অনুভবের প্রহর পর্ব_২৮

0
330

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____২৮

মোতালেব মিয়া হাতের পেয়ারায় বড়সড় কামড় দিলেন। পেয়ারা টা ভারী মিষ্টি। চিনির চেয়েও অধিক মিষ্টি। খেতে ভালো লাগছে। পেয়ারার মিষ্টি মিষ্টি ভাবটা দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মন খারাপ ভাব কেটে গেছে। সম্পূর্ণ কাটেনি। তবে অনেকখানি কমেছে।

তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের একটা ওয়ার্ডে অবস্থান করছেন। তিনি বাদে আরো আটজন আছেন। সবাই অসুস্থ। এদের মধ্যে একমাত্র তিনিই একটু সুস্থ। তার পাশের বিছানায় কিশোর বয়সের একটা ছেলে। ডান পা টা ব্যান্ডেজ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে৷ হয়তো ভেঙে গেছে। ছেলেটা তার ছোট ছেলের বয়সী। তিনি মনে মনে বললেন, আহারে!

ছেলেটার হাতে একটা বই। পোশাক-আশাক পরিষ্কার। দেখে বড় ঘরের মনে হচ্ছে। তিনি হঠাৎ আন্তরিক গলায় জিগ্যেস করলেন,

‘বাপজান একটা পেয়ারা খাইবা?’

ছেলেটা এক পলক তাকালো৷ কিন্তু উত্তর দিল না কোনো। পরক্ষণে ফের বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মোতালেব মিয়া বড় অসহায় বোধ করলেন। এই যুগটাই এমন। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মুরুব্বিদের সম্মান দেয় না। অথচ তিনি যখন এর বয়সের ছিলেন তখন কত বিনয়ী ছিলেন। স্কুলের হেড টিচার পর্যন্ত তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো।

‘চাচা, আপনার শরীর কেমন?’

মোতালেব মিয়া ডানপাশে তাকালেন। নাজমুল ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছে। এই ছেলেটার স্বভাব চরিত্র অত্যন্ত ভদ্র। যেমন বিনয়ী, তেমন শান্তশিষ্ট।

‘শরীর ভালো। কপালে আর বাম হাতের আঙুলে এট্টু ব্যথা শুধু।’

নাজমুল একটা টুল টেনে বসে পড়লো। হাতের ফলের ব্যাগটা বিছানার একপাশে নামিয়ে রাখলো। মোতালেব মিয়ার কন্ঠের জোরের মতো শরীর ততটা ভালো মনে হচ্ছে না। বাম চোখ ফুলে গেছে। কপালে ব্যান্ডেজ, বাম হাতের চামড়া ছিঁড়ে গেছে অনেকখানি। গলার কাছে চামড়া লাল হয়ে আছে। তবে গুরুতর কিছু নয় বলে নাজমুল স্বস্তি পেল। শ্বাস ফেলে বললো,

‘এতবড় দূর্ঘটনা কি করে ঘটলো?’

‘আমার কোনো দোষ নাই, বুঝলা? সতেরো বছর বয়স থেকে গাড়ি চালাইতেছি। ফিরতি পথে ধীরে সুস্থে ড্রাইভ করে আসতেছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা দিল। সবই কপাল বুঝলা বাপজান। বড় সাহেবের গাড়ি চালাই কত বছর হইলো। ঢাকার এত ব্যস্ততার মধ্যেও ঝড়ের মতো গাড়ি চালাইছি৷ কিন্তু কোনো এক্সিডেন্ট হয় নাই। কিন্তু গতকাল কেমনে কি হইলো মাথায় ঢুকে না। বড়ই আচনক এই পৃথিবী। বুঝছো! আমার এলাকার এক চেয়ারম্যান। দিব্যি ভালো মানুষের মতো ঘুরে বেড়ায়। একদিন ভোরবেলা চা খাইতে গিয়া জিহ্বা পুড়ায় ফেলল। এটা কি আর বড় ব্যাপার! জিহ্বা পুড়ছে, ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু না! দুদিন যায়, তিনদিন যায়। জিহবা আর ঠিক হয় না। পরে কিছুদিন পর ডাক্তার বলে, পোড়ার জায়গাতে ক্যান্সার হইছে। এরপর কত চিকিৎসা, কত টাকা ঢালা। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো৷ কিছুতেই কিছু হইলো না৷ পরপারে চলে গেল।’

