অনুভবের প্রহর পর্ব-১১

0
1701

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১১

অনুভব ঘুম জড়ানো চোখে দেখলো তার পেটের কাছের টিশার্ট কেউ আঁকড়ে ধরে আছে। মুহূর্তে ঘুম উবে গেল তার। ভালো মতো তাকিয়ে দেখলো প্রহর তার কাছ ঘেঁষে শুয়ে আছে। শিউরে উঠলো সে। বিস্ফারিত চোখে প্রহরের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। একটা স্বপ্নের স্মৃতির মতো মনে হলো সবটা। ঘুমের মধ্যে প্রহর নড়ে উঠতে অনুভবের স্বপ্নে ভাটা পড়লো। বুঝতে পারলো এটা স্বপ্ন নয়, প্রহর সত্যি সত্যি তার পাশে শুয়ে আছে।

চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল তার। ঠাওর করার চেষ্টা করলো কে কার কাছে এসেছে। সে প্রহরের কাছে না-কি প্রহর তার কাছে? মাথাটা সামান্য উঁচু করে চারপাশে ঘুরালো৷ দেখতে পেল সে মেঝেতে শুয়ে আছে। ধপ করে মাথাটা বালিশে এলিয়ে দিল। সে প্রহরের বিছানায় যায়নি। প্রহরই বালিশসহ তার বিছানায় চলে এসেছে। বিষয়টা আবিষ্কার করে তার রেগে যাওয়ার কথা। ধাক্কা দিয়ে প্রহরকে পাশ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু কেন জানি সে কাজটা করতে পারলো না। রাগতে পারলো না মেয়েটির উপর। ডান হাতটা মাথার নিচে দিয়ে সে প্রহরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো৷ এত কাছে থেকে মেয়েটিকে কখনো তার দেখা হয়নি। শুধু কাছে থেকে দেখা হয়নি ব্যাপারটা তা নয়। সে প্রহরের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। মেয়েটির মুখচ্ছবি কেমন তা বিশদ ভাবে বলতে পারবে না। সেকেন্ডের কাঁটা ঘর পরিবর্তন করতে কতটা সময় নেয়? সেই সময় টুকুর বেশি সে তাকিয়ে থাকেনি। আজ প্রহরের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।

বাল্বের শুভ্র আলোর সবটা প্রহরের মুখে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সেই আলোয় তার নাকে জমা তেল চিকচিক করছে। সামনের ছোট করে কাটা চুলগুলোতে সম্পূর্ণ কপাল ঢেকে আছে। অনুভব বাম হাতটা বাড়িয়ে দিল। শাহাদাত আঙুলের ডগা দিয়ে হালকা করে কপাল স্পর্শ করলো। কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিল। প্রহরের গা থেকে তীব্র একটা গন্ধ আসছে। বিদেশি ব্রান্ডের কড়া পারফিউমের গন্ধ। এই গন্ধটা সে প্রহর আশপাশে থাকলে তবেই পায়। যেই গন্ধ মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায় না, আরো তীব্র ভাবে অনুভূতির নৈরাজ্যে হারিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

ঘুমের মধ্যে প্রহর ঠোঁট কামড়ে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব বুকের ভেতর ধাক্কা খেল। এই মেয়েটা সবসময় তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়। সে চোখ সরিয়ে নিল। এখনি উঠে পড়া দরকার। সাবধানে প্রহরের হাতের ভাঁজে থাকা টিশার্টের অংশ ছাড়িয়ে নিল। একটু পিছিয়ে এসে উঠে পড়লো।

ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হলো সে। ঘড়িতে সময় দেখলো। ভোরের আলো ফুটতে বেশি সময় বাকি নেই৷ এখন আর ঘুমানোর প্রশ্ন উঠে না। মেঝে থেকে একটা বালিশ উঠিয়ে বিছানায় রাখলো। প্রহরকে ডাকতে নিতে থেমে গেল। প্রহরের এখন বিছানায় ঘুমানো উচিত। হুট করে মা ঘরে ঢুকলে মেঝেতে বিছানা দেখে দুঃশ্চিন্তা করবে। সে চাইছে না তার মা কোনো ভাবে ছিঁটেফোঁটা দুঃখ পাক।

