অনুভবী হিয়া পর্ব-২৭

0
1753

#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির

২৭.

কেবিনে এক প্রকার বিরক্ত নিয়ে বসে ফাইল ঘাঁটছে মিহির। ঠিক বসে আছে না জুরপূর্বক বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। সামনের চেয়ারে বসে টেবিলে ভর দিয়ে দুই গালে হাত রেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ। এই জীবনে এমন অস্বস্থিতে কখনোই পরেনি মিহির। সকালে অফিসে এসেই কিছু ফাইল চেক করে শুভর কেবিনে দিতে এসেছিলো সে। ব্যাস! নিজে না এসে যদি রায়হান কে পাঠাতাম। উফ কেনো যে আসতে গেলাম। বেলা সাড়ে ১২টা বাজে। ভিতরে রাগ দমিয়ে শান্ত গলায় বললো মিহির,

‘শুভ! এই নিয়ে ছয় থেকে সাত বার ফাইলটা চেক করেছি। সব এমাউন্ট ঠিক আছে কোথাও ভুল নেই। আপনি আর একবার চেক করে দেখেন।’

‘উহুম!’ গালে হাত রেখেই ছোট করে উত্তর দিলো শুভ।

‘উহুম মানে কি? ফাইলে কোনো ভুল নেই। বাহানা দিয়ে আপনি ইচ্ছে করে আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন তাই না?’ রেগে ঝাঁঝালো গলায় বললো মিহির। মিহিরের কথা যেনো শুভর কানে যায় নি আগের মতোই বসে মিহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘সমস্যা কি আপনার? এইভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেনো? জীবনেও মেয়ে মানুষ দেখেন নি?’ বিরক্ত নিয়ে বললো মিহির। শুভ আগের মতোই ভাবলেশহীন ভাবে নেশাক্ত গলায় বললো,

‘মেয়ে দেখেছি কিন্তু তোমার মতো সুন্দর অপ্সরী কাউকে দেখিনি। তোমাকে আজীবন দেখলেও মন ভরবে না। তোমার এই চোখের চাহনি বার বার আমাকে গায়েল করে।’

শুভর কথা শুনে মিহিরের গায়ে শীতল হাওয়া শিরা উপশিরায় বয়ে গেলো। শুভর এই নেশাক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাধ্য তার নেই। চোখ নামিয়ে নেয় মিহির। নিরবতায় চলে যায় কিছুসময়।

‘মিহি?’

চোখ তুলে শুভর দিকে তাকায় মিহির। তখন শুভ আহ্লাদী কন্ঠে বলে, ‘তুমি এতো কিউট কেনো? লাইক রেড স্ট্রবেরী। একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।’ রসগোল্লার মতো চোখ করে তাকাই মিহির। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আপনা আপনি মুখ থেকে বের হয়ে আসে, ‘অসভ্য।’

‘অসভ্যের হবু বউ।’ বলেই জুড়ে জুড়ে হাসে শুভ। হাসলে তার ডান গালে ছোট একটা টুল পরে। যা মিহির খুব পছন্দ। সেই টুল পরা হাসির দিকে তাকিয়ে আনমনে মুচকি হাসে সে।
______________

লাইব্রেরী তে কাচুমুচু হয়ে বসে আছে রাহুল আর সামির। তাদের ঠিক সামনে বসে আছে মাহিন। বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়েও তাদের আড় চোখে প্রখর করছে মাহিন। রাহুল সামির কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। গলা ঝেড়ে বলে মাহিন, ‘কিছু বলার থাকলে নির্ধিদায় বলতে পারেন।’

সামির ঠোঁটে হাসি টেনে এক আঙুলে থুতনি চুলকে বলে, ‘আসলে ভাইয়া আমরা কিছু বলতে এসেছিলাম। আমাদের তো চিনেনই। মানে হচ্ছে..’ সামিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাহিন বাঁকা হেসে বলে, ‘বন্ধুর হয়ে উকিলাতি করতে আসছেন?’ সামির কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। পরোক্ষনে নিজেকে সামলে বলে, ‘আসলে ব্যাপার টা তেমন না আবার এমনি। কিভাবে বুঝাই বুঝতেছি না। সরাসরি বলে ফেলি রাগ করবেন না ভাই। শুভ মিহিরকে অনেক ভালোবাসে। আমরা চাই ওরা এক হয়ে যাক। আর সেটা ফ্যামিলি থেকে পারমিশন নিয়েই।’

