অনুভবে তুই পর্ব-২০

0
1900

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০

সুহানা শেখ যে রাতে চলে গেলেন, সেইরাতে কারোরই ঠিকমতো খাওয়া হলো না। নেহার বিয়ের শপিং উপলক্ষে সবার মধ্যে যে উত্তেজনা কাজ করছিলো নিমিষেই তা ম্লান হয়ে গেল৷ নিজের একমাত্র ছোটবোনের কার্যকলাপ আদ্রিশের বাবা এতোটাই ক্ষুণ্ণ হন যে, রাতে আর ঘর থেকেই বের হননি। ইমতিয়াজ সাহেবও লজ্জিতবোধ করেন। ভায়রায় মেয়েকে এভাবে অপমানিত করেছে তারই বোন আর তিনি এতদিন পরে জানলেন? মিতালি-নিশিতা ননদের কান্ডে বিমূঢ় হয়ে গেলেন। বাড়ির মেয়েদের কারোরই মন ভালো নেই। তবে উৎস দিব্যি আছে। সে খাওয়াদাওয়া সেরে নিজের ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মগ্ন। তার মতে, যে অন্যায় করেছে সে প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে, এতে না খেয়ে থাকার মতো তো কিছু হয় নি। কিন্তু আদ্রিশকে স্বাভাবিক দেখায়। পূর্ব দিনগুলোর মতোই নিজের কর্মকান্ড বজায় রেখেছে। খাওয়াদাওয়া সেরে, অফিসের কিছু ফাইল নিয়ে বসে কাজ দেখলো অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর নিজ হাতে তৈরি করা কড়া কফির মগটা নিয়ে ব্যলকনির ইজি চেয়ারটাতে বসে থাকে। কফির ঘ্রাণে নিস্তেজ দৃষ্টিজোড়া যখন হঠাৎ হঠাৎ রোজার ব্যলকনিতে পড়ে, বুকের ভেতর চিনচিনে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে আদ্রিশ। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীতে একা বসবাসরত একজন মানব। নিদারুণ একাকীত্বতা নিয়ে ব্যলকনিতেই কেটে যায় সারাটি রজনী। শেষ রাতের বর্ষণের মনোমুগ্ধকর ছন্দপতনে হালকা করে চোখ খুলে তাকায়, ঘুমে ব্যঘাত ঘটে। পূর্ব দিকের কৃষ্ণাভ আসমানে উদিত জ্বলন্ত নক্ষত্রটির পানে তাকিয়ে ভাবে, রোজা কি ওকে কখনোই অনুভব করে না?

ওদিকে গ্রাম্য স্নিগ্ধ বাতাস যখন জানালা ভেদ করে ভারী পর্দাগুলো ওড়িয়ে দেয়, কপাট অবলোকন করে রোজাও বাইরে দৃষ্টি দেয়। পাশে ঘুমিয়ে থাকা চাচাতো বোনটিকে একপলক দেখে আড়ালে চোখ মুছে। রাত গভীর হলেই ওর মনে পড়ে যায় ক্ষতগুলো। নেহার এনগেজমেন্টের দিন ওর সাথে করা আদ্রিশের ব্যবহারগুলো। সত্যিটা কি আদৌ জানেনা! কিন্তু আজকাল মনের কোণে যে ছোট্ট ভাবনা হুটহাট উদয় হয়, সেখানে আদ্রিশকে নির্দোষ বলেই মনে হয়। ওর বেদনাভরা কথাগুলো মনে পড়লেই রোজার মন খারাপ হয়। লোকটা ওকে ভালোবাসে, তা সে জানে। কিন্তু এই যে, রাত হলেই আদ্রিশকে দেখার ইচ্ছে জাগে, এলোমেলো চুলে, ক্লান্ত শরীরে যখন রোজার হাতের কফি খেতে খেতে যে সুখপূর্ণ বাঁকা হাসিটা দিতো রোজা সেটা খুব মিস করে। দিনের আলোতে মানুষটা সারাক্ষণ ওর মনোজগতে নিঃশব্দে বিচরণ করে। গোধূলির রক্তিম আলোয় বেপরোয়া লোকটিকে দেখার যে তীব্র বাসনা জাগ্রত হয়, কিছুতেই তা সামাল দিতে পারে না রোজা। বাড়ির সকলের সামনে নিতান্তই ভালো থাকার অভিনয় চালিয়ে গেলেও, রোজা জানে, সে আসলে ভালো নেই। আচ্ছা, মানুষটা কী ওকে ভুলেই গেল? গ্রামে চলে আসার পর একদিনও তো খোঁজ নেয় নি! রোজার কপট অভিমান হয়, রাগ হয়। বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে নাগচাঁপার সুবাস ভেসে আসে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়। রাতের নীরবতাকে দুমড়েমুচড়ে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে উচ্চারিত হয় ফজরের আযান। নির্ঘুম রাতের শেষ প্রহরটাতে মন খারাপ ভাবটাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকতে রোজা বিছানা ছেড়ে ওঠে বসে। চুলগুলো হাতখোঁপা বেঁধে নিয়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নেয়। বেশ ঠান্ডা লাগছে। পায়ে স্যান্ডেল চাপিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিঁড়িকোঠা অন্ধকার। ভয়ভয় ভাবটা কাটিয়ে কলপাড় থেকে অযু সেরে আসে। তারপর নিজের ঘরে ফিরে নামাযে বসে।
নামাজ শেষ হতেই খুলে রাখা জানালা বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। দু-চোখ ভারী হয়ে নেমে আসে ঘুম।

