#অনুভবে_তুমি
#শেষ_পর্ব
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
আজ ইভানের জীবনে কি ঘটতে চলেছে তা সে জীবনেও কল্পনা করে নি।ইভান কোনোদিনও এই দিনটা ভুলতে পারবে না।কারণ মুহিব সাহেব তার নিজেরই স্ত্রী,মেয়ে আর ছেলের বউকে বন্দি করে ইভানকে ব্লাকমেল করছে।অথচ কাল পর্যন্ত তাদের পরিবারটা কত সুন্দর ছিলো!সবাই মিলেমিশে এতো বছর থাকার পরও শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু ভুলে গেলো মুহিব সাহেব।ওনার মধ্যে কোনো অনুশোচনায় দেখা গেলো না।তিনি এতোদিন যা যা অপরাধ করেছেন পরিবারের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে যদি সবকিছু ভুলে যেতেন,সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতেন তাহলে হয় তো সবাই তাকে ক্ষমা করে দিতো।কিন্তু মুহিব সাহেব তার উলটো কাজ করলেন।
তিনি ইভান কে শর্ত দিলেন যদি ইভান তাকে দেশের বাহিরে পালাতে সাহায্য করে তাহলেই সে সবাইকে মুক্ত করে দেবে।ইভান কখনোই ভাবে নি তার বাবা এই রকম একটা জঘন্য কাজ করবে।ইভান তার বাবার আসল পরিচয় জেনেও চুপ করে ছিলো।কারণ অতশী এখনো তার হাতে আছে।সেজন্য সে কোনো একশন নেয় নি।কিন্তু ইভান কিছু করার আগেই মুহিব সাহেব তার নেক্সট পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছে।কারণ তিনি যে একজন নামকরা সন্ত্রাসী।দেশের ছোট বড় সকল সন্ত্রাসীদের লিডার।যার দ্বারা সব ধরনের কাজ করা সম্ভব।ইভান মুহিব সাহেব কে তার বাবার সেই মহানুভবতা চেহারার আড়ালের ভয়ংকরী চেহারাকে কখনোই কল্পনা করতে পারে নি।
এদিকে মুহিব সাহেবের কথা পুরো দেশের লোক জেনে গেছে।সকল টিভি চ্যানেলে এখন মুহিব সাহেব কে নিয়ে নিউজ হচ্ছে।মুহিব সাহেব যখন তার স্ত্রী এবং মেয়ে মৌরিকে জোর করে হোটেল থেকে বের করছিলেন তখন অনেকেই বাঁধা দেয় মুহিব সাহেব কে।মুহিব সাহেব তখন তার পিস্তল বের করে সবাইকে ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।ইতোমধ্যে হোটেলের সেই সিসিটিভির ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে।ইভান কে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে সে বিষয় টা এড়িয়ে গেলো।কিন্তু দিশান,নীলয় আর শুভ্র কিছুতেই চুপ থাকতে পারলো না।এর আগে শুধুমাত্র ইভানের জন্য তারা মুহিব সাহেবের ব্যাপার টা গোপন রেখেছিলো।কিন্তু এবার তারা সবকিছু বলে দিলো সবাইকে।যার জন্য ইভান ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো। কারণ উপর থেকে মুহিব সাহেব কে ধরার জন্য চাপ সৃষ্টি করলো।ইভান এখন কি করবে?মুহিব সাহেব কে ধরে দিলে যদি আবার তিনি সবাইকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলেন তখন কি হবে?পরে আবার ভাবলো এটাও কি সম্ভব?তার বাবা কি সত্যি সবাইকে খুন করবে?ওনার কি হাত একটুও কাঁপবে না?উনি কিভাবে নিজের স্ত্রী আর মেয়েকে খুন করবেন?
ইভান চুপচাপ বসে বসে এসব নিয়ে ভাবছে। আর ভাবছে কিভাবে সে এক ঢিলে দুই পাখি মারবে।তার বাবাকে সে অনেক সুযোগ দিয়ে ফেলছে।কিন্তু এবার আর তা করা যাবে না।হঠাৎ ইভানের কাছে মুহিব সাহেব আবার ফোন দিলেন।আর বললেন, ইভান এসব কি হচ্ছে?এয়ারপোর্টে এতো পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কেনো?তোকে না বলেছি আমি দেশ না ছাড়া পর্যন্ত কাউকে জানাবি না।এখন আমি পালাবো কি করে?
তুই আমাকে সাহায্য করার পরিবর্তে ধরার চেষ্টা করছিস?এর পরিনতি কি হতে পারে একবার ভেবে দেখেছিস?
