#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
২৮.
ক্যাফেতে বসে আছে মাহিন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সামনে বসে থাকা শুভ, সামির, রাহুল আর আদিলের দিকে। শান্ত মুখে এক হাত রেখে ঠোঁট টিপে হাসি আটকে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে। এই কয়দিন শুভ আচ্ছা মতো জ্বালিয়ে মারছে মাহিনকে। এমন ভাবে আবদার করছে যেনো কোনো পুতুল পছন্দ হয়েছে আর তার সেটা লাগবেই লাগবে। রাহুল মেঁকি হাসি দিয়ে বলে, ‘কি খাবেন বলেন আজকে আমার পক্ষ থেকে ট্রিট।’
শান্ত চোখে মুখে হাসি রেখে বলে, ‘আমার আপাতত ক্ষিদে নেই। মাহিন তোর কি চাই? না মানে তুই তো আবার..” শান্তর কথার পিঠে বলে মাহিন, ‘ বেশি না বললেই নয়?’
আড্ডা মাস্তিতে মেতে আছে ক্যাফের বাকি সদস্যরা। কথার এক পর্যায়ে শুভ মাহিনের উদ্দেশ্যে বলে, ‘দেখো মাহিন! যা করতে চাইছি সব পারিবারিক ভাবেই করতে চাইছি। তুমি রাজি থাকলে আমি আব্বু আম্মুকে নিয়ে তোমাদের বাসায় আসবো। আর আমি তো না মেনে নেওয়ার কোনো কারন দেখছি না!’
তীক্ষ্ণ চোখে বলে মাহিন, ‘মানা না মানার কোনো প্রশ্নই এখানে আসছে না। এই বিষয়ে আর না আগালেই ভালো।’ হুট করে রাহুল বলে, ‘কেনো আগাবে না? তারা দুজনই যখন একে অপরকে ভালোবাসে তাহলে আপনি না করার কে?’
বাঁকা হাসে মাহিন। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বলে, ‘মিহু কি একবারো বলেছে ভালোবাসে?’ শুভ অসহায় দৃষ্টি দিয়ে বলে, ‘বলেনি বাট সি লাভস মি। বুঝার চেষ্টা করো!’
‘মূল্যবান জিনিস খুব সহজে পেয়ে গেলে সেটার মূল্য কমে যায়। আপনি পেয়েছিলেন ঠিকি কিন্তু মর্যাদা দিতে পারেন নি। এখন না হয় একটু কষ্ট করুন। কষ্টের ফল মিষ্টি হয়!’
________________
ইউকে থেকে বাংলাদেশে ব্যাক করে বনানীর নিজস্ব বড় একটা এপার্টমেন্টে উঠে জিহান। দেশে ফিরেই বিশ্বস্ত সেক্রেটারির কাছ থেকে মাহিন শান্তর সম্পূর্ণ বায়োডাটা জানতে চাই সে।
ছবিসহ কিছু কাগজ প্রত্র জিহানের সামনে রাখে। মাহিনের ছবি দেখিয়ে বলে সেক্রেটারি নিলয়, ‘স্যার, ইনি হচ্ছেন এমআর হাসান উরফে আয়াত হাসান মাহিন! সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। প্রফেশন লাইফে তাকে এমআর হাসান নামে চিনে সবাই। বাড়ি কুমিল্লা, বর্তমানে মা, ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকা থাকে।’
শান্তর ছবি এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ আর ইনি হচ্ছেন এসআর আরাফ উরফে শান্ত আরাফ। উনার বাড়ি কুমিল্লা। সম্পর্কে মাহিনের ফুফাতো ভাই। বাবা মার একমাত্র সন্তান।’
‘দুজনের মাঝে কেসের ইনভেস্টিগেশন করে কে?’ থুতনিতে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে জিহান। নিলয় উত্তর দেয়, ‘আয়াত হাসান মাহিন। ক্যাসটা উজ্জ্বল আহসানের আন্ডারে পরলেও মাহিন সবটা সমাধান করে। উনি নিজেই কোটে প্রমান পেশ করবে।’
‘মম কে আদালতে নেওয়া হবে কবে?’
‘সামনের সাপ্তাহের বুধবার!’
