অনুভবী হিয়া পর্ব-৪২

0
2316

#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির

৪২.

‘পাপ্পাপা!’

হাস্যউজ্জল চেহারায় সদ্য ফুটফুটে বাচ্চাটি একটু একটু করে কথা বলছে। পাশ থেকে শুভ তার ছোট ছোট কোমল পা দুটো হাতে নিয়ে নাচিয়ে নাচিয়ে বলে, ‘পাপা সাইকেল সাইকেল।’

সাইম খিলখিল করে হেসে উঠলো। শুভও সাইমের সাথে হেসে দুলে কথা বলছে। পাশ থেকে মিহির বলে উঠে, ‘তোমরা রেডি?’

শুভ সাইমকে কোলে নিয়ে বলে, ‘ইয়াহ্ মেডাম, উই আর রেডি ফর গো! রাইট পাপা?’ হেসে উঠে সাইম। মিহির শাড়ির আচল টেনে বলে, ‘তাহলে আমার কুচিটা একটু ধরো আমি ঠিক করতে পারছি না।’

শুভ সাইম কে বিছানায় বসায়। অতঃপর মিহিরের সামনে হাটু গেড়ে বসে কুচি ঠিক করতে করতে বলে, ‘তোমার সাথে আমরা দুজন রেডি হলাম। আর তোমার এখনো হয় নি। এতো টাইম লাগে কেনো?’

মিহির কড়া গলায় বলে, ‘চুপ করো।’

শুভ কুচি ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। মিহির আয়নায় একবার নিজেকে ভালো করে দেখে শুভকে বলে, ‘কেমন লাগছে আমাকে?’

শুভ মৃদু হেসে মিহিরের কপালে চুমু একে বলে, “মাশা’আল্লাহ! আমার সাইমের আম্মু টাকে প্রচুর কিউট লাগছে।’ তখন পাশ থেকে সাইমের আওয়াজ আসে। দুজন তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। শুভ এগিয়ে সাইমকে কোলে নিয়ে বলে, ‘ওলে বাবারে, তোমাকেও আদর দেই।’

মিহিরও এগিয়ে সাইমের গালে চুমু দেয়। শুভ বলে, ‘আমার?’ মিহির চোখ পাকিয়ে তাকায় শুভর দিকে। শুভ আফসোস স্বরে বলে, ‘থাক লাগবে না। বেবি আসার পর থেকে বদলে গেছো। আমাকে চোখেই পরে না তোমার। আদর তো দূর একটা ছোট্ট কিস ও দাও না। সব বেবির জন্য খালি।’

মিহির অবাক হয়ে যায়। মিহিরের রিয়েকশন দেখে শুভ হেসে ফেলে। অতঃপর মিহিরের গাল টেনে বলে, ‘আসো লেইট হয়ে যাচ্ছে।’ সাইমকে শুভ কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। মিহির শুভর পিছে পিছে যায়।

ড্রয়িংরুমে এসে দেখে আয়াজ আর মিথিলা বসে আছে। শুভ মিহির নিচে নামার পরেই মিথিলা উঠে সাইমকে কোলে নিয়ে বলে, ‘দাদু ভাই, মাশা’আল্লাহ। দাদুকে সাথে নিবে? দাদু চকলেট দিবো।’ সাইম কি বুঝলো কে জানে। খিলখিল করে হেসে উঠে দাদূর কথায়। আয়াজ বসে থেকেই বলে, ‘দাদু ভাইকে আমার কাছে দাও।’

মিথিলা এগিয়ে সাইমকে দেয় তার কাছে। আয়াজ কোলে নিয়ে বলে, ‘দাদু ভাই আমার একদম আমার মতো। কি বলো মিথিলা?’ তারপর শুভর উদ্দেশ্যে বলে, ‘সন্ধ্যার আগে ফিরে এসো, সাইম কে নিয়ে রাতে বাহিরে থাকার দরকার নেই। খারাপ কিছুর নজর লাগতে পারে।’ শুভ সম্মতি জানায় বাবার কথায়। মিহির এগিয়ে সাইমকে কোলে নিয়ে নেয়। তার পর শুভ মিহির সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়।
_____________

কোলাহল পূর্ন শহর, ব্যস্ত নগরী। কিছুক্ষণ আগে থাকা ঘোলাটে আকাশ এখন বর্ষণমুখর। টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা পরছে ধরনীর বুকে। এই বর্ষণ কারোর জীবনে রঙ্গিন দিন আনে, আর কারোর জীবনে মেঘের মতোই ঘোলাটে আকাশ উপহার নিয়ে আসে। ছয় তলার এপার্টমেন্টের ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে থাইগ্লাসের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চোখ রাখে মাহিন। অনুভূতি শূন্য এই চোখ। নির্বিকার, হাহাকার, যন্ত্রনার। কেউ নেই কারোর পাশে। কেউ নেই দুঃখ ভাগ করে বুঝে নেবার। আকাশটা আজও সেই দিনের মতো মেঘলা। চোখের কার্নিশে জল চিকচিক করছে। ভাবছে তার সেই চঞ্চল, হাসিখুশি সুহারানী কে নিয়ে। মেয়ে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আইসিইউ তে নেওয়ার একদিন পরেই সুহা কোমায় চলে যায়। আজ দুবছর সুহার এখনো জ্ঞান ফিরে নি। মাহিনের সাথে আর আগের মতো হাসিখুশি কথা বলে না, অভিমান করে না, ভালোবাসেন না বলে দাবি করে না। মাহিনকে একলা করে সেই যে ঘুম দিয়েছে এখনো উঠে নি। অপেক্ষায় আছে মাহিন সেই দিন টির জন্য যে দিন সুহা তাকে ‘মিঃ হাল্লুক’ বলে ডাকবে। নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহিন। তখন মোবাইলে কর্কষ আওয়াজে রিংটোন বেজে উঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে তাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে কল এসেছে। এই প্রফেশনের জন্যই আজ তার সুহা বেচে থেকেও তার পাশে নেই। কল রিসিভ করে কথা বলার পরেই মিহিরের কল আসে। ঠোটে হাল্কা হাসি টেনে মাহিন কল রিসিভ করে।

