#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২২
অভিমান আর অভিযোগের পাল্লা যখন ভারী হয়ে যায়, তখন সম্পর্কে আসে পরিবর্তন। আদ্রিশের বেলায়ও তা-ই হয়েছে। নিয়মমাফিক সব কাজকর্ম করলেও ওর ভেতরের বিরাট পরিবর্তনটা বাড়ির সকলেই টের পেয়েছে। আগের মতো নেহা-ফিহাকে হুটহাট ধমক না দেওয়া, একা থাকা, কম কথা বলা সবকিছু বেশ চোখে পড়ছিল ওদের। বাড়ির সবার মধ্যকার বন্ধনটা হঠাৎই যেন নড়বড়ে হয়ে গেলো। এর মধ্যে নেহার বিয়ের তারিখ ঠিক হলো ডিসেম্বরের একুশ তারিখ। বিয়ের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো ততই বাড়ির সকলের ব্যস্ততা বাড়ছিলো। বাজার-সদাই করা, আত্মীয়-স্বজন নিমন্ত্রণ, ইভেন ম্যানেজমেন্টের কাজ সবকিছু মিলিয়ে হুলস্থুল অবস্থা। বাড়ির মহিলাদের ওপর পড়লো শপিংয়ের দায়দায়িত্ব। কিন্তু একমাত্র বোন সুহানা শেখ বাড়ির বড় মেয়ের বিয়েতে থাকবে না, এটা কেন যেন মানতে পারলেন না ইনায়েত ও ইমতিয়াজ সাহেব। আলাদা করে পরামর্শ করলেন তাঁরা দুই ভাই। আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করা হলে ও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। সব সত্যি যখন প্রকাশ হয়েই গেছে তখন আর বিরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করাটাকে যুক্তিসংগত মনে হয় নি ওর। অবশ্য ইশার কথা চিন্তা করেই আদ্রিশ ফুফুকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাকে ছেড়ে ইশা এতদিন ধরে এ বাড়িতে থাকছে ঠিকই, কিন্তু সারাক্ষণ অপরাধবোধে মনমরা হয়ে থাকে।
অবশেষে ছেলের মতামত নিয়ে, সবদিক বিবেচনা করে বোনকে ফোন লাগালেন ইনায়েত সাহেব। সুহানা শেখ ফোন ধরলেনও। ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে নেহার বিয়েতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অপরাধবোধে পিষ্ট সুহানা শেখের চিন্তিত ছিলেন খুব। প্রিয় ভাইঝির বিয়ে নিয়ে তার গড়া অনেক আশা-আকাঙখা মুখ থুবড়ে পড়েছিল প্রায়। এতসব বিশ্রি কান্ডকীর্তি ভুলে যে ভাই-ভাবি তাঁকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছেন এতে তিনি বেশ লজ্জিত বোধ করলেন। এই একমাসে তিনি হাড়ে হাড়ে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভুগছিলেন। ইনায়েত সাহেব অবশ্য কিছু শর্ত দিয়ে তাঁকে ক্ষমা করে দেন। সুহানা শেখ ভাইয়ের মহানুভবতায় বেশ অবাক হলেন। একপর্যায়ে নিজের কান্না আটকাতে না পেরে তিনি বললেন, ‘আমাকে সত্যিই মাফ করে দিয়েছেন বড় ভাইজান?’
ফোনের ওপাশ থেকে ইনায়েত সাহেব গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, ‘প্রথমবার বলেই ক্ষমা করে দিলাম। আশা করি এরপর এরকম ভুল করার চিন্তা মাথায়ও আনবি না। নিজের মেয়েকে একটু বুঝতে শিখিস, মেয়েটার মুখের দিকে তাকানোই যায় না।’
সুহানা শেখ উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাইজান ইশা কেমন আছে?’
‘যেমন থাকার তেমনই আছে। তোর মেয়েকে তোর চেয়ে বেশি কেউই চিনবে না। অবশ্য তুই তো ওকে কখনো বুঝতেই চেষ্টা করিস নি।’
‘আমারই ভুল ছিল ভাইজান। সেদিন যদি রোজাকে এভাবে কটুক্তি আর অপমান না করতাম তাহলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।’
‘কাজ করার আগে সবদিক ভেবেচিন্তে দেখতে হয়। এখন এসব বলে লাভ নেই।’
‘আদ্রিশ কী আমার ওপর এখনো রেগে আছে?’
‘নাহ।’
সুহানা শেখ নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছে ও?’
ইনায়েত সাহেব হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘ভালো আছে। তবে আগের মতো নেই, অনেক পালটে গেছে। জানিসই তো ছেলেটা কত জেদি।’
সুহানা শেখ চুপ করে রইলেন। তাঁর কারণেই যে এ অবস্থা এটা ভাবতেই মন বিষিয়ে উঠলো। ভাবনার প্রহর কাটিয়ে অনেকক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘রোজা মেয়েটার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা যায় বড় ভাই?’
