#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৪৫
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
ইভানরা মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে গেলো।এদিকে মুহিব সাহেব ইভানের হঠাৎ মুন্সিগঞ্জ যাওয়া দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন।তিনি শুধু ভাবতে লাগলেন হঠাৎ ইভান মুন্সিগঞ্জে কেনো গেলো? মুহিব সাহেবের একটাই ভয় ইভান যদি মুন্সিগঞ্জে একবার তার পরিচয় বলে তাহলে সবাই চিনে যাবে তাকে।কারণ মুন্সিগঞ্জের সকল লোক মুহিব সাহেব কে ভালো করেই চেনে।কিন্তু মুহিব সাহেব কখনোই তার পরিবারের লোকদের মুন্সিগঞ্জের কথা বলে নি।এটা যে ইভানদের গ্রামের বাড়ি তা ওরা কেউই জানে না।ইভানরা জানে শহরেই তাদের বাসা।আর তার দাদা-দাদি অনেক আগেই মারা গেছে।মুহিব সাহেব বুঝতে পারলেন এবার আর ওনার রেহাই নাই। ইভান যেভাবে পিছনে লেগেছে যেকোন মুহুর্তে তার সম্পর্কে জানতে পারে।সেজন্য মুহিব সাহেব অন্য লোকের দ্বারায় ইভানকে খবর দিলো যে, তিনি অতশীর খোঁজ জানেন।তাড়াতাড়ি করে যেনো ইভান সেই জায়গায় চলে আসে।ইভান অতশীর কথা শোনামাত্র আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না।সাথে সাথে রওনা দিলো।মুহিব সাহেব এবার ইভানকে অতশীকে খোঁজার জন্য ব্যস্ত রাখবেন।যাতে করে ইভান আর তার পিছনে না ছুটে বেড়ায়।
এদিকে অতশীকে অন্ধকার একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছে মুহিব সাহেব।কারণ অতশী মুহিব সাহেবের ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছে।এখন তিনি অতশী কে ছেড়ে দিতেও পারছেন না, আবার মেরে ফেলতেও পারছেন না।সেজন্য তিনি এখন ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যেই অতশীকে খাবার দেয় মুহিব সাহেব।যখন খাবার দেওয়া হয় শুধুমাত্র তখনি অতশীর হাত পা খুলে দেওয়া হয়।অতশী অনেক চেষ্টা করেও এই ঘর থেকে বের হতে পারে নি।সে শুধু দিন রাত দোয়া পড়তে থাকে যাতে শীঘ্রই ইভান তার খোঁজ পায় আর তার বাবার আসল পরিচয় জেনে যায়।
এদিকে ইভান অতশীর কথা শুনে সবাইকে সাথে নিয়ে সেই জায়গায় চলে এলো।ইভান গাড়ি থেকে নেমেই লোকটিকে আবার ফোন দিলো। লোকটি যে ঠিকানার কথা বলেছিলো সেখানেই তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।ইভান লোকটিকে দেখামাত্র এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলো কই অতশী?কই?ইভান একদম হাঁপাতে লাগলো।
লোকটি তখন একটা পোস্টার দেখিয়ে বললো স্যার আপনি এই মেয়েটাকে খুঁজছেন না?ইভান পোস্টার টি হাতে নিয়ে বললো হ্যাঁ।এখন বলো কই সে?লোকটি তখন বললো,স্যার এই নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তি টা আমি কিছুদিন আগে দেখেছিলাম।সেজন্য মেয়েটিকে দেখেই চিনতে পেরেছি।
ইভান তখন লোকটির গা ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,এই শালা,আসল কথা বল।এতো পেঁচাচ্ছিস কেনো কথা?অতশী কই? কই দেখেছিস তাকে?
লোকটি ইভানকে এমন রাগান্বিত দেখে বললো, স্যার আপনি রাগ করতেছেন কেনো?কই আমাকে একটু ধন্যবাদ দিবেন,আমার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন তা না করে উলটো রাগ দেখাচ্ছেন?
ইভান লোকটির কথা শুনে আরো বেশি বিগড়ে গেলো।ইভানকে এমন রাগান্বিত দেখে শুভ্র এগিয়ে এলো।আর বললো,ভাই এতো বেশি ন্যাকামি না করে বলো অতশী কই?তুমি কই তাকে দেখেছো?
