#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩২
আদ্রিশ যে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত এটা রোজা বুঝতে পারলেও ওর কিছু করার ছিলো না। কারণ লোকটা কাউকেই কিছু বলে না। যা ভাবার, যা করার, নিজে থেকেই সেসব করে নেয়। সেজন্য বিষয়টা নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করা নিজের মস্তিষ্ককে সামলালো সে। এদিকে দুই পরিবারের সবাই যেহেতু রাজি সেজন্য খুব শ্রীঘ্রই বিয়ের দিনক্ষণ পাকাপোক্ত করা হলো। অবশ্য বাড়ির লোকজন সবাই সেটাই চেয়েছিল। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে, তাও আবার সবার পছন্দের পাত্রীর সঙ্গে। এর থেকে আনন্দ আর খুশির কি হতে পারে! কিছুদিনের মধ্যে রোজার ভার্সিটির ক্লাসও শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়ের যেহেতু কয়েকদিন পরেই বিয়ে, সেজন্য সুলতানা স্বামীর সাথে কথা বলে ঠিক করলেন তারা রোজাকে নিয়ে গ্রামেই ফিরে যাবেন। বিয়ে পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। রোজার নিজ বাড়িতেই বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করা হবে। বাস্তবতা বুঝতে পেরে রোজারও সেটাই ঠিক বলে বোধগম্য হলো। কিন্তু বাদ সাধলো আদ্রিশ। বিয়ের যেহেতু দিন পনেরো বাকি, তো সবকিছু এখানে থেকেই করা যায়। ঝামেলাও কম হবে। কিন্তু আজিজুর সাহেব রাজি হলেন না। তিনি গ্রামের চেয়ারম্যান। আর তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে কি-না এখানে থেকে দেবেন? এটা কিছুতেই মানার মতো নয়। ধুমধাম আয়োজন করে তিনি মেয়েকে আদ্রিশের হাতে তুলে দেবেন। এখানে মেয়ের পরিবারেরও নিজস্ব চিন্তা-ইচ্ছা-স্বপ্ন আছে; সেটা ভেবেই ইনায়েত সাহেব আদ্রিশকে বোঝালেন। অগত্যা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে আদ্রিশ বিষয়টা মেনে নিলো। কিন্তু সে মোটেও রোজাকে দূরে করতে চায় নি। রোজ সকালে রোজাকে দেখেই ওর দিন শুরু হওয়াটা আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে সারাটাদিন কেমন অদ্ভুত অস্থির লাগে ওর। কিন্তু রোজাকে সে আজীবনের জন্য নিজের করে পাবে, এজন্য কিছুটা কষ্ট তো পোহাতেই হবে। এইসব বলে নিজেকে বুঝ দিলো আদ্রিশ।
কাল ভোরের ট্রেনে রোজারা গ্রামে চলে যাবে। টিকিট টাকাও ইতোমধ্যে শেষ। আদ্রিশ এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরে খবরটা শুনেই ওর মেজাজ তরতর করে বেড়ে গেলো। এত শ্রীঘ্রই যে রোজারা চলে যাবে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি সে। ঠিকঠাক করে কফিটাও খেতে পারলো না। রাতের খাবারের সময় মনের কোণে সুপ্ত একটা ইচ্ছে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে রোজার পাশের চেয়ারে ইশাকে দেখেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো ওর। কেউ কি জানে না, এখন রোজার আশেপাশে থাকা, একটুখানি সময় কাটানোর ইচ্ছে আদ্রিশের থাকতে পারে? এটা তো ওর মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সবাই কি মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো ভুলে গেল? হয়েছেটা কি সবার?
আদ্রিশের চেহারায় গৌড়বর্ণের মেঘ যেন খেলাধুলা করতে লাগলো। ইশা পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে আচমকা ওর দিকে চোখ পড়লো। ভাইয়ের মনোভাব চট করেই বুঝতে পারলো ইশা। কেউ ওদের লক্ষ্য করছে না দেখে ইশা বোকা বোকা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে অতি নিচু স্বরে বলল, ‘এ–এখানে বসবে নাকি? আমি কি পাশের চেয়ারটাতে চলে যাব? হুম? তুমি কী রেগে আছ ভাইয়া?’
