” মাত্র ১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে আমাকে কেন বিয়ে করেছো জোনাকি? শুধুমাত্র টাকার জন্য। তাহলে আমি তোমাকে ৩০ লক্ষ টাকা দিচ্ছি, ডিভোর্স পেপার সাইন করে চলে যাও।”
পায়ের উপর পা তুলে নির্বিকার স্বরে বললেন রৌধিক। মাথার ঘোমটা তুলে অবলোকন করলাম সেদিকে। ভারী শাড়ি তুলে নিচে নেমে স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,
“টাকা টা আমার খুব দরকার ছিলো আর আপনার বাবার সম্মান বাঁচাতে আমাকে দরকার ছিলো।”
তিনি ঘরের একপাশে থেকে অন্যপাশে পায়চারী করলেন। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“এই মেয়ে শোনো, তোমাকে বিয়ে করেছি ঠিকই কিন্তু আমার মনে, আমার লাইফে তোমার কোনো জায়গা নেই। বুঝতে পেরেছো তুমি?”
সদ্য বিয়ে হওয়ার বরের মুখে এমন কথা শুনে পিত্তি জ্বলে উঠলো আমার। সকলের সামনে হাঁসি মুখে বিহেবিয়ার করে বাসর ঘরে এসে এমন কথা বলছে।
দুইহাত বুকে গুঁজে জবার দিলাম,
-” তো? কি করব আমি? নাচবো? আমাকে না বুঝিয়ে আপনি নিজেকে বুঝুন, আপনি এক্সজেকলি কি চান? আপনি চাইলে বিয়েটা আটকে পারতেন।”
আমার প্রত্যুত্তরে হয়তো সামনে থাকা মানুষটির পছন্দ হলো না। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আমার পানে। অস্বস্তিতে ছেড়ে গেল দেহ। কিন্তু আমাকে পাত্তা দিলেন না তিনি। টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পটা বিকট শব্দে ছুঁড়ে ফেললেন নিচে। কেঁপে উঠলাম আমি। দুহাতে কান চেপে দেয়ালের সাথে মিশে রইলাম। হুট হাট শব্দ গুলোতে আমার ফোবিয়া রয়েছে। কেউ জোরে কথা বললে আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু আমার দূর্বলতা বুঝলেন না তিনি। গুছিয়ে রাখা ঘরের সব জিনিস পত্র গুলো একে একে মাটিতে ফেলতে লাগলেন তিনি। আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলছেন,-” এইটুকু একটা পিচ্চি মেয়ে আমার উপর গলা তুলে কথা বলার সাহস পাও কী করে? আজ তোমাকে আমার মন থেকে বের করে দিয়েছি। খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার ঘর এবং জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো।”
ভাঙ্গা চোড়া জিনিসপত্র গুলো মাঝে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। মাটিতে ফেলে রাখা ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলো ডিঙিয়ে চলে গেলেন তিনি। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দু’পা এগিয়ে এলাম আমি। পরবর্তী পা ফেলার আগেই ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম। পিছিয়ে বসে পড়লাম বেডের উপর। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে কাঁচ বের করার চেষ্টা করলাম। বেশ গভীরে না যাওয়াতে সহজে তুলে ফেলতে সক্ষম হলাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। এই অহংকার ছেলেটার মান সম্মান রাখতে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে আমায়। চোখের পাতা বড্ড ভারী ঠেকছে। বালিশ টেনে বেডের এক কোণে জায়গা করে শুয়ে পড়লাম। নিজের পরিবার ছেড়ে, নিজের প্রিয় জিনিস গুলো ছেড়ে অন্য একটা ছেলের সাথে সারাজীবন এক সাথে থাকতে হবে, ভাবতেই কষ্টে কেঁপে উঠছে শরীরটা।
.
আমি জোনাকি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ একজন তরুণী। দুই বোন আর বাবাকে নিয়েই আমাদের পরিবার। বোনের জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেছেন। আমাদের সুখের কথা চিন্তা করে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। ভালোই চলছিলো আমার দিনকাল। হঠাৎ একদিন বাবার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। তুলনামূলক শরীর ফুলে উঠছিলো। বমি বমি ভাব, উচ্চ রক্তচাপ। পরিক্ষা করে কিডনি রোগ ধরা পড়েছে। প্রতিদিন ঘরে বসে কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বা সিএপিডি করতো। জয়া তাকে সাহায্য করে। তখন থেকে বাবা বেকার। আমি সংসারের হাল ধরি। ছোট বোন জয়ার স্কুলের খরচ আর বাবার ওষুধ পত্রের টাকা জোগাড় করতে করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল আমাকে। তার উপর খাবারের টাকা। এভাবে বছর দুই পেরিয়ে যায়। মাস খানেক আগে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জবের অফার পাই। তারপরে আমাদের অবস্থান আরেকটু উন্নতি হয়।
সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর জ্ঞান হীন অবস্থায় পেলাম। শতবার ডাকার পরেও সারা দেয়নি। ভয় পেয়ে গেলাম দুইজনে। জয়ী কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। আমি জয়ীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। ধরাধরি করে হসপিটালের নিয়ে এলাম। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালো, বাবা নিয়মিত ওষুধ খেতেন না, ডায়ালাইসিস করতেন না। এতে ভেতরে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পনেরো লক্ষ টাকা লাগবে। অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমি।
তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ান অফিসের বস আদ্রিক আহম্মেদ। তার ছেলের বিয়ে উপলক্ষে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু বিয়ের দুই দিন আগে কনে পালিয়ে যায়। নিজের সম্মান বাঁচাতে আমাকে তার পুত্র বধূ করতে চায়।
শর্ত সাপেক্ষে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
.