মোতালেব মিয়া থামলেন। নাজমুলকে নিশ্চুপ দেখে আবার বলা শুরু করলেন,

‘জীবনটা হইলো অঘকা। অর্থাৎ অদ্ভুত ঘটনার কারখানা। কখন কি হইবো, কি ঘটবো টের পাওয়া যায় না। প্রহর মার কপালে এতটুকু ছিল বইলাই পেছন থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা মারছে। তা না হইলে ধাক্কা মারার জন্য দুনিয়ায় কি গাড়ির অভাব পড়ছিল, কও? পড়ে নাই। কিন্তু ট্রাক আইসা আমাদের গাড়িটারেই ধাক্কা মারলো। তবে সময় মতো সাইড করছিলাম। তা না হইলে আরো বড় অঘটন ঘটতো।’

‘অঘটন যা ঘটার তা অলরেডি ঘটে গেছে।’

মোতালেব মিয়ার কথার ঝুড়ি শূন্যে মিলিয়ে গেল। তাকে বড় চিন্তিত দেখাল৷ জড়োসড়ো হয়ে জিগ্যেস করলো,

‘প্রহর মা কেমন আছে? ওই ছেলেটা? ওরা সুস্থ আছে, ভালো আছে। তাই না?’

নাজমুল উত্তর দিল না। উত্তর দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। প্রহর, অনুভব দুজনের কেউ-ই সুস্থ নয়। অনুভবের আঘাত ততটা প্রকট না হলেও কিডনির বিধ্বস্ত অবস্থা। আর প্রহরের আঘাতটা মুখসহ দেহের একপাশে লেগেছে। অবস্থা কেমন ডাক্তার কিছু বলছে না। দূর্ঘটনার স্থান ঢাকা থেকে বেশ দূরে। তৎক্ষনাৎ তাদের কাছের এক প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকাতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

‘আপনি বিশ্রাম নিন৷’

নাজমুল উঠে দাঁড়ালো। অপ্রকৃতস্থের মতো হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। মোতালেব মিয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। হাতের আধ খাওয়া পেয়ারাতে কামড় দিতে ভুলে গেল। পাশের বিছানার ছেলেটা হঠাৎ ঘুরে তাকালো। হাত বাড়িয়ে বললো,

‘আমায় একটা পেয়ারা দিন চাচা।’

_________

চোখ খুলতে সামনে ঝুঁকে থাকা উদ্বিগ্ন একটা মুখ দেখতে পেল অনুভব। মুখটা পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু নাম মনে পড়ছে না। কয়েক সেকেন্ডের বেশি চেয়ে থাকতে পারলো না।দ্রুত চোখ বুজলো অনুভব। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। ঢোক গিলল সে। নাকে কড়া ফিনাইলের গন্ধ এসে লাগছে। দ্রুত নাক কুঁচকালো!

‘অনুভব? চোখ খোল। কেমন লাগছে এখন?’

কন্ঠস্বরও পরিচিত। কিন্তু কার কন্ঠ ঠাওর করতে পারছে না অনুভব। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ শূন্য মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো তথ্য নেই। শরীর অনড়। বাম পায়ের বুড়ো আঙুল কিড়মিড় করছে। কিন্তু নাড়াতে গিয়ে পারলো না।

‘অনুভব? চিনতে পারছিস আমাকে? চোখ খোল তো।’

বাহুতে কেউ সামান্য ঝাঁকি দিল। অনুভব বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট স্বরে বললো,

‘নাজমুল? তুই কোথা থেকে আসলি?’

কপাল কুঁচকে গেছে অনুভবের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নাজমুলের দিকে। বার দুয়েক কপাল কুঁচকানো-প্রসারিত হলো। আচমকা সে চেঁচিয়ে বললো,

‘প্রহর? প্রহর কোথায়? নাজমুল, প্রহর কোথায়?’

ধড়ফড় করে উঠার চেষ্টা করলো সে। নাজমুল বাঁধা দিল। অনুভবকে চেপে ধরে বললো,

‘প্রহর ঠিক আছে অনুভব। তুই অসুস্থ! চুপচাপ থাক।’

‘আমি ঠিক আছি। ঠিক আছি! প্রহরকে দেখতে হবে।’

‘বললাম তো প্রহর ভালো আছে। সুস্থ আছে।’

অনুভব কিছু শুনলো না। বাঁধা মানলো না। বার বার উঠার চেষ্টা করলো। নড়চড়ের ফলে বাম হাতের সুঁচে রক্ত উঠে গেল। নাজমুল চেঁচিয়ে নার্সকে ডাকলো। অনুভবকে জাপটে ধরে বললো,

‘তোর নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখ অনুভব। তুই সুস্থ না। তোর কথা পেঁচিয়ে যাচ্ছে।’

‘প্রহরকে দেখতে হবে আমার। দেখতে হবে ও সুস্থ আছে কি না! আমি জ্ঞান হারাবার পূর্বে দেখেছি ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে নাজমুল। আমার শার্টে ওর রক্ত লেগে আছে। ওকে দেখতে হবে আমার।’