‘এমআর হাসানের সাথে কথা বলতে চাই। এজ সুন এজ পসিবল।’ চোখ মুখ শক্ত করে বলে জিহান। নিলয় ‘ঠিক আছে!’ বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
রাগে মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে জিহানের মুখ। দুই হাতে মুখ ঢেকে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নেয় সে। চুল মুঠ করে ধরে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে, ‘মম তোমার কিছু হবে। আই’ম হেয়ার! আমার মম কে জেল থেকে বের করে আনবো। পৃথিবীর সব থেকে কাছের মানুষ সে তার কিছু হতে দিবো না। শেষ করে ফেলবো সব।’
_____________
এই কয়েকদিন ধরে মাহিনের পিছে শুভসহ তার বন্ধুরা আঠার মতো লেগে আছে। বিকজ ফর মাহিনকে কনভেন্স করার জন্য। অবশ্য তাদের এভাবে ঘুরিয়ে মাহিন প্রচুর মজা নিচ্ছে। নিবে না কেনো? একটা মাত্র বোনের প্রেমিক বলে কথা। একটু নাকানিচুবানি না খাওয়ালেই নয়। ভাবেই হাসি পাচ্ছে তার।
‘এই আপনি হাসছেন কেনো?’ লাইব্রেরীতে মাহিনের পাশে বসে থাকা সুহা ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করে। মাহিন নড়েচড়ে বসে বলে, ‘এমনি!’ সুহা কুঁচকানো ভ্রুঁ আরো গাঢ় করে বলে, ‘ এমনি কেউ হাসে?’ হেসে উত্তর দেয় মাহিন, ‘আমি হাসি!’
‘কাল কখন ঘুমিয়েছিলেন?’
‘তিনটা ঘুম আসে নি তাই।’
সুহা বললো, ‘ঘুম আসে নি কেনো?’ ছোট করে উত্তর দেয় মাহিন, ‘ এমনি।’
সুহা বিস্মিত হয়ে বলে, ‘যা বাবা আপনি দেখছি কলকাতার নায়ক দেবের লাইট ভার্সন হয়ে গেছেন!’ ভ্রুঁ বাঁকা করে জিজ্ঞেস করে মাহিন, ‘মানে?’
সুহা ঠোঁট টেনে হেসে বলে, ‘দেব ফেসবুকে ছবি দিলেই ক্যাপশন দেয় এমনি! আপনিও এখন এমনি এমনি করছেন। আমার জামাই দেবের লাইট ভার্সন ভাবা যায়?’
সুহার মুখে ‘জামাই’ শুনে ঘাড় কাত করে গভীর চোখে বাকা হেসে বলে, ‘জামাই?’ ভ্যাবাচেকা খায় সুহা। এই লোক যেই পরিমানের অসভ্য মুখ একবার ছুটলে থামে না।
একটা মেয়ে এসে মাহিনের পাশে বসে মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ‘হাই! আমি আফসানা। তুমি?’
সুহা চোখ বড় বড় তাকায় মেয়েটির দিকে। মাহিন প্রতিত্তরে বলে, ‘মাহিন!’ সুহা চোখ ত্যাড়া চোখে মাহিনের দিকে তাকায়। কিন্তু তার এই চাহনি মাহিন দেখেনি। মেয়েটি মাহিনের হাতে থাকা বইটি নিয়ে বলে, ‘দেখি কি পরছো?’
মাহিন বিরক্তি হয় কিন্তু তা প্রকাশ করেনি। সুহা রাগে কিড়মিড় করছে। কই সে তো কতদিন ঘুরেছে মাহিনের নামটা জানার জন্য, মাহিন তো তাকে নাম বলেনি। আর এই মেয়ে জিজ্ঞেস করতে না করতেই গরগর করে নাম বলে দিলো।
অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটা নিজে থেকেই বকবক করছে। মাহিন ভ্রুঁ উঁচিয়ে বিরক্তিবোধ করছে। সুহার রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।
‘এই মাহি তোমার মোবাইল নাম্বার টা দাও তো!’
ধপ করে উঠে দাঁড়ায় সুহা। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে মাহিনের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে যায়। সুহা চলে যাওয়ায় মাহিনও উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটি বলে, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
মাহিন কড়া গলায় ঝাড়ি মেরে বলে, ‘আমার বউয়ের পিছে যাই।’ বলেই বেরিয়ে যায় লাইব্রেরী থেকে। পুরো কলেজে সুহাকে পায় নি। জ্বিব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে ভাবে ‘আজকে আমি গেছি’
________________
ফুটপাত ধরে বুকে হাত গুঁজে হাটছে সুহা। তার পাশে হাটছে মাহিন। সেই কখন থেকে সুহার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু সুহা কিছুতেই কথা বলছে না। লাইব্রেরীতে ঘটা ঘটনার পর তিন দিন হয়েছে কিন্তু এখনো সুহার রাগ ভাঙ্গে নি। মাহিন কে পিছে পিছে আসতে দেখে সুহা ঝাঁঝালো গলায় বলে, ‘সমস্যা কি আপনার? পিছে পিছে আসতে বারণ করেছি আপনাকে?’
