অনুভবে তুই পর্ব-২৫

0
1947

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫

এনগেজমেন্টের পরের দেড়মাসে রিজভী এবং নেহার সম্পর্কে খুব উন্নতি হয়েছে। দু’বার দেখাও করেছিলো। তখনই রোজার সঙ্গে হবুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নেহা। প্রায়ই দু’জনের ফোনে কথা হতো। কথা বলতে বলতে অবশ্য রিজভী-নেহা দু’জন দু’জনকে কখন যে মন বিনিময় করে বসে আছে টেরই পায় নি। নেহা কিছুটা শান্ত স্বভাবের হলেও রিজভী ঠিক তার উল্টো। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, লেবু বেশি চিপলে তিতা হয়ে যায়? নেহার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। যে মেয়ে গলা উঁচু করে কোনোদিন ‘টু’ শব্দটা পর্যন্ত করে না, সেই মেয়ে বিয়ের মাত্র ক’টা দিন আগে সামান্য কারণ নিয়ে এত রাগ দেখাবে ভাবেনি রিজভী। ব্যাপারটা অতি তুচ্ছ! কাল সারাদিন অফিসের কাজের অনেক চাপ ছিল, সেজন্য লাঞ্চ খাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ওর। রাত দশটায় বাড়িতে ফিরতেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় রিজভীর। তবে সময়মতো ঔষধ খাওয়ার পরই তা দ্রুত ঠিক হয়ে যায়। আর এই ব্যাপারটায় নানাপ্রকার ঝাঁঝালো মশলা মাখিয়ে, ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে একটা গল্প বানিয়ে হবু ভাবীর কাছে উপস্থাপন করেছে ইমতি। ফোনের মধ্যে রিজভীর অসুস্থতার খবর শুনে নেহা বেজায় চটে গেল। সারাদিন না খেয়ে চাকরি করতে রিজভীকে কে বলেছে? এত এত টাকা দিয়ে কী করবে সে? নেহা কি টাকার পাগল? নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যার খেয়াল নেই, সে আবার বউয়ের খেয়াল রাখবে কীভাবে? কেয়ারলেস লোক কোথাকার! তৎক্ষনাৎ রিজভীকে ফোন দিয়ে রাগারাগি করলো অনেকক্ষণ। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে সোজা সুইচড অফ করে রাখলো। ওদিকে, রিজভী বেচারা তো বউয়ের রাগ দেখে হতভম্ব! নেহার কান্ডে রিজভী যখন বারবার ওকে ফোনে ট্রাই করেও পাচ্ছে না তখন ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ব্যাপারটা কে নেহাকে জানিয়েছে খোঁজ করতেই ইমতি ভয়ে ভয়ে ভাইয়ের কাছে সবটা স্বীকার করলো। ওকে আচ্ছামত কানমলা দিয়ে রিজভী ফিহাকে ফোন করে নেহাকে চাইলো। কিন্তু নেহা বেজায় রেগে ওর সাথে কথা বলবে না বলে ফিহার সাথেও অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করলো। অগত্যা পুরো ব্যাপার ফিহাকেই খুলে বললো রিজভী। নিজের বোনের কান্ডে অবাক হলো ফিহা। বিমূঢ় চেহারা নিয়ে বসে থাকা নেহাকে দেখে নিয়ে রিজভীকে বললো তাঁর হবু বউ বেশ রেগে আছে। কিছু বলতে গেলে নেহাৎ কামড়ে দেয় তাই ওকে আর ঘাঁটালো না ফিহা।

এ রাগকে হাতিয়ার করে রিজভীর কাছ থেকে শালিদের ট্রিট আদায় করার শর্ত জারি করলো ফিহা-ইশা। বিপাকে পড়ে রিজভীও রাজি হলো শালিদের ট্রিট দিতে। আপাতত প্রেয়সীর রাগ ভাঙানোটাই ওর কাছে মুখ্য বিষয়। এজন্য সামনাসামনি দেখা করে কথা বলে নেওয়াটাই বেশ সুবিধের। ঠিক হলো, কাল হাফ অফিস করে শালিদের নিয়ে বেরুবে রিজভী৷ যেহেতু, বিয়ের বাকি তিনদিন, তাই পরদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই যখন একটু আড্ডায় মশগুল হবে বলে ঠিক করলো তখনি আদ্রিশদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন এলো। মিতালি ফোন ধরে বুঝতে পারলেন নেহার হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন এসেছে। রিজভীর মা জানালেন, শালিদের নিয়ে একটু বাইরে বেরোতে চায় তার ছেলে, সঙ্গে অবশ্য নেহা থাকলে ভালো হয়। ইশা-ফিহার জোরাজুরিতে সবার অগোচরে তিনি অনুমতি দিলেন ওদেরকে যাওয়ার জন্য! রিজভীর কথাটা গোপন করেই মেলায় যাওয়ার বায়না ধরলো ফিহা। অনেকক্ষণ জোর করার পরে নেহা যেতে রাজি হলো, সঙ্গে রোজাকেও তৈরি হতে বললো।

আদ্রিশ সারাদিন বাড়িতেই ছিলো৷ ঘুম থেকে ওঠে লিভিংরুমে আসতেই বাড়ির মেয়েদেরকে একা একা সেজেগুজে বেরুতে দেখে আপনাআপনি ভ্রু’কুঁচকে এলো তাঁর। চোয়ালজোড়া শক্ত করে পেছন থেকে ডেকে ওঠলো সে, ‘পরীটরী সেজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোদের?’