রাহুলও সম্মতি দিয়ে বলে, ‘হ্যা ভাই! ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে তো আমরা বাধা দেওয়ার কে বলুন? ওরা হ্যাপি থাক এটাই তো চাই তাই না।’

মাহিন চেয়ারে গা এলানো অবস্থায় থুতনিতে হাত রেখে স্বাভাবিক ভাবে বলে, ‘আমি যতটুকু জানি মিহু শুভকে ভালোবাসে না!’ সামির বললো, ‘মিহু ভালোবাসে সেটা খুব ভালো করেই জানি আমরা। আপনি রাজি থাকলেই সে সম্পর্কে এগোবে।’

রাহুল পারে না হাত জুর করে বলে, ‘ভাইয়া প্লিজ রাজি হয়ে যান। আপনি যা বলবেন আমরা তাই করবো। না করবেন না প্লিজ!!’

মাহিনের এবার হাসি পাচ্ছে। বয়সে বড় ভাইদের সামনে নিজেকে এভাবে দেখে হাসিতে তার লুটিয়ে পরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা মনে দমিয়ে রেখে বাহিরে গম্ভীর্য বজায় রেখে বলে, ‘একটা প্রভাত আছে – যার বিয়ে তার হুশ নাই পাড়াপড়শির ঘুম নাই! যাই হোক, ভেবে দেখবো। আমি আমার বোনের মুখে হাসি দেখতে চাই। কেউ মিহুকে কষ্ট দিলে তার জান কেড়ে নিতে দ্বিতীয় বার ভাববো না। মনে রাখবেন কথাটা!’ বলেই বেরিয়ে যায় সে।

সামির রাহুল একে অপরের মুখে চাওয়া চাওয়ি করছে। রাহুল অসহায় ফেসে বলে, ‘ভাই তো নয় যেনো বাংলা মুভির নিশা। আসলেই শুভর কপাল পুড়া।’
_______________

আরএস কোম্পানি বড় একটা প্রজেক্ট পেয়েছে যার জন্য কোম্পানির স্টার্ফ এমপ্লয়দের নিয়ে ছোট খাটো একটা বার্বিকিউ পার্টি হবে। পার্টি সাধারনত অফিসেই সন্ধ্যার পর হবে। অফিসের ছাদে আয়োজন করা হয়েছে। নরমাল কোল্ড ড্রিংকস, চকলেট, চিপ্স ছাদের এক পাশে লম্বা একটা টেবিলে সাজানো হয়েছে। ছেলে এমপ্লয়রা বার্বিকিউ বানাতে ব্যস্ত। মেয়েরা পাশাপাশি বসে আড্ডা দিচ্ছে তো তাদের সাহায্য করছে। মিহিরের এখানে আসার ইচ্ছে ছিলো না, শুভর জুড়াজুড়িতে আসতে হয়েছে। এখন একপাশে দাঁড়িয়ে মেয়ে দের সাথে গল্প করছে সে।

খাওয়া দাওয়া শেষে গোল হয়ে বসে আছে সবাই। ছেলেরা এক পাশে মেয়েরা সবাই একপাশে। মিহির শুভ একেওপরের সামনে বসে আছে। হাসি আড্ডার মাঝে সবাই শুভকে জোর করে গান গাওয়ার জন্য। একজন এমপ্লয় তো গিটার এনে রেখেছে। বাধ্য হয়ে গিটারে আওয়াজ তুলে শুভ। চারদিকে নিরবতা বিরাজ করছে তার গান মনোযোগ দিয়ে শুনার জন্য।

মিহিরের দিকে তাকিয়ে গান গাওয়া শুরু করে শুভ,

~ আমি তোমার সাথেই আমাকে খুঁজে পাই
এখনো যত্ন করে যায়,
যদিও তুমি বহুদূরে..
আমি আজও পাগল তোমারি ওই প্রেমে
গেছি হারিয়ে রাতের আকাশে
তবে কি কাহিনী শেষ আমাদের?
আমি ভাবি, যদি আবার
ছুতে পারতাম তোমাকে
সত্যি বা স্বপ্নই হোক
এ দূরত্ব শেষ হয়ে যেতো যে।