অনুভবের গলা নিস্তেজ হয়ে এলো। লড়াইয়ের শক্তি ফুরিয়ে এলো। নার্স এসে কড়া সিডাকটিভ পুশ করলো। আস্তে আস্তে দেহ নেতিয়ে এলো। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো। মাথাটা বালিশে রেখে গায়ে চাদর টেনে দিল নাজমুল। অনুভবের ভেজা চোখের কোণ মুছে দিল। আর দাঁড়ালো না। দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে এলো।

বুকের ভেতর জ্বলছে তার। সবকিছু অদ্ভুত ঠেকছে। এলোমেলো লাগছে। ঠিক কি করলে সব আগের অবস্থায় ফিরে আসবে জানা নেই।

ইমার্জেন্সি ইউনিটের সামনে ইরতাজ উদ্দিন চিন্তিত মুখে বসে আছে। চোখ মুখ ভয়ানক শুকনো। তার পাশে মিসেস রাবেয়া অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। তাকে সামলাচ্ছে প্রহরের ফুপি। দূর্ঘটনার খবর শুনে তিনি কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন। সিঁড়ির কাছে অফিসের কর্মস্থ অনেক লোক দাঁড়িয়ে। সবার মুখের কথা বন্ধ।

নাজমুল এগিয়ে গেল।

‘মোতালেবের শরীর কেমন?’

‘স্যার, উনি আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ। কপালে দুটো স্টিচ লেগেছে শুধু।’

ইরতাজ উদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চুপসানো স্বরে বললেন,

‘অনুভবের অবস্থা কেমন?’

‘সে খবর দেওয়ার জন্যই এসেছিলাম। জ্ঞান ফিরেছে। প্রহরকে দেখার জন্য পাগলামি করছিল। এজন্য ডাক্তার আবার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে।’

ইরতাজ উদ্দিন আর কিছু বললেন না। নাজমুল পাশ থেকে ইমার্জেন্সি কীট গায়ে চাপলো। তারপর আইসিইউ ইউনিটে ঢুকল।

বেড নাম্বার ১৬ এ প্রহর শুয়ে আছে। দুদিন হয়ে গেছে এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার ভেঙে চূড়ে কিছু না বললেও নাজমুলের প্রচন্ড ভয় লাগছে। ডাক্তার একের পর পরীক্ষা করে যাচ্ছে। বিছানার কাছে এগিয়ে গেল নাজমুল। প্রহরের মুখে মাস্ক লাগানো। কেমন টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। চোয়ালের এক পাশে সেলাই দেখা যাচ্ছে। গলার কাছে কি যেন পেঁচানো। নাজমুলের বুক কেঁপে উঠলো। এই মেয়েটা এত কষ্ট পাচ্ছে কেন? এত কষ্ট কি এর পাওয়ার কথা ছিল? কি অদ্ভুত দুনিয়া!

বিছানার আরো কাছাকাছি গেল নাজমুল। প্রহরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

‘অনুভবের জ্ঞান ফিরেছে প্রহর। ও একদম সুস্থ আছে। আপনিও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন প্লিজ।’

গলা ভিজে উঠলো নাজমুলের। এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে চলল।

_________

অনুভব আছে আধো ঘুমে, আধো জাগরণে। চিন্তা শক্তি হ্রাস পেয়েছে। সাথে বোধশক্তিও! কিন্তু ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়েছে। গায়ের গন্ধ শুঁকেই টের পাচ্ছে কখন ডাক্তার আসছে। কখন নার্স আসছে, যাচ্ছে। সে ঠোঁট নাড়ানোর চেষ্টা করলো। দেহজুড়ে কেমন অবসাদ।

‘আপনি এখন কেমন বোধ করছেন?’

‘কিছুই বোধ করছি না। প্রহরকে একটু ডেকে দিবেন?’

‘প্রহর কে?’

‘আমার স্ত্রী। আমাকে দেখতে আসেনি?’

‘হ্যাঁ, এসেছিল। দরজা থেকে দেখে চলে গেছে।’

‘ভেতরে আসেনি কেন?’

‘ডাক্তার অনুমতি দেননি। আপনি শরীরের ভেতর কোনো অস্বাভাবিকতা অনুভব করছেন?’

‘হুঁ। তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বমি বমি পাচ্ছে।’

‘রক্তে টক্সিকের মাত্রা বেড়ে গেছে। সেজন্য অস্বস্তি লাগছে। একটু পর ডায়ালাইসিস করা হবে। তখন সুস্থ বোধ করবেন।’

‘হুঁ।’

আর উত্তর এলো না। অনুভব আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here