#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
সন্ধ্যে নেমে গেছে অনেক আগেই। খাতায় ছক কেটে খেলাটা বেশ জমে ওঠেছে। যার যার নামের পাশে তাঁদের পয়েন্ট বসানো হচ্ছে। সর্বশেষে যোগ করে দেখা হবে মোট পয়েন্ট। তার ওপর নির্ধারিত হবে বিজয়ী। সবাই খেলাটা বুঝলেও রোজা কিছুতেই এই অদ্ভুত খেলার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। বাড়িতে আগে কত চোর-পুলিশ খেলেছে, কই এমন তো হয় নি। যদিও এই খেলার সাথে ওটার কোনো মিল নেই। তবে এখানে রাজা-প্রজার একটা ব্যাপার আছে। উৎস টোকেন চাল দিচ্ছে। সবার সামনে রোজাও গোমড়া মুখে বারবার টোকেন ওঠাতে লাগলো। রোজা ছাড়া ওদের বাকি সবারই একবার না একবার রাজা-রানী-মন্ত্রী-সেনাপতি-উজির ওঠছে। সবচেয়ে কম পয়েন্ট প্রজাতে। রোজার বারবার এটাই উঠছে। ফলে ওর দখলে সবার চেয়ে কম পয়েন্ট। মনে মনে ভয়ানক রাগ হচ্ছে আদ্রিশের ওপর। কারণ সবার আগেই সে টোকেন দখল করে নেয়, আর রোজা সবার পরে। এই নিয়ে নয়বার আদ্রিশ রাজা হলো। আর একবার ওঠলেই সে উইনার। খেলার নিয়মানুযায়ী যে হারবে তাকে শাস্তি পেতে হবে উইনারের ইচ্ছানুযায়ী। সেক্ষেত্রে রোজাকেই পানিশমেন্ট পেতে হবে। আর এটা ও কিছুতেই চায় না।
লাস্টবার চাল দিলো ইশা। খপ করে আদ্রিশ একটা টোকেন তুলে নিল, পানিশমেন্ট থেকে বাঁচার জন্য রোজাও তড়িঘড়ি করে একটা কাগজ তুললো। কিন্তু ফলাফল ‘শূন্য।’ বরাবরের মতো আদ্রিশ রাজা আর সে প্রজা হলো। সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট নিয়ে এগিয়ে গেল আদ্রিশ, হেরে গেল রোজা। সবাই যখন হইহই করে খেলা উপভোগ করছিল রাগে-ক্ষোভে রোজার গা জ্বলে যাচ্ছিল। উল্লাসে মেতে ওঠা সবাইকে ওর শত্রু বলে মনে হচ্ছিলো। রোজা চোখ নামিয়ে চুপ করে বসে রইল। আদ্রিশ সবাইকে চুপ থাকতে বলে রোজার উদ্দেশ্যে বলে ওঠল, ‘খেলায় তুমি হেরেছ, আমি জিতেছি। সো এখন আমি যা পানিশমেন্ট দেব তা-ই মানতে হবে তোমাকে।’
অনেকক্ষণ মৌন থাকার পর রোজা মাথা তুললো। নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ক কী পানিশমেন্ট?’
আদ্রিশ চিন্তাভাবনা করলো কী শাস্তি দেওয়া যায়। তেমনকিছু না পেয়ে বলল, ‘আমার খুব পছন্দের একটি খাবার রান্না করে খাওয়াতে হবে তোমাকে।’
‘কী রান্না?’
‘কাচ্চি বিরিয়ানি।’
রোজা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বিরিয়ানি রান্না করতে জানি না।’
‘সিরিয়াসলি?’
‘জি।’
‘খেতে পারো?’
রোজা অপমানিত বোধ করলো আবারও। ইশা রোজার অবস্থা দেখে হাসছে। রোজার দিকে একপলক তাকিয়ে আদ্রিশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মেয়ে, আমার দিকে তাকাও। চোখ নামিয়ে বসে আছ কেন?’
আড়ষ্ট হয়ে রোজা বলল, ‘কই না তো!’
ইশা এবার বলে উঠলো, ‘এখানে বসে থাকা সবাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বুঝেছ? তুমি কী ভাইয়াকে ভয় পাও নাকি?’
রোজা চুপ থাকলো। প্রতিউত্তর দেওয়ার আগেই ইশা আবার বলল, ‘তুমি এত ভীতু কেন? ভাইয়াকে এত ভয় পাওয়ার তো কিছু হয়নি। আসার পর থেকে তোমাকে লক্ষ্য করছি, তুমি চুপটি করে বসে আছো!’
