#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৬
রাফির করা ঘৃণিত এ কান্ডে গ্রামের লোকেরা বেশ ক্ষেপে গেলো। জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজে রাফি আর ওর সাথীদের বের করা হলো। তারপর সবাই মিলে একচোট মারধর করে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ইভটিজিংসহ আরও নানা অভিযোগ ছিলো ওর বিরুদ্ধে। সবশেষে চেয়ারম্যান বাড়ির বিয়েতে ওর করা অসভ্য কর্মকান্ডটাই যেন ওর জীবনের কাল হলো। আর ইমাদকে ফার্স্ট এইড দেওয়া হলো, বেচারার মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গেছে। ওর ক্যামেরাটাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাইহোক, এসব ঘটনার ইতি টানা শেষে নির্বিঘ্নে বিয়ের বাকি নিয়মনীতি অনুসরণ করা হলো। এরপর এলো কনে বিদায়ের পালা। রোজাদের গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসতে স্বাভাবিকের চেয়ে আরও কয়েক ঘন্টা লেগে গেল যানজটের কারণে। তার মধ্যে কান্নাকাটি করা ও সারাদিনে পেটে কিছু না পড়ায় গাড়িতেই রোজার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেলো, দু’তিনবার বমিটমিও করলো। পুরো সময়টাতে আদ্রিশ বেদনার্থ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রোজার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো, ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো। কিন্তু মারামারির ঘটনাটার জন্য রোজা বেশ বিরক্ত ছিল ওর ওপর। কেন আদ্রিশ এসব ঝামেলায় জড়াতে গেল? অন্য লোকেরা তো ছিল, তাহলে ওকেই কেন বিয়ে করতে এসে বখাটের গায়ে হাত তুলতে হবে? মহা ধুরন্ধর আর রাগী এই পুরুষটির এই দিকটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না রোজা। ওদিকে, আদ্রিশের করুণ চেহারা দেখে ফিহাও গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রোজাকে অসহ্য লাগছিলো ওর। কিন্তু ও অসুস্থ বলে দিরুক্তি করলো না, নিজেই ওকে সামলানোর চেষ্টা করলো। আর ওদের তিনজনের কান্ড দেখে পেছনের সিটে বসা উৎস আর ইশা মিটিমিটি করে হাসতে লাগলো। হাসির শব্দ শুনে ফিহা জ্বলন্ত চোখে তাকালো। একটা ধমক দিয়ে ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে ক্ষোভ নিয়ে বলে, ‘তোদের সমস্যা কী ভাইয়া? একজন অসুস্থ মানবীকে সেবা করা কী অপরাধ? তোরা যেভাবে চোরের মতো হাসছিস আমার কিন্তু এটাই মনে হচ্ছে। প্লিজ স্টপ।’
এবার উৎস হাসি থামিয়ে ধীর গলায় বলল, ‘হাসি আসলে কি সেটা চেপে রাখা যায়? তুই পারবি? তোদের তিনজনই হচ্ছিস অদ্ভুত চরিত্র। ভাইয়ের ওপর রোজার না যতটা দরদ, তারচেয়ে বেশি দরদ উতলে ওঠছে তোর।’
ফিহা আবারও রাগ নিয়ে তাকালো। একহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে কটমট করে বলল, ‘কারণ ভাইটা আমার।’
উৎস কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘তাই নাকি? আর আমি তোর কেউ না? রোজাও তোর কেউ না? নিজের একটা ভাই থাকতে এমন দুশমনি কথাবার্তা কেমনে বলিস তুই? এমন বিভীষণের মতো আচরণ তোকে মানায় না।’
ফিহা উত্তরে কিছু বলার আগেই আদ্রিশ থমথমে গলায় বলল, ‘তোরা যদি চুপ থাকতে না পারিস তাহলে এক্ষুনি গাড়ি থেকে নেমে যা।প্যানপ্যান করে মাথা খাচ্ছিস, ইডিয়ট কোথাকার!’
