#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০
অতিশয় অপমানে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। রৌধিকের ব্যবহারে সবকিছু ঝাঁপসা লাগছে। মাথাটা ধরে আছে সকাল থেকে। রাস্তা জ্যামে আঁটকে আছে অধিক সংখ্যক গাড়ি। তার ফুট পাত দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। দু হাতে বাজারের ব্যাগ ভর্তি বাজার। সিগন্যাল পড়ল। যাত্রীরা একে একে রাস্তা পাড় করতে লাগলো। আমিও রাস্তা পেরুতে লাগলাম। মাঝপথে যেতেই একটা চলন্ত বাইক ছুটে এলো। আমার পা ঘেঁষে ছুটে গেল বহুদূরে। হাঁটুতে ধাক্কা লাগল। হুট করে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে রাস্তার মাঝে পরে গেলাম আমি। পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়লাম নিচে। ব্যাগটা হাতে থেকে নিচে পড়ে গেল। পাটের ব্যাগ হওয়াতে বাজারপত্র ব্যাগের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইল। আমি চাপা আর্তনাদ করে সিগন্যালের দিকে চাইলাম। এখন লাল রঙের আলোটা জ্বলছে। দশ সেকেন্ডে রয়েছে। আমি নিজেকে সামলে উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলাম। সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। ভিড় জমে গেল মুহুর্তেই। কেউ একজন গম্ভীর গলায় বললেন,
“আপনারা সরুন। আমি দেখছি।”
সবাই ফাঁক করে তাকে ভেতরে আসার জায়গা দিলেন। হুট করে কেউ এসে সামনে দাঁড়ালো। ফর্সা একজন ছেলে। গায়ে সাদা এপ্রোন। হাঁটু গেড়ে বসলো পাশে। ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে নিজের গাড়িতে রাখল। আমার পাশে বসে ধরে ধরে উঠানোর চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হলো সে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“দাঁড়িয়ে না থেকে তুলুন ওনাকে।”
পেছন থেকে একজন তরুণ বেরিয়ে এলো।
আমার বাহুতে হাত রেখে ফুটপাতে নিয়ে এলেন। বিদ্যুৎ খাম্বের সাথে দাঁড় করিয়ে এদিকে ওদিক চাইলেন। ধৈর্য হারা হয়ে বললেন,
“এখানে তো একটা ফার্মেসি ছিলো। ফার্মেসি টা কোথায় গেল!”
এই প্রথম ছেলেটির মুখ দেখলাম আমি। কাকতালীয় ভাবে এই ছেলের মুখের সাথে আমার যথেষ্ট মিল রয়েছে। আমার থুতনির মাঝবরাবর যেখানে তিল তারও ঠিক একই জায়গা তিল রয়েছে। সেই তরুণী না বুঝার কন্ঠে বললেন,
“স্যার আপনিই তো ডাক্তার। আপনিই যদি ওনাকে ব্যান্ডেজ টা করিয়ে দিতেন।”
বুঝতে পারলাম, এই মেয়েটা তার এসিস্ট্যান্ট। ডাক্তার ছেলেটি মেয়েটির দিকে বিরাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“এরজন্য আপনাকে আমি অপদার্থ বলি মিস্ বিভা। আমি ডাক্তার হলেও একজন পুরুষ। মহিলা মহিলার কাছে ক্লোজলি সবকিছু শেয়ার করতে পারে।”
ডাক্তার কিয়ৎক্ষণ গভীর ভাবে ভেবে আমাকে নিজের গাড়ির কাছে নিয়ে গেলেন। ফাস্ট এইড বক্স বের করে বিভার কাছে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাঁটুতে অনেকটা ছিলে গেছে। বিভা নিজেই ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।
গাড়িতে বসে আছি ডাক্তার সাহেব, বিভা আর আমি। বাড়ির সামনে এনে গাড়ি থামালেন। বিভার দিকে চেয়ে সহজ ভাষায় বললেন,
“ওনাকে রুমের ভেতরে দিয়ে তবেই আসবেন। (ব্যাগগুলো দেখিয়ে) এগুলোও দিয়ে আসবেন।”
বিভা মেয়েটি আমাকে একদম ঘরে রেখে এলো। অতঃপর আবার ব্যাগ নিয়ে এলো।
পায়ের এই অবস্থা দেখে জয়া পুরো কেঁদে দিলো। বাবাও একটু বকলেন। জয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘরের পুরো কাজ করলো। আমাকে একদম কোনো কাজে হাত লাগতেই দেয় নি। রাতে ব্যাথাটা একটু বেড়েছিল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
_________
সকাল ১০ টা এগারো। লাইব্রেরী তে বসে আছি আমি
সকাল সকাল অহির ফোন করে পরীক্ষার কথা জানায়। দুদিন পর থেকে পরীক্ষা। তাই পায়ে ব্যাথা নিয়েও ক্লাস করতে এসেছি।
খাতায় কলম চালাচ্ছি আমি। অহির দেওয়া নোটস গুলো নিচ্ছি। কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বলল,
” কি ব্যাপার তোর জোনাকি? এসে থেকে দেখছি, কেমন চিন্তায় আছিস। কেমন জানি বদলে গেছিস তুই।”
আমি এক গাল হাসলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম,
” কেমন লাগছে?”