সকালে ফোন বাজার বিরক্তিকর শব্দে রোজার ঘুম ভাঙে। বালিশের নিচ থেকে হাতড়ে ফোনটা বের করে ঘুমুঘুমু চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে উৎসের নাম দেখতে পায়। ফুল নেটওয়ার্ক পেয়ে যাওয়ায় রোজা দ্রুত উঠে বসে। মুহূর্তেই চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। কলটি রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যালো ভাইয়া?’

উৎস জবাব দেয়, ‘এখনো ঘুমাস না-কি? কন্ঠস্বর এমন কেন?’

রোজা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ঘুমাচ্ছিলাম। রাতে ঘুম হয় নি। তুমি তো বাড়িতে পৌঁছে আর ফোন দাওনি? মা অপেক্ষায় ছিল! তোমার শরীর ঠিক আছে তো? ভালোভাবে পৌঁছাতে পেরেছো তো?’

‘হুম ভালোই আছি আলহামদুলিল্লাহ।’

ইতস্তত করে রোজা জিজ্ঞেস করে, ‘বাসার সবাই কেমন আছে? ভালো আছে তো?’

বোনের প্রশ্ন শুনে উৎসের হাসি পেয়ে যায়। কোনোরকমে হাসিটা আটকে বলে, ‘এত প্রশ্ন একসাথে? বাসার সবাই ভালো আছে। আসলে তুই কার খোঁজ নিতে চাচ্ছিস?’

রোজা থমকায়। ধরা পড়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ওঠেপড়ে লাগে। কপালে ভাঁজ ফেলে ঢোক গিলে। তারপর কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘কারোর না তো!’

উৎস নির্বিকার হয়ে বিছানায় বসে। গলার স্বরটা পালটে যায়। অনেকটা গম্ভীর সুরেই বলে, ‘আমার থেকে লুকিয়ে লাভ নেই রোজানু। তুই আসলে ভাইয়ের খবর জানতে চাইছিস। খোঁজ নিয়ে কোনো লাভ আছে? তুই কিছু কর‍তে পারবি? সে তো দেবদাসের মতো নিজের ঘরে পড়ে আছে। খাবারটাও নিজ ঘরেই খায়, তাছাড়া খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না, কারো সাথে বেশি কথাও বলে না।’

ফোনটা কানে রেখেই রোজা ডান-পাশে তাকায়। ওর পাশে শুয়ে ছিল চাচাতো বোন মিলা। এতক্ষণ খেয়াল করেনি রোজা। মিলা হয়তো অনেক আগেই ওঠে বেরিয়ে গেছে, ঘরে নেই। রোজা দরজাটা লাগিয়ে দেয়। তারপর ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘কেন? ওনার কি হয়েছে?’

