#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___০৮
‘স্যরি! ভেরি স্যরি স্বামী।’
‘স্বামী’ শব্দটা অনুভবের বুকে গিয়ে কাঁটার মতো খচ করে বিঁধলো। কড়া কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। এখন আর বলে কি হবে! এমনিতে তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। মাকে কথাটা কি করে বলবে? কি করে তাকে জানাবে যে সে বিয়ে করেছে? মা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে বুঝতে পারছে না। এতবড় সিদ্ধান্ত মাকে জানিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। অথচ সে মাকে বার বার কল করতে নিয়ে পিছু হটে এসেছে।
অনুভবের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহরের চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না?’
‘কি বলবো? তোমাকে থাপ্পড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।’
‘তো দিন না। আমি কি একবার না করেছি? আমার গালের উপর এখন সম্পূর্ণ অধিকার আপনার মি. পূর্বিতা মাহমুদ প্রহর।’
অনুভব চমকে গেল। কিছুক্ষণ পর তোতলানো সুরে বলল,
‘হোয়াট ডিড ইউ সে? মি. পূর্বিতা মাহমুদ প্রহর? কাকে ডাকছো এসব বলে?’
‘কাকে আবার? প্রহরের একমাত্র স্বামীকে। বিয়ের পর বরের নামের আগে মিসেস লাগিয়ে যেমন স্ত্রীর নাম হয়, তেমনি স্ত্রীর নামের পূর্বে মি. লাগালেই তো স্বামীর নাম হওয়ার কথা। আজ থেকে আপনাকে আমি বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে মি. পূর্বিতা মাহমুদ প্রহর বলে ডাকবো। আমার মি. প্রহর।’
‘স্টপ দিস ননসেন্স! যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছো? গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না, তবুও কথার ফুলঝুরি শেষ হয় না?’
‘আহা! রেগে যাচ্ছেন কেন? বিয়েটা আপনি করেননি। আমি করেছি। মানে এখানে আমি বর আপনি কনে। বাকি জীবনটা আমি বরের ভূমিকা পালন করবো। আর আপনি বউ! মানে আমি বর, আপনি বউ। বর-বউ!’
‘শাট আপ!’
অনুভব এক লাফে উঠে দাঁড়ালো। তার কন্ঠ একটু বেশিই উঁচু ছিল বোধ হয়৷ কেবিনের বাইরে থেকে ইরতাজ উদ্দিনের কন্ঠ ভেসে এলো। তিনি বলছেন,
‘বাবা, চেঁচামেচি করছো কার সাথে?’
অনুভব শ্বাস ফেলল। জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,
‘প্রহর খেতে চাচ্ছে না। সেজন্য একটু ধমক দিয়েছি। জটিল কিছু না। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।’
‘অহ। অসুস্থ মানুষ। একটু টলারেট করো বাবা। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’
কেবিনের ওপাশের শব্দ মিলিয়ে গেল। অনুভব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রহরের দিকে বড় বড় চোখে তাকালো। বিনিময়ে প্রহর তৃপ্তির হাসি হাসলো। চোখ সরিয়ে অনুভব হেঁটে কেবিনের জানালার কাছে গেল। জানালার পর্দা টেনে সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার হলুদ আলো চোখে পড়লো। সূর্য ডুব দিয়েছে অনেক আগে। শহরে অন্ধকার নেমেছে। এই অন্ধকারের বিপরীতে লক্ষ্য লক্ষ্য বাল্ব, লাইট জ্বলে উঠেছে। শুধু তার ভেতরে বেড়ে উঠা অন্ধকারের কোনো প্রতিষেধক নেই। সেই অন্ধকার দূর করার মতো কোনো আলো নেই পৃথিবীতে। সেখানে ঘোর অমানিশা, গাঢ় অন্ধকার। যে অন্ধকার দেখে নিজের আত্মাও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে। ভয় পায়!