অপর পাশ থেকে মিহির বলে উঠে, ‘ভাই কোথায় তুমি?’

‘বাসায়! কেন?’

বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে মিহির, ‘কেন কি আবার হবে। তোমার ভাগ্নে, হয়েছে তো তোমার মতোই।’

হেসে ফেলে মাহিন। তারপর বলে, ‘মামা টাহ কি করছে?’

মিহির ঠোট উল্টে বলে, ‘জ্বালাচ্ছে, এর জ্বালা কবে সে পরপার হয়ে যায় আল্লাহ ভালো জানে।’

মাহিন গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘মিহির?’ বিরক্তির মাঝে কি বলে ফেলেছিল মিহির হুশ আসে। পরোক্ষনে হেসে প্রশংজ্ঞ বদলায়। বলে, ‘আসো তো, সাইম কে সামলাও। তোমার জন্য কান্না করছে সাইম।’

মাহিন হেসে উত্তর দেয়, ‘আসছি। কি লাগবে তোর?’

‘না, তুমি চলে আসো শুধু।’

মাহিন ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দেয়। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির। ভাইটা তার অনেক বদলে গেছে। মিহিরের মা রাশেদা গতবছর স্টোক করে মারা গেছে। সেই পর থেকে মাহিন একা থাকে। মিহির কত করে বলে বলেছিলো তাদের সাথে থাকার জন্য কিন্তু মাহিন থাকে না। মাঝে মাঝে দেখা করতে এসে আবার চলে যায়। ভাইকে দূর থেকে এমন নির্বিকার, ভাবলেশহীন দেখে কষ্ট হয় মিহিরের। সুহা যদি সুস্থ থাকতো তাহলে তার ভাইয়ের জীবনও আর পাঁচটা মানুষের মতো সুন্দর স্বাভাবিক হতো। চোখ ঘোলা হয়ে আসে তার। তখন শুভ রুমে আসে। মিহিরকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এসে অস্থির হয়ে বলে, ‘মিহি কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?’

মিহির শুভকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। ভাঙ্গা গলায় বলে, ‘ভাইকে এভাবে দেখতে আর ভালো লাগে না আমার শুভ। কষ্ট হয় অনেক।’

শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। সব কিছু।’

‘কোথায় ঠিক হচ্ছে শুভ? দুই বছর ধরে সুহা কোমায় আছে। সুহা অন্তত্য আমাদের সাথে থাকতে পারতো। সুহাকে অনেক মিস করি শুভ।’

শুভর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। নিশব্দে মিহিরকে আগলে বলে, ‘হুশ কাঁদবে না। দেখো সাইম তাকিয়ে আছে। দো’য়া করো সব ঠিক হয়ে যাবে।’
_______________

রাত তখন সাতটা ছুঁই ছুই। মাহিন হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে ভিতরে যায়। তার হৃদস্পন্দন কাপছে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। বুকের ভীতর হাজারো ব্যাথা চেপে একটি কেবিনে ঢুকে। কেবিনে হাল্কা টিমটিম আলো জ্বলছে। মাহিন এগিয়ে লাইট অন করে বেডে তাকায়। মুহূর্তে তার চোখের কোণে পানি এসে পরে। ঠোটে ঠোট চেপে এগিয়ে বিছানার পাশে থাকা টুলে বসে। ফ্যাকাশে মুখ, এলোমেলো চুলে মুখে অক্সিজেন মাক্স রেখে শুয়ে থাকা তার সুহারানীর দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় সে। সুহার বা হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায় মাহিন। এক হাতে সুহার হাত বুকে চেপে রেখে আরেক হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে আহত গলায় বলে, ‘সুহারানী? তাকাও প্লিজ। দেখো তোমার হাল্লুক তোমার জন্যই বসে আছে। কাঁদছি আমি দেখো। এভাবে একা করে গেলে কেন তুমি? এখনো সময় হয় নি তোমার চোখ খুলার? ভালোবাসি সুহা। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।’

মাহিন কিছুটা এগিয়ে সুহার কপালে গাঢ় চুমু একে বলে, ‘তোমার অপেক্ষায় আছি সুহা। খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাও।’

মাহিন চোখের পানি মুছে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। ডক্টরের সাথে কথা বলে গাড়িতে উঠে। উদ্দেশ্য তার ভাগ্নে সাইমের কাছে যাওয়া।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here