মাহিন অপরাধী ন্যায় বলে, ‘এখনো রেগে আছো কেনো? আর হবে না বললাম তো।’ সুহা মৃদু চেঁচিয়ে বললো, ‘কেনো হবে কেনো? যান না গিয়ে আরো কথা বলুন। একবারে বিয়ে করে বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলুন।’
সুহার কথায় বিষম খায় মাহিন। হাল্কা কেশে আশেপাশে তাকিয়ে বলে, ‘আমার বাবুর আম্মু তো হবে তুমি অন্যদের কেনো বানাবো।’ চোখ কুঁচকে বলে সুহা, ‘কে হবে আপনার বাচ্চার মা? বিয়ে করলে তো আপনার বাচ্চার মা হবো।’
‘আর রাগ করে থেকো না প্লিজ।’ অসহায় হয়ে বলে মাহিন। সুহা হাটতে হাটতে ব্যঙ্গ করে বলে, ‘কি টান ওই শাঁকচুন্নির জন্য হ্যাহ। আমি কত দিন ঘুরেছি আপনার পিছে আমাকে পাত্তা দেওয়া তো দূরের কথা নাম টাও বলেন নি। সুন্দর করে কথাও বলেন নি আমার সাথে। আর ওই মেয়ে আসতে না আসতে কি সুন্দর তাকিয়ে নাম বলে দিলেন। আবার অনেকক্ষণ পাশাপাশি বসে কথাও বলেছেন। আহা প্রেম! এই আপনি আবার পিছে আসছেন কেনো? ওয়েট আপনি কি ওই শাঁকচুন্নিকে নাম্বার দিয়েছেন? আই সোয়ের ভাল্লুক মশাই আমি আপনার গর্দান নিবো।’ শেষের কথা গুলো কোমড়ে হাত রেখে কড়া চোখে বলে সুহা।
মাহিন ঠাট্টা করে বলে, ‘নাম্বার চেয়েছে না দেই কিভাবে বলো?’
সুহা স্থব্ধ হয়ে যায়। ঠোঁট ভেঙ্গে আসে তার। চোখ ছলছল করছে। নাক লাল হয়ে গেছে। সুহাকে দেখে মাহিন হতভম্ব হয়ে যায়। ভাবতেও পারেনি তার কথা এতো সিরিয়াস ভাবে নিয়ে নিবে। মাহিন এগিয়ে এসে ব্যস্থ হয়ে বলে, ‘এই সুহারানী কাঁদছ কেনো? আমি তো মজা করছিলাম। কেঁদো না প্লিজ!’
সুহা নাক টেনে বলে, ‘আপনি অনেক খারাপ। আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। দূরে যান আমার থেকে।’ মাহিন দুই হাত দিয়ে সুহার চোখ মুছে বলে, ‘খুব ভালোবাসি আমার সুহারানী কে। মাহিন তো শুধু মাত্র তার সুহারানী, সে তার সুহারানী কে ছেড়ে কোথায় যাবে বলো?’
সুহা কান্না থামিয়ে মাহিনের দিকে তাকায়। চোখ লাল হয়ে আছে তার। মাহিন হাতের আঙুল দিয়ে স্বযত্নে পানি মুছে মৃদু হেসে বলে, ‘আমার এই পিচ্চি সুহারানী যে এতো আমাকে এতো ভালোবাসে জানতাম না তো। ভাবছি খুব তাড়াতাড়ি তাকে আমার ঘরে তুলতে হবে।’
সুহা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসি দেয়। মাহিন দুষ্টু হেসে বলে, ‘উফ সুহা আমাকে কি দেখালে বলো তো? তোমার কান্নামিশ্রিত গাল নাক লাল হয়ে যাওয়া মুখ প্রচুর এক্টাক্ট্রিভ। আই’ম জাস্ট কন্ট্রোলনেস। এখন তো দেখছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে টা করেই ফেলতে হবে।’
সুহার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। কড়া গলায় বলে, ‘অসভ্য!’
চলবে..!!