অনুভবের প্রহর পর্ব-১৬

0
1828

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____১৬

প্রহরের ভীত কন্ঠস্বর অনুভবের মন নরম করে দিল। অভেদ্য নিঃসঙ্গতার তল স্পর্শ করলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো সে। তারপর করুণা ঝেরে কপাল কুঁচকে বলল,

‘ঠিক আছে। ওই রুমে চলো তাহলে।’

প্রহরের পিছু পিছু অনুভব রুমে ঢুকলো। অভ্যাস বশত দরজা বন্ধ করতে নিয়ে মনে পড়লো বাসায় সে আর প্রহর বাদে কেউ নেই! আর দরজা বন্ধ করলো না। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে তার। এতগুলো দিন মা অন্তত পাশের রুমে ছিল। কিছুটা সাহস পেত। কিন্তু আজ কেমন অসহায় লাগছে নিজেকে। প্রহরের মতো ভয়ংকর দূর্যোগকে বরাবরের মতো মোকাবিলা করতে পারবে তো?

রোজকার মতো মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে নিল অনুভব। হাতের বালিশটা একপাশে রেখে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নত তার। অনুভবের কপাল কুঁচকে গেল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘আবার কি ফন্দি আঁটছো?’

‘কিছু না।’

প্রহরের ঝটপট উত্তর। অনুভব সন্তুষ্ট হতে পারলো না। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘কিছু তো একটা ভাবছো। কি ভাবছো?’

প্রহর কিছুক্ষণ নিরব রইলো। পরমুহূর্তে সব অভিমান ভুলে গেল। ইতস্তত করে বলল,

‘ভাবছি আর কতদিন আমরা আলাদা ঘুমাব? অনেক তো হলো। এবার কিন্তু আমাদের একসাথে ঘুমানো উচিত। কি বলেন?’

অনুভব চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রহরের কথা কানে তুলল না। না শোনার ভান করে শুয়ে পড়লো। তার প্রশ্ন করাই ভুল হয়েছে! প্রহর এমন সব উত্তর দিবে তা জানা কথা। তবুও প্রহরের মুখ থেকে শোনার পর তার বুকের ভেতর কেমন অস্থিরতা ভর করলো। হৃদপিণ্ডের ভেতর কিছু একটা উলোট পালোট হতে থাকলো। সে দ্রুত দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করলো।

প্রহর কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। অনুভবের উত্তর না পেয়ে চোখ তুলে তাকালো। অনুভব শুয়ে পড়েছে। দেখে কপাল কুঁচকে গেল। কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘আপনি শুয়ে পড়লেন কেন?’

অনুভব উত্তর দিল না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। প্রহর কিছু সময় ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর সরে এসে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। গোল্লায় যাক অনুভব! সেমিস্টার ফাইনাল নিকটবর্তী হচ্ছে। অথচ পড়াশোনার নাজেহাল দশা। এখন একটু মনোযোগ দিয়ে পড়া দরকার।

রীতিমতো আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ থেকে বই, খাতা বের করলো সে। খাতা খুলতে জ্বলজ্বল করে অনুভব লেখাটা ভেসে উঠলো। এই মানুষটার জন্য সে কতটা ডেসপারেট ভাবতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। কত রাত শুধু পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা একটা নাম লিখে গেছে। মুচকি হেসে অনুভবের দিকে তাকালো সে। অনুভব তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে। অনুভবের চওড়া পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রহরের শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো।

কিছু সময় কেটে গেছে। অনুভবের চোখ দুটোতে তন্দ্রার ভাব এসেছিল। শরীরের অবসাদের ছায়া সরে গিয়ে স্রেফ একটা স্থবিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। আচমকা কর্ণকূহরে জোরালো শব্দ ভেসে এলো। মেয়েলি সুরের চিৎকারের শব্দ। কিছুক্ষণ কান পেতে ঠাওর করার চেষ্টা করলো। চিৎকারের শব্দ হঠাৎ হাউমাউ কান্নায় পরিণত হলো। ধপ করে চোখ খুলল সে। শব্দটা জানালার ওপাশের বাড়ি থেকে আসছে। এত রাতে কান্না করছে কেন? কোনো বিপদ হলো না তো? একলাফে উঠে বসলো সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকাতে প্রহরকে দেখতে পেল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে প্রহর। মেয়েটার সতর্ক দৃষ্টি তার উপরই ন্যস্ত। টেবিলে খুলে রাখা বইয়ের পাতায় মনোযোগ নেই। হঠাৎ প্রহর নড়েচড়ে উঠলো৷ বিচলিত কন্ঠে শুধাল,

‘কে কান্না করছে?’