সূর্যের নরম আভা চোখে পড়তেই নিদ্রা ভঙ্গ হলো আমার। মাথা চেপে ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। চারদিকে পর্যবেক্ষণ করতেই বুঝতে পারলাম আমি কোথায় আছি। মাথা তুলে দেয়ালের দিকে তাকালাম। সাতটা পঁয়ত্রিশ বাজে। আমার গায়ে ব্লাঙ্কেট জড়ানো। ব্লাঙ্কেট ছাড়িয়ে ফ্লোরে পা রাখতেই আঁতকে উঠলাম। সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে পা তুলে ফেললাম। পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ করা। কিন্তু আমার যতোদূর মনে আছে, কালকে রাতে আমি পায়ের ব্যান্ডেজ তো দূরে থাক। রক্ত পর্যন্ত মুছি নি। দৃষ্টি গেল ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার দিকে। নিজের গায়ে শাড়ি আর না দেখে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। দ্রুত ব্লাঙ্কেট দিয়ে শরীর পেঁচিয়ে নিলাম। এই রুমে আমি ছাড়া কেউ নেই। রৌধিক রাতে বেরিয়ে গিয়েছিল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দৃষ্টি ঘুড়াতেই নজর পড়লো সোফার উপরে। সেখানে আরামসে ঘুমিয়ে আছে রৌধিক। তার দেহের অনেকটা অংশ সোফার বাইরে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঘন পাপড়ি যুক্ত গ্ৰথণ চোখ। বাম ভ্রু এর একটু উপরে লালচে তিল। যা চুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে সর্বক্ষণ। এখনো চুল দিয়ে সম্পূর্ণ ললাট ঢেকে আছে। তবে তার ফাঁক দিয়ে তিলটা বেরিয়ে রয়েছে। পড়নে লাল টি শার্ট। নিঃপাপ মুখ টা যখন তখন যে কারো নজর কেড়ে নিতে পারে। পাশ থেকে শাড়িটা তুলে কোনো রকম শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম। এগিয়ে গেলাম তার দিকে। হুট করেই ইচ্ছে করলো তার ঘন কালো চুলে হাত দিয়ে আলো এলোমেলো করে দেই। নিজেকে সংযত করতে চাইলেও বারবারই ব্যর্থ হলাম। চুলের হাত ছোঁয়ানোর আগেই নড়েচড়ে উঠলো সে। নিভু নিভু চোখে ঝাঁপসা আমার দিকে চেয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলেন।
ফট করে উঠে গেলাম আমি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে দু’পা ফেলতেই টান লাগলো আঁচলে। ধরার আগেই কাঁধ ঘেঁষে নিচে গড়িয়ে পড়লো। পেছনে ফিরে চাইলাম একনজর। রৌধিক পূর্বের ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। তার পিঠের নিচে বেশ কিছুটা অংশ রয়েছে। আরো কাছে গেলাম তার। হাতটা চোখ মুখের সামনে বেশ কয়েকবার ঘুড়িয়ে কাঁধ থেকে পিন বিহীন শাড়িটা খুলে ফেললাম। সন্তর্পণে পা ফেলে ওয়াশরুমের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
শাওয়ার শেষ করে বুঝতে পারলাম, সাথে কিছু আনা হয়নি। দরজা খুলে মাথা বের করলাম। ততক্ষণে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেছে প্রাকৃতিক আলোয়। ঘর গোছানো। ঘুমন্ত রৌধিক নেই। বেলকেনির দরজা খোলা। বাথরোব পড়ে ভেজা ভেজা পা ফেলে বেরিয়ে এলাম শাড়ি নিতে। শাড়ি আদোও আছে কি-না, না জেনেই বের হয়েছি। এটাই ছিলো আমার দ্বিতীয় ভুল। বাবার জন্য বাধ্য হয়ে রৌধিককে বিয়ে করা ছিলো, সর্বপ্রথম ভুল।
এদিক ওদিক শাড়ি খুঁজে ব্যর্থ হয়ে যখন হার মেনে বসে পড়েছিলাম তখন শোনা গেল শক্তপোক্ত অস্পষ্ট পুরুষালী কন্ঠস্বর,
চলবে..ইনশাআল্লাহ
রেসপন্সের ভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্ব দেওয়া হবে। রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।
#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০১