#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯
কিন্তু রান্নাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেমনকিছুই হাতের কাছে পেলো না রোজা। একবার ভাবলো মিতালি বা নিশিতাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করবে কোথায় কি আছে। কিন্তু তাঁরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে বিধায় ওদের ডিস্টার্ব করতে মন সায় দিলো না। অগত্যা পানির গ্লাসটা নিয়েই ছাদের দিকে রওনা হলো রোজা। একধাপ সিঁড়ি পেরুয় আর একধাপ নামে, ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে জমে গেলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। ছাদে গিয়ে দেখল, আদ্রিশ চেয়ারে হেলান দিয়ে গোল টেবিলের ওপর পা-জোড়া তুলে চোখ মুদিত করে বসে আছে। সাদা শার্টটার বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা। আর কোলের ওপর অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে ওর কালো কোর্টটা। পারফিউমের কড়া সুবাসে ভাসছে চারপাশ, তার সাথে বাগানের ফুলের সুগন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। আদ্রিশের চেহারায় ক্লান্ত ভাব, চুলগুলো হালকা বাতাসে কপালের ওপর ওড়াওড়ি করছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে মাত্র ছুটি পেয়ে নিজেকে যেন প্রকৃতির কাছে সঁপে দিয়েছে! ভীষণ আদুরে দেখাচ্ছিল তখন আদ্রিশকে। রোজা ওর এই অবস্থা দেখে কী করবে বুঝে ওঠতে পারলো না। ওকে ডাকবে না-কি ডাকবে না এ দ্বিধাদ্বন্দ নিয়েই চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল গ্লাস হাতে। লোকটা কি বেশিই ক্লান্ত? তার ওপর অফিস থেকে ফিরেই গরম চা খেয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলল! দ্বিধা ভুলে একসময় মানবিক বিবেচনায় রোজা নিজেই এগিয়ে গেল। ইতস্তত করে ডাকলো, ‘শুনছেন? এই যে?’
আদ্রিশ শুনলো না, চোখ খুলে তাকালোও না। রোজা গলায় জোর এনে বিরস মুখে আবার ডাকলো, ‘এইযে? শুনতে পাচ্ছেন? আহা, উঠুন না!’
মিষ্টি কন্ঠস্বরের ডাকটি যেন তীরের মতো বক্ষপিঞ্জরে আঘাত হানলো। রোবটের মতো চোখ খুলে তাকালো আদ্রিশ। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়া নারী মূর্তিটি ওকে দেখে চমকে দু’পা পিছিয়ে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গ্লাস হাতে। আদ্রিশ পা নামিয়ে বসলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এভাবে কে ডাকছিল?’
রোজা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি।’
‘কেন?’
‘আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
‘চোখটা লেগে গিয়েছিল। কিন্তু তুমি এভাবে ডাকছিলে কেন?’
রোজা পানির গ্লাসটা দেখিয়ে জবাবে বলল, ‘আপনি না পানি খেতে চেয়েছিলেন? মিষ্টি কিছু পাই নি নিয়ে আসার জন্য। তাই শুধুই পানি এনেছি।’
আদ্রিশ গ্লাসটি হাতে নিয়ে বসে রইলো কিয়ৎক্ষণ। হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, ‘মিষ্টি কিছুর দরকার নেই তা তো আগেই বলেছি। বাই দ্যা ওয়ে, বিশ মিনিট লাগে একগ্লাস পানি আনতে?’
রোজা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘নাহ!’
আদ্রিশ চড়া গলায় বলে ওঠে, ‘তাহলে এত দেরি কেন? নাকি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছিলে?’
রোজা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘তা কেন হবে?’
আদ্রিশ পানির গ্লাসে চুমুক বসাতে বসাতে বলল, ‘তুমি তো ডেঞ্জারাস মেয়ে। পারতপক্ষে আমার সামনে পড়তে চাও না। ভীষণ ইন্টিলিজেন্ট গার্ল।’
রোজা থতমত খেয়ে বলল, ‘এরকম বলছেন কেন?’
আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘একমাস! আমার সামনে এসেছ তুমি? পালিয়ে বেড়িয়েছো সারাক্ষণ। কি ভেবেছো, আমি কিছু বুঝতে পারি না? আমাকে তোমার বোকা মনে হয় মিস.রোজা?’
ধরা পড়ে যাওয়ায় রোজা দৃষ্টি অবনত করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর উত্তর কি দেবে জানা নেই। পরক্ষনেই আদ্রিশের ওপর রাগ হলো, হলো নিজের ওপরও। কেন যেচে পড়ে ওর জন্য পানি আনতে গিয়েছিল? এই আদিক্ষেতাটা না দেখালে লোকটার সামনে এত এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না। বিব্রতকর পরিস্থিতি যেন সবসময় ওর জন্যই তৈরি হয়ে বসে থাকে। রোজা ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করল, ‘আমি কোথা থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি? সারাক্ষণ তো বাসা নয়তো ভার্সিটিতেই থাকি!’