‘বুঝতে পারছি না। দেখে আসি। হয়তো কোনো বিপদে পড়েছে।’

তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অনুভব। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,

‘দরজা বন্ধ করে থাকো। আমি একটু বাহির থেকে আসছি।’

প্রহরের ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। অনুভব আর অপেক্ষা করলো না। দরজার দিকে পা বাড়াল। ক্ষীপ্র হস্তে দরজায় হাত রাখতে টিশার্টে টান অনুভব করলো। শরীর বাঁকিয়ে তাকাতে কপাল কুঁচকে গেল। চোখ দিয়ে ইশারা করে শুধাল,

‘সমস্যা কি?’

প্রহর আরো শক্ত হাতে অনুভবের টিশার্ট মুঠোয় পুড়লো। ভীত সুরে বলল,

‘আমি একা থাকতে পারবো না।’

‘একা থাকতে পারবে না মানে? কেন পারবে না?’

‘ভয় পাই!’

ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা খুবই নিচুস্বরে উচ্চারণ করলো প্রহর। অনুভব টিশার্ট ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। প্রহরের ভীত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল,

‘ভয় পাবে কেন তুমি? আশ্চর্য! রুমে লাইট জ্বালানো৷ এত আলোর মাঝে কেউ ভয় পায়?’

পাশের বাড়ি থেকে সম্মিলিত কান্নার শব্দ কানে প্রকট হলো। অনুভব আর সময় ব্যয় করলো না। দরজা ঠেলে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। তার সাথে সাথে প্রহরও এলো। সদর দরজার ছিটকিনি খুলতে ফের প্রহরের কন্ঠ কানে এলো।

‘আমিও আপনার সাথে যাব।’

অনুভব ঘুরে দাঁড়াল। বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘প্রহর সবসময় জিদ করবে না। বারণ করে দিলাম। তোমাকে আশপাশের কেউ চিনে না। দেখেনি! যত কম মানুষ দেখবে, তত ভালো।’

‘মাথা খারাপ আপনার অনুভব? সবসময় শুধু অন্যদের চিন্তা করেন কেন? কে কি ভাবলো! কে কি দেখলো! কে কি বললো ইত্যাদি! আমি বলছি না যে আমি একা থাকতে পারবো না?’

প্রহরের উঁচু গলার সুরে ঘাবড়ে গেল অনুভব। শুকনো ঢোক গিলল। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘মাথায় ভালো মতো ওড়না পেঁচিয়ে নাও!পেছন পেছন আসো।’

দরজায় বাহির থেকে তালা ঝুলিয়ে দিল অনুভব। অন্ধকার গলি। সন্ধ্যার দিকে আলো জ্বালানো থাকে। রাত গভীর হলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করতে চাইলো সে। কিন্তু তার আগেই আশপাশের দু একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। কান্নার শব্দে সবার হয়তো ঘুম ভেঙে গেছে। ইতোমধ্যে আশপাশ থেকে আলো এসে গলির অন্ধকার কিছুটা দূর করেছে। সে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল।

দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে গেল অনুভব। এ বাড়ির বয়স্কা মহিলাটা মারা গেছে। সংবাদটা তার কলিজায় গিয়ে আঘাত হানলো। কেমন ধাক্কার মতো খেল ভেতরে। এই এলাকায় আসার পর থেকে মানুষটাকে চিনে সে। প্রতিদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে দেখতো গলিতে বসে আছে। গতকাল বিকেলেও একবার দেখেছে। অথচ আজ মানুষটা নেই! ভেতরে কেমন একরাশ শূন্যতা এসে ভর করলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো গলির মাথায়। যে জায়গাটাতে বৃদ্ধা প্রায়ই বসে থাকতো। কি অদ্ভুত মানুষের জীবন!

আস্তে আস্তে এক-দুজন করে ভীড় জমে যাচ্ছে। আশপাশের জানালা খুলে অনেকে দেখার চেষ্টা করছে। অনুভব নড়ে উঠলো। প্রহরের হাত চেপে ধরে বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। আপাতত তার এখানে কোনো কাজ নেই। বৃদ্ধার ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি আছে। তারাই সব ব্যবস্থা করবে। তাছাড়া শহরে সবাই একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। প্রথমদিকে সে ভীষণ অবাক হয়ে যেতো। চারিদিকে কেমন স্বার্থপরতার ছাপ। একজন বিপদে পড়লে অন্যেরা বড়জোর জানালা খুলে দেখবে। এর বেশি কেউ কিচ্ছু করবে না। অথচ গ্রামে পুরো উল্টো চিত্র। কোনো বিয়ে বাড়িতে বা কেউ মারা গেলে পুরো গ্রামে হৈ চৈ পড়ে যায়। একেবারে অপরিচিত মানুষও মৃত মানুষটার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে। ব্যথিত হয়। কত তফাৎ!