লোকটি তখন বললো, কিছুক্ষন আগে একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো এখানে।সেই গাড়ির ভিতর ছিলো মেয়েটি।মেয়েটির হাত পা মুখ বাঁধা ছিলো।গাড়িটির দরজা খোলা থাকায় আমি উঁকি দিয়ে গাড়ির ভিতর দেখতেই মেয়েটিকে দেখে ফেলি।আমি মেয়েটিকে দেখামাত্র চিৎকার করে উঠি।আর তখনি লোকগুলি গাড়ি স্টার্ট দেয়।
লোকটির কথা শুনে ইভান কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।কারণ সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না লোকটিকে।কিন্তু দিশান লোকটিকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। ইভান হঠাৎ শুভ্র কে বললো একে ধরে নিয়ে চলো আমাদের সাথে।লাঠি দিয়ে কয়েকটা আঘাত করলেই সব ভন্ডামি বের হয়ে যাবে।
–স্যার কি বলছেন এসব?আমি যা দেখেছি সেটাই বললাম।এখন আপনারা বিশ্বাস করবেন কি করবেন না সেটা আপনাদের ব্যাপার।আমাকে যেতে দিন স্যার।আজকাল কারো ভালো করতে নেই।এই বলে লোকটি চলে যেতে ধরলো।কিন্তু শুভ্র লোকটিকে যেতে দিলো না।সে লোকটির গলা টিপে ধরে বললো, আমাদের সাথে ফাজলামি করিস?জানিস আমরা কে?আমরা হলাম সি আই ডির লোক।সি আই ডির নাম শোনামাত্র লোকটি ভয় পেয়ে গেলো।তিনি আর একটা কথাও বললেন না।
এদিকে দিশান ইভানকে বললো,স্যার লোকটির কথা তো সত্যও হতে পারে।চলেন আমরা ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখি।ইভান সেই কথা শুনে বললো লোকটি মিথ্যা কথা বলছে দিশান।অতশীর যদি চোখ মুখ বাঁধাই থাকে তাহলে সে কি করে এক দেখাতেই চিনে ফেললো?নিশ্চয় এর পিছনে সন্ত্রাসীদের একটা হাত আছে।একে নিয়ে চলো আমাদের সাথে।সেই কথা শুনে দিশান আর শুভ্র লোকটিকে গাড়িতে ওঠালো।লোকটি তা দেখে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।স্যার আমাকে বাড়ি যেতে দিন।বাড়িতে আমার বউ বাচ্চা আছে।ইভান সেই কথা শুনে লোকটির বাড়ির ঠিকানা চাইলো।লোকটি প্রথমে বলতে চাইছিলো না।ইভান তখন লাঠি দিয়ে জোরে করে একটা আঘাত করলো।লোকটি তখনও তার বাড়ির ঠিকানা বললো না।এবার ইভান রাগ করে একের পর এক আঘাত করায় লোকটি বললো, স্যার বিশ্বাস করুন আমি কিছু করি নি।এক লোক কিছু টাকা আমার হাতে গুজে দিয়ে বললো চার জন লোক আসবে এখানে।তুই শুধু পোস্টার টা দেখিয়ে এই কথাগুলো বলবি।আমি সেজন্য মোবাইল করেছিলাম আপনাদের।বিশ্বাস করুন স্যার আমি জানতাম না আপনারা সি আই ডির লোক।তাহলে কখনোই এভাবে মিথ্যা কথা বলতাম না।ইভান লোকটির কথা শুনে বললো যে লোকটি এসব বলতে বলেছে তার চেহারা কেমন?
–লোকটি শ্যাম বর্নের,আর খাঁটো সাইজের ছিলেন। লোকটির চাপ দাঁড়ি ও আছে।
ইভান লোকটির কথা এখনো বিশ্বাস করতে পারলো না।লোকটি আরো অনেক কথা লুকাচ্ছে।সেজন্য ইভান লোকটিকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখলো।আর আবার মুন্সিগঞ্জ চলে গেলো।
মুন্সিগঞ্জ গিয়ে ইভান প্রথমে প্রতিটা বাজারে গিয়ে মুন্নি বেগম আর আকবরের কথা জানতে চাইলো।তারপর একে একে প্রতিটা বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কেউই তাদের চিনতে পারলো না।আর চিনবেই বা কি করে আকবর মারা গেছে সেই অনেক বছর আগে, আর মুন্নি বেগমও সেই থেকে গ্রাম ছাড়া হয়েছে।তবে মুহিব সাহেব মাঝে মাঝে আসতো এই গ্রামে।ইভানরা যখন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মুন্নি বেগম আর আকবরের কোনো খোঁজ পেলো না তারা তখন নিরাশ হয়ে চলে যেতে ধরলো।ঠিক তখনি প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হলো।সেজন্য ইভানরা আর চলে যেতে পারলো না।তারা সবাই মিলে মুন্সিগঞ্জেই রয়ে গেলো।এলাকার চেয়ারম্যান ইভানদের নিয়ে তার বাড়ি চলে গেলেন।আর অনেক খাতির যত্ন করতে লাগলেন।