ইনায়েত সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’
‘আমি ওর সাথে কথা বলে সবটা বুঝিয়ে বলবো।’
ইনায়েত সাহেব হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘আমার জন্যই যখন সব ঝামেলার সৃষ্টি তখন ঝামেলা ভঙ্গের দায়দায়িত্বও আমার ওপরই বর্তায়। অন্তত একবার চেষ্টা তো করে দেখি!’
সুহানা শেখের দৃষ্টি ডুবন্ত রক্তিম সূর্যের দিকে স্থির৷ কন্ঠে একরাশ আক্ষেপ। ইনায়েত সাহেব এ ব্যাপারে আর কোনো বাক্যব্যয় করলেন না। আরো কিছুক্ষণ বোনের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে তাঁকে ও বাড়ি যেতে বললেন। ফোন রেখে সুহানা শেখ অনেকক্ষণ একান্তে বসে রইলেন। তাঁর অচঞ্চল দৃষ্টিজোড়া সন্ধ্যেবেলার আবছা আলোছায়ার লুকোচুরির ওপর। ঘরের ভেতর নিদারুণ নিস্তব্ধতা। তার পুরো বাসাটিই প্রায় খালি। সুহানা শেখের স্বামীর মৃত্যু হয়েছে তিন বছর আগে। এরপর মেয়ে ইশাকে নিয়েই থেকেছেন এতদিন। প্রায় একমাস ভাইদের ও নিজের মেয়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে বেশ কষ্টেই দিনাতিপাত করেছেন তিনি। কাজের বুয়াই ছিল তার সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী। তবে ভাইয়ের ফোন পাওয়ার পরে তার মনে যে শান্তি সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে দ্বিগুণ করতেই তিনি রোজার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন বলে ঠিক করলেন। প্রয়োজনে রোজাকে আদ্রিশের বউ বানানোর জন্য যা যা করতে হয়, তার সব চেষ্টাই তিনি করবেন বলে ঠিক করলেন। একটি ভুলের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে যেতে দিতে পারেন না তিনি।
———————————————————-
রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে তরকারি কুটছিলো রোজা। ওর মন বিশেষ ভালো নেই৷ সেদিন আদ্রিশের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা হওয়ার পর থেকে নিজেকে বেশ তুচ্ছ মনে হচ্ছে ওর। এরমধ্যে আজিজুর রহমান বেশ কয়েকবার মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করলেও রোজা কাউকে কিছুই বললো না। আনমনা হয়ে শসা কাটতে গিয়ে বটিতে হাত কেটে গেলো ওর। বেদনায় জর্জরিত হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘আহ’ শব্দটি। সুলতানা হতচকিত হয়ে ওঠে দাঁড়ালেন। মেয়েত কাছে এসে ধমকের সুরে বললেন, ‘অকর্মা কোথাকার! কাজ যখন করতেই পারিস না তখন রান্নাঘরে আসিস কেন? ইশ কতখানি কেটে গেছে! তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।’
রোজা ব্যথাতুর নয়নে তাকালো। অতঃপর অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ঠিকই বলেছো। আমি একটা অকর্মা। না কোনো কাজ পারি, না কারো মন বুঝতে পারি। আমার তো পৃথিবীতে বেঁচে থাকারই অধিকার নেই।’
সুলতানা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন, ‘এসব আবার কী হাবিজাবি কথা তোর? এই বয়সেই জীবনের প্রতি এত অনীহা দেখাস? এত বছর সংসার করেও কোনোদিন এসব কথা চিন্তাতেও আনিনি। তুইও আনবিনা। দেখি হাতটা দে!’
সুলতানা একটা কাপড়ের টুকরো এনে ভালোভাবে কাটা জায়গাটা জীবাণুমুক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। রোজাকে আর কোনো কাজে হাত লাগাতে না দিয়ে ওর ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। মেয়ের আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন লক্ষ্য করে কিছু একটা আন্দাজ করলেন তিনি। রোজাকে কখনোই এত উদাস দেখেন নি সুলতানা। চিন্তিতমুখে তিনি সবজি কাটায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা চালালেন। ওদিকে, ঘরে ফিরে সময় কাটানোর মতো কোনো কাজ না পেয়ে ফোনটা হাতে নিলো রোজা। অনেকদিন যাবৎ নেহা-ফিহার সঙ্গে ওর কোনো যোগাযোগ নেই। গোপনে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে রোজা নেহাকে ফোন লাগালো। কিন্তু দু’বারই নট রিচেবল আসায় এবার ডায়াল করলো ফিহার নম্বরে।
নেহার বিয়েতে কাদেরকে ইনিভাইটেশন পাঠানো হয়েছে তার লিস্ট নিয়ে বসেছিল ফিহা৷ বিরক্তিতে গাঁট হয়ে রাগে ফুঁসছিলো। ঠিক তখনি মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলে ওঠতেই রোজার নামটি ভাসতে দেখা গেল। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকালো ফিহা। না চেনার ভান করে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’
রোজা বিগলিত কন্ঠে বলল, ‘আমি রোজা। কেমন আছো ফিহা আপু?’
ফিহা তিক্ত কন্ঠে বলে ওঠে, ‘তোর কী মনে হয়? আমরা অনেক আনন্দে আছি? খুব ফুর্তিতে আছি? ধেইধেই করে নাচছি? বাসার সবাই মিলে পার্টি দিচ্ছি?’
রোজা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘এসব কী বলছো ফিহা আপু?’
ফিহা শক্ত গলায় বলল, ‘যেমন প্রশ্ন করেছিস, তেমন উত্তর।’
‘তুমি কী আমার ওপর রেগে আছো?’
ফিহা রাগ সামলাতে না পেরে চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘তুই কোথাকার কে যে রেগে থাকবো? হুম?’
রোজা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে আবারও শোনা গেল ফিহার ক্ষুদ্ধ কন্ঠ, ‘শোন রোজা। তুই নিশ্চয়ই ফোন করেছিস আমাদের খোঁজখবর নিতে? বলি কী, এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। তোর এসব আদিখ্যেতা অন্য কোথাও গিয়ে দেখালে হয়তো দু-একজন দেবদাস স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতো। কিন্তু তোর তো আত্মসম্মানবোধ প্রবল। কারো কাছেই ছোট হবি না। কেউ কোনো দোষ না করলেও তোর চোখে সে-ই দোষী। যাকগে সেসব। এসব বলে-কয়ে-জেনে তোর কোনো লাভ আছে? নেই তো? সো, নিজের চরকায় তেল দে আর আমাদের ভুলে যা।’
রোজা পাংশুটে মুখে জবাব দেয়, ‘আমি এতোটা খারাপ?’
ফিহা ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল, ‘নাহ। তুই একেবারে সরলসোজা, ভদ্র মহিলা। তোর মতো ভদ্র’দের সাথে আমি ফিহা কোনোরকমের যোগাযোগ রাখতে চাই না।’
ফিহার লাগামহীন কথাবার্তার মানেটা বেশ বোধগম্য হলো রোজার। ওর এই বোনটা যে আদ্রিশকে কতটা ভালোবাসে সেটাও রোজা জানে। নেহা যতটা রোজাকে ভালোবাসে, ফিহা ঠিক ততটাই আদ্রিশকে ভালোবাসে। ফিহার রাগ ভাঙাতেই রোজা আচমকা বলে ওঠল, ‘আপু আমার হাত কেটে গেছে।’
ফিহার চেঁচানো ভাবটা একটু কমলেও গলার স্বরটা নরম হলো না। আগের মতোই সে বলল, ‘তো? আমাকে বলছিস কেন? আমি কী বলেছি তোকে হাত কাটতে?’
রোজা চোখদুটো বুজে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘তোমার ভাই বলেছে।’
ফিহা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে?’
রোজা কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ও-ওনি বলেছে।’
ফিহা সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আদ্রিশ ভাই?’
‘হুম।’
ফিহা বোকা বনে গেল, ‘কীভাবে?’
রোজার চোখের কোণে চিকচিক করছে জলধারা। এক্ষুণি যেন তা গড়িয়ে পড়বে। অনেকটা অভিযোগের সুরেই সে বলল, ‘তরকারি কুটতে বসে হঠাৎই মনের ভেতর এসে আমাকে ইমোশনাল বানিয়ে দিয়েছিল তোমার প্রেমিক ভাই। সে-কী রাগ ওনার! আমিতো ভয়েই আধমরা হয়ে যাচ্ছিলাম। এটা-ওটা-সেটা করে পরিশেষে বলে গেল, আমি ওনার কেউ না। আমি নাকি স্বার্থপর। ওনার হৃদয়ে বসবাস করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি যতই বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমি ওনার হৃদয়েশ্বরী হতে চাই; কিন্তু ওনি সেকথা বুঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। তখনি অন্যমনস্ক অবস্থায় শসা কাটতে গিয়ে বটিতে লেগে পুরো রক্তাক্ত অবস্থা হয়ে গেছে হাতটার। ফিহা আপু, বলো তো এরজন্য দায়ী কে? আমি? না তোমার ভাই?’
ফিহা ভ্রুকুঞ্চন করে হতবাক গলায় বলে ওঠল, ‘আমার ভাই।’
—————————————–
[নোট: নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে নিজেদের মতামত জানাবেন আশা করি। গল্প এবার অন্যদিকে মোড় নিয়েছে, কেমন লাগছে?]
চলবে…