প্রহর গভীর ঘুমে। তার নিঃশ্বাস ভারী। ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিতে চাইলো অনুভব। তাই কোনো ঝামেলা না করে প্রহরকে কোলে তুলে নিল। নিঃশব্দে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেঝে থেকে কাঁথা তুলে গায়ে জড়িয়ে দিল। আপাতত তার কাজ শেষ।

টেবিলের সাথের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো সে। চোরা চোখ দুটো ঘুরেফিরে প্রহরের উপর গিয়ে নিবদ্ধ হতে চাইলো। ঘরজুড়ে কেমন মেয়েলি একটা গন্ধ। বুকের ভেতরটা অজানা অনুভূতি আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ঘরময় হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো। চোখের সামনে প্রহরের ঘুমন্ত মুখটা বার বার ভেসে উঠছে। সে আর সহ্য করতে পারলো না। রুমের দরজা খুলে সোজা বাইরে বের হয়ে গেল।

___________

নামায শেষ করে রুমের বাইরে বের হলেন ফাতেমা বেগম। অনুভবের রুমের দিকে উঁকি দিলেন। দরজা ভেড়ানো। রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। কাল রাতে অনুভবের জন্য ভাত বেড়ে ঢেকে রেখেছিলেন। ঢাকনা উঁচু করে দেখলেন ভাত খায়নি।

কাল রাতে দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি। অনুভব ভেতরে ঢুকে তাকে অপেক্ষা করতে দিল না৷ হাত-মুখ ধুয়ে সে খেয়ে নিবে এই বলে ঘুমুতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন আবিষ্কার করলো ছেলেটা রাতে না খেয়ে ছিল। তিনি ঝটপট রান্না শুরু করে দিলেন। সকাল সকাল রান্না করলে খেতে পারবে। দ্রুত পাতিলে করে চুলায় গরম পানি বসিয়ে দিলেন।

‘মা!’

মেয়েলি সুরের ডাকে পেছন ফিরলেন তিনি। দেখলেন প্রহর এগিয়ে আসছে। কি সুন্দর স্নিগ্ধ মেয়েটা। প্রকৃতির মতো ঝকঝকে একেবারে। মেয়েটির মুখে মা ডাক শুনে তাঁর মন ভরে উঠলো। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছিলেন তিনি। সবসময় একটা মেয়ের অভাববোধ করতেন। আজ ভোরবেলা প্রথমবারের মতো মনে হলো পরম করুণাময় তার ইচ্ছে পূরণ করে দিয়েছেন। তিনি হাসিমুখে বললেন,

‘বলো মা।’

প্রহর ভেতরে ঢুকল। কপালের কাছের চুলগুলো কানের পাশে গুঁজলো। ঠোঁট জুড়ে উপচে পরা হাসি। তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না সে প্রিয়তম মানুষটার বাসায় এক রাত কাটালো। ঘুম ভাঙতে শ্বাশুড়ি মায়ের মিষ্টি হাসি দেখতে পেল। সে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘কি রান্না করবেন এখন?’

‘রুটি আর ডাল রান্না করি৷ অথবা সবজি।’

‘আমি রুটি বেলতে পারি। বানাব?’

‘সে কি! না। তোমায় করতে হবে না। আমি নিজেই করে নিবো। কয়েকটা মাত্র রুটি বানাতে হবে।’

‘না। আমিই করবো মা। আপনি ময়দা মেখে দিন।’

প্রহরের জিদের কাছে হার মানলেন ফাতেমা বেগম। পাতিলের পানি টগবগ করে ফুটছে। তিনি ময়দার মধ্যে গরম পানি দিয়ে মেখে নিলেন। ময়দা মাখার এক ফাঁকে জিগ্যেস করলেন,

‘অনুভব ঘুম থেকে উঠেনি?’

‘হ্যাঁ, উঠেছে তো। আমি ঘুম থেকে উঠার পর রুমে দেখিনি।’

‘বাইরে হাঁটতে বের হয়েছে বোধ হয়।’

____________

‘আপনি ভার্সিটি যাবেন কিন্তু বই-পুস্তক কিছু নিবেন না?’