আদ্রিশ ভরাট কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছো। না জানার ভান করছো কেন? এই জিনিসটা কিন্তু আমি ভীষণ অপছন্দ করি।’
‘ইয়ে মানে..’
আদ্রিশ অপ্রতিভ কন্ঠে আদেশসূচক শব্দব্যয় করল, ‘নিজেকে বেশি চালাক ভেবো না! এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসার জায়গা কি সব আমার দখলে? কি প্রমাণ করতে চাও আমি নির্দয়? তোমাকে দাঁড় করিয়ে আমি আরামে বসে আছি? বদনাম করতে চাও আমাদের নামে? বসো এখানে, কথা আছে!’
রোজা বাক্যহারা হয়ে গেল। লোকটার উল্টাপাল্টা কথাবার্তার দরুন ওর হার্টবিট রকেটের গতিতে ছুটছে। আবার কি বলতে চায়? আচ্ছা, আদ্রিশ কী ওর হার্টবিট করার জোরালো শব্দ শুনতে পাচ্ছে? ওফ..ভয়ে হার্ট-টা বুঝি বেরিয়েই এলো। আদ্রিশের রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে না-সূচক কিছু বলার সাহস করলো না রোজা। বাড়িতে ঘুমন্ত দু’জন মানবী ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই যে এই লোকটার হাত থেকে ওকে বাঁচাবে। আজ আদ্রিশের হাত থেকে আর রক্ষা নেই সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে রোজা। এতদিন পালিয়ে বেড়ানোর কড়ায় গন্ডায় হিসাব আদায় করে নেবে যেন। ওকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিশ তীব্র কন্ঠে ধমকে ওঠতেই রোজা অন্য আরেকটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কোনো বদনাম করতে চাই না।’
আদ্রিশ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখো। নেহা-ফিহা-উৎস এবং ওর ফ্রেন্ডসার্কেলের সব ফ্রেন্ড, ওদের সঙ্গে তো ঠিকই হেসেখেলে কাটিয়ে দিচ্ছো। শুধু আমার বেলাতেই অন্যরকম বিহেভিয়ার! কিন্তু কেন? আমি কী বাঘ? নাকি ভাল্লুক?’
রোজা বলার চেষ্টা করল, ‘আমি সবার সঙ্গেই মেশার চেষ্টা করি।’
আদ্রিশ তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘সিরিয়াসলি? এতবড় একটা বাড়িতে কী আমি থাকি না? সকালের চা, বিকেলের স্ন্যাকস’টা, রাতের ব্ল্যাক কফিটা তুমি নিজের হাতে তৈরি করো। কারণ তোমার ভালো লাগে। মা-বাবা, ছোটা চাচা-চাচী, উৎস, নেহা-ফিহা সবার ঘরে ঘরেই সেসব পৌঁছে যায়। কিন্তু এই একমাসের কোনো একদিন তো মনে পড়ে না, সেসবের ভাগ আমি পেয়েছি! এই অধমকে কি তোমার চোখে পড়ে না?’
আদ্রিশের রাগী স্বরে বলা কথাগুলো শুনে রোজার কাশি ওঠে গেল। সবকিছু যেন ডায়েরিতে নোট করে রেখেছে ও। কখন কি করছে না করছে এসব আদ্রিশ কীভাবে জানলো? ও তো বাড়িতেই থাকে না। রাতের বেলা আদ্রিশ যখন বাড়ি ফিরে তখন বাড়ির অর্ধেক লোক-ই ঘুমে বিভোর থাকে। তাহলে? রোজাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় কাশতে দেখে আদ্রিশ হাতের কাছে থাকা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ফিনিশ ইট।’
রোজা অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে পানির বোতলে চুমুক বসায়। নিজেকে সামলিয়ে বোতলটা টেবিলের ওপর রেখে দেয়। তখন সূর্য ডুবে চারদিকে আঁধার নেমে এসেছে। ছাদের চারিধারে ফিট করা চারটা বাতি একসঙ্গে জ্বলে ওঠলো। হলদেটে আলোয় ছেয়ে গেল পুরো ছাদ। গাছের পাতার রঙ পালটে গেল, ফুলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠলো। মসজিদ থেকে ভেসে এলো মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠের মাগরিবের আযান। আদ্রিশ রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘রিলাক্স?’
প্রতুত্তরে রোজা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে সায় জানালো, ‘ঠিক আছি।’
আদ্রিশ কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘নিচে যাও। আর লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, যদি লুকোচুরি করার চেষ্টা করো তাহলে এই একমাস যেভাবে শান্তশিষ্ট রুপে দেখেছো, তারচেয়ে দশগুণ উগ্রতা দেখতে পাবে আমার মধ্যে। আমার ভাগের সবকিছুর অধিকার যেন আমারই থাকে, অন্য কেউ যেন সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে মাই গার্ল!’
রোজা চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হাত-পা ঘেমে ওঠলো। শক্ত কাঠ হয়ে বসে রইল। কর্ণকুহরে কোনো শব্দ-বাক্য ভুল করে ঢুকে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে ওর। আচমকা আদ্রিশ নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠে পড়লো। কয়েক কদম এগিয়ে এসে রোজার মুখোমুখি অন্য আরেকটি চেয়ারে বসে পড়লো। কোর্টটা টেবিলের ওপর রেখে রোজার গায়ের পাতলা শালটা টেনে মাথায় ওঠিয়ে দিয়ে বলল, ‘হরিণীদের এভাবেই মানায়। প্রসাধনবিহীন স্নিগ্ধ চোখমুখ, এলোমেলো চুলে। ললাটের ভাঁজে আর কপোলের রক্তিম আভায়!’
রোজা বিস্ময়ে বিমূঢ়। কি করছে আদ্রিশ? কি হচ্ছে এসব ওর সাথে? অনেক কষ্টে ঢোক গিলে রোজা শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলছেন আপনি?’
আদ্রিশ চেহারায় কাঠিন্য ভাবটা বজায় রেখে বিগলিত কন্ঠে বলে ওঠলো, ‘এতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম নিজেকে বুঝার জন্য। আজকের এই বিকেলটার জন্য।’
রোজা হতবিহ্বল হয়ে বলল, ‘ম মানে?’
আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘হরিণীদের বেশিকিছু বোঝাতে নেই। তাঁরা সবসময়ই নিষ্ঠুর, নির্দয়। তাঁরা অনুভূতি বোঝে না, ওদের বোঝার ক্ষমতা নিতান্তই তুচ্ছ। কেউ তাঁদের চোখের সামনে পাণিপ্রার্থী হয়ে পড়ে থাকলেও সেটা তাঁদের চোখে ধরা পড়ে না।’
ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না রোজা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিয়ৎক্ষণ। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না। আদ্রিশ সেটা বুঝতে পেরেই ধমকের সুরে বলে ওঠল, ‘তুমি নিজেকে যতই গর্তে লুকিয়ে ফেলতে চাও না কেন, আমি ঠিকই গর্ত থেকে বের করবো, দরকার পড়লে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনবো। তুমি চেনো না আমাকে। কি কি করতে পারি সেটাও তোমার মতো ষ্টুপিড আন্দাজ করতে পারবে না। আজকের এই কথাগুলো মনে রাখার চেষ্টা করবে, ওকে? এখন যাও।’
রোজা দ্রুতগতিতে সেখান থেকে চলে এলো। হাত-পা ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে। বেশিকিছু বোধগম্য না হলেও আদ্রিশ কীসের ইঙ্গিত করেছে বিষয়টা ওর কাছে স্বচ্ছ জলরাশির ন্যায় পরিষ্কার। খালার বাড়ি পড়াশোনা করতে এসে যদি এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, আর বাবা-মা যদি জানতে পারে তাহলে ওরা ঠিক কতটা কষ্ট পাবে, অপমানিত বোধ করবে সেটা কি রোজা কাউকে বোঝাতে পারবে? নাকি আদ্রিশ বোঝার চেষ্টা করবে? কিন্তু লোকটা তো নিষ্ঠুর, নিজের মতো করেই এসব ভেবে বসে আছে, রোজার কথা তো একবারও ভাবলো না!
———————————
নোট: পরীক্ষা চলছে, ছোট জানি, অনিয়মিতভাবে দিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের রেসপন্স তুলনামূলকভাবে কম, অন্যান্য পর্বগুলোর চেয়ে। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং দু-একলাইনে হলেও নিজের অনুভূতি জানাবেন (গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশা করতাম, দু-একজন শুভাকাঙখী ভুলত্রুটি শুধরে দিতো। আজকাল সেটা আর হয় না তাই, গঠনমূলকের আশা ছেড়ে দিয়েছি।) অগ্রিম ধন্যবাদ।
Israt’s Typescripts এ যোগদান করে মতামত, আলোচনা-সমালোচনা জানাতে পারেন।
চলবে…