“মনে হচ্ছে তুই বিয়ে করে ভূত হয়ে গেছিস। ”
“বিয়ে করলে বুঝি ভূত হয়ে যায়?”
“তা নয় কিন্তু তোকে বিবাহিতা মহিলাদের মতো লাগছে।”
আমি কিছু বলবো তাই আগেই বেল বেজে উঠলো। ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলাম।
ক্লাসে বসে আছি। স্যার ক্লাসে পড়া বুঝাচ্ছে। গালে হাত গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। হুট করেই মনে হলো আমার ওরনাটা আমার কাছে নেই। কেউ পেছন থেকে ধীরে ধীরে ক্রমাগত আমার ওরনা টেনে চলেছে। আমি বুকে হাত দিলাম। ওরনাটা টেনে পেছনে তাকালাম। একটা ছেলে আমার ওরনা টেনে হাতে পেছাচ্ছে। আমি একটু সামনে এগিয়ে বসলাম। নত কন্ঠে বললাম,
“অহি তোর কাছে কোনো সেপটিফিন আছে?”
“কেন?”
“ওরনাটা পড়ে যাচ্ছে। থাকলে দে!”
অহি সেফটিপিন দিতেই ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিলাম শরীরে। একটু পরে সামনের দিকে খেয়াল করলেই বুঝতে পারলাম। কয়েকটা ছেলে ফোন হাতে নিয়ে কিছু একটা দেখছে আর হাসছে। বিশ্রী তাদের হাঁসি। ইশারায় আমাকে দেখাচ্ছে। বিরক্ত হলাম আমি। বারবার মনে হচ্ছে, আমাকে নিয়েই তারা হাসছে। ভেবে নিলাম, আর ক্লাস করব না। তাই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। অহিও আমার পেছনে পেছনে চলে এলো।
করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“কি হয়েছে তোর জোনাকি? এতো দিন পর ভার্সিটিতে এসেছিস। তারপরেও ক্লাস করবি না।”
“আমার ইচ্ছে। আমি কী করব না, না করব। এখন তোকে জিজ্ঞাসা করতে হবে..
“কুল জোনাকি। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করছি, কেন এসেছিস। এতো হাইপার হওয়ার কী আছে। আশ্চর্য।”
ছেলেগুলোর উপর রাগ দেখাতে গিয়ে অহির সাথে বা’জে ব্যবহার করে ফেললাম। তাই ছোট করে স্যরি বললাম। অতঃপর করিডোর দিয়ে বাইরে তাকালাম। মনে হলো রৌধিকের মতো কেউ ভার্সিটির ভেতর আসছে। আমি চোখ পরিষ্কার করে আবার চাইলাম।সেটা রৌধিকই ছিলো। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটে উঠল। রৌধিক মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চাইলো। অতঃপর উপরের দিকে এগিয়ে এলো। আমিও রৌধিককে দেখে নেমে গেলাম নিচে। চারপাশে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পারলেই যেন গিলে খায়। মেয়েরা রীতিমতো বলছে,
“কী হ্যান্ডসাম বয়। যে করেই হোক এই ছেলেটার সাথে প্রেম করতেই হবে।”
আমি বিরবর করে বললাম,” দাঁড়া শাত’চুন্নি।
রৌধিক আমার সামনে আসতেই তার পথ আঁটকে দাঁড়ালাম। পায়ের দিকে চেয়ে রইল। ধীরে ধীরে মুখ উপরে তুলে মুখের দিকে চাইলো। স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“সমস্যা কী? সামনে থেকে সর।”
রৌধিক পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই আমি হাত দিয়ে আঁটকে দাঁড়ালাম। সন্দিহান স্বরে বললাম,
“আপনি এখানে কী করছেন?”
