#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩
মাঝরাতে বুকের উপরে ভারী কিছু আবিস্কার করলাম। নাকে ভেসে এলো বিচ্ছিরি গন্ধ। ঘুমের মাঝে তিঁতঘুটে ঢেকুর উঠলো। ফট করে চোখ মেলে তাকালাম। আমার দুপাশে হাত রেখে রৌধিক নির্ভাবনায় ঝুঁকে আছে। গলা খাঁকারি দিয়ে অশান্ত কন্ঠে বললাম,
” কী? কী হচ্ছে কি মিঃ? উঠুন আমার উপর থেকে।”
নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলো আমায়। ঘুমু ঘুমু চোখ তার। হাত বাড়িয়ে আমার মাথার অগোছালো চুলগুলো ললাটের উপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। হুট করেই অধর ছুয়ে দিল ললাটের মাঝবরাবর। কেঁপে উঠলাম আমি। খামচে ধরলো তার হাত। তিনিও কেঁপে উঠলো। রক্ত গড়ালো হাত বেয়ে। তিনি নিজের হাতের দিকে চেয়ে নেশালো মানুষের ন্যায় টেনে টেনে বললেন,
” আমাকে আঘাত করছিস তুই? রিভেঞ্জ নিতে শিখে গেছিস দেখছি। তুই জানিস না রৌধিক কাউকে অহেতুক আঘাত করে না। তাহলে..
ঠোঁট উল্টে বললেন তিনি। নাকের ডগায় নিজের নাক ঘসলেন। তীব্র গন্ধ আরো তীব্রতর হয়ে উঠলো। বিদেশি মানুষ। জানতাম, রৌধিক এইসব খেয়ে আসবে। তবুও কেমন বিশ্বাস যোগ্য হতো না। হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো আমায়। নিজের বলিষ্ঠ পুরুষালী হাতটা পিঠের ক্ষত স্থানে রাখলো। হাত বোলালেন কিয়ৎক্ষণ। নয়ন যুগল আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে এলো। আমার মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে দম বন্ধ শ্বাস নিলেন। হুট করেই আমাকে ছেড়ে ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। সেকেন্ড দুই অতিবাহিত হওয়ার পরে মাথা বের করে সহজতর ভাষায় বললেন,
” যাও! সোফায় গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। আমার কথার অবাধ্য হলে কি হতে পারে, তা তোমার ধারণার বাইরে!”
অধর দিয়ে জিভ ভিজিয়ে নিলাম। ঘনঘন পলক ফেলে আমতা আমতা করে বললাম, ” মা-মানে?
হুস বলে ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। উঠে গিয়ে কাবার্ড হাতরাতে লাগলেন। নিজের কাঙ্খিত জিনিসটা হাতে নিয়ে বসলেন আমার সন্নিকটে। আমার হাত টেনে নক গুলো স্বযত্নে কেটে দিতে লাগলেন। হাত সরানোর চেষ্টা করতেই চোখের ভ্রু কেটে দেওয়ার দেয়ার চেষ্টা করলো। অসহায় হয়ে চেয়ে রইলাম। আমার এতো সাধের নক। ভাঙা গলায় বললাম, ” প্লীজ! ছাড়ুন। কি করছেন?”
” হুস! দেখেছো আমার হাতের কি অবস্থা? তোমার এই সুন্দর রুপের মাঝে এই বড় বড় অপদার্থ নখগুলো বেমানান।”
হাতের পিঠ দেখিয়ে বললেন। সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। অনুতপ্ত হলাম আমি। আমিই বা কি করতাম, তিনি হুট করে ওমন করেছেন বলেই তো?
অস্থিরতা মেশানো কন্ঠে বললেন,” আমি কখনো কোনো নারী জাতির গাঁয়ে হাত তুলি নি। তুইই প্রথম যাকে আঘাত করেছি। বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করো কিছু করিনি। ভালোবাসা আমাকে অসহায় করে দিয়েছে।”
আমি চুপ করে রইলাম। মুগ্ধ হলাম আরো একবার। মিনমিনে বললেন,” জানো আজ তোমাকে কতোটা সুন্দর লাগছিল? একদম পরীর মতো। আমার ঘরেও একটা পরী রয়েছে, আমি জানতাম না। বিলিভ মি!
তুমি আমার জোনাকি পোকা। আমার আঁধার ঘরের জোনাকি। নিভু নিভু আলোয় জ্বলে উঠ তুমি। আমার অনুবদ্ধ আয়াসের সমাপ্তি।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম আমি। তারমানে এই ছেলেটা সকালে আমাকে বকার ফাঁকে ফাঁকে দেখছিল। ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা। তখন এমন ভাব নিচ্ছিল, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। অতি সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
-” তাহলে সকালে আপনি আমাকে ঐ নজরে দেখছিলেন?”
” কোন নজরে? আমি বউ বউ নজরে দেখছিলাম! আমার বউ। আমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে দেখবো। তুমি বলার কে?”
” আমি কে মানে?”
“সেই তো? তুমি কে?”
