রেস্টুরেন্ট ভর্তি লোকের সামনে নেহার গালে তাঁর হবু বর সজোরে থাপ্পড় মারলো। সঙ্গে সঙ্গেই ওর ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ ফুটে ওঠলো। নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল নেহার। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আবারও চড় পড়লো ওর ডান গালে। পরপর দুটো থাপ্পড় খেয়ে আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল নেহা আর তাঁর বোনেরা। ভয়ে কাঠ হয়ে গেল ওরা। কোন কারণে তাঁর হবু বর শাখাওয়াত এরকম করছে নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কে সেটার আন্দাজ করতে পারল না নেহা। রেস্টুরেন্টে পরিবার নিয়ে লাঞ্চ করতে আসা সবাই অদ্ভুত চোখে ওদের দেখে যাচ্ছে। কারো ঠোঁটের কোণে হাসি। যেন চড় মারার ঘটনাটায় তারা খুব বেশি মজা পেয়েছে। লজ্জায়, অপমানে গা শিরশির করে ওঠলো নেহার। দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক, কিন্তু ওর মনে হচ্ছে অতি শ্রীঘ্রই জ্ঞান হারাবে। পেছনের দিলে কিছুটা হেলে পড়তেই নেহাকে ধরে ফেলল ওর কাজিন রোজা। খুব সাবধানে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো সে নেহাকে। এতক্ষণের পুরো ঘটনাটার চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী ছিল রোজা। শাখাওয়াতের উগ্র ব্যবহারের কারণ খুঁজছিল সে। কিন্তু পরপর দু’বার নেহাকে থাপ্পড় খেয়ে নেতিয়ে পড়তে দেখে ওর শরীরের রক্ত যেন ছলকে ওঠলো। কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না ব্যাপারটা। খুব একটা কথা না বললেও এই পর্যায়ে এসে ও আর চুপ থাকতে পারল না। ফিহা’কে নেহার খেয়াল রাখতে বলে সে শাখাওয়াতের কাছ এসে দাঁড়ালো। ক্ষুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী সমস্যা আপনার? এরকম কেন করলেন আপুর সাথে?’ শাখাওয়াত গরম চোখে তাকালো ওর দিকে। পরক্ষণেই দৃষ্টি ঠান্ডা হয়ে এলো। ফিচেল হেসে বলল, ‘সমস্যা একটাই, আমি তোমার বোনকে বিয়ে করতে পারব না।’ রোজা চুপ করে কথাটা কর্ণগোচর করল। তারপর গলার স্বরটা উঁচুতে এনে বলল, ‘সেটা তো সরাসরি আপনার মা-বাবাকে জানিয়ে দিলেই পারতেন। রেস্টুরেন্টে ডেকে এনে সিনক্রিয়েট করার কী দরকার ছিল? আর সিনক্রিয়েট বলছি কেন? এটা তো অন্যায়, আপনি মহাঅন্যায় করেছেন আপুর সাথে।’ শাখাওয়াত আগের মতোই হাসলো। বলল, ‘এটা তোমার আপুর সাথে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অধিকার..’ কথাটা শেষ করতে দিল না রোজা। তার আগেই রাগী স্বরে বলে ওঠলো, ‘কোনোক্রমেই এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে পারে না। আপনার সাথে আমার বোনের এখনো বিয়ে হয় নি যে আপনি তাঁর গায়ে হাত তুলবেন, অপমান করবেন। আর কীসের অধিকার? হবু বর হতে পারেন, তাই বলে মাথা কিনে নেন নি যে, অধিকার বলে জঘন্য ব্যাপারটাকে চালিয়ে দিচ্ছেন।’ ‘আই লাইক ইউ।’ রোজা বিস্মিত হয়ে গেল। মুখের কথা হারিয়ে গেল। নেহার দিকে একপলক দৃষ্টি ফেলে তারপর আবার শাখাওয়াতের দিকে তাকালো। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললেন আপনি?’ শাখাওয়াতের ঠোঁটে ক্রুর হাসি। বাঁ-চোখটা টিপে দিয়ে বলল, ‘বাবা-মা তোমার বোনকে পছন্দ আমার জন্য পছন্দ করেছে। জোর করে আজ আবার দেখাও করতে পাঠিয়েছে। আমি বিয়ে করতে চাই না ওকে। ওর সাথে আমার যায় না, দেখেই তো রাগ পেয়ে গেল আমার। আর রাগ হলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না আমি। এই যে, এখনো তোমার বোন এখানে আছে ইচ্ছা করছে আরও থাপ্পড় মেরে বিয়ের শখ ঘুচিয়ে দিই! তবে এখানে এসে তোমার মতো একটা সাহসী, স্ট্যান্ডার্ড মেয়েকে দেখে প্রথম দেখায়ই যে প্রেমে পড়ে যাব, সেটা তো ভাবি নি। আই লাইক ইউ এন্ড লাভ ইউ!’ রোজা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এসব কী বলছে লোকটা? সত্যিই কী সে আজ সাহস দেখিয়ে এতগুলো কথা বলে ফেলেছে লোকটাকে? ওকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাখাওয়াত একটু এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল, ‘বসো, বসে কথা বলি আমরা?’ রোজা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। ব্যগ্র কন্ঠে শাখাওয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার সাহস হয় কী করে আমার হাত ধরার?’ ‘এভাবে তাকাতে হয় না, বুকের ভেতর ব্যথা হয় তোমার চোখের ওই নেশায়!’ রোজার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। বিষ ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ! তীক্ষ্ণ কন্ঠে সে বলল, ‘আপনার মতো লো ক্লাস মেন্টালিটির একজনের সঙ্গে আপুর বিয়ে ঠিক হচ্ছিলো ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে।’ শাখাওয়াত ক্রুর হাসি হেসে বলল, ‘আমার বেড পার্টনার হিসেবে তোমায় দারুণ মানাবে।’ রোজা বিস্মিত, কুন্ঠিত, লজ্জিত, হতভম্ব! নেহা আর ফিহাও শাখাওয়াতের এই কথাটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছে। এত নীচ একটা লোকের সাথে ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, ভাবতেই বাবার ওপর রাগ হলো ওর। মাথার ভেতর তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কোনোমতে একটা ম্যাসেজ লিখলো সে তাঁর ভাইকে। টেক্সট সেন্ড করে ওঠে আসলো নেহা। পরণের শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে রোজাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। রোজার চোখে টলমল পানি। সে কোনোদিন কারো কাছ থেকে এমন জঘন্য কথা শুনে নি। শাখাওয়াত একটা চেয়ারে বসে কোল্ড কফির স্ট্র’তে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘তো? কী খাবে বলো? আর ভেবে এখনি বলে দাও আমার সাথে কখন মিট করবে তুমি? বিয়ে করতে চাইলেও বলতে পারো বা অন্য কিছু চাইলেও আমি রাজি। আ’ম স্ট্রং ম্যান। অনেক সুবিধা পাবে এরজন্য, হতে পারে সেটা টাকা বা সামথিং…’ নেহা ঘৃণাভরা কন্ঠে বলল, ‘ফার্দার আমার বোনকে আপনি এসব কথা বলেছেন তো, ভালো হবে না!’ শাখাওয়াত ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল, ‘ওহ আই সী? তুমি? লাইক সিরিয়াসলি? যে নিজেই আমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে ভদ্রমেয়ের মতো তা হজম করে নিয়েছ, সেই তুমি আমায় হুমকি দিচ্ছ?’ নেহা চেঁচিয়ে ওঠল, ‘হ্যাঁ, দিচ্ছি। আমি এতক্ষণ চুপ ছিলাম কারণ সিনক্রিয়েট না হয় সেজন্য। ভদ্র পরিবারের মেয়ে তো, রাস্তার কুকুরের মতো সব জায়গায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পছন্দ করি না।’ শাখাওয়াত শক্ত কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমায় কুকুর বলছ? এডভান্টেজ কী তুমিও চাও নাকি? বিজনেসম্যান দেখে লোভে পড়ে গেছ?’ নেহার রাগ চড়ে ওঠলেও সন্তপর্ণে তা সামলে নিলো। চোখ বুজে শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বলল, ‘নাহ, কুকুর তো তাও ভালো। আপনি নর্দমার কীটের চেয়েও জঘন্য। যেখানেসেখানে কিলবিল করে ওঠেন। লো মেন্টালিটির ক্লাসলেস লোক!’ শাখাওয়াত রেগে গেল। ইতোমধ্যে রেস্টুরেন্টের অসুস্থ পরিবেশ দেখে অনেকেই তাঁদের পরিবার নিয়ে ওঠে গেছে। তবুও দু-চারজন যুবক বসে শাখাওয়াতের রঙ-তামাশা আর রোজাদের অপদস্থ হওয়া দেখছে! কেউ আবার ওদেরকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। রোজা ব্যাপারটা কোনোক্রমেই সহ্য করতে পারলো না। রেস্টুরেন্টের পরিবেশটা ওর কাছে জঘন্যতম একটা জায়গা বলে মনে হচ্ছে। ম্যানেজার, ওয়েটাররাও কিছু বলছে না৷ এ পর্যায়ে এসে শাখাওয়াত হিংস্র গলায় বলল, ‘আমি ক্লাসলেস? হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি কী ভাবছো আমার টাকাপয়সা নেই? আমার যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে!’ রোজা এবার চেঁচিয়ে বলল, ‘টাকাপয়সা আছে, তবে মনুষ্যত্ব নেই। যেটা সবচেয়ে দামী জিনিস!’ শাখাওয়াত রাগে কফির মগটা উপুড় করে টেবিলে ফেলে দিলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে রোজার দিকে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। রোজা ভড়কে দু-পা পিছিয়ে গেল। নেহা আর ফিহা ভয় পেয়ে গেল। শাখাওয়াত রোজার গালে নিজের গাল ঘষতে যাবে ঠিক তখনই কে যেন পেছন থেকে শাখাওয়াতকে লাথি মারলো। আর ও ছিঁটকে গিয়ে পড়লো রোজার পায়ের ওপর। হতভম্ব হয়ে চোখ তুলে তাকালো রোজা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেহার ভাই উৎস আর তার বন্ধুদের দল। রক্তবর্ণ গাঢ় চোখে তাকালো উৎস রোজার দিকে। অতঃপর নেহার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোরা তিনজন গাড়িতে গিয়ে বস। এই অজাতকুজাতের ক্লাস আমি নেব!’ উৎসে’র চার বন্ধুও সমস্বরে বলে ওঠল, ‘তোরা যা নেহা। এরে দেইখা নিব আমরা।’ রোজা তখনো নড়লো না জায়গা থেকে। উৎস বিরক্তি নিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কী সমস্যা তোর? বলছি না গাড়িতে গিয়ে বস? শুনছিস না কেন? না-কি এক থাপ্পড় মারব?’ রোজা এবার ছলছল কন্ঠে বলল, ‘এ এই লোকটা আমাকে ওর জঘন্য হাতে ছুঁয়েছে, ও ও ভালো লোক নয়..’ উৎস ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরে গালে হাত রাখলো। কন্ঠে নম্রতা এনে বলল, ‘দরকার হলে ওর হাত কেটে নেব আমি, তুই কাঁদিস না৷ প্লিজ গাড়িতে গিয়ে বস, ড্রাইভার চাচা পৌঁছে দেবে তোদের।’ উৎস ফিহা আর নেহাকে গমগমে গলায় আদেশ করলো রোজাকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসতে। রোজা ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘ও ওনি বলেছেন আমার সাথে রাত কাটাতে চান, নেহা আপুকেও থাপ্পড় মেরেছেন.. লোকটা জঘন্য ভাইয়া, প্রচন্ড জঘন্য!’ কথাটা শুনেই মাথায় আগুন ধরে গেল উৎস’র। রোজাকে ঠেলে গাড়িতে ওঠিয়ে দিলো নেহাদের সাথে। শেষ বিকেলের মরা আলোয় উৎস অনিমেষ চাহনি মেলে ওদের চলে যাওয়া দেখল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলল, ‘হারামিটার এত শখ তোকে বেড পার্টনার বানানোর? ওর সেই শখ যদি ঘুচিয়ে না দিই তবে আমি উৎস না।’ উৎসের আদেশে ওর চার বন্ধু আশফি, ইমাদ, মাহিদ, রেনন মিলে রেস্টুরেন্ট থেকেই তুলে এনেছে শাখাওয়াতকে। নিয়ে আসা হয়েছে রেনন, ইমাদ’দের ফ্ল্যাটে। আর রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে এসেছে কেন তারা প্রতিবাদ করেনি। শাখাওয়াত এ ঘটনায় খানিকটা ঘাবড়ে গেল। ওকে বসিয়ে রাখা হয়েছে ফ্লোরে। উৎস হাতমুখ ধুয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো শাখাওয়াতের সামনে। আঁৎকে ওঠল শাখাওয়াত। নেহা, রোজাদের সামনে নিজেকে যতটা স্মার্ট দেখাচ্ছিল, সেটা ফুরুৎ করেই উবে গেল। উৎস ওর গাল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘কী বলেছিলি তুই? আমার বোনদেরকে তুই বেড পার্টনার বানাতে চাস? তোর এত বড় স্পর্ধা? তোর মতো কুত্তাকে তো গুলি করে মারা উচিৎ আমার। কিন্তু না, সেটা করব না। তোর মতো বেজন্মা কুত্তাদের মেরে হাত নষ্ট করতে চাই না। তোকে কী শাস্তি দেওয়া যায় বল তো?’ ইমাদ আর রেনন বলল, ‘শালার বেশি কুড়কুড়ানি না? দিয়া দে বুকের ওপর একটা ঘুষি। সব কুড়কুড়ানি বাইর হইয়া যাইবো।’ উৎস হিংস্র কন্ঠে বলল, ‘ঠিক বলছিস। তবে ঘুষিটা বুকে নয়, ওর মেইন পার্টে যাবে! কীরে নর্দমার কীট, ওটা না থাকলে কী করবি এবার?’ শাখাওয়াত দস্তুর মতো জমে গেল। ভয়ার্ত কন্ঠে আমতাআমতা করে বলল, ‘মা মানে?’ চলবে…ইনশাআল্লাহ! ভুলক্রটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#অনুভবে_তুই #পর্ব-১
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-