#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৯
“আমার বিবাহিত বউকে আপনি কার কাছে বিয়ে দিতে চাইছেন, শ্বশুর মশাই?
আমি এখানে। মানে আপনার মেয়ে জামাই এখানে।”
রৌধিকের কষ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি। ভীত হলাম। অফিসের পোশাকে এসে হাজির হয়েছে এখানে। শুভ, বাবা আর শুভের মা রৌধিকের দিকে চেয়ে আছে সন্দিহান চোখে। রৌধিক তেড়া মানুষ। সত্যি বলে না দিলেই হয়। শুভ আমার দিকে অসন্তুষ্ট চোখে তাকালেন। টেনে টেনে বললেন,
“এই সেই ছেলেটা, যাকে আমি জোনাকির সাথে দেখেছিলাম। সেদিন আমার জোনাকির গায়ে হাত তুলেছিল। ওকে তো আমি..
কথা শেষ করল না। রৌধিকের কলার টেনে ঘু’ষি বসিয়ে দিল গালে। আকস্মিক ঘটা দূর্ঘটনায় রৌধিক নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। দেয়ালের সাথে গিয়ে বাড়ি খেল। দেয়ালে হাত রেখে উঠতে নেওয়া আগেই আরো একটা ঘু’ষি দিল। রৌধিক মাটিতে পরে গেল। তার চক্ষু জোড়া আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফুটছে। দাঁত দিয়ে উপরের অধর চেয়ে ধরেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে। রৌধিক তবুও শান্ত ভদ্র ছেলের মতো সব সহ্য করে রয়েছে। শুভ শান্ত নেই। পুনরায় রৌধিককে মারার জন্য হাত বাড়িয়েছে। আমি থামানোর জন্য এগিয়ে গেলাম। কিছু বলার উদ্যেগ নিতেই গম্ভীর গলায় বাবা বললেন,
“কে হচ্ছে কি শুভ? একজন মানুষ বাড়িতে এসেছে। বসতে না বলে মার’ছো। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি। যাও..
শুভ আরো একটা ঘুষি মা’রলো। চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি জানো না, চাচা। এই ছেলেটা সেদিন পাবলিক প্লেসে জোনাকির গায়ে হাত তুলেছে..
“তো! তাই বলে তুমি ছেলেটার গায়ে হাত তুলবে। যাও এখান থেকে..
শুভ প্রখর চাওনি দিয়ে চলে গেল। রৌধিক ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে বাঁকা হাসলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে টাইপিং করে মিটমিটে হাসলেন।
“কে তুমি বাবা?”
“আমি রাফসান আহম্মেদ রৌধিক। বাকিটা পরে বলছি, আগে আপনি খেয়ে নিন। কতো বেলা হয়ে গেল।”
রৌধিকের সোজাসুজি উত্তর। বাবাকে সালাম করলেন। আলিঙ্গন করলেন। পিঠের পেছনে বালিশ নিয়ে বাবাকে আধ শোয়া করে দিলেন। নাস্তা নিয়ে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলেন। আমাকে ইশারায় মেডিসিন দিতে বললেন। আমি মেডিসিনের বক্স এগিয়ে দিতে নিলেই ছো মেরে নিয়ে দিলেন। লিস্টের সাথে মিলিয়ে বাবাকে খাইয়ে দিলেন। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। আমি তার পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি জুতোর বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললেন,
“আধ ঘন্টা সময় দিলাম। এর ভেতরে অফিসে দেখতে চাই। অফিসে এসে একদম আমার কেবিনে আসবে।”
“মানে! বাবার এই অবস্থা। আজকেই হসপিটাল থেকে রিলিজ করেছি, আর আজই অফিসে যাবো। বাবার কখন কী প্রয়োজন হয়!”
রৌধিক এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরে টেনে দুই দেয়ালের মাঝের ফাঁকা স্থান চেপে ধরলেন। হাত সরিয়ে দেয়ালের দুই পাশে রাখলেন। দুজনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে কাছে এলেন। ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললেন,
“আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি কিছু? আমি আসতে বলেছি মানে আসতে হবে। শুনতে পেরেছো তুমি?”
কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো আমার। ভীত কন্ঠে বললাম,” পেরেছি!”
সাথে সাথে দূরত্ব বজায় রেখে সরে গেল সে। পকেটে হাত রেখে
“গুড!” আই লাইক ইট।
তুমি জানো, এই রৌধিকের গায়ে হাত তোলার সাহস কারো নেই। সেদিন তোমার গায়ে আর আজ তোমার শুভ আমার গায়ে হাত দিয়েছে। ওর হাত আমি ভেঙ্গে দিবো। যাতে আমাকে কিংবা আমার জিনিসে হাত দেওয়ার আগে তিনবার অন্তত ভাববে।
আমি মেসেজ করে গার্ডদের শুভকে আটকাতে বলেছি।”
চামড়ার জোতার মৃদু শব্দ করে বেরিয়ে গেল সে। শূন্যতায় মিলিয়ে গেল সে। দমকা হাওয়া বইলো। ধুলো এসে চোখের মাঝে ঢুকলো। চোখের মাঝে কাঁটার মতো বাজতেই নুড়ে গেল চোখের পাতা। ধ্যান ভাঙল আমার। দৌড়ে অপর পাশের বেলকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক গাড়িতে বসে, কাঁচ নামিয়ে বেলকেনির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সান গ্লাস টা শার্টের সাথে মুছে চোখে দিয়ে বলল,
“শ্বশুর মশাইকে দুটো ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। মনে হয় না রাতের আগে ঘুম ভাঙবে।”
“মানে কি, এই সময়ে বাবাকে?”