চৌকাঠ পেরুতে গিয়েই আদ্রিশের প্রশ্ন শুনে থেমে গেলো ফিহা। হতাশ হয়ে পেছনে ফিরে মিথ্যে বলার চেষ্টা করলো, ‘আ আসলে মেলায় যাচ্ছিলাম। নেহা আপুর বিয়ে হয়ে গেলে সবাই একসাথে তো আর যেতে পারবো না। তাই আরকি…’

আদ্রিশ কুটিল চোখে তাকালো, ‘তোরা চারজন? আর কে যাবে?’

ইশা বিরস কন্ঠে বলল, ‘আমরা আমরাই।’

নেহা এবার বলে ওঠল, ‘উৎস ভাইয়াকে বলেছিলাম, কিন্তু ও বাবার সাথে বাজার করতে গেছে। এই ভিড়ভাট্টায় এতগুলো মেয়ে নিয়ে যাওয়াটা রিস্ক। আমি বলিকি, তুমি চলো না আমাদের সাথে….’

সম্পূর্ণ কথাটা শেষ করার আগেই পাশ থেকে নেহার হাত চেপে ধরলো রোজা। আদ্রিশ কেন যাবে? ও গেলে সারাক্ষণ পিঞ্চ করে কথা বলবে, ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনেই থাকতে চায় না রোজা। নিজের স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে এতবার ‘স্যরি’ বলার পরেও যখন লোকটার রাগ কমলো না, তাহলে আর কিছুই করবে না সে৷ আগের মতোই থাকার চেষ্টা করবে রোজা। নেহার কথাটা বিবেচনায় এনেই আদ্রিশ গম্ভীর গলায় বলল, ‘ওয়েট, চেঞ্জ করে আসছি।’

বাহ! এত অল্পতেই রাজি হয়ে গেলো লোকটা? বেশিক্ষণ সাধতেও হলো না। বোনেদের নিয়ে যেন তার কত চিন্তা! চিন্তা করতে করতে শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে যাচ্ছে, আহারে! বিভৎস কিছু কথাবার্তা মনে মনে আওড়িয়ে রোজা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হচ্ছে ও না গেলেই ভালো, মেলায় গিয়ে কোনো রুপ আনন্দই করা যাবে না শুধু আদ্রিশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর গুরুগম্ভীর ভাবসাবের জন্য!

পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আকাশ। লালচে আকাশের বুকে ওড়ে বেড়াচ্ছে নীড়ে ফেরা পাখির দল। ক্লান্ত-শ্রান্ত শহরের বুকজুড়ে ব্যস্ত ভাব। পথে ধুলোর ওড়াওড়ি, মানুষে গিজগিজ করছে। ভিড়ভাট্টায় পা ফেলাও যেন দায়। টিকিট নিয়ে মেলার গেইটে ঢুকতেই রিজভীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সবাই। অফিস থেকে এসেছে যে, ওর ক্লান্ত মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। নেহা ভীষণ অবাক। রিজভী ওদেরকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এলো। কিন্তু আদ্রিশকে দেখেই চুপসে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বোকা বোকা গলায় বলল, ‘আসলে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, আপনারা এখানে?’

আদ্রিশ ফুরফুরে মেজাজে বলল, ‘এই এলাম আরকি! ভালোই হলো, নেহার সাথে কিছুটা সময় থেকে যাও।’

‘জি!’

নেহা রোজার হাত চেপে ধরে রাগে কিড়মিড় করছিলো। ফিহাকে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিলো যেন। ফিহা বিশ্বজয়ীর হাসি দিয়ে বলল, ‘নিয়ে যান ভাইয়া, আপনার হবুকে নিয়ে এদিকওদিক ঘুরে আসুন।’