‘একটু এদিকে আসুন তো।’
প্রহরের জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে পেছন ঘুরলো অনুভব। এগিয়ে এসে বলল,
‘ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছে। চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকো। যেটুকু খাদ্য পাকস্থলীতে প্রবেশ করেছে, সেটুকু বিশ্লেষিত হয়ে শক্তি উৎপাদন করতে দাও। তারপর না হয় আবার কথা বলো।’
‘আপনি এমন শক্ত গলায় কথা বলছেন কেন? আজ আমাদের ফার্স্ট নাইট। মানে বাসর রাত।’
অনুভব ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলো। বাহিরে প্রকাশ করলো না। ভ্রু জোড়া কুঁচকে কপালের খাদ গভীর করলো। ধমকে বলল,
‘থ্রেড দিয়ে বিয়ে করেছ। আবার বাসর কিসের?’
‘কাছে আসুন। বুঝিয়ে দিচ্ছি।’
অনুভব ছিটকে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আশপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ নেই। এই ঠোঁটকাটা মেয়ে তার মান সম্মানের দফারফা করে দিবে। মনোযোগ ঘুরাতে সে ফোন নাড়াচাড়া শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর টুল টেনে নিয়ে প্রহরের থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। ঘড়িতে সময় দেখলো। মায়ের নাম্বার ডায়াল করে ফোন দিল। ওপাশ থেকে ফোন উঠাতে সে নিচুস্বরে বলল,
‘মা, আমার ফিরতে একটু রাত হবে। চিন্তা কোরো না।’
বলে সে ফোন কেটে দিল। প্রহর সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘ফোন কাটলেন কেন? এদিকে দিন। আমিও মায়ের সাথে কথা বলবো।’
‘তোমার মা বাসায় খাবার আনতে গেছে। একটুপর এসে যাবে। তখন মন ভরে কথা বলো।’
‘আমি আপনার মা মানে শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বলবো।’
অনুভব চুপ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিল আর মুখ খুলবে না। যত আশকারা দিবে, প্রহর তত বকবক করতে থাকবে। সে চুপ থাকার পরিক্ষা দিক! আপাতক সময় দু হাতে ঢেলে সরানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। প্রহরের বাবা-মা ফিরলেই সে বাড়ি ফিরবে।
বাম হাতে চলমান স্যালাইনের দিকে তাকালো প্রহর। অর্ধেকের বেশি এখনো রয়েছে। শক্তি না পেলেও ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করছে সে। এই যে মানুষটা তার কত কাছে চলে এসেছে, কত কাছে বসে আছে। এতেই তার ভেতরটা পুলকে ভরে যাচ্ছে। মুচকি হাসলো সে। হাত দিয়ে ইশারা করে অনুভবকে কাছে ডাকলো। অনুভব কপাল কুঁচকে তাকাতে সে বলল,
‘কিচ্ছু করবো না। একটু কাছে আসুন তো। অসুস্থ মানুষকে ভয় পান আপনি?’
‘সমস্যা কি? ঘুমিয়ে পড়তে বলেছি না?’
‘এদিকে আসুন। একটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়বো। সত্যি বলছি।’
‘আমি কানে কম শুনি না। এখান থেকে স্পষ্ট শুনতে পাব।’
‘এদিকে এসে বসবেন কি না বলুন!’
প্রহরের কন্ঠের জোরের কাছে টিকতে পারলো না অনুভব। টুল টেনে প্রহরের কাছাকাছি এসে বসলো। মুখে তার অনীহার ছাপ স্পষ্ট। বিরক্তিতিতে কপাল কুঁচকে আছে। এসব বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারলো না প্রহরকে। সে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘এত ভালো কেন আমার বর?’
অনুভব রাগী চোখে তাকাতে সে হাসি বন্ধ করলো। পরমুহূর্তে ডান দিয়ে অনুভবের ডান হাতটা চেপে ধরলো। অনুভবের রাগের তোয়াক্কা না করে সে হাতটা নিজের গালে ছোঁয়াল। চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসলো।অনুভব বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,
‘হাত ছাড়ো!’
