#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৭
অফিসে বসের আসনে নিজের বরকে দেখে মাথা ঘুড়ছে আমার। চারদিকে এতো আলোর মাঝেও দুচোখে ধোঁয়াশা ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। রৌধিককে মোটেও আশা করি নি এখানে। হুট করে তাকে দেখে চমকে গেলাম। রৌধিক এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।রৌধিক তার প্রত্যুত্তর না পেয়ে কঠোর স্বরে বললেন, “ওয়াট ইজ ইউর নেম মিস্ ওর মিসেস?”
কেঁপে উঠলাম আমি। নিজের ভেতরে ফিরলাম। আমাকে স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে ম্যানেজার সাহেব বললেন, -” মিস্ জোনাকি। ও, ও জোনাকি!”
রৌধিক টেবিলে আঘাত করে বলল,
” আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করছি? যাকে জিজ্ঞেস করেছি, সেই বলুক। অহেতুক কথা বলা আমি পছন্দ করি না, ম্যানেজার সাহেব। তাছাড়া আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি? করি নি। এভাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আশা করি নেক্সট টাইম থেকে মনে রাখবেন কথাটা। আপনি আপনার কাজে যান! আর আপনি..
সারাদিনে মাত্র ৮ ঘন্টা অফিসে আজ করেন। তার উপরে এতো দিন আসেন নি কেন? কোনো ছুটি নিয়েছিলেন? জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি কেন?”
রৌধিকের কড়া প্রশ্ন। আমি মুখ ফুটে কিছু বলতে চাইলে ধমকে উঠলেন তিনি। ফাইল টা ছুঁড়ে ফেলে বললেন,-” আশ্চর্য! এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও এখান থেকে আর এই ফাইলটা চেক করে তবে তুমি বাড়িতে যাবে। নাও আউট!”
আমি ফাইলটা তুলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। নিজের টেবিলে বসে কাজ করতে লাগলাম। লাঞ্চ টাইমে আহির, সারা খেতে ডেকেছিল। কাজের কারণে খাওয়া হয়ে উঠেনি। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। রাত আটটা বাজলো। অফিস ছুটি হয়ে গেল। আমি তখনও নির্বিকার ভাবে কাজ করে চলেছে। রাত বাড়তে লাগলো। হুট করে আলো বন্ধ হয়ে গেল। দৃষ্টি ফিরে চাইলাম আমি। সবকিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারদিকে কেউ নেই। অন্ধকারে কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কানে অস্পষ্ট নুপুরের শব্দ শ্রবণ হচ্ছে। হুট হাট শব্দ গুলোতে আমার ফোবিয়া আছে। অন্ধকারে ব্যাগ হাতরে ফোন খুঁজলাম। নিভু নিভু আলো। চার্জ নেই। দরজার কাছে গেলাম। বাইরে থেকে বন্ধ। কিছু স্টার্ফরা নিচ তলায় রাতে কাজ করে। সেখান থেকে আওয়াজ আসছে। গরমে ঘেমে গেছি আমি। বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেললাম। পেছনে ঘুরতেই হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে আলো নিভে গেল। বসে পড়লাম নিচে। হাতরে ফোন খোঁজার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। ভাঙা ভাঙা কয়েক টুকরো হাতে এলো। ঠাস করে মাথায় কিছু একটা পড়লো। জিম ধরে রইলো মস্তিষ্ক। ধীরে ধীরে ঝাঁপসা হয়ে এলো চোখজোড়া। বুঝতে পারলাম জ্ঞান হারাচ্ছি।
.
চোখের পাতায় পানির কণা পড়তেই নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলাম। সর্বপ্রথম দর্শন হলো রৌধিকের মুখশ্রী। পানির বোতল ঠোঁটের কোণে রেখে হেলিয়ে দিলো মুখে। পানির সাহায্যে গলা ভিজিয়ে নিঃশ্বাস নিলাম। নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আমায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” আর ইউ ওকে?”