আদ্রিশ নিচু স্বরে কিন্তু কর্কশ গলায় উত্তর দিল, ‘ইচ্ছে করছে খাবারের টেবিলটাই উল্টিয়ে দিই। বুঝতে পারছিস?’
ইশা হাসি বন্ধ করে বলল, ‘ওকে ওকে। আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। এক্ষুণি ওঠে যাচ্ছি। টেইক ইউর টাইম।’
বলেই ইশা সেখান থেকে ওঠে গেলো। এসব কথা রোজার কর্ণগোচর হতেই ও অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে। আদ্রিশ থমথমে চেহারা নিয়ে ওর পাশে বসতেই প্রশ্ন করল, ‘আপনার কি খানিকটা লজ্জাও নেই? কোথায়, কীভাবে ব্যবহার প্রদর্শন করতে হয় সেটার নূন্যতম জ্ঞান কি আপনার মধ্যে নেই? আচ্ছা আপনি কি বিয়ের পরেও সবার সামনে আমার সাথে এরকম ব্যবহার করবেন?’
আদ্রিশ ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘মনে হয়।’
রোজা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আই সোয়্যার, আমি আপনার সংসারই করবো না। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবো। যে আমাকে বুঝবে, যে আমাকে এমন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে না, তাঁকেই খুঁজে নেব।’
আদ্রিশ হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে? সোজাসুজি কথা বলি, সেজন্য তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? তোমার একটুও মায়া হবেনা আমার জন্য?’
রোজা দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘একদমই না। যে আমাকে সম্মান দিতে জানে না, তার জন্য আবার কীসের মায়া?’
আদ্রিশ সবার সামনে চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও নিশ্চুপ রইলো। কারণ রোজা এটা পছন্দ করবে না। সেজন্য ও ‘স্যরি’ কথাটি উচ্চারণ করে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভুলবশত টেবিলের নিচ দিয়ে রোজার পায়ে ধাক্কা লেগে গেলো। আর অসহায় ভঙ্গিতে রোজাকে দেখলো। এদিকে আদ্রিশের অসহায় ভঙ্গিমা দেখে রোজার পেট ফেটে হাসি এলো। কিন্তু মুরুব্বিদের সামনে আর হাসি দিলো না। চোখেমুখে কাঠিন্যতা এনে তীব্র দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে তাকাতেই ও থেমে গেল৷ আদ্রিশ বলল, ‘বিলিভ মি, এটা নিতান্তই এক্সিডেন্ট। আমি ইচ্ছে করে করি নি।’
‘এটা নিতান্তই দুর্ঘটনা নয়। সব আপনার ইচ্ছাকৃত কাজ। আপনি আজকাল বেশি লু-তু-পু-তু ব্যবহার করছেন।’
এটা বলেই রোজা আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আদ্রিশ আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালো। আদ্রিশ লু-তু-পু-তু কাজ করেছে? কীভাবে বলতে পারলো রোজা? এত নির্দয় ব্যবহারে আদ্রিশের মনটা যে ছাই হয়ে ধোঁয়ার ন্যায় ওড়ে যাচ্ছে এটা বুঝি বোঝে না রোজানু? আজ ওকে আগের তুলনায় ভীষণ কঠিন আর রাগী মনে হচ্ছে। এতদিন আদ্রিশ ওকে কতই না বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। আর এখন? ছোঁয়ার আগেই লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছে। কথার মারপ্যাঁচে ফেলে ওকে নাস্তানাবুদ করেছে। লোকে বোধহয় ঠিকই বলে, বউয়ের সামনে অধিকাংশ লোকই নেংটি ইঁদুর। মাঝেমধ্যে বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ করা ছাড়া ওদের আর কাজ নেই। শেয়ালের মতো চালাকি করলে ঘোড়ার পায়ের লাথি খেতে হয়! মেয়ে মানুষ এত নির্দয় হয় রোজাকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না আদ্রিশ। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। আদ্রিশ যেহেতু সবার পরে খেতে বসেছে তাই টেবিলে সে একাই রয়ে গেলো। ইশারা করে রোজাকে একটু অপেক্ষা করতে বললে রোজা ওকে পাত্তাই দিলো না৷ রোজার এ ব্যবহারে আদ্রিশ আর খেলোই না। ওঠে হনহন করে চলে গেলো। নিশিতা পেছন থেকে ডাকলেও আদ্রিশ শুনলোই না।
যেহেতু ভোরের ট্রেনেই সুলতানারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, তাই খুব তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লেন তিনি। রোজাকেও ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। কিন্তু ডাইনিংয়ের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়তেই রোজা আর হাসি চাপতে পারলো না। কীভাবে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে আদ্রিশকে ভাবতেই নিজেকে সুখী সুখী লাগছে। কিন্তু ভোরে যাওয়ার সময় যদি দেখা না হয় এই ভেবেই সে আদ্রিশের ফোনে একটা ম্যাসেজ লিখলো, ‘ভোরে বাড়ি যাচ্ছি। আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলাম বলেই জানালাম। শুভ রাত্রি।’
ফোনে বিরক্তিকর “টুং” শব্দটা হতেই আছাড় দিতে ইচ্ছে করলো আদ্রিশের। কিন্তু অনেকদিন পর স্ক্রিনে রোজার নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে দেখে তাড়াতাড়ি সেটা “সিন” করে লেখাটা পড়লো। তারপর তড়িঘড়ি করে টাইপ করে লিখলো, “সাবধানে থেকো৷ আর এখন একটু দেখা করবে প্লিজ। আমি সকালে দেরিতে ওঠি, যদি দেখা না পাই।”
ওপাশ থেকে রোজা উত্তর দিল, “কেন?”
____“প্লিজ, ভালোবাসি।”
অগত্যা রোজা নেহার ঘরের বারান্দায় এলো। আদ্রিশকেও ওর ঘরের বারান্দায় আসতে বললো। দু’জন দু’জনকে দেখলো। আদ্রিশ রেগে গিয়ে বলল, ‘এটা কি ধরনের দেখা করা?’
রোজা হাসি আটকে বলল, ‘কাছ থেকেও দূরে। না ছুঁয়ে দেখা করা।’
আদ্রিশ রেগে বলল, ‘তুমি এভাবে মিন করছো কেন? আমি কি সবসময় তোমায় ছুঁই নাকি? একবার রাগের মাথায় ভুল করে… ‘
রোজা ওকে থামিয়ে দিয়ে অসমাপ্ত বাক্যটা পূর্ণ করল, ‘গভীরভাবে ছুঁয়েছিলেন।’
আদ্রিশের রাগের পারদ হুট করেই নেমে গেলো। অদ্ভুত এক ঘোরে থেকেই বলল, ‘আরেকবার ছুঁই? দূর থেকে?’
রোজা অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে?’.
‘এভাবে।’
বলেই আদ্রিশ বাতাসে চুমু এঁকে দিলো। ওর কান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রোজা দাঁড়িয়ে রইলো। ও অনুভব করলো বাতাসটা যেন মুহূর্তেই ওর গাল ছুঁয়ে গেলো। লজ্জা পেলো সে। রাত্রির নিঃস্তব্ধতার ঘনঘটায়, কালচে মেঘের ছুটে চলা দেখতে দেখতে দু’জনে বারান্দায় কাটিয়ে দেয় অনেকটা সময়। মাঝরাতে বৃষ্টি নামে, ঘুমের ঘোরে দু’জনেই দু’জনকে অনুভব করে। কিন্তু কেউই জানতে পারে না কারোর মনের খবর৷
—————————————————————————
[নোট: দেরি এবং ছোট হওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আর মতামত জানাবেন।]
চলবে…