প্রহরের স্পর্শে অনুভবের বুকের ভেতর চিরস্থায়ী ঝড় শুরু হলো। হার্টের গতিবিধি বেড়ে গেল। সে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে প্রহর টেনে ধরে বলল,
‘আমি কিছুক্ষণ ঘুমাব। আমার প্রশান্তিতে ঘুমানোর জন্য আপনার একটুখানি স্পর্শ প্রয়োজন। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করবেন না। আমি ছাড়ছি না। বেশি টানাটানি করলে আমার বাম হাতের সুঁচে রক্ত উঠে যাবে। বুঝতেই পারছেন।’
অনুভবের হাত থেমে গেল। আর ছাড়ানোর চেষ্টায় গেল না। প্রহর হাতটা আরো শক্ত করে আকঁড়ে ধরলো। মোলায়েম স্বরে বলল,
‘ভালোবাসি স্বামী।’
বুকের গহীনের দীর্ঘশ্বাস গুলো ধামাচাপা দিল অনুভব। বাইরে বের করে প্রহরের শ্বাস নেওয়া অক্সিজেন টুকু সে ধ্বংস করতে চায় না। তার জীবনটা এত সাদা কালো কেন? আর একটু রঙিন হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? প্রহরের বন্ধ চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল সে। মনে মনে বলল,
‘প্রতিদিন কিছু ইচ্ছেকে পুড়িয়ে মারি
প্রতিদিন কিছু ইচ্ছেকে পাঠাই নির্বাসনে
ভালবাসা কি ভীষণ প্রতারক
হৃদয় ভেঙেছে যার সেই জানে ।’
______রুদ্র গোস্বামী
যদি একে অপরের মন পড়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা সবাইকে দিতো, তাহলে প্রহর ঠিক বুঝতে পারতো অনুভবের বুকের ভেতর সে অন্য রকমে ঝড় তুলে দিয়েছে। যে ঝড়ে তার বুকের পাড় ভেঙে চূড়ে যাচ্ছে। অজানা অনুভূতিতে সে ভেসে চলেছে।
______________
তিনদিন পর অনুভবের বাড়ির সামনের গলিতে গাড়ি থামলো। প্রহর তার মায়ের সাথে জিনিসপত্র নিয়ে অনুভবের বাড়ির দিকে এগোল। গতকাল হসপিটাল থেকে রিলিজ নিয়েছে সে। শরীর সামান্য দূর্বল থাকলেও মোটামুটি সুস্থ। কাল সকালবেলা সে অনুভবকে কিছুক্ষণের জন্য হসপিটালে দেখেছিল। আর দেখা হয়নি। সেজন্য রাতের বেলা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে অনুভবের বাড়িতে সে থাকবে। অনুভব আর ফাঁকি দিতে পারবে না। পড়াশোনা সব সে অনুভবের বাড়িতে থেকে করবে। বাবা-মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে সে কাপড়চোপড় নিয়ে রওনা করেছে।
দরজা খুলে ফাতেমা খুশিমনে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। হাত ধরে প্রহরকে ঘরে তুলে নিল। অনুভবের বিয়ের কথা শুনে প্রথমে তিনি ঘাবড়ে গেলেও পরমুহূর্তে ভুল ভেঙে গেছে। একটা মেয়ে তার ছেলেকে এতটা ভালোবাসে, এটা ভেবে খুশি হয়েছেন তিনি৷ এখন তিনি কিছুটা চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন। মনের খচখচানিটা দূর হবে। তার সন্তানের খেয়াল রাখার জন্য অন্তত অন্য কেউ আছে এ ধরায়।
কিছুক্ষণ কথা বলে মাকে রেখে প্রহর অনুভবের রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকতে সর্বপ্রথম তার বিছানার দিকে নজর গেল। সেই ছোট্ট স্টিলের খাটটা সরানো হয়নি। এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু? এখানে তো বড়জোড় একজন আরামসে শোয়া যায়। তারা দুজন এত ছোট্ট বিছানায় ঘুমাবে কি করে? চিন্তাগুলো তার মস্তিষ্কে দ্রুতবেগে ছুটোছুটি শুরু করলো।
‘প্রহর, অনুভব এসেছে।’
বাইরে থেকে মায়ের কন্ঠ কানে এলো প্রহরের।
(চলবে)
ছোট হয়ে গেছে। নেক্সট পার্ট বড় করে দিবো ইনশাআল্লাহ। ভালোমতো রি-চেইক করা হয়নি।🧡