“হম।”
রৌধিক আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনারা কেমন দায়িত্ব পালন করেন, আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। স্টার্ফরা ফ্লোরের ভেতরে আছে কি নেই, সেটা চেক না করেই লক করে দিচ্ছেন। তাহলে আপনাদের কেন রাখা হয়েছে। স্পিক আপ..
আমিই তো যাওয়ার সময় লক করে যেতে পারি। কালকে এসেই আমার সাথে দেখা করবেন। ”
সবাই মাথা নিচু করে আছে। রৌধিক আমাকে কোলে তুলে নিলেন।
_______
দুজনের মাঝে আকাশ পাতাল দূরত্ব। রৌধিক ড্রাইভ করছে আমি বসে আছি। বাবা আর বোনের কথা খুব মনে পড়ছে। ব্যাগটা রেখে এসেছি। ফোনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। নেই বললেই চলে। রৌধিক আঢ় চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি তখনও ফোন চালু করার চেষ্টা করছি। নিজের ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নমনীয় স্বরে বলল,
” চাইলে আমার টা দিয়ে ট্রাই করতে পারো।”
কোনো প্রত্যুত্তর না করে ফোনটা নিলাম। সর্বপ্রথম নজরে এলো সময়। বারোটা আটচল্লিশ। বাবার নাম্বারে ডায়াল করলাম। দুইবার দিতেই রিসিভ হলো। জয়া ফোন তুলে হ্যালো বলল। ঘুম ঘুম তার কন্ঠস্বর।
” আমি জোনাকি। তোরা কেমন আছিস এখন?”
“বাবা ভালো আছে আপু। তুই ভালো আছিস তো আপু?”
” হ্যাঁ। আমি ভালো আছি। ঘুমিয়েছিলি বুঝি?”
-” হ্যাঁ আপু। আপু..
থেমে গেল জয়া। আমি সন্দিহান স্বরে বললাম,” কিছু বলবি?”
” বলতে চেয়েছিলাম! আসলে ডাক্তার কালকে বাবাকে রিলিজ করে দিবে। আগের সব টাকা তো পরিশোধ করা আছে। তবে দুদিনের হসপিটালের বিল, ওষুধ পত্রের টাকা পাবে। পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো হয়েছিল। আমি ডাক্তারকে বলে ত্রিশ হাজারে ম্যানেজ করেছি। কালকে সকাল দশটার মধ্যে বাবাকে বাড়িতে নিতে না পারলে কালকের বিলটাও দিতে হবে।”
নিশ্চুপ আমি। আমার কাছে এক টাকায়ও নেই। কালকে সকালের মাঝে কিভাবে এতোগুলো টাকা ম্যানেজ করবো? টাকার অভাবে নিজেকেই তো বিক্রি করে দিলাম। ধ্যান ভাঙল জয়ার কথায়,
” আপু দুদিন পর আমার পরীক্ষা শুরু হবে। স্কুলের বেতন পরীক্ষার ফ্রি।”
” চিন্তা করিস না। ঠিক যোগার হয়ে যাবে। রাখছি! বাবার যত্ন নিস।”
ওপাশের উত্তরের অপেক্ষা না করে রেখে দিলাম ফোন। ফোন নাম্বার টা কেটে স্টেয়ারিং এর উপর রাখলাম। রৌধিক ফোনের দিকে চেয়ে বলল,”ফোন নাম্বারটাও ডিলেট করে দিলে।”
কিছু না বলে সিটে গাঁ হেলিয়ে দিলাম। চোখজোড়া বন্ধ করে রইলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত ঠেকছে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হলো। রৌধিকের কন্ঠ শোনা গেল।
“জোনাকি, আমরা এসে পড়েছি।”
ফট করে উঠে বসলাম। আমি আলতো চোখে চাইলাম। বললাম,
“ক-কি?”
