#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১০
মেঝেতে বিছিয়ে রাখা কাঁথার উপর প্রহর বালিশ রাখতে অনুভব তার হাত চেপে ধরলো। এক টানে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
‘সমস্যা কি তোমার? কথা বলছ না কেন?’
প্রহর প্রশ্নের উত্তর দিল না৷ পূর্বের মতো নির্বাক রইলো। অনুভবের হাতের মাঝে থাকা হাতটা শুধু টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। অনুভব অত্যাশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলো প্রহরের এত নির্লিপ্ততা সে মোটেই সহ্য করতে পারছে না। উন্মাদ, ক্ষ্যাপাটে আর তাকে নিয়ে পাগলামিতে ভরপুর প্রহর তার বেশি পছন্দের। একটু একটু করে তার ভেতরে উদ্বেগের কালো ছায়া সংক্রমিত হতে থাকলো। উথাল পাথাল চিন্তা হতে লাগলো প্রহরকে নিয়ে। সে নরম গলায় বলল,
‘প্রহর, অনেক রাত হয়েছে। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি নিচে ঘুমাচ্ছি।’
অনুভবের উপর জমে থাকা দীর্ঘদিনের অভিমান, তার অবহেলা ও অসহ্য বিদ্বেষ আর বহুদিনের এক তরফা প্রণয়ের কষ্ট প্রহরের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল। ভেতরটা জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে উঠলো যেন। এক ঝটকায় অনুভবের বন্ধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। সে যেন ঘোর স্নায়ুযুদ্ধে নেমেছে। অনুভব আর সহ্য করতে পারলো না। ভেতরে চেপে রাখা রাগটা তরতর করে বেড়ে গেল। প্রহর তাকে পেছনে রেখে ঘুরে দাঁড়াতে সে আবার তার কবজি চেপে ধরলো। এবারে কোনো ছাড় দিল না। দাঁতে দাঁত চেপে হাতের বন্ধন শক্ত করলো। সে দেখতে চায় প্রহর কতক্ষণ ব্যথা সহ্য করতে পারে। কতক্ষণ মুখ দিয়ে উঁহু শব্দ না করে থাকতে পারে।
রক্তলাল চোখে ক্রোধ নিয়ে বলল,
‘তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ আমার সাথে কথা বলবে না? মুখ খুলবে না?’
প্রহর হাতে ব্যথা পেলেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল। তবুও মুখ খুলল না। এই প্রথম প্রহরের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে চেয়ে অনুভব তার জিদ সম্পর্কে অবগত হলো। সে-ও ছাড়ার পাত্র নয়। প্রহরের মুখ খুলিয়ে তবেই ছাড়বে। সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রহরের কবজিতে চাপ দিল সে। প্রহর আর সহ্য করতে পারলো না। কবজির হাঁড় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল যেন। দু চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো। চিৎকার করে বলল,
‘হাত ছাড়ুন বলছি।’
সঙ্গে সঙ্গে অনুভব হাত ঢিলে করলো। প্রহর দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি চেপে ধরলো। এক পলক পরখ করে দেখলো লাল হয়ে গেছে। নখ বসে গেছে চামড়ায়! সে ক্রধান্বিত চোখে অনুভবের দিকে তাকালো। অস্ফুট স্বরে বলল,
‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? কি করছেন এসব?’
‘এগজ্যাক্টলি প্রহর! আমারও সেইম প্রশ্ন। পাগল হয়ে গেছো তুমি? এসব কি করছো?’
‘হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি ৷ আর পাগলামি করছি।’
‘আর পাগলামি করতে হবে না। অনেক করেছ। এবার বলো, রাতের খাবার খেয়েছ?’
‘খাব না তো কি করবো? আমার সর্বগুণে গুণান্বিত গুণধর স্বামীর জন্য রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো? না খেয়ে থাকবো?’
অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝতে পারলো রাত করে ফিরেছে বলে প্রহর রেগে আছে। তবে মেয়েটা খেয়েছে ভেবে পরিতৃপ্ত হলো। প্রহরের সাথে তার পরিচয়ের কতগুলো দিন হয়ে গেল। এতগুলো দিন সে খুব সূক্ষ্ম ভাবে মেয়েটাকে ইগনোর করেছে। তার ব্যাপারে সবসময় উদাসীন ছিল। কারণ সে যে অস্থির এক পরিমন্ডলের বাসিন্দা। সদা ঘূর্ণায়মান সে পরিমন্ডল থেকে কারো দিকে মনোযোগ দেওয়া যায় না। এমনকি নিজের দিকেও না! যখন তখন সে নিজেই ছিটকে পড়বে যে!
লম্বা করে শ্বাস নিল সে৷ এক পা প্রহরের দিকে এগিয়ে এলো। উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘এত হাইপার হচ্ছো কেন? তোমার শরীরের কন্ডিশন ভালো না। কয়েকদিন আগে যে হসপিটালে এডমিট ছিলে ভুলে গেছো? এত রাত অবধি জেগে থাকতে কে বলেছে তোমাকে?’
‘আপনাকে এত রাত অবধি বাসার বাইরে থাকতে কে বলেছে?’
‘কেউ বলেনি! এখন চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ো। তোমার রেস্টের প্রয়োজন।’
প্রহর জোর গলায় বলল,
‘আমি তো ফোর্স করে আপনার জীবনে ঢুকে পড়েছি। তাহলে আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করছেন কেন? অসুস্থ হই হবো৷ তাতে আপনার কি?’
‘তাতে আমার কিছুই না! আবার অনেক কিছু। তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তোমার বাবা আমায় জেলে পাঠাবে।’
‘শুধু বাবার ভয়ে আমার কেয়ার করতে আসবেন না। বারণ করে দিলাম আপনাকে।’
বলে প্রহর আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না। ঝুপ করে কাঁথা বিছানো মেঝেতে শুয়ে পড়লো। অনুভবের চেহারায় ফুটে উঠলো গভীর বেদনার ছাপ। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। বুক চিঁড়ে বের হওয়া একের পর এক দীর্ঘশ্বাসগুলো বদ্ধ রুমের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেতে লাগলো। যে দীর্ঘশ্বাসের কোনো রঙ হয় না। কোনো প্রতিধ্বনির সৃষ্টি হয় না। বাতাসে মিশে শুধু কটু গন্ধ ছড়ায়। যার ফলে বাতাস ক্রমেই ভারী হয়ে উঠে। শ্বাস নিতে তখন কষ্ট হয়। গলায় কাঁটার সতো বিঁধে। মাথা নিচু করে সে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে। একটু নড়েচড়ে সে ডান কাত হলো। দেখলো চোখজোড়া বন্ধ। এতক্ষণ সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগলেও আর ভাবাভাবির মধ্যে গেল না অনুভব। আচমকা নিচু হয়ে প্রহরকে কোলে তুলে নিল সে।
আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেল প্রহর। কয়েক সেকেন্ড থমকে অনুভবের মুখ পানে চেয়ে রইলো। এটা কস্মিনকালেও সে ভাবেনি। হঠাৎ সংবিৎ ফিরতে সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছোটাছুটি শুরু করলো। হাত পা নাড়তে অনুভব আরো শক্ত করে তাকে চেপে ধরলো। মুহূর্তে প্রহরের ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে গেল। সুবোধ বালিকার মতো স্থির হয়ে এলো সে। বুকের গহীনে পূর্বাভাস বিহীন ঝড়ের সৃষ্টি হলো৷ যে ঝড় মোকাবেলা করার শক্তি তার নেই। অনুভবের গভীর স্পর্শে এই বিধ্বংস নৈঃশব্দ্য ও ভয়ংকর নির্জনতায় চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
দু হাতের মাঝে প্রহরকে স্থির দেখে অনুভব হাঁটা ধরলো।একে অপরের শ্বাস-প্রশ্বাস, বুকের ধড়ফড়ানি, দু একটা মশার গুনগুন শব্দ আর নিশাচরের ডাকের ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অনুভব বিছানায় গিয়ে প্রহরকে শুইয়ে দিল। প্রহর আর বিপত্তির সৃষ্টি করলো না। তার কেমন যেন লাগছে। নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। ভালোবাসার অদ্ভুত জোয়ারে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে যেন। তলিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশের অতল কূপে। তার মন-প্রাণ চাইছে অনুভব আরো কাছে আসুক৷ তাকে চিরদিনের জন্য বাহুডোরে আঁকড়ে ধরুক।
‘আর কোনো নাটক করবে না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।’
এবারে অনুভবের কড়া কন্ঠ প্রহরের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারলো না। এই যে মানুষটা তাকে নিজে থেকে কোলে তুলে নিয়েছিল, এতেই সে দারুণ খুশি৷ অন্তত এক সপ্তাহ সে অনুভবের সব অবহেলা সহ্য করে নিতে পারবে। সে মিহি সুরে বলল,
‘আপনি কোথায় ঘুমাবেন?’