আদ্রিশের ধমক শুনে সবাই চুপ করে গেলো। ফিহা বিশ্বজয়ীর হাসি হাসলো। রোজা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে বসে ওদের কথোপকথন শুনলেও ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করলো না। আদ্রিশদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে গেল। রোজাকে বরণ করলো আদ্রিশের মা মিতালি। একমাত্র ছেলের বউ পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি। সব রিচুয়ালস পালন শেষ করতে করতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। এরপর রোজাকে আদ্রিশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঠিক তখনই সকল রাগটাগ কর্পূরের মতো উবে গিয়ে লজ্জায় সিক্ত হয়ে ওঠলো রোজার মুখখানি। নেহা-ফিহা, ইশা ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে একসময় ওকে একা বসিয়ে বিদায় নিলো। আর ইনায়েত সাহেব আদ্রিশের সাথে লিভিংরুমে বসে দরকারি কথা বলছিলো। সবাই যাওয়ার পর দরজার কপাটটা হালকা চাপিয়ে ফ্রেশ হয়ে সালোয়ার-কামিজ পরে নিলো রোজা। সারাদিনের ক্লান্তিতে দু-চোখ ঘুমে বুজে আসায় ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো ও। মিনিট দশেকের ভেতর পুরোপুরি ঘুমে মগ্ন হয়ে গেলো। নির্জন ঘরটিতে ভেসে বেড়াচ্ছিলো রোজার গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।
ইনায়েত সাহেবের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে দোতলা’য় নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো আদ্রিশ। নেহা-ফিহা-ইশা আর উৎস ডাইনিংয়ে বসে গল্প করছিলো। তখনই পেছন থেকে উৎস আদ্রিশকে বলল, ‘জীবনের প্রথম বাসররাত পালন করতে যাচ্ছো, এটা নিয়ে তোমার অনুভূতি কী ভাই?’
আদ্রিশ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘তোকে বলতে হবে? ছোট ছোট’র মতো থাক। বেশি কথা বললে কানের নিচে একটা দিয়ে সোজা করে দেব।’
‘সে তুমি যা-ই বলো না কেন, ঘরে ঢোকার আগে আমাদের ফি’টা দিয়ে গেলেই চলবে।’
আদ্রিশ অবাক হয়ে বলল, ‘ফি’ মানে? কীসের ফি?’
‘বাসরঘরে ঢোকার ফি’।’
আদ্রিশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘আমার ঘরে আমি ঢুকবো, তোদের কেন টাকা দেব? কী করেছিস তোরা আমার জন্য? না প্রেম করতে কোনো হেল্প করেছিস, না বিয়ে করতে হেল্প করেছিস। উপরন্তু তুই সবসময় রোজার সাইড নিয়ে আমার প্রেমের বারোটা বাজিয়েছিস। নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকলে বেহায়ার মতো টাকা চাইতি না তুই উৎস।’
উৎস বিরস চোখে তাকিয়ে বলে, ‘রোজার সব খোঁজখবর আমি দিইনি তোমায়? এটা কীভাবে অস্বীকার করতে পারো তুমি? এই তার প্রতিদান? মাই গড!’
আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে বলে, ‘আমি তো সেসব অস্বীকার করি নি। কিন্তু ওর খবর দেওয়ার আগে তুই যেভাবে আমার সঙ্গে ভাব দেখাতি, তাই আজ তোর প্রাপ্তির খাতাটা থাকবে শূন্য, জাস্ট শূন্য।’
বলেই আদ্রিশ গটগটিয়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেল। উৎস বিরস মুখ বসে রইলো। আর বাকি তিনজনের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠলো। খ্যাটখ্যাটে আদ্রিশের, গম্ভীর-শান্ত রোজা। দু’জন একসাথে কীভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো সামলায় এটাই এবার দেখার বিষয়।
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। প্রকৃতিতে বিরাজমান ঠান্ডা হাওয়া আর ধোঁয়াটে কুয়াশার জাল। একফালি চাঁদের টুকরো রাতটাকে আরও মোহনীয় করে তুলছে। আদ্রিশ যখন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো, দেখলো বাতি নিভানো। খানিকটা চমকিত হয়ে ও দেখলো বেড সাইডের ল্যাম্প থেকে মৃদু হলদেটে আলো জ্বলছে। ও ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো বিছানায় রোজা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর পড়ে আছে। কাপড়টা একটু সরে যাওয়ায় ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। আদ্রিশের চোখে ঘোর লেগে এলো। ওর মনে হলো, ঘরে আলো থাকলে মুহূর্তটা এতো মায়াবী মনে হতো না। এ যেন স্বর্গসুখের মতো অনুভূতি! ভাবনার প্রহর থেকে বেরিয়ে আদ্রিশ চাপা নিঃশ্বাস ফেললো। চোখ তুলে রোজাকে পরখ করে দেখলো রোজা ঘুমিয়ে আছে। তাতে আপনাআপনিই ওর ভ্রু কুঁচকে এলো। ধীরপায়ে হেঁটে কাউচের ওপর বসে ভাবলো, বিয়ে বাড়ির মারামারির ঘটনার জন্য রোজা ওর ওপর এখনো রাগ করে আছে মনে হয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় ইস্তফা দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। রোজাকে ঠিকঠাকমতো শুইয়ে দিতে গিয়ে দেখলো ওর গা হালকা একটু গরম হয়ে আছে। আদ্রিশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। বাড়ির সবাই মাত্র ঘুমিয়েছে, তাদেরকে বিরক্ত করতে ওর ইচ্ছে করলো না। রোজার ঘুমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য ব্যলকনিতে এসে খুব পরিচিত একজন ডাক্তারকে ফোন করে বিষয়টা জানালো এবং সেইমতো জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দিলো রোজাকে। কপালে রুমাল ভিজিয়ে জ্বর নামানোর প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে নিলেও দুর্বল রোজা বেশিকিছু টের পেলো না। আদ্রিশের টি-শার্টের কোণা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো আর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে চাইলে আদ্রিশ কান পাতলো। ও শুনতে পেলো রোজা বলছে, ‘আপনি, এখানে? সত্যিই? ভালোবাসেন তো, বলেছিলেন না? বসে থাকুন। যাবেন না কোথাও। আমি স্বপ্ন দেখছি; সেটা ভাঙতে চাই না।’
অস্পষ্ট গলায় এসব বলেই আবারও ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়লো রোজা। আর এসব শুনে আদ্রিশ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দূরে সরে গেল। বুকের বাঁ-পাশে হাত রেখে হার্টবিটের কাঁপুনি অনুভব করে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আদ্রিশ। অতঃপর মূল বিষয়টা বুঝতে পেরে নিঃশব্দে হেসে আবারও রোজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে গাঢ়ভাবে একটা চু-মু খেলো। তারপর গায়ের ওপর কম্বল টেনে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। সারাক্ষণ হম্বিতম্বি ভাব নিয়ে থাকা মেয়েটাও যে ঘুমের ঘোরে এভাবে কথা বলতে পারে ভেবেই নিজেকে সুখী সুখী মনে হলো ওর। নিজের প্রিয় মানবীটাকে বুকে জড়িয়ে চাঁদ দেখা, এই মুহূর্তটাই বাসররাতের সবচেয়ে সুন্দর উপহার বলে মনে হলো আদ্রিশের।
—————————————————————————-
[নোট: যেহেতু গল্পে আর কোনো রহস্য অবশিষ্ট নেই, সেহেতু এগুলো শুধুমাত্র এক্সটা পর্ব হিসেবে পড়ে নিন।
আর অবশ্যই ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আর মতামত জানাবেন আশা করি। প্রচন্ড বৃষ্টিতে লোডশেডিং ও নেটওয়ার্ক গতি কম থাকায় আজ তাড়াতাড়ি আপলোড করে দিলাম।]
চলবে…