“কুল। আস্তে। উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি। আমরা বাড়িতে এসে গেছি।”
ওহ্ বলে সিট বেল্ট খুলে ফেললাম। দরজা খুলে পা রাখার আগেই রৌধিক এসে হাজির। আমাকে পুনরায় পাঁজাকোলা করে বের করলো। পা দিয়ে ঠেলে দরজা বন্ধ করে দিল। হাঁটতে শুরু করলো। আমাই তার গলা পেঁচিয়ে ধরে বললাম,
“আমাকে নামান। আমি পারব।”
“আই নো, ইউ ক্যান। ইউ হ্যাভ দ্যাট পাওয়ার। বাট আই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট পাওয়ার টু ট্রাস্ট ইউ। দ্যান আই হ্যাভ নার্সিং টু ডু।”
ধীরে ধীরে আমাকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন হাওয়ার বেগে। রাত বেশি হওয়াতে কেউ জেগে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে। সিঁড়ি পেরিয়ে আঠাশ কদম ফেলে নিজের ঘরে ঢুকলেন। মনে হলো এই বাড়ির সবকিছু তাঁর চেনা জানা। বেডের উপর বসিয়ে দিলেন। একদম বেডের মাঝ বরাবর। আমি মনে করেছিলাম, নিচে ফেলবে। কিংবা ভুলবশত নিচে রেখে দিবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। অর্থাৎ তিনি যেমন মেপে মেপে কথা বলে, তেমন মেপে মেপে কাজ করেন।
আলো জ্বেলে দিলো। আলোক হীনতায় গিজগিজ করা ঘরটা আলোয় ভরে উঠলো। তীর্যক আলো চোখে পড়তেই চোখ কুঁচকে এলো। সময় নিয়ে চোখ মেলতেই রৌধিককে অনুপস্থিত দেখতে পেলাম। ভেবে নিলাম, রৌধিক তার কক্ষে আছে। আমাকে আমার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে রেখে গেছে। এবারও আমাকে ভুল প্রমাণিত করল। ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়ামী শ্রবণ হলো। সে দিকে তাকালাম। ভেতরে আলো জ্বলছে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আশে পাশে অবলোকন করে বুঝতে পারলাম এটা রৌধিকের ঘর। ততক্ষণে রৌধিক বেরিয়ে এসেছে। কাবার্ড হাতরে টাওয়াল নিয়ে মুখ, হাত পা মুছে সোফার হাতলে মেলে দিলেন। তার কান্ড দেখে বললাম,
“ক, কি করছেন আপনি? রং উঠে যাবে তো?”
রৌধিক তদানীং বেডের মাঝ বরাবর শুয়ে পড়েছে। আমার দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তো! আমার ঘরে প্রতিটি জিনিস এক মাস অন্তর অন্তর চেঞ্জ করা হয়। পুরোনো কিংবা ফেটে যাওয়া জিনিস আমার পছন্দ নয়। আই ডোন্ট লাইক ইট।”
“আমিও তো কিছুদিন পর পুরোনো হয়ে যাবো। অলরেডি ফেটে গেছি। আ’ম মিন কপাল কেটে গেছে। এবার কী আমাকেও চেঞ্জ করবেন?”
“স্যরি আমি তো ভুলেই গেছি!”
শব্দ করে উঠে বসলেন রৌধিক। কপালের দিকে চেয়ে মেডিসিন বক্স বের করলেন। তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে কপালে ঘসে দিতে দিতে বললেন,
” সবকিছু কি এক জোনাকি?”
“হ্যাঁ। একই তো? আমি পুরোনো হয়ে গেছি, তাই সেদিন পাবলিক প্লেসে..। আমি পুরোনো হয়ে গেছি, তাই আমার খোঁজ নেন নি দুদিন।”
“জোনাকি, তুমি কি আমার অভিমান বুঝতে পারো না? তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে ঘর থেকে চলে গেছো, আমার কি কষ্ট হয় না। এই দুদিনে একবারও কী আমার খবর নিয়েছো?”
চুপ করে রইলাম আমি। জবাব নেই আমার কাছে।রৌধিক নিজের কাজ করছে। একবারও জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি দিচ্ছে না। বড়ই অদ্ভুত সে।
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]