‘না নিবো না। আমার বিদ্যাসাগর হওয়ার ইচ্ছে নেই।’

‘বিদ্যাসাগর হওয়ার ইচ্ছে কেন থাকবে? আপনি তো আদুভাই হবেন। তা ফোর্থ ইয়ারে আর কত বছর থাকবেন?’

প্রহরের তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠ বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারলো না অনুভবকে। সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘যতদিন না কর্তৃপক্ষ অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিচ্ছে ততদিন আমিও ভার্সিটি ছাড়ছি না। অর্ধেক চাঁদ ছাড়া ভার্সিটি ত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না। ‘

‘আপনি এভাবে বাউণ্ডুলের মতো পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়ান। পরিবারে কর্মক্ষম তো কেউ নেই। সংসার চলে কিভাবে?’

উসখুস করতে করতে প্রহর প্রশ্নটা করেই ফেলল। সত্যি তার কৌতূহল হয়েছে বিষয়টা নিয়ে। অনুভবের বাবা নেই। অনুভবও কোনো কাজকর্ম করে না। তাহলে তাদের সংসার চলে কিভাবে? সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো। কিন্তু অনুভব প্রশ্নটা না শোনার ভান করে হেঁটে চলেছে। প্রহর আর বাড়াবাড়ি করলো না। বকাঝকা করবে হয়তো।

হাঁটতে হাঁটতে তারা গলির শেষ মাথায় পৌঁছাল। উদ্দেশ্য ভার্সিটি যাওয়া। অনুভব রিকশার জন্য রাস্তায় তাকিয়ে আছে। প্রহরের মুখে অমলিন হাসি। অনুভবের সাথে এক রিকশায় ভার্সিটি যাবে ভাবতেই তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।

‘রিকশা আসছে। এটাতে করে তুমি আগে ভার্সিটি যাও। আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি। না হলে সবাই সন্দেহ করতে পারে।’

‘মানে?’

‘মানে মানে করছো কেন? আমাদের বিয়েটা লুকিয়ে রাখতে হবে৷ ভুলেও কাউকে জানাবে না। তোমার পাটখড়ির মতো শুকনো বান্ধবীকেও না! কাউকে বলবে না। মনে থাকবে?’

প্রহরের মুখের হাসি কর্পূরের মতো উবে গেল। ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল সে। প্রবল দুঃখবোধে ছেয়ে গেল মনের আকাশ। সে ভেবেছিল অনুভবের সাথে একত্রে ভার্সিটি আসা যাওয়া করবে। মাঝে মাঝে নানা অজুহাতে হাত চেপে ধরবে৷ অন্যান্যদের মতো ভার্সিটির চিপায় চাপায় গল্পে মেতে থাকবে। কিন্তু এই ছেলে তো একের পর এক শর্ত জুড়ে দিল। সে প্রতিবাদ করার ফুরসত পেল না৷ রিকশা এসে সামনে দাঁড়ালো। অনুভব চোখ দিয়ে ইশারা করতে সে মুখ গোমড়া করে রিকশায় উঠে পড়লো।

___________

বৃষ্টির মৌসুম চলছে৷ যখন তখন বিনা নোটিশে আকাশ কাঁপিয়ে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়। চলমান রিকশা থেকে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো প্রহর। বিকালের বিমুগ্ধ আকাশ। তবে তার আকাশ পানে তাকিয়ে মনে হলো আজও বৃষ্টি হবে। যেন তেন বৃষ্টি নয়। যাকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি। মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। বৃষ্টি আর অনুভব! এই দুটো শব্দ যেন একে অপরের পরিপূরক। এই দুটো জিনিস একত্রে তাকে নেশা ধরিয়ে দেয়। অন্য রকম মাদকতায় ডুবিয়ে দেয় প্রতি মুহূর্ত।

তার ভাবনার মাঝে চলন্ত রিকশায় কেউ এক লাফে উঠে পড়লো। চমকে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো অনুভব ঘর্মাক্ত শরীরে তার পাশে বসে পড়েছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here