রুমে ঢুকার পর অনুভবের খেয়াল হলো প্রহর এখনো তার পেটের কাছের টিশার্ট শক্ত হাতে চেপে ধরে আছে৷ অন্য সময় হলে সে রাগারাগি করতো। কিন্তু এই মুহূর্তে রাগতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।’

প্রহর টিশার্ট ছেড়ে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালো। রুমের আশপাশে শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তারপর বিছানায় এককোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসলো। তার শরীর কাঁপছে ধীরগতিতে। চোখের সামনে উল্টাপাল্টা চিত্র ভাসছে। এই একটা জায়গা ছোটবেলা থেকে ভীষণ ভীতু সে। মৃত মানুষ! মৃত মানুষ দেখলে বা কাছে কেউ মারা গেছে শুনলে কোথা থেকে ভয় এসে জেঁকে ধরে। এতটা ভয় যে রাতেরবেলা ওয়াশরুমে পর্যন্ত একা যেতে পারে না। সে জানে এই ভয়ের কোনো ভিত্তি নেই। তবুও নিজেকে শান্ত করতে পারে না!

আজও শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা ভয় বয়ে চলেছে। পাশের বাড়ি থেকে গুনগুন করে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। হুটহাট আবার কান্নার শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বুকের ভেতর অজানা ভয় এসে চেপে বসছে তার। মন ঘুরানোর জন্য নজর অনুভবের উপর দিয়ে রেখেছে সে। অনুভব কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করলো। হঠাৎ গামছা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রুম খালি হতে দম বন্ধ আসার উপক্রম হলো প্রহরের। কাঁপা কাঁপা হাতে টেবিলের উপরের খোলা বইটা বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভুলেও এদিক ওদিক তাকালো না। বার বার মনে হতে থাকলো, পেছনে কেউ বুঝি দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুণি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে!

বইপত্র গুছিয়ে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালো। অনুভব বের হচ্ছে না কেন? শূন্য রুমে আর অপেক্ষা করতে পারলো না। দৌঁড়ে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় ধুপধাপ শব্দ করলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনুভব দরজা খুললো। ডান হাতে মুখের পানি মুছলো। জিগ্যেস করলো,

‘কি হয়েছে?’

‘আমি ওয়াশরুমে যাব!’

প্রহর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো। অনুভব ভেতর থেকে বের হয়ে এলো৷ তাকে আলনার দিকে যেতে দেখে প্রহর ভেতরে ঢুকলো। দরজা খোলা রেখে ঝটপট চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল শুধু। তার বের হতে হতে দেখলো অনুভব ফ্লোরের বিছানায় বসে পড়েছে৷ শোয়ার বন্দোবস্ত করছে। প্রহরের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। একা ঘুমানো তার পক্ষে অসম্ভব। ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে তাকালো সে। ঠিক জানালার ওপাশের বাড়িতে একজন মৃত ব্যক্তি রয়েছে। সে এপাশে একা ঘুমাবে কি করে? কি করে?

রুমের মাঝামাঝি প্রহরকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুভব কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো। একটুপর প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? কোনো সমস্যা?’

‘আমি একা ঘুমাতে পারবো না।’

‘হুঁ?’

প্রহর এদিকে এলো। শরীর এখনো কাঁপছে। তার প্রাণবন্ত ঘনসন্নিবদ্ধ চোখজোড়ায় অজানা ভয় ভর করেছে। সেই ভয় পাওয়া দৃষ্টি দেখে অনুভবের মন নরম হয়ে এলো। আশ্যস্তের সুরে বলল,

‘কি হয়েছে প্রহর? ভয় পাচ্ছো?’

প্রহর কিছু বলার চেষ্টা করলো। সুবিধা করতে পারলো না। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। ঝাপসা দৃষ্টি লুকানোর জন্য অন্যদিকে তাকালো। অনুভবের আর বুঝতে বাকি রইলো না। ফ্লোর থেকে বালিশটা উঠিয়ে নিয়ে বিছানায় রাখলো। কোনো তর্কাতর্কির মধ্যে গেল না। নিঃশব্দে বিছানার এককোণে শুয়ে পড়লো। একটুপর কাঁথা গায়ে টেনে বলল,

‘পাশে এসে শুয়ে পড়ো। সারারাত একফোঁটা স্পর্শ যেন না লাগে। একটু আধটু স্পর্শ করবে তো ভোরবেলা বাপের বাড়ি রেখে আসবো। চিরদিনের জন্য!’

(চলবে)

আসসালামু আলাইকুম। ছোট হয়ে গেছে। অনেকদিন পর লেখা এজন্য! মোটামুটি সবাই রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। পেইজের রিচ কম! ইনশাআল্লাহ রেগুলার পাবেন এখন। শুভরাত্রি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here