ফিহা গলার স্বরটা নামিয়ে বলল, ‘আমাদের রোজা এমনই রে। ভীতুর ডিম একটা।’
রোজা দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো ফিহার দিকে। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে গলার স্বর নরম করে ফিহাকে বলল, ‘আমি ভীতু না।’
নেহা-ফিহা-উৎস ওর এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেলল। ইশা কন্ঠে নম্রতা এনে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বলতে চাইছো তুমি সাহসী? এনি প্রুফ?’
ইশার মজার ছলে বলা কথাটা সবাই ধরতে পারলেও রোজা সিরিয়াসলি নিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘নো।’
উৎস ছাড়া বাকি সবাই আরো একদফা হেসে ফেলল। আদ্রিশ বিরক্ত হয়ে ধমক দিল ওদের। মেয়েদের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা ওর ভালো লাগে না। হাসাহাসির ব্যাপারটা শেষ হতেই আদ্রিশ শাস্তি হিসেবে রোজাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যই বললো। ওদিকে রোজা মুখ গুঁজে আছে। পারবে না বলে রাজি হচ্ছে না, আবার মুখ ফুটে কিছু বলছেও না দেখে ইশা বিরক্তই হলো। একপর্যায়ে বলল, ‘থাক ভাইয়া, ওকে অন্যকিছু দাও। শেষে দেখা যাবে হাত-পা পুড়িয়ে কয়লা হয়ে বসে আছে। হাজার হোক, বাড়ির গেস্ট বলে কথা।’
ইশার কথা যুক্তিসম্মতই মনে হলো সবার। বিচারবিবেচনা করে অবশেষে মত পরিবর্তন হলো আদ্রিশের। হাত-পা পুড়িয়ে ফেলার কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন চমকে ওঠেছে। কারণটাও অজানা। হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা ওকে অকারণেই ভয় পায়। তখনি ওর মাথায় কুটিল বুদ্ধি এলো। এটা নিয়েই কিছু একটা শাস্তি দিলে মন্দ হবেনা। আদ্রিশ ধীর কন্ঠে বলল, ‘সেকেন্ড এন্ড লাস্ট, রাত বারোটায় একা ছাদে যেতে হবে। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে তুমি সাহসী। ওকে? আর এটা যদি না পারো, তাহলে রান্নাটাই করতে হবে। কোনোটাই না করলে এর থেকে ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে। আফটার অল আমি বলেছি, কোনো প্রকার কথার নড়চড় হলে তোমায় দেখে নেব…’
বিরিয়ানি রান্নার চেয়ে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করাটাই বেশি সহজ বলে বোধ হলো রোজার। সেজন্য তাড়াতাড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘জি, রাজি আমি রাজি।’
আদ্রিশ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বলে, ‘ভেরি গুড।’
এরপর ওদের আড্ডা ভেঙ্গে গেল। যে যার মতো ঘরে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে সন্ধ্যের নাস্তা করার জন্য মিনিট বিশেক পর আবারও জমায়েত হলো টিভির আসরে। উৎস, রোজা, নেহা-ফিহা, ইশা ওদের মনোযোগ টেলিভিশনে। তখন অফিস থেকে ফিরলেন ইনায়াত সাহেব, ইমতিয়াজ সাহেব। কাপড়চোপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে এসে জড়ো হলেন দুই ভাই। ওদেরকে বসার জায়গা করে দিল উৎস। নিজে ওঠে গিয়ে কার্পেটে পা মুড়িয়ে বসে পড়ল। তারপর ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘বড়চাচী, আব্বুরা এসেছে। নাস্তা দিয়ে যাও।’
ইমতিয়াজ সাহেব বললেন, ‘ভাবীকে ডাকছিস কেন? তুই গিয়ে নিয়ে আয়।’
‘আমি?’
‘কেন? কী সমস্যা?’
উৎস অস্ফুটস্বরে বলল, ‘যাচ্ছি।’
বাবার ধমক শুনে উৎস ওঠে যেতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই মিতালি ট্রে’ নিয়ে ঢুকলো। পেছনে আরেকটা ট্রে’তে করে দু-প্রকারের বিস্কিট, মিষ্টি, আর পাস্তা সাজিয়ে নিয়ে এলেন নিশিতা। সবার হাতে হাতে প্লেট তুলে দিলেন তিনি। সবাইকে দেওয়া শেষ করে মিতালি রোজার কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি মিষ্টি পছন্দ করো না? নিশিতার কাছ থেকে জানলাম তুমি ভীষণ ঝাল পছন্দ করো?’
‘জি।’
‘আমিও খুব ঝাল পছন্দ করি। এ বাড়ির কেউ-ই তেমন ঝাল খায় না। ওদের জন্য তরকারিতেও ঝাল দিতে পারি না। তাই নিজের হাতে তোমার জন্য একটু ঝাল করে হালিম রান্না করেছি আমি। খাবে তো?’