আমি কিছু বলতেই চাইলেই হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। আঙুল তুলে সোফার দিকে দেখিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। ঘুমের ঘোরে কিসব বললেন। অথচ আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। সকালে বললে, একদমই বিশ্বাস করতে পারবে না। এই ছাই পাশ যদি হারাম না হতো, তাহলে আমি নিজে তাকে কিনে খাওয়াতাম।
রুমের বাতি নিভিয়ে ড্রিম বাতি জ্বলিয়ে দিলাম। কাবার্ড থেকে ব্যাগ বের করলাম। সেখানে স্বযত্নে রাখা ডাইরীটা হাতে নিলাম।
উপরে লেখা আছে অনুবদ্ধ আয়াস 💚। বেশ কিয়ৎক্ষণ হাত বুলিয়ে নিলাম লেখাটার উপর। অনুভূতিতে দেহের সর্বাঙ্গ পূর্ণ হয়ে গেল। চোখ জোড়া গ্ৰথণ করতেই কার্নিশ গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। টেবিলের উপর বসে লিখতে বসলাম মনের ভেতরের চাপা আর্তনাদ গুলো। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। দক্ষিণা হাওয়া বইছে জানলা দিয়ে। শাড়ি আঁচল টেনে কলম চালালাম ডাইরীর ফাঁকা পৃষ্ঠায়।
বাবা,
জানি না কেমন আছো তুমি? আমি সর্বদা তোমার কথা মেনে জীবনের প্রতিটি ধাপ এগিয়েছি। আজ তুমি আমার পাশে নেই, জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত টা আমি নিয়ে ফেলেছি। তোমার ইচ্ছে ছিল, লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে একটি ছেলের হাতে তোমার মেয়েকে তুলে দিবে। কিন্তু সেই ইচ্ছে টা নাহয় স্বপ্নই রয়ে গেল। ইচ্ছে টা পূরণ করতে হলে তোমাকে বাঁচাতে হবে। তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে, তবে আমার মাধ্যমে নয়। জয়ার মাধ্যমে হবে।
জানি না কিভাবে তোমাকে সত্যি টা বলবো। তবে একটু ধৈর্য ধর, ঠিকই বলবো..
পায়ের কাছে কিছু একটা বিকট শব্দে পড়ল। কলম পড়ে গেল হাত থেকে। ফট করে চাইলাম। রৌধিক বেডের উপর বসে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চেঁচিয়ে বললেন,
” এইভাবে কাঁদছ কেন তুমি? সিমপ্যাথী জন্য। তাই তো! তোমার সিমপ্যাথীতে আমাকে ভুলাতে পারবে না। নিজের ইনোসেন্স দেখিয়ে সবাইকে পুতুল বানাতে পারলেও, আমাকে পারবে না। তাই এই নাটকটা একলিস্ট ঘরে বসে করো না। নেক্সট টাইম ভাববো না। সোজা বের করে দিবো। স্টপ..
শেষের শব্দ টা চেঁচিয়ে বললেন তিনি। কেঁপে উঠলাম আমি। তিনি ত্রুব্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে বেলকেনিতে চলে গেলেন। আমি আগের ন্যায় বেলকেনির দিকে চেয়ে আছি। এইতো ভালো ব্যবহার করেছিলেন, তাহলে হঠাৎ কি হলো তার? আমি কাঁদছি বলে তার কষ্ট হচ্ছে না-কি আলোর কারণে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে? ডাইরীর মাঝে কলম রেখে ব্যাগে ভরে রাখলাম। অতঃপর ফাঁকা জগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আন্টি বারবার বলে গেছেন, রৌধিক আসলে তাকে খাবার এনে দিতে। আত্মীয়-স্বজন চলে গেছে, তাই তাড়াতাড়িই শুয়েছে তারা।
ট্রে নিয়ে হাজির হলাম। রুম ফাঁকা। নাকে বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে। রুম স্প্রে দিয়ে গন্ধ দূর করার চেষ্টা করলাম। বেলকেনির দিকে পা বাড়ালাম। রৌধিক বেলকেনির রেলিং এ দুই হাত রেখে দূর আকাশে চেয়ে আছেন। হয়তো নিজের অতীত মনে পড়ছে। আমার জায়গায় শেফাকে মনে পড়ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
” শুনছেন? আপনার খাবার এনেছি! খেয়ে নিন।”
রৌধিক চাইলো আমার দিকে। তার চোখে অসহায়ত্ব খুঁজে পাচ্ছি। চোখে চোখ রাখার মতো সাহস নেই আমার। শান্ত গলায় বলল,
” আমি খাবো না। যাও! তুমি খেয়ে নাও।”
” রাত তো অনেক হলো। সারাদিন কিছু খান নি। বেশি না, একটু কিছু খেয়ে নিন।”
” তোমাকে আমি যেতে বলেছি। জাস্ট গো! এইধরনের মেয়েদের সাথে একটু ভালোভাবে কথা বললেই, মাথায় চড়ে বসে।”
হাতের পিঠ দেখিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে। সন্দিহান স্বরে বললাম,” ওয়াট ডু ইট মিন বাট এই ধরনের মেয়ে। সম্মান এবং সামলে কথা বললেন। এই ধরনের মেয়ে আপনার বউ হতে আসে নি। আপনার বাবার সম্মানের কথা ভেবে বিয়েতে বসেছে। আমি এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি স্বার্থপর নই। অন্যের উপকারের মূল্য দিতে জানি।”
আর কথা না বাড়িয়ে সোফা এসে শুয়ে পড়লাম। এই মানুষটা গিরগিটির মতো। গিরগিটির চেয়েও বেশি রং বদলায়। গিরগিটির রং বদলাবে এটা স্বাভাবিক। গিরগিটিও এতো তাড়াতাড়ি নিজের রং বদলাতে পারে না। যেটা সে পারে। শাড়ির লম্বা আঁচল টেনে শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]