‘তোমার বুকের উপর। এটা শুনতে চাও?’
লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল প্রহর। ছি! সহসা আর কিছু বলতে পারলো না। অনুভব সরে এসে বলল,
‘আমি মেঝেতে শুয়ে পড়বো। সমস্যা হবে না!’
প্রহর উত্তর দিল না। অনুভব লাইট বন্ধ করতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে রুম ঢেকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রহর মৃদু স্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,
‘লাইট বন্ধ করবেন না!’
অনুভব অাবার লাইট জ্বালাল। প্রহরের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি মাখা কন্ঠে শুধালো,
‘কেন?’
‘আমি অন্ধকার ভয় পাই।’
‘মানে? আমি কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরে দেখলাম তুমি রুম অন্ধকার করে বসে আছো। তখন ভয় পাওনি?’
‘আসলে আমি অন্ধকার ভয় পাই না। অন্ধকারে আপনাকে ভয় পাই।’
‘হোয়াট?’
প্রহর আর উত্তর দিল না। মুখ লুকিয়ে ফেলল। অনুভব প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে দেয়ালের পাশ থেকে সরে এলো। পাতলা গামছা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। সে যেতে প্রহর এক লাফে বিছানায় উঠে বসলো। সে চাইছে রুমে আলো জ্বলুক। আলোতে লুকিয়ে ঝুঁকিয়ে অনুভবের মুখটা দেখতে পাবে। ঠিকমতো তো দেখা হয়নি মানুষটাকে। একটু তাকালেই শুধু ধমকায়। আজ রাতে সে মন ভরে দেখবে।
ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে প্রহর দ্রুত শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে মরার মতো পড়ে রইলো। অনুভব যাতে টের না পায় সে জেগে রয়েছে। অনুভব হাত মুখ মুছে শক্ত মেঝেতে শুয়ে পড়লো। বালিশে মাথা রাখার পর এক পলক প্রহরের দিকে তাকালো। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। সে-ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না। আলোর তীব্রতার কাছে হার মেনে উঠে পড়লো৷ আধ ভেজা গামছাটা টেনে নিল হাতে৷ চোখের উপর সেটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। এবারে কাজ হলো। শীতল স্পর্শে চোখের পাতা দ্রুত ভারী হয়ে এলো। ডান কাত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
____________
শেষরাতের দিকে অনুভবের ঘুম পাতলা হয়ে এলো। বাম কাত ঘুরতে নিতে টিশার্টে টান পড়লো৷ ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল তার। মনের ভুল ভেবে আবার কাত ঘুরতে নিল। পূর্বের ন্যায় টান পড়লো। এবার জোরপূর্বক চোখ খুলল সে। ঘুম জড়ানো চোখে চেয়ে দেখলো তার পেটের কাছের টিশার্ট কেউ আঁকড়ে ধরে আছে। মুহূর্তে ঘুম উবে গেল। ভালো মতো তাকিয়ে দেখল প্রহর তার কাছ ঘেঁষে শুয়ে আছে।
(চলবে)
ছোট করে হলেও এখন থেকে ইনশাআল্লাহ নিয়মিত দিবো।