‘কি হবে? ভালোবাসায় ব্যর্থ প্রেমিকদের যে অবস্থা হয়, তাই হয়েছে। তুই জানিস, বাড়িতে সেদিন কত বড় একটা ঝামেলা হয়ে গেছে?’

‘কীসের ঝামেলা?’

‘ফুপির কারণে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস, তা জেনে আব্বুরা খুব ক্ষেপে গেছে। ফুপিকে তো বাড়িতে আসতেই মানা করে দিয়েছে।’

রোজা আঁৎকে ওঠে বলল, ‘সামান্য কারণে এটা করার প্রয়োজন ছিল না৷ ঝামেলাটা তোমার ভাই তৈরি করেছে। ওনার জন্যই তোমাদের ফুফু আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। শাস্তিটা তোমার ভাইয়ের প্রাপ্য।’

উৎস রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চাপিয়ে বলে, ‘তুই যদি সামনে থাকতি না, আই সোয়্যার তোর গালে দশটা থাপ্পড় লাগাতাম। যতক্ষণ না তোর গাল ফেটে রক্ত বেরুতো, ততক্ষণ থাপ্পড় চলতেই থাকতো। এই মেয়ে, তুই কী খাইয়া বড় হইছিস? যেটা জানোস না সেটা নিয়ে অহেতুক একজনকে দোষারোপ করিস কেন? ফুপি তোকে বলছিল যে ভাই তাকে এসব বলছে? বল..’

উৎসের রাগ আর ধমক শুনে চমকে ওঠে রোজা। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক বোঝাতে শুকনো হেসে বলে, ‘না। ওনি তো বলেন নি।’

‘তাহলে এতো ভ্রান্ত ধারণা মনের মধ্যে রাখিস কেন? ভাই তো এই সম্বন্ধে কিছুই জানায়নি।’

‘তাহলে?’

উৎস ওকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলে। সমস্ত ঘটনা শুনে রোজার মুখমন্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। অবশেষে মানুষটাকে ভুল বুঝলো সে? উৎস যতক্ষণ কথা বললো ততক্ষণে একটি শব্দও ব্যয় করে নি রোজা। নিজের ওপর রাগে জর্জরিত হয়ে যায়। সুহানা শেখের জন্য নির্দোষ মানুষটাকে ভুল বুঝে এত কথা শুনিয়েছে ভাবতেই নিজের গালে ঠাস করে চড় মারার প্রয়াস জাগে। উৎসের কলটি কেটে সে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে বিছানায়!

————————

ইনায়েত সাহেব বসে আছেন ড্রইংরুমের সোফায়। তিনি ছাড়াও ইমতিয়াজ সাহেব, বাড়ির দুই বউ মিতালি, নিশিতা, আদ্রিশ আর উৎস আছে। নেহা-ফিহা-ইশা তিনজন নিজেদের ঘরে। ড্রইংরুমের পরিস্থিতি খুব গম্ভীর। কারো মুখেই রা নেই। যদিও কি কারণে আলোচনায় বসা হয়েছে তা আন্দাজ কর‍তে পারছে আদ্রিশ, কিন্তু বাবার কথা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। বিমূঢ় পরিস্থিতিটাকে শিথিল করে তুলতেই ইনায়েত সাহেব গলা ঝাড়লেন। নিজ পুত্র আদ্রিশের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

আদ্রিশ গম্ভীর গলায় বলল, ‘রোজার বিষয়ে তো?’

‘হুম, ঠিক।’

আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকালো, ‘কি জানতে চাও?’

‘তুমি কী সত্যিই ওকে পছন্দ করো?’