ইভানের মন টা স্থির হতে পারছিলো না।সে শুধু ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু বৃষ্টি কিছুতেই থামলো না।বৃষ্টির সাথে সাথে তুমুল বেগে বাতাসও বইতে লাগলো।এদিকে চেয়ারম্যান ইভানদের আদর যত্নের কোন কমতি রাখলেন না।চেয়ারম্যান ভেবেছে ইভান অবিবাহিত। সেজন্য তিনি তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন। সেজন্য ওনার মেয়েকেই খাবার পরিবেশন করতে বললেন।ইভানের খাবারের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না।সে শুধু ভাবছে কখন বের হবে এই বাসা থেকে।তার অস্থিরতা কিছুতেই থামছিলো না।
চেয়ারম্যান ইভানের গ্রামের ঠিকানা জানতে চাইলো।তার বাবা কি করে বা তারা থাকে কোথায় এসব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ইভান তখন বললো তারা শহরে বড় হয়েছে।আর তার বাবা একজন নামকরা উকিল।চেয়ারম্যান ইভানের কথা শুনে খুব খুশি হলেন।তিনি খুশি হলেন এটা ভেবে যে ইভানের ফ্যামিলিও অনেক ভালো।সে শুধু নিজে একজন সি আই ডি অফিসার নয়।তার বাবাও একজন উকিল।এমন ঘরই তিনি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলেন।কিন্তু নিজের মুখে বলতে পারছিলেন না।সেজন্য বুদ্ধি করে তিনি ইভানদের বাসার ঠিকানা নিয়ে নিলো।আর ইভানকে জানায় শহরে গেলে তার বাসায় যাবে।
বৃষ্টি পড়ার গতি কিছুটা কমে গেছে।তবে এখনো টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।ইভান সেজন্য আর এক মুহুর্ত ও দেরী করলো না।সবাইকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।তবে সে চেয়ারম্যান এর ব্যবহার এ এতোটাই মুগ্ধ হলো যে যাওয়ার সময় তার ফোন নাম্বারও দিয়ে গেলো আর বলে গেলো কখনো কোনো দরকার হলে অবশ্যই যেনো তার সাথে যোগাযোগ করে।
হঠাৎ চেয়ারম্যান ইভান কে জিজ্ঞেস করলো তারা কেনো খুঁজছে এই মানুষ দুইজনকে?তারা কি অপরাধ করেছে।ইভান তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বললো।চেয়ারম্যান আকবরের কথা শুনে বললো,আপনারা যে কোন আকবর কে খুঁজছেন বুঝতে পারছি না।আমি শুনেছি একসময় আকবর নামে একজন নামকরা সন্ত্রাসী ছিলেন এই গ্রামে।
সন্ত্রাসীর নাম শুনে সবাই চমকে উঠলো। ইভান তখন জিজ্ঞেস করলো তিনি কই আছেন এখন?বা ওনার আত্নীয় স্বজন এদের কোনো খোঁজ দিতে পারবেন?
–আকবর বেঁচে নেই।আর ওনার আত্নীয় স্বজনের ব্যাপারে কিছু জানি না।তবে ওনার একজন ছেলে আছে।খুবই ভালো মানুষ তিনি।বাবার মতো সন্ত্রাসী হয় নি।শহরে পড়ালেখা করে ওখানেই চাকরি পেয়েছে।আর ওখানেই বিয়ে শাদি করেছে।
ইভান কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা আকবরের সেই ছেলের নাম কি?
চেয়ারম্যান সাহেব কোনো দ্বিধা ছাড়াই বললেন মুহিব চৌধুরী।
মুহিব নাম শোনামাত্র ইভানের মনে হয় পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। এদিকে দিশান,শুভ্র আর নীলয় একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। ইভান তখন বললো আপনি শিওর যে ওনার ছেলের নাম মুহিব?
–কি বলছেন এসব?শিওর মানে?ওনাকে সবাই ভালো করেই চেনে।আপনি গ্রামের সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।মুহিব সাহেব কে চেনে না এমন কোনো লোক নেই এ গ্রামে।
ইভান চেয়ারম্যান এর কথা শুনে তার বাবার ছবি দেখিয়ে বললো দেখেন তো ইনি সেই মুহিব নাকি?
–হ্যাঁ ইনিই সেই মুহিব।তখনকার সময়ে আমাদের গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষিত ছেলে ইনি।এখনকার ছেলেমেয়েরা ওনার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তারাও পড়ালেখায় ভীষণ মনোযোগী হয়েছে।
ইভান আর স্থির থাকতে পারলো না।তবুও সে কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো কিন্তু এ মুহিবের তো বাবা মার নাম অন্য।ওনার বাবা মার নাম তো আকবর ও মুন্নি নয়।
চেয়ারম্যান সেই কথা শুনে বললো,আকবর আর মুন্নি তো মুহিবের নিজের বাবা মা না।ওনারা মুহিব কে দত্তক নিয়েছে।
ইভান আর এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে গেলো।ইভানের এমন অবস্থা দেখে দিশান,নীলয় আর শুভ্র কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না।ইভান কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
#চলবে,
গল্পটি একদম শেষের দিকে।আর এক পর্ব দিয়েই শেষ করবো।