#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১
একটা বড় কালো রঙের গাড়ি এসে আমার সামনে থামলো। এক নজর দেখেই বুঝতে পেরেছি, এটা রৌধিকের গাড়ি। তবুও আমি সেদিকে না তাকিয়ে সামনের দিক এগিয়ে যাচ্ছি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রৌধিক। পেছন থেকে ক্রমাগত “জোনাকি, জোনাকি” বলে ডেকে চলেছে। আমি পাত্তা দিলাম না। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। এই লোকটার সাথে কোনো কথা নেই আমার। কখনো কোনো কথা বলবো না। না মানে না। পেছন থেকে টেনে ধরলো হাত। আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার? কতোবার ডাকছি, শুনতে পারছ না কেন? আশ্চর্য।”
আমি তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম। আমাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। নিজের অপর হাত দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার জোনাকি? কাঁদছ কেন? হুয়াই?”
অভিমান ভরা মন নিয়ে শুধালাম,
“সমস্যা কী? সামনে থেকে সরুন।”
হাতটা আরেকটু চেপে ধরে বললেন,”আমার সাথে চলো।”
“এখন আপনি আমাকে শেখাবেন, আমি কী করব? তাছাড়া আমি কেন কাঁদবো? আমি মোটেও কাঁদছি না। সরুন আমার সামনে থেকে। পথ ছাড়ুন।”
রৌধিক আমার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে রইলেন। পাশ থেকে রিক্সা যেতে দেখলাম। তাই রিক্সা দাঁড় করিয়ে চুপচাপ উঠে বসলাম। আশে পাশের মানুষ কেমন কটু চোখে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। রৌধিক রিক্সায় হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। মানিব্যাগ থেকে থেকে টাকা বের করে মুঠ করে রিক্সা ওয়ালার হাতে দিয়ে দিলেন। মিটিমিটি হেসে বললেন,
“চাচা আমার বউ। একটু ঝগড়া হয়েছে, তাই কিছুতেই যেতে চাইছে না!”
রিক্সা ওয়ালাও তার সাথে আমাকে শান্তনা দিলেন,”মা, সংসারে এমন ঝ’গড়া ঝাঁটি স্বামী স্ত্রীর মাঝে সবসময় হয়। যাও, ফিরে যাও।”
আমি তৃক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে রৌধিকের দিকে তাকালাম। কিছু না বলেই কোলে তুলে নিলেন আমায়। হাত দিয়ে গাড়ির দরজা টা খুলে আমাকে ফন্ট সিটে বসিয়ে দিলেন। লক করে দিলেন, যাতে বের হতে না পারি। অতঃপর তিনি ঘুরে এসে সামনের সিটে বসলেন। গাড়ির কাঁচ তুলে দিলেন। বললেন,
“আশ্চর্য তো কাঁদছো কেন?”
আমি গাড়ির দরজার সাথে মিশে গেলাম। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। রৌধিক একটু এগুলেন। অতঃপর হাত টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন। দুগালে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললেন,
“কথা বলবে না?”
প্রত্যুত্তর দিলাম না আমি। বিনিময়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। রৌধিকের হাত গাল থেকে নামিয়ে মুখ আড়াল করে নিলাম। রৌধিক আমাকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” আমার উপর অভিমান করেছো তুমি? আ’ম স্যরি দীপ্তিময়ী। আমার মাথা এতোটাই গরম হয়ে গেছিলো। ওদেরকে না মা’রা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমি তোমাকে হার্ট করে ফেলেছি?”
নিজের থেকে রৌধিককে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু এতোবড় একটা হাতির মতো মানুষের কাছে আমি মশার চেয়েও ক্ষুদ্র। কিয়ৎক্ষণ চেষ্টা করে না পেরে বললাম,
“একদম আমার সাথে কথা বলবেন না আপনি, একদম না। আমার চারপাশেও আসবেন না।
বুকে মুখ গুঁজেই রইলাম। রৌধিকের গলা জড়িয়ে ধরে দৃঢ় করে নিলাম। সামনের দুটো বোতাম খুলে নাক মুছে নিলাম শার্টে। নাক কুঁচকালেন। কিছু বললেন না মুখে। আমি নাক মুছতে মুছতে বললাম,
“আপনি বড্ড খা’রাপ রৌধিক। আমাকে সবর্দা কষ্ট দেন। কি করেছি আমি? জানেন ওরা আমাকে কতো বা’জে কথা বলছিলো? আমি দেখতে সাদাসিধে হলেও পেটে পেটে নাকি অনেক। আমি ছেলে দেখলেই শুরু করে দেই।”
তিনি কিছু বললাম না। তার হাত দুটি আমার পিঠে রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। রৌধিকের মুখের আকৃতি কেমন হয়েছে, ধারণা নেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” স্যরি আর কেঁদো না, আমার জন্য যখন তোমাকে এতো কিছু সহ্য করতে হয়েছে। আমি সবকিছু ঠিক করে দিবো।”
“কী ঠিক করবেন আপনি? কী ঠিক করবেন? অহিও আমাকে বলছে, আপনি আমাকে চেনেন না। অথচ একটু আগে বললেন, আমি আপনাদের ওয়াইফ। তাহলে? তখন কেন ইগনোর করলেন? হুয়াই?”
রৌধিক আমাকে একপাশে নিয়ে নিজের পড়নের শার্টটার বোতাম খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। নিচের দিকটা দিয়ে নাক মুছে দিয়ে বললেন,
“এবার পুরোটাই তোমার। নাক মুছা হয়ে গেলে বাড়িতে নিয়ে যেও। গোসল করে মাথা মুজো!”
“আপনি মুছেন। আমি এখন বাড়িতে যাবো। কোনো কথা বলবো না, আপনার সাথে।”
আর কিছু বললাম না আমি। কেঁদে চলেছি ক্রমাগত। রৌধিক আমার মাথায় হাত চালাচ্ছে। বোতলের ছিপি খুলে হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি পানি খেয়ে আবার রৌধিকের বুকে মাথা গুজলাম। তিনি বুঝিয়ে চলেছে আমায়। রৌধিকের মিষ্টি মিষ্টি কথায় বাচ্চাদের মতো ঘুম পাচ্ছে আমার। রৌধিকের কান্ডে ঘুমের পড়লাম একসময়।
_____________
মাঝরাত। চারিদিকে অন্ধকার বিরাজমান। যাকে বলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখ মেলেতেই আলোকহীন আঁধার দৃষ্টিগোচর হলো। জানালার মস্ত পর্দাটা হাওয়ায় উড়ছে। শিশির বিন্দু পড়ার আওয়াজ শুনতে পারছি। ওঠার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলাম, অদৃশ্য কোনো বন্ধনে আমি পেঁচিয়ে আছি। সামনের দিকে চাইতেই ল্যাপটপের মৃদু আলো চোখে পড়লো। রৌধিক একহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমি তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাকে একহাতে পেঁচিয়ে ধরে ল্যাপটপে কাজ করছে সে। ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। রৌধিক আমার দিকে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। উঠে বসলাম আমি। তিনি ল্যাপটপ টা রেখে আলো জ্বালিয়ে দিলো। চোখ কুঁচকে এলো আমার। ঝাঁপসা সবকিছু পরিষ্কার হতেই বুঝতে পারলাম, আমি রৌধিকের ঘরে। রাত দুইটা বাজে। মাথায় বাজ পড়ল আমার। বাবা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে। আমি কখনো এতোক্ষণ ঘুমাই না, আজ কি হলো আমার। পানিটা খাওয়ার পরই ঘুম ঘুম পেয়েছে।
বালিশের পাশে ওরনাটা রাখা। আমি ঝরনা কোনোরকম শরীরে পেঁচিয়ে নেমে দাঁড়ালাম বেড থেকে। রৌধিক আমার হাত ধরে ফেললেন। সন্দিহান গলায় বললাম,
“দৌড়াচ্ছো কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“বাড়িতে। জয়া, বাবার আমার জন্য চিন্তা করছে।”
“চিন্তা করছে না। হাত মুখ ধুয়ে এসো। কিছু খাবে। দুপুরে ঘুমিয়েছো, এখন উঠেছো। এতো ঘুম কাতুরে তুমি।”
বলেই মিটিমিটি হাসলেন তিনি। তিনিই কিছু একটা করেছেন, যাতে আমি এতোক্ষণ ঘুমাই। আবার বলছে চিন্তা করবে না।
“মানে..
“মানে জানতে হলে, আগে খেতে হবে। এতো রাত করে শাওয়ার নেওয়ার দরকার নেই। ঠান্ডা লেগে যাবে। কিছু খেয়ে নাও, যাও..
এতো রাতে একা বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। হাত মুখ ধুয়ে, মাথায় পানি দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেডের উপর একপা তুলে বললাম,
“এবার বলুন।”
রৌধিক টাওয়াল এনে ধীরে ধীরে চুল মুছিয়ে দিলেন। হাত পা মুখ মুছিয়ে দিয়ে খাবার এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” আমি দুজন আয়া পাঠিয়েছি তোমার বাড়িতে। তারাই যাবতীয় কাজ এবং তোমার বাবার অসুস্থতা দেখবে। রান্নাও করবে।
আমি ফোন করে বলেছি, অফিসের কাজে আঁটকে গেছ। তাই আজকে ফিরতে পারবে না।”
রৌধিক টেবিলের উপর থেকে খাবার নিল। মেখে আমার মুখের সামনে ধরল। মুহুর্তেই মন পড়ল তার তিক্ত ব্যবহারের কথা। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। রৌধিক একহাত দিয়ে গাল চেপে অন্যহাত দিয়ে খাবার মুখে পুড়ে দিল। অধর চেপে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“মুখের খাবার ফেললেই তোমার খবর আছে।”
আমি মুখ ফুলিয়ে খেতে লাগলাম। এই ছেলেটা সবসময় আমার উপর জোর খাটায়। আমিও জিম করব। তার চেয়েও বড়, শক্তিশালী বডি বানিয়ে গায়ের জোর দেখাবো। হমমম্।
_______
রৌধিক সকালে উঠেই অফিসে চলে গেছে। আমি ভার্সিটিতে এসেছি। অহি আমার পাশে বসে আছে। রৌধিক তো কালকে বড় বড় কথা বলেছিল, আজকে সে আসবে। কোথায় সে? আসেনি তো।
আমি মন খারাপ করে ক্লাসের দিকে পা বাড়াতেই অহি বলে উঠল,
“ঐদিকে দেখ জোনাকি। কালকে যেই ছেলেটা এসেছিল না, সেই ছেলেটা আজকেও এসেছে।”
আমি ফিরে চাইলাম। সবাই ছোট বড় বড় করে রৌধিকের দিকে তাকিয়ে আছে। রৌধিক ধীরে ধীরে হেঁটে আমাদের দিকে আসছে। আজকে আমি আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলবো না, যদি সে আজকেও এড়িয়ে যায়।
রৌধিক একদম আমার সামনে এসে দাড়ালো। ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। আমার গালে হাত রেখে হুট করেই অধরে অধরে ছুঁয়ে দিলেন। সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার আগেই সরে দাঁড়ালো সে। আমার হাত ধরে বলল, ” চলো।”
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। ছুটতে লাগলাম। রৌধিক পেছনে পেছনে আসছে। আমাদের এভাবে দেখে মেয়েগুলো বলছে,
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]