ইভান তার বাবার কথা শুনে হাসতে লাগলো আর বললো তুমি কি সত্যি আমার বাবা?আর মৌরি তোমার সত্যি কি নিজের মেয়ে?তুমি কি করে নিজের মেয়ে আর স্ত্রীকে খুন করার চিন্তা করলে?
–ইমোশনাল ব্লাকমেল করবি না ইভান।এই মুহুর্তে আমার নিজের জীবন বাঁচানো টা সবচেয়ে বেশি ইমপরমেন্ট।আমি আর কাউকে চিনি না।
–ছিঃ বাবা।তুমি আমাদের বাবা নামের কলঙ্ক।আমি ভাবতেই পারছি না তুমি আমাদের সেই বাবা যার আদর্শে আমরা এতো বড় হয়েছি?
–আসল কথায় আয়।মোড় ঘোরাস না।
ইভান মুহিব সাহেবের সাথে কথা বলছে আর দিশানরা সেই নাম্বার ট্রাকিং করে লোকেশন বের করার চেষ্টা করছে।মুহিব সাহেব ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ইভান দিশানদের জানায়।আর তারা মুহিব সাহেবের নাম্বার ট্রাকিং করে লোকেশন পেয়ে যায়।এদিকে ইভান কথা বলেই যাচ্ছে।
লোকেশন অনুযায়ী পৌঁছে গেলে সেখানে ইভানরা কাউকেই দেখতে পেলো না।ব্যাপার টা ভীষণ অদ্ভুত লাগলো ইভানের। অথচ এখানেই দেখাচ্ছে লোকেশন।ইভান আজ আর একাই আসে নি।পুরো দলবল নিয়েই এসেছে।চারপাশে পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে।আর ইভান খুঁজতে থাকে মুহিব সাহেব কে।এদিকে ইভানরা আসার সাথে সাথে টের পেয়ে যায় মুহিব সাহেব।কারণ তিনি সিসিটিভি সেট করে রেখেছেন চতুর্দিকে।মুহিব সাহেব সাথে সাথে কল কেটে দেয়।তিনি ভাবতেই পারেন নি ইভান এতো সহজে তার আস্তানায় প্রবেশ করবে।
ইভানকে দেখামাত্র মুহিব সাহেব পালানোর চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না।কারণ ইভান এক কি.মি দূরত্ব পর্যন্ত পুলিশ পাহারায় রেখেছে।মুহিব সাহেব যখন দেখলেন তার পালানোর সব রাস্তায় বন্ধ তখন তিনি চুপচাপ তার আস্তানায় লুকিয়ে থাকলেন।
ইভানরা বুঝতে পারছে না মুহিব সাহেব আসলে আছে কোথায়?তবে লোকেশন এখানেই দেখাচ্ছে।হঠাৎ শুভ্র ফোন দিলো আর বললো মুহিব সাহেবের তিনটা আস্তানায় পুলিশ এট্যাক করেছে।আর সকল সন্ত্রাসীদের ধরে জেলে নিয়ে গেছে পুলিশ।
–গুড।
–আর মাত্র দুইটা বাকি আছে স্যার।আজকের মধ্যে এই দুইটাও ধ্বংস করে ফেলবো।
–গুড জব শুভ্র।আর সাবধানে থেকো।
–ইয়েস স্যার।
এই বলে শুভ্র ফোন রেখে দিলো।
এদিকে এখন পর্যন্ত কেউ খুঁজে পেলো না মুহিব সাহেব কে।ইভান তখন নির্দেশ দিলো পুরো জায়গা খনন করে দেখো।যেহেতু লোকেশন বার বার এখানেই দেখাচ্ছে সেহেতু এখানেই আছে অপরাধী।
ইভান আশেপাশের সকল জায়গা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো। আশেপাশে যত বাসা বাড়ি আছে সবগুলোই ভালো করে তদন্ত করলো।তবুও কোথাও কোনো ক্লু পেলো না।হঠাৎ মাটি খনন করা লোকগুলো একটা গর্ত খুঁজে পেলো।গর্ত টা ইঁদুরের গর্ত ভেবে তারা কোনো গুরুত্ব দিলো না।সেজন্য তারা অন্য জায়গায় খুঁড়তে লাগলো।ইভান যখন চারপাশে তদন্ত করে এসে আবার সেই খননের জায়গায় এলো সেও ইঁদুরের গর্ত টি দেখতে পেলো।ইভান দেখার সাথে সাথে নির্দেশ দিলো ভালো করে জায়গা টা খনন করতে।জায়গা টা৷ ভালো করে খনন করতেই বড় একটা গলির মতো রাস্তা দেখা গেলো।যা দেখামাত্র ইভান গুলি হাতে নিয়ে আগে আগে চলে গেলো।আর দিশান পিছু পিছু চলে গেলো।
