতুহলী চোখে সবকিছু দেখছে। বিকেল পাঁচটা বাজার আগেই ইভান রা পৌঁছে যায় ওদের বাড়িতে। ইভান ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে ধারা আর ইহিতা কে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। বাড়ির দারোয়ান ইভান কে দেখে চিনতে পেরে হাসিমুখে গেট খুলে দেয়। ইভান হাঁটার উপর তার সঙ্গে ভালো মন্দ কিছু কথা বলে। বাড়ির বাগানে ইভানের ভাইয়ের দুই ছেলে খেলাধুলা করছে। ধারা ইতালিতে চলে যাওয়ার পরে কিছুদিন পরে ইভানের বড় ভাইয়া বাড়িতে এসে থাকা শুরু করেছে। বাচ্চাদের থেকে একটু দূরে ইভানের ভাইয়া ভাবি রা বাগানের রাখা চেয়ার টেবিলে বসে কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। তার কেউ এখনো ইভানদের খেয়াল করেনি। ইভান ধারার কোল থেকে ইহিতা কে কোলে নিয়ে ইহিতার কানে কিছু একটা বলে ওকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। ইহিতা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে ইভানের বড় ভাইয়া দের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে টোল পড়া গালে হেসে দিয়ে বলল,
‘ হ্যালো বড় বাবা। হাউ আর ইউ?’
মুহূর্তে সবাই চমকে ওঠে? ও এখন এখানে কিভাবে? জুয়েল তাড়াতাড়ি করে ইহিতার সামনে এসে ওকে কোলে নিয়ে অবাক গলায় বলল,
‘ আই এম ফাইন মামনি। কিন্তু তুমি এখানে কিভাবে? তোমার মাম্মা পাপা কোথায়?’
ইহিতা হাতের ইশারায় গেটের দিকে তাকাতে বলে। ইভান আর ধারা হাসি মুখে এদিকে আসছে। এরমধ্যে জুয়েল আর লাবিদের ছেলে দুটো ইহিতা কে দেখে খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। ইভান এসে লাবিদ কে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ কেমন আছো ভাইয়া তোমরা?’
লাবিদ ভাইকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমরা ভালো আছি, কিন্তু তোরা হঠাৎ? কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।’
জুয়েল সূক্ষ্ম গলায় বলল,
‘ তোরা আসবি আমাদের একবারে জানাবি না? আমাদের মামনি প্রথমবার আমাদের বাড়িতে আসবে। আর তোরা আমারে কিছু জানালি না!’
ইভান প্রতিবাদী গলায় বলল,
‘ তোমরা যখন প্লান করেছিলে আমাদের জানিয়ে প্লান করেছিলে? খুব তো কক্সবাজারে, সাজেকের ভিডিও পাঠিয়ে দিয়েছিলে আমার মেয়েটাকে খেপিয়ে দেওয়ার জন্য। তাহলে আমরা কেন বলে আসবো?’
ইভানের কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। লামিয়া ওদের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল,
‘ তবে যাই বলো ইভান তোমার সারপ্রাইজ টা কিন্তু একদম আনএক্সপেক্টেড ছিল। একদম চমকে গেছি সবাই। আমাদের কথাগুলোর মাঝে হঠাৎ করে কোথা থেকে ইহিতা মামনি এসে জিজ্ঞেস করে বড় বাবা কেমন আছে! যেমন বাবা তেমন মেয়ে দুটোই পুরো বিচ্ছু।’
লামিয়ার কথা শুনে আরো একদফা হাসির রোল পড়ে যায়। ধারা কিছু না বলে হাসি মুখে সবার কথা শুনছে। লাবিদ মৃদু স্বরে বলল,
‘ ভাইয়া তুমি অনেকক্ষণ হলো মামনি কে কোলে নিয়ে আছো। এবার আমার কাছে একটু দাও।’
জুয়েল ধমকের সুরে বলল,
‘ তোরে এত হিংসুটে কেন? দেখলি মাত্র কোলে নিয়েছি মামনি কে। এরমধ্যে আমার কোল থেকে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছিস। আচ্ছা নে কোলে কিন্তু দশ মিনিট রেখে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিবি।’
রুমি হেসে বলল,
‘ ভাইয়া এমন ভাবে কথা বলছে যেন ইহিতা কোন খেলনা, দশ মিনিটের জন্য লাবিদ কে খেলতে খেলনাটা দিয়েছে।’
রুমির কথা শুনে সবাই আবার হেসে দেয়। জুয়েল হাসি মুখে বলল,
‘ তা নয় তো কী। ও আমার কাছে খেলনা ই। অনেক কথা হয়েছে এবার চলো ঘরে চলো। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে ওরা। রেস্ট প্রয়োজন ওদের। ওদের খাওয়া-দাওয়া ও ব্যবস্থা করতে হবে।’
জুয়েলর কথা শুনে সবাই ধারা আর ইভান কে নিয়ে বাড়ির ভিতরে দিকে যায়। বাড়িতে ঢোকার সময় ইভান ধারার কোমরে চিমটি কেটে বলল,
‘ ওহ বউ! বউ বাড়িতে আসতে না আসতে আমার প্রেম প্রেম পাচ্ছে। বিয়ের পরে এই বাড়িতে কত প্রেম করেছি দুজনে। এই সুযোগে আবার আগের মত প্রেম করে নিবো। কী বলো তুমি?’
ধারা চোখ গরম করে বলল,
‘ তুমি কী আমার হাতে খামচি খাবে না কী চিমটি। কোন টা খেলে তোমার পেটে ভরবে?’
ইভান মন খারাপ করে বলল,
‘ বিল্লু রানী তুমি সব সময় এসব কথা বলে, আমার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে দেও। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়ছি না।’
ধারা ইভানের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ ভারী নির্লজ্জ লোক তুমি। একদম আমার পিছন পিছন আসার চেষ্টা করবে না, আসলে মেরে একদম হাত-পা ভেঙ্গে দেবো।’
এইটুকু বলে ধারা হনহনিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। ইভান ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দেয়।
চলবে….