রোজা মিতালির দিকে তাকালো। কী সুন্দর মিষ্টি করে কথা বলছে ওর সঙ্গে। আর এই মহিলাটির ছেলেই কি-না ওই আদ্রিশ! কত তফাৎ মা-ছেলের মধ্যে। নিশতা যতটুকু খেয়াল রাখছে রোজার প্রতি, তারচেয়ে কোনো অংশেই কম খোঁজ নিচ্ছেন না তিনি। শ্রদ্ধায় ভরে ওঠলো রোজার মন। হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মিতালির কথায়। কেন যেন না কথাটি বলতে পারেনি সে। মন্থর কন্ঠে সে বলল, ‘খাবো।’
মিতালি হেসে বলল, ‘খুব ভালো মেয়ে তুমি রোজা। আমাকে তুমি চাচী ডেকো, নেহাদের মতো।’
রোজা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা চাচী।’
মিতালি রান্নাঘরে গিয়ে হালিমের বাটি নিয়ে এলো। ঝাল হালিমের সুগন্ধ হাওয়ায় ভাসছে। রোজা খুব তৃপ্তি নিয়েই সেটা খেতে লাগল। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো ইশা। মিতালি আর রোজার কথাটুকুও সে শুনেছে৷ পুরো ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে পাশে বসা ফিহাকে নিচুস্বরে বলল, ‘তোমার বোন আর বড় মামানীর মাঝে কী কেমিস্ট্রি দেখেছো? ঘটনা কী?’
ফিহা গালে হাত রেখে সন্দেহী কন্ঠে বলল, ‘আমিও তাই ভাবছি!’
‘তোমার বোনটা কিন্তু অনেক মিষ্টি।’
ধোঁয়া ওঠা কফির মগে ছোট চুমুক দিয়ে ইশার পানে তাকালো ফিহা। উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে কী বুঝাতে চাইছিস?’
ইশা রহস্যময়ী হাসি হেসে বলে, ‘তুমি যা ভাবছো তাই!’
‘আমি কী ভাবছি?’
‘ভাইয়া রোজার প্রতি একটু ডেস্পারেট, মনে হয় না তোমার?’
‘উৎস ভাইয়া?’
ইশা চোখ বড় বড় করে তাকালো। দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে অবসন্ন কন্ঠে বলল, ‘আদ্রিশ ভাইয়া।’
ফিহা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো, ‘বলিস কি! তুই এতকিছু কেমনে জানিস? ইশা…’
ইশা চোখ টিপে হাসলো, ‘পর্যবেক্ষণ, লাস্ট কয়েকটা ঘন্টা গভীর পর্যবেক্ষণের সহিত এটাই বুঝতে পারলাম আদ্রিশ ভাইয়া রোজার প্রতি একটু ডেস্পারেট।’
‘কেমনে কি বইন? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। দু’দিনও হয়নি ভাইয়া আর রোজার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। আমরাই কিছু ধরতে পারলাম না আর তুই কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলি এসব?’
‘হু গেলাম।’
ফিহা এদিকওদিক দেখে নিয়ে বলল, ‘ক্লিয়ার করে বলতো!’
ইশা হাতের মগটা রেখে দিল। তারপর গলা নামিয়ে বলতে লাগল, ‘তুমিই বলো, ভাইয়া কোনোদিন খেলতে রাজি হয়েছে আমাদের সাথে? আজ ওকে জোর করতে হলো না, একবার বলাতেই এমনভাবে রাজি হয়ে গেল যেন রোজা খেলছে বলেই সে খেলতে রাজি হয়ে গেল। খেলার সময়ও আমি লক্ষ্য করেছি ভাইয়ার চাহনি, অন্যরকম মুগ্ধতা দেখেছি রোজার জন্য! নয়তো ভাবোই না, অন্য কারোর রান্না সে কোনোদিন খেতে চায়? ছোট মামানির হাতের রান্নাই তো খায়না, সেখানে রোজার? পরে কী সহজ ডেয়ার দিয়েছে দেখলে তো?’
ফিহা চিন্তিতমুখে বলল, ‘এর মানে কি এটাই যে, ভাইয়া রোজার জন্য কিছু অনুভব করে?’
‘এক্সাক্টলি এটাই বুঝাতে চেয়েছি তোমায়।’
‘বুঝতে পেরেছি!’
Group – Israt’s Typescripts এ যোগদান করে মূল্যবান মন্তব্য জানাতে পারেন।
[নোট: মতামত কী আপনাদের? ভালো না মন্দ লাগছে পড়তে? কোন দিকটা একটু ফুটিয়ে তোলা দরকার বলে মনে হয়? একটু ধরিয়ে দিলে উপকার হয়। কোন জায়গায় মিস্টেক ঠিক খেয়াল হচ্ছেনা।]
[বি দ্র: গল্প ঠিক কত পর্বের মধ্যে শেষ হলে পড়তে আরামবোধ করেন?]
চলবে…