ভালোলাগা, ভালোবাসার তফাৎ কি যে হয় জানতাম না,
তবে কি আজ সব দুষটা আমার, দেড়ি করেছি বুঝতে তবু ভয়,
ভয় পেয়ো না, আমি আছি, তোমারি পাশে
দূরে যেও না, রাখবো আমি, জড়িয়ে তোমাকে!!
(SayAn)

পুরোটা সময় শুভ মিহিরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মিহিরের মনে হচ্ছিলো এই গানটা তাদের জন্যই গাওয়া। প্রত্যেকটা লাইন যেনো তাদেরকে নিয়েই লিখা।

ছাদের কার্নিশ ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে মিহির শুভ। তারা দুইজন বাদে সবাই চলে গেছে পার্টি শেষে। দীর্ঘ নিরবতা পালন করে ‘তোমাকে আজকে সুন্দর লাগছে মিহি!’ হাস্যউজ্জল চেহারায় বলে শুভ। মিহির ঘাড় কাত করে শুভর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘থ্যাংকস!’

শুভ আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে, ‘রাতের আকাশের এই হাজার তারার ভিড়ে যেমন চাঁদ টা বেশি আকর্ষণীয়, তেমনি আমার পৃথিবীর বসন্তে কৃষ্ণচূড়া ফুলের সেই রক্তিম মোহনীয় আভা তুমিতে আমি আসক্ত!’

আমি অপলক তাকিয়ে আছে তার প্রেমিক পুরুষটির দিকে। বুকের বা পাশের ভারি জায়গাটা হালকা করতে প্রেমিক পুরুষের উষ্ণ অলিঙ্গন দরকার। শুভ মিহিরের পাশে দাঁড়িয়ে ডান গালে এক হাত রেখে শীতল কন্ঠে বলে, ‘ভালোবাসো?’

মিহিরের চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি কান্নায় ভেঙে পরবে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ। গাল দিয়ে চোখের পানি গরিয়ে পরে। শুভ মৃদু হেসে চোখের পানি মুছে বলে, ‘এই পাগলী কাঁদছ কেনো? থাক ভালোবাসি বলতে হবে না। আমার পাশে থাকলেই চলবে। কেঁদো না প্লিজ তোমার চোখের পানি আমার সয্য হয় না।’

তাৎক্ষণাৎ শুভকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে মিহির। শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আগলে নেয় তাকে। মিহি যে তাকে ভালোবাসে সেটা সে জানে। কিন্তু কেনো স্বিকার করছে না বুঝতে পারছে না। হয়তো তার দেওয়া কষ্টের কারণে। আলতো করে মিহিরের মাথায় চুমু দিয়ে হাত বুলাতে থাকে সে।

রাতে মিহিরকে বাড়িতে পৌছে দেয় শুভ। মিহির গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাটা ধরতেই শুভ ডাকে পিছে ঘুরে দাঁড়ায় সে।

পিছে ঘুরেই প্রশ্ন ছুঁড়ে মিহির, ‘কিছু বলবেন?’

শুভ পকেটে হাত গুঁজে বলে, ‘না!’ কথা পিঠে আবার প্রশ্ন করে, ‘তো ডাক দিলেন যে?’

মৃদু হেসে বলে, ‘এমনি দিয়েছি। বাসায় যাও!’

মিহির ভ্রুঁ উঁচিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। গেইটের ভিতরে ঢুকার সময় আবার শুভ ডাক দেয়। পিছে ফিরে বলে মিহির, ‘আবার কি?’

শুভ গাড়িতে হেলান দিয়ে হেসে বলে, ‘গুড নাইট!’ প্রতিত্তরে মুচকি হেসে বলে মিহির, ‘ইউ টু!’ বলেই চলে যায় সে। তার যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে শুভ।

‘এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে কবে? কবে ভালোবাসার মানুষটাকে একান্তে নিজের বাহুডোরে পাবো? এই অশান্ত মন যে কিছুতেই অপেক্ষা করতে পারছে না। কাছে চাইছে তাকে খুব করে চাইছে। হারিয়ে যেতে চাইছে সাদা মেঘের ফাকে উকি দেওয়া এক চিলতে মিষ্টি রোদের মাঝে।’

চলবে..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here