ইভান বাকিদের আসতে নিষেধ করলো।কারণ তারা গলি দিয়ে যেতে যেতে একটা ঢাকনা দেখতে পেলো।যা নিচ থেকে তোলা যাচ্ছে না।ইভান আর দিশান অনেক চেষ্টা করে ঢাকনা টা তুলে বাহিরে এসে দেখে তারা একটা ঘরের মধ্যে এসে গেছে।কিন্তু ঘরটাতে কেউ ছিলো না।ইভানরা ঘরটার দরজা খুলতেই দেখে তারা বাহিরে এসে পড়েছে।ইভানরা তখন বুঝে গেলো অপরাধী এই ঘরের মধ্যে প্রথমে ঢোকে। তারপর ঢাকনা খুলে গর্তের ভিতর দিয়ে ভিতরে যায়।ইভান আর দিশান এবার সবাইকে ডাকলো।আর সেই গর্ত অনুসরন করে সোজা চলে গেলো।ইভান সবার প্রথমে আছে।তারপর দিশান।বাকি পুলিশের সদস্য রা পিছে পিছে।
এদিকে মুহিব সাহেব সিসিটিভি ক্যামেরার সাহায্যে সবকিছু দেখছে।তিনি কি করবেন এখন বুঝতে পারলেন না।তবে এটা বুঝতে পারলেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।তবুও তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য সবাইকে বেঁধে গুলি তাক করে ধরে থাকলেন।ইভানরা তাকে ধরা মাত্র তিনি শুট করার ভয় দেখাবেন সবাইকে।
ইভানরা ভিতরে প্রবেশ করে তাজ্জব লেগে গেলো।কারণ ভিতরে একটা সুন্দর রাজপ্রাসাদ।এতো সুন্দর করে সাজানো যা দেখে ইভানরা আশ্চর্য হয়ে গেলো।এক এক করে সবাই ঢুকে পড়লো রাজপ্রাসাদে।আর ঢুকেই প্রতিটা রুম চেক করতে লাগলো।ঘরগুলো এমন পরিপাটি করে সাজানো মুহুর্তের মধ্যে সবাই ভুলে গেলো এটা কোনো সন্ত্রাসীর আস্তানা।মনে হলো সবাই কোনো দর্শনীয় জায়গায় এসেছে।কিছুদূর যেতেই তারা সুন্দর একটা পুকুর দেখতে পেলো।তা দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেলো।মাটির নিচে পুকুর!সবাই বেশ আশ্চর্য হলো আর পুকুরের নিকট চলে গেলো।পুকুরের কাছে যেতেই সবার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো।যখন তারা সুন্দর পুকুর টার পাড়ে মানুষের মাথা, হাত, পা আর তাজা রক্ত দেখতে পেলো।ইভান এই দৃশ্য দেখামাত্র ভয় পেয়ে গেলো।সে তখন জোরে জোরে করে ডাকতে লাগলো আম্মু?মৌরি?অতশী?
কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না।ইভানের পুরো শরীর এবার থরথর করে কাঁপতে লাগলো।সে দৌঁড়ে চারপাশে খুঁজতে লাগলো অতশীদের।
মুহিব সাহেবের এই পুকুরের নাম হলো বিলাশ পুকুর।তিনি এ যাবৎ যত মানুষ খুন করেছেন তাদের লাশ কেটে কেটে এই পুকুরের মাছদের খাওয়ান।একটা মানুষ কত টা নিষ্ঠুর হলে এইরকম একটা অমানবিক কাজ করতে পারে।ইভান তার বাবার এই নিষ্ঠুরতা দেখে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারলো না।তার ইচ্ছে করছে বাকি সবার মতো তার বাবাকেও কুঁচি কুঁচি করে কেটে এই মাছদের খাওয়াতে।কিন্তু এরকম কাজ সে কখনোই করতে পারবে না।কারণ আইন অনুযায়ী মুহিব সাহেবের ফাঁসি হবে।সেজন্য ওনাকে জীবিতই ধরে নিয়ে যেতে হবে।তার সাথে অনেক বোঝাপড়া আছে।
ইভান পাগলের মতো চারদিকে খুঁজতে লাগলো আর অতশীর নাম ধরে ডাকতে লাগলো।বা কোনোবার মৌরির নাম ধরে ডাকলো।তবুও কেউ সাড়া দিলো না।সবশেষে তারা আরেকটা ছোট কুটুরি দেখতে পেলো। তবে ঘরটির কোনো জানালা দরজা কিছুই ছিলো না।ঘরটির ভিতরে প্রবেশ করবে কিভাবে সেটাই বুঝে উঠতