#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২
” বিয়ে প্রথম সকালেই বুঝিয়ে দিলে, তুমি ঠিক কি? শাড়ি না পড়ে আমার ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছ? কালকে তো বড় বড় জ্ঞান দিয়েছিলে, আগে নিজেকে বুঝতে!”
চরণ জোড়া থেমে গেল। মনে হলো মাটির ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য শিকড় এসে পা দুটো আঁটকে দিলো। সাথে সাথে পেছনে ফিরলাম। রৌধিক তখন দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দুহাত দিয়ে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করে অন্যদিকে ফিরলাম। তুতলিয়ে তুতলিয়ে বললাম,
” আসলে শাড়িগুলো কোথায় রাখা আছে, জানি না।”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন, ” জানো না, না-কি না জানার ভান ধরছো?”
বলেই এগিয়ে এলেন তিনি। হাতে তার টুথব্রাশ। ওয়াশরুশে ঢুকে ব্রাশ ধুয়ে রাখলেন। ট্যাপ ছেড়ে মুখে দিয়ে কুলি করে বেরিয়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর আলমারি খুলে দিলো। হাত টেনে আলমারির সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
” এখানে এতো এতো জামা কাপড় আর তুমি শাড়ি খুঁজে পাচ্ছো না। হাউ ফানি!”
” এগুলো তো শেফার জন্য কেনা জামা কাপড়..
” তো! কি হইছে? শেফার বরকে নিজের বর করতে পেরেছ, তার বিয়ের বেনারসী গায়ে জড়াতে পেরেছ। তাহলে এগুলো পড়তে কি সমস্যা?”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। একদিন নিজের এই অবস্থা, অন্যদিকে এই লোকটার কটু কথা! দুটোতেই হাঁপিয়ে উঠেছি।
রৌধিক আলমারির ভেতর থেকে একটা শাড়ি বের করে ছুড়ে ফেললো আমার উপর। কেঁপে উঠলাম আমি। কর্কট কন্ঠে বললেন,
” এবার তো শাড়ি পেয়েছো? দাঁড়িয়ে না থেকে বিদেয় হও। নাকি নিজেকে দেখানোর বাকি আছে? তাহলে আমাকে না দেখিয়ে রাস্তায় গিয়ে দেখাও, অন্তত কিছু টাকা পাওয়া যাবে!”
সাথে সাথে শরীরের লোম গুলো দাড়িয়ে গেল। শেষে একটা রাস্তার মেয়ের সাথে তুলনা করলো। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে এতোটাই নিচ হয়ে গেছে, আমি তার কি হই। সেটাই ভুলে গেছে। তবে আমি চুপ রইলাম না। দ্বিগুন তেজ নিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ! প্রয়োজনে রাস্তায় গিয়েই দেখাবো। তাদের দেখালে টাকা পাওয়া যায়। আপনি তো আর টাকা দিতে পারবেন না। দিলেও বাবার টাকাই দিবেন। নিজে তো আর উপার্জন করেন না। টাকার মর্ম কি বুঝবেন?”
বলতে দেরী হলো চড় পড়তে দেরী হলো না। আরো একটা চ’ড় মা’রতে গিয়েও থেমে গেলেন। অন্যদিকে ফিরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন। তার চোখের মণি গুলো জ্বলজ্বল করছে। শাড়িটা নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি শাড়িটা কোনোরকম তুলে ওয়াশরুমের ভেতরে ছুটলাম।
________________
সোফার উপরে সং সেজে বসে আছি আমি। মাথায় একহাত কাপড় টেনে নত হয়ে আছি। যে যার মতো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। আমার পাশে বসে আছে রৌধিক ভাইয়ার ছোট বোন আদ্রিতা, ফুফুতো ভাই জাবিন, জান্নুবী। জান্নুবীর বয়স সাড়ে তিন বছর। আদ্রিক আঙ্কেল নিচে নামলেন। গিয়ে টেবিলে বসলেন। আমাকেও নিয়ে বসানো হলো। আমার সোজাসুজি চেয়ারে বসে আছে রৌধিকের দাদী এবং তার পাশে দাদা। আঙ্কেল বেশ গম্ভীর মানুষ, খাবার টেবিলে একদম কথা বলা পছন্দ করেন না। এমনকি প্লেট, চামচের টুং টাং ধ্বনিও না। বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে আদ্রিক আঙ্কেল বললেন,
” এই বাড়িতে তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
” না আঙ্কেল।”
আমার মৃদু স্পষ্ট জবার।
” তোমার কিছু প্রয়োজন হলে রৌদুকে বলবে। কি বলছি আমি, সেই নিজেই তো একটা অপদার্থ।
আমার বলবে। আমাকে বলতে সংকোচ হলে তোমার মাকে বলবে। তাছাড়া আদ্রু তো আছেই।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই খাবারে মনোনিবেশ করলেন। পুনরায় নিরিবিলি হয়ে গেল। পায়ের শব্দ শোনা গেল। আদ্রিক আঙ্কেল সিঁড়ির দিকে তাকালেন। রৌধিক শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নেমে আসছে। ডাইনিং অতিক্রম করে যাওয়ার সময় ডেকে উঠলেন আঙ্কেল,
“রৌদু! দাঁড়াও!”
আঙ্কেলের গলা গম্ভীর। রৌধিক থেমে গেল। মাথা নত করে দাঁড়ালো। রৌধিক বেপরোয়া হলেও আঙ্কেলের কাছে একদম বাচ্চা। আদ্রিক আঙ্কেল উঠে গেলেন। রৌধিকের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
” রৌদু কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
” ক্লাবে!” রৌধিকের একরোখা জবাব।
” কাল তোমার বিয়ে হয়েছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। প্রেস, মিডিয়া গিজগিজ করছে। আর তুমি ক্লাবে যাচ্ছো? তুমি জানো, এই খবরটা লিক হলে আমার মান সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
রৌধু, তুমি বিয়ে করেছো! সংসার হয়েছে। কিছুদিন পরে বাচ্চার বাবা হবে।”
” বাবা আমি তোমার মান সম্মানের কথা ভেবে এই বিয়েতে রাজি হয়েছি। আমাকে দিয়ে সংসার কিংবা বাচ্চার চিন্তা করো না।
কালকে রাতে আমি সাফ-সাফ জানিয়ে দিয়েছি, আমার মনে কিংবা ঘরে কোথাও এই মেয়েটার জায়গা হবে না।”
রাগে পিত্তি জ্বলে উঠলো আমার। এই মেয়ে, এই মেয়ে ছাড়া কথাই বলতে পারে না সে। খাবার ছেড়ে দু’পা এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-” এই শুনেন, আমি আপনার ঘরে কিংবা আপনার মনে থাকার জন্য মরে যাচ্ছি না। এই বাড়িতে তো আরো জায়গা আছে, আমি সেই ঘরেই থামবো।”
আমার কথা শেষ আগেই আঙ্কেল বললেন,-” না! তোমরা এক ঘরেই থাকবে। আমি চাই না, প্রেস মিডিয়া সামান্য এক বিষয় নিয়ে জল ঘোলা না করুক।
রৌধু ঘরে যাও।”
বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন তিনি। রৌধিক হিংস্র বাঘের ন্যায় আমার দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু তার হিংস্রতায় আমি ভয় করি না। অন্যদিকে চেয়ে রইলাম, বেশ হয়েছে। আমাকে কথা শোনানো হচ্ছিলো না। এবার বোঝ!
রৌধিকও প্রস্থান করলেন। রৌধিক যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। আঙ্কেলের উপর রাগ সব আমার উপরে ঝাড়বে।
.
হাতে খাবারের ট্রে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি মিনিট বিশেক হয়েছে। সামনে পা ফেলতেই গিয়েও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে রুমের দরজা খুলে অন্তর্ভাগে প্রবেশ করলাম। রৌধিক বেডের মাঝ বরাবর বসে ফোন টিপছে। আমি না তাকিয়ে বুঝতে পারছি, রৌধিক তার রৌদ্রমাখা চোখে তাকিয়ে আছে। টেবিলের উপর রেখে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম,-” আন্টি খাবার পাঠিয়েছে!”
বলেই উল্টো হাঁটা ধরলাম বেলকেনির দিকে। বেলকেনির দরজা পেরিয়ে আরেক পা ফেলতেই হাত ধরে ফেললো কেউ। এক টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন আমায়। মাথার ঘোমটা টানা কাপড় খুলে পড়লো নিচে। আমার হাত পেছনে মুচড়ে ধরলেন পেছনে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার মুখের দিকে চাইলাম। ত্রুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি চাইলেই ভয়ংকর ভাবে চোখ রাঙালো। দাঁতে দাঁত ফিসিয়ে বলল,
” কি মনে করো তুমি নিজেকে? আজ তোমার জন্য! একমাত্র তোমার জন্য বাবা আমাকে খাবারের খোঁটা দিয়েছি। তোমাকে তো ইচ্ছে করছে..
বলেই ধাক্কা দিয়ে বেলিকেনির রেলিং এর উপর ছুড়ে মারলেন। সরে আসতে নিলে আরো দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলেন। ঝুঁলে রইলাম বেলিকেনি দিয়ে খানিকটা বাইরে। পিঠে মাঝে কিছু একটা ফোঁটার মতো ব্যাথা অনুভব করলাম। তবে দৃঢ় নয়। তার হাত সরিয়ে আসতে নিলে পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মুখ কুঁচকে গেল। চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠলাম। সাথে সাথে দুই বাহু খামচে ধরলাম রৌধিকের। চোখের কার্নিশ গড়িয়ে অশ্রু পড়তে লাগলো। রৌধিক সন্দিহান চোখে চাইলো। গালে হাত রেখে বলল,
” এই মেয়ে কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?”
নিভু নিভু চোখে চাইলাম। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছে দেহটা। ততক্ষণে সবাই এসে জড় হয়েছে রুমে। আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশি আন্টি বলল,
” জোনাকি, কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?”
” আমার পিঠে!” ব্যাথিত কন্ঠে বললাম।
রক্তে পিঠের দিকটার ব্লাইউজ ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। সবাই ধীরে ধীরে আমাকে দেয়াল থেকে সরিয়ে আনল। গ্ৰিল বিহীন রেলিং এর সূচালো কোণায় অসাবধানতায় পিঠ আঁটকে গেছিলো। যেটা ব্লাউজ ভেদ করে উন্মুক্ত পিঠে আঘাত করেছে।
অতি সাবধানে বেডের উপর বসিয়ে দিল আমায়। রৌধিক মাথা নিচু করে রয়েছে। আদ্রিক আঙ্কেল চ’ড় বসালেন রৌধিকের গালে।
” বাবা আমি আসলে..
তেজ নিয়ে বললেন,
” চুপ! একদম চুপ! এই মেয়েটাকে আমার সম্মান বাঁচাতে আমার বাড়ির বউ করে এনেছি, আঘাত করতে আনি নি। তুমি আমার উপরের রাগ এই মেয়ের উপর দেখিয়ে কি অবস্থা করেছো দেখেছো? তোমার শেফা হলে এটা করতে পারতে? যে মেয়েটা আমার এবং আমার পরিবারের সম্মান বাঁচিয়েছে, তাকে তুমি..
রৌধিক আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে না, আদ্রিক আঙ্কেলের কোনো কথা তার কানে পৌঁছেছে। নিভু নিভু অধর নেড়ে কিছু একটা উচ্চারণ করলো, তা শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছালো না আমার। আদ্রিক আঙ্কেল রৌধিক কে রুম থেকে বের করে দিলেন। রৌধিকের অসহায় মুখ দেখে কষ্ট হচ্ছিল আমার। আমি জানি মনে হচ্ছিল, সে ইচ্ছে করে কিছু করে নি। রাগের বশে হয়ে গেছে।
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]