আমার হাত সরিয়ে ধমকে বললেন,
“তোমাকে আমি সরতে বলছি। সর..
আমাকে সরিয়ে দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। মুহুর্তেই হেঁসে উঠলো সকলে। বিদ্রুপ করে বলল,
“দেখ, মেয়েটার অবস্থা। পাত্তাই দিল না। বলি, তোমাকে দেখতে তো ভালো ঘরেই মেয়ে মনে হয়। কিন্তু তোমার পেটে পেটে এতো দূর।”
আরেকজন বলল,
“ছেলে দেখলেই শুরু হয়ে যায়। বলি পেটে পেটে এতো দূর?”
একদিকে ক্লাসের ছেলেদের কান্ড, অন্যদিকে রৌধিকের এই অবহেলা আবার এদের কটু কথা। সবকিছুতেই কান্না পেয়ে গেল আমার। কাউকে কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে এলাম।
.
বেশ কিছুক্ষণ ধরে লাইব্রেরী বসে কেঁদে চলেছি আমি। সবাই আমাকে দেখলেই হাসে। অহি এসে আমার পাশে বসে বলল,
“তুই এখানে আর আমি তোকে সব জায়গায় খুঁজছি।”
আমি প্রত্যুত্তর দিলাম না। অহিও কোনো কথা বললো না, হয়তো উত্তর টা ওর জানা। আমাকে শান্তনা দিতে দিতে বলল,
” ঐ ছেলেটা কে? তুই চিনিস তাকে? তোর ব্যবহার দেখে মনে হলো, তুই তাকে চিনিস। কিন্তু তার ব্যবহার দেখে মনে হলো, সে তোকে চেনে না।”
এবারও কিছু বললাম না। আমি নির্বিকার ভাবে কেঁদে চলেছি। এভাবেই সময় অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষণ। অহি পুনরায় বলল,
“ছেলেটা মাঠের মাঝখানে কতো গুলো ছেলেকে মা’রছে। কেউ ধরার সাহস পাচ্ছে না।”
“মানে?”
“আমি নিজেই জানি না। দেখলাম ঐ ছেলেটা কতোগুলো ছেলেকে মাঠের মাঝখানে ফেলে মারছে। ভিড় জমে গেছে।”
আর শোনার মতো পরিস্থিতিতে রইলাম না আমি। আগে পিছনে না চেয়েই ব্যাথার্ত পা নিয়ে ছুটলাম। মাঠের মাঝখানে ভিড় জমে গেছে। ভিড় ঠেলে ভেতরে গেলাম। রৌধিক ক্লাসের সেই ছেলেগুলোকে এবড়ো থেবড়ো লা’থি দিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর লাগছে তাকে। একটু পরে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলছে। হাতে তার মোটা লাঠি। ছেলেগুলোর নিচে পড়ে আছে। হাত পা থেকে রক্ত পড়ছে। রৌধিকের থামার নামই নেই। ফোনগুলো ভেঙ্গে পড়ে আছে নিচে।
আমি রৌধিকের কাছে গিয়ে লাঠি ফেলে দিলাম। চেঁচিয়ে বললাম,
” কী? সমস্যা কী আপনার? এভাবে মা’রছেন কেন ওদের? কী করেছে ওরা?”
“এখন তুমি আমাকে শিখাবে আমি কী করব?”
তৎক্ষণাৎ প্রিন্সিপাল স্যার এসে হাজির হলো। চেঁচিয়ে বললেন,
“কে আপনি? আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্টদের কে কেন মা’রছেন?”
” আমি রৌধিক। আহম্মেদ গ্ৰুপ এড ইন্ডাসট্রির মালিক আদ্রিক আহম্মেদের একমাত্র ছেলে। কেন এদের মা’রছি তাই তো। চলুন বলছি..
বলেই প্রিন্সিপালের সাথে চলে গেলেন তিনি। সাথে সাথে এম্বুলেন্স এসে এদেরকে নিয়ে গেল। আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
সবাই আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে। বিদ্রুপ করে বলছে,
” হিরোর সামনে হিরোইন সাজতে এসেছিলো, এখন জিরোইন হয়ে গেছে।”
আমি আশাহত মন নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কেন আমার সাথে সবসময় এভাবে ব্যবহার করেন তিনি। আমার সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলা যায় না।
[চলবে..ইনশাআল্লাহ]