“নো প্রবলেম জোনাকি। আমি একটু হলেও ডাক্তারী সম্পর্কে জানি। তাই তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি না আসা পর্যন্ত আমি মুখের এই রক্ত মুছবো না। তোমার ওরনা দিয়ে মুছে দিবে।”
অবাক হলাম আমি। রৌধিক গাড়ি চলে গেল। গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই বাবার ঘরে এলাম। বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে ওষুধের ডোজে। ঘর গুছিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম।
_____________
অফিসে এসে জানতে পারলাম, রৌধিক অফিসে আসে নি আজ। কিন্তু আরো আধ ঘন্টা আগে বেরিয়েছে। ব্যাগ রেখে কাজে লেগে পড়লাম। এভাবে কেটে গেল ঘন্টা খানেক। বারবার আমার শুভোর জন্য ভয় করছে। রৌধিক যা বলেছে যদি সত্যি করে ফেলে। আমার ধ্যান ভাঙল পায়ের আওয়াজে। রৌধিক হনহনিয়ে নিজের কেবিনে গেছে। রৌধিকের পায়ের শব্দ অন্যদের হাঁটার শব্দ থেকে আলাদা। পেছনের পায়ের তলার সাথে ঘসে ঘসে হাটে।
কাজে মনোযোগ দিলাম আমি। বিকট শব্দে কেঁপে উঠলাম। সম্পূর্ণ ফ্লোরের সবাই জড় হয়ে গেল। একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। ম্যানেজার সাহেব নেই। তাকে বদলি করা হয়েছে। কাল থেকে নতুন ম্যানেজার আসবে। সবাইকে কাজ করতে বলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দরজা নক করলাম কোনো রেসপন্স পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কেবিনের সব জিনিস ভেঙে পড়ে আছে। রৌধিক কোথাও নেই। কয়েক পা ফেলতেই দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম আমি। পেছনে ফেলতেই রৌধিকের ভয়ংকর মুখের সম্মুখীন হলাম। মুখশ্রী পুরো লাল হয়ে গেছে। রাগে নাকি রোদের তাপে বুঝতে ব্যর্থ হলাম। এখনো রক্ত শুকিয়ে আছে। আমি ওরনা দিয়ে রক্ত মুছে দিতে লাগলাম। তিনি স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করল,
“শুভ তোমার কে হয়?”
হাত থেমে গেল। ভুতুড়ে ঢোক গিলে বললাম,
“মানে..
আমাকে ছেড়ে দেয়ালে আঘাত করে বলল,
“তুমি কানে শুনতে পাও না। আমি জানতে চাইছি, শুভ তোমার কে হয়?”
“শুভ আমার বাবার দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে।”
বিরাগী হলো রৌধিক। এগিয়ে এসে খামচে ধরলো বাহু। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আমি জিজ্ঞাসা করেছি, তোমার কী হয়? তোমার বাবার কী হয়, সেটা নয়।
রৌধিকের হাতের নক জামা ভেদ করে কাঁধে ঢুকে যাচ্ছে এমন অবস্থা হয়েছে। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছি আমি। দেহ সহ্য করার ক্ষমতা রাখলেও চোখ রাখলো না। গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। নত কন্ঠে বললাম,
“ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।”
রৌধিক আমার দিকে চাইলেন। বাম চোখের পানিটুকু বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে মুছে দিলেন। ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“জোনাকি, যাও। আমার সামনে থেকে, আমার অফিস থেকে যা। বাড়ি চলে যাও তুমি। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি। মাথা খারাপ হয়ে গেলে আর পারব না।”
জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। হাত তার মুষ্টিবদ্ধ করা। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে বললাম,
” শুনুন..
” কি শুনবো আমি। কি বলতে চাও। সামান্য একটা কথা বলতে তুমি পারছো না। অন্যর কাছে শুনতে হয়, তুমি তার বাধ্য’ক্তা। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, তুমি তার প্রাক্তন নাকি হবু বউ..
“স্যার, নতুন ম্যানেজার এসেছে। ”
দরজা খুলে একজন স্টার্ফ বলল। রৌধিক কোর্ট টা তুলে গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল,
“তাকে বসতে বলুন। আর একজন স্টাফ পাঠান। এগুলো পরিস্কার করে দিন।”
“ওকে স্যার” বলে স্টার্ফ চলে গেল। রৌধিকও তার পিছু চলে গেল। আমি নামক একজন মানুষ যে এখানে আছি, তা হয়তো তার কাছে মনেই হয়নি। আমি চলে এলাম। নিজের টেবিলে রাখা ব্যাগ টা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। জীবন টা বড্ড অগোছালো লাগছে। রৌধিক নামক মানুষটা আমার জীবনের ছন্দ বদলে দিয়েছে। হারিয়ে দিয়েছে মানে। সে নিজেই জানে না, সে কি চায়।
আপনি বড্ড খারা’প রৌধিক। আমাকে বুঝতে পারেন না।
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]