আদ্রিশ ব্যগ্র কন্ঠে জবাব দেয়, ‘সত্যিই।’

ইনায়েত সাহেব নড়েচড়ে বসেন। সচরাচরই আদ্রিশ স্পষ্টবাদী, সেটা জানেন তিনি। কিন্তু ছোট ভাইয়ের ভায়রার মেয়েকে যে আদ্রিশ পছন্দ করে বসে থাকবে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেননি তিনি। বাড়ির সকলেই খুব পছন্দ করে রোজাকে, অবশ্য তিনি নিজেও করেন। নেহা-ফিহা-ইশাকে যেভাবে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখেন, রোজার সম্বন্ধেও ঠিক ততটাই কনসার্ন তিনি। আদ্রিশের কাছ থেকে উত্তর পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করেন, ‘এটাকে কি ভালোবাসা ধরে নেব? নাকি মোহ? দুটোর মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে কিন্তু। তুমি বুঝেশুনে কথা বলো।’

আদ্রিশ সামান্য হেসে বলল, ‘আমি ছোট বাচ্চা নই বাবা। যথেষ্ট বুঝি। আমি নিজের কাছে খুব ভালোভাবেই পরিষ্কার আছি। আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। তোমাদের কী এতে আপত্তি আছে?’

ইনায়েত সাহেব ভাই ও ভাইয়ের বউয়ের দিকে তাকালেন। কারোরই এতে আপত্তি নেই। মিতালির সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তিনি বেশ পছন্দই করেন রোজাকে। আর বাড়ির ছোট সদস্যরা তো রোজা বলতে পাগল। সবার মতামত নিয়েই তিনি আদ্রিশের প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘আমাদের কারো কোনো আপত্তি নেই।’

আদ্রিশ স্মিত হেসে বলে ওঠলো, ‘আমারও কোনো সংশয় নেই। কিন্তু ছোটচাচীর বোনের মেয়েটার সংশয় আছে। জানোই তো, অহেতুক বিষয়ে সন্দেহ করে সে আমাকে কতটা অবিশ্বাস করেছে! সম্পর্ক হয় তখনই, যখন দুজন দু’জনকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে। কিন্তু রোজার মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও দেখি নি আমি। আসলে ও কোনোদিনই বুঝতে চায়নি আমাকে। তাছাড়া আমাদের মধ্যে যতটুকু সম্পর্ক ছিলো, তা অনেকদিন আগেই চুকেবুকে গেছে। তাই আমি চাই, এ ব্যাপারটা নিয়ে তোমরা আর মাথা ঘামিও না। সবচেয়ে বড় কথা কী জানো? রোজা আমাকে ভালোবাসে না।’

একথা শুনে উৎস কিছু একটা বুঝাতে চাইলো আদ্রিশকে। কিন্তু সে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো ব্যাপারটা যেন এখানেই শেষ হয়। আর কোনো কথা উঠুক বা বাড়াবাড়ি হোক তা ও চায় না। সবার উদ্দেশ্যে এই কথাটা ব্যক্ত করে ড্রইংরুম থেকে প্রস্থান করে আদ্রিশ। উৎস ওর যাওয়ার পানে নির্বাক চেয়ে থাকে। ভাইয়ের চাপা অভিমানটা বেশ ভালোভাবেই টের পায় সে। নেহা-ফিহা-ইশাকে ব্যাপারটা জানায় ও। সবারই মনক্ষুন্ন হয়৷ চারজন বসে শলাপরামর্শ করে। ঠিক করে নেহার বিয়েকে উপলক্ষ্য করে জোরজবরদস্তি করেই হোক, রোজাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। বাড়ির কারোরই যখন ওদের সম্পর্কে আপত্তি নেই, একটা সুযোগ নিয়ে দেখাই যাক না রোজা-আদ্রিশের বন্ধনটা হয় কি-না!

————————————————————————-

Group- Israt’s Typescripts

[নোট: চারদিন পর গল্প দিলাম। এজন্য হয়তো অনেকে রেগে আছেন, সবার কাছেই আন্তরিকভাবে দুঃখিত আমি। জানেনই তো, এক্সামের সিজন চলছে। তাছাড়া অন্য আরেকটা কাজে আটকে পড়েছি। চাইলেও নিয়মিত দেওয়া হয়ে ওঠছে না। গল্পটার ওপর সত্যিই বিরক্ত হয়ে গেছি, অন্য কোনো গল্পে এতো বিরতি দিইনি আমি। চেষ্টা করছি খুব দ্রুত শেষ করে দেওয়ার। আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য জানিয়ে পাশে থাকবেন আশা করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here