আদ্রিশের সামনে কিছু বলার সুযোগই পেল না নেহা। রিজভী অসহায়ের মতো ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। অগত্যা ওর সঙ্গে নেহাকে যেতেই হলো। ওরা যেতেই ফিহা ইশাকে নিয়ে মেলার ভিড়ে ঢুকে গেল। রোজাকে সঙ্গে যেতে বললোই না। এটা করার আরেকটা কারণ আছে, ফিহা জানে আদ্রিশ রোজাকে এখনও কতটা চায়। রাগ-বিভেদ যতই করুক না কেন অভিমানের পাহাড় ভেঙে গেলে আদ্রিশ ঠিকই রোজাকে চাইবে। তাছাড়া রোজাও যে ইতোমধ্যে আদ্রিশকে পছন্দ করে সেটা তো ও স্বীকারই করবছে। মেলায় এসে দুজনকে স্পেস দেওয়ার এই সুযোগটা ও কাজে লাগাতে চাইলো। সেজন্য ইশাকে নিয়ে একপ্রকার কেটে পড়লো ওখান থেকে। ওরা চলে যাওয়ার পর রোজা অবাক হয়ে দেখলো আদ্রিশ ছাড়া ওর পাশে আর কেউ নেই। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো ওর। লোকটা আবার ওকে ফেলে চলে যাবে নাকি? তাহলে মেলার ভিড়ে ও তো হারিয়েই যাবে। ওহ গড! কেন যে এসেছিলো? জানতোই তো, যতটা উৎফুল্ল হয়ে মেলায় এসেছে, আদ্রিশ নামক ব্যাটা থাকলে সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। আদ্রিশ অপলক দৃষ্টি বিনিময়ে দেখলো ওকে। রোজার ইতস্তত ভাবটা মুহূর্তেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি এঁটে আদ্রিশ রোজাকে বলল, ‘রোবটের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমার সাথে এসো।’

বুকের ভেতর দখিনা হাওয়া বয়ে গেলো যেন।
মৃদুমন্দ হাওয়ায় একগাছি চুল ওড়ে বারবার ওর মুখের সামনে পড়ছে। রোজা কাঁপতে থাকার দরুণ ঠিক করে না পারছে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে আর না পারছে ক্লিপে আটকাতে। বিরক্তিতে ওর মুখ তেঁতো হয়ে আছে। কোন দুঃখে ও হিজাব ছাড়া এখানে এলো? মেজাজ বিগড়ে নাইনটি সিক্স হয়ে যাচ্ছে গেলো ওর। তার ওপর আদ্রিশের ‘তুমি’ করে বলা দেখে গায়ের কাঁপুনিটা যেন থামতেই চাইছে না।

‘আশ্চর্য! এভাবে কাঁপছো কেন?’

রোজা কাঁপতে কাঁপতেই বলল, ‘আমি বাসায় যেতে চাই। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমি মরে যাব।’

আদ্রিশ কপালে ভাঁজ ফেলে ওর ডানহাত ধরে ভিড় ঠেলে সামনে এগুতে এগুতেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি’ করে বলছি, কারণ তুমি আমার বয়সে ছোট। অন্য কোনো কারণ ভেবে নেওয়ার প্রয়োজন নেই মিস.রো-জা-নু। আদ্রিশ আগের মতো নেই, পালটে গেছে।’

আচানক রোজার কাঁপুনি থেমে গেল। হতভম্ব দৃষ্টিতে আদ্রিশের মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর শক্ত কন্ঠে বলল, ‘প্রথম অনুভূতি বিনিময় করেছেন, আপনি। প্রথম ভালোবাসার কথাটা ব্যক্ত করেছেন, আপনি। হুট করে এত ভালোবাসা দেখিয়ে যখন সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে সম্পর্কে তিক্ততা চলে আসে বা মন পরিবর্তন হয়, তখন সেটা আর যাইহোক, আমার মতে ভালোবাসা নয়। আপনি কোনোদিন রোজানুকে ভালোই বাসেননি মিস্টার.আদ্রিশ। আপনি আগের আদ্রিশ নেই, পালটে গেছেন অনেকটাই। তবে রোজানু ঠিক আগের মতোই আছে, ভালোবাসার সংজ্ঞাটা ওর কাছে বেশ পরিষ্কার। রোজানু কখনো পাল্টাবে না। রোজানু হুটহাট কারো প্রেমে পড়তেও জানে না। এ বিষয়টা যদি মাথায় রাখেন তাহলে খুবই ভালো হবে, ভা-ই-য়া।’

প্রেয়সীর মুখ থেকে ‘ভাইয়া’ শব্দটা যে পাথরের চেয়েও ভারী মনে হয়, আদৌ সেটা কোনো প্রেয়সী জানে? আদ্রিশ রোজার হাত ছেড়ে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই একটা মাটির তৈরি জিনিসপত্র, ফুলদানি, আর কাচের শো-পিসের দোকান ছিল। রগরগে রাগটা মাথায় চড়ে বসতেই আদ্রিশ আছাড় দিয়ে দুটো বড় ফুলদানি, আর কাচের আয়না ভেঙে তছনছ করে ফেললো। দোকানি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে চিৎকার করে ওঠলো। আদ্রিশের অদ্ভুত কান্ড দেখে রোজা মিটিমিটি হেসে সেখান থেকে চলে এলো। এসেছিলো না, রোজাকে কথা শোনাতে? পারলো কই? আদ্রিশ পাল্টাতে পারে, রোজানু কখনোই নয়।

———————————————————–

[নোট: আজকের পর্বে বর্ণনা বেশি, সেজন্য রেগে যাবেন না কেউ। সবটাই গল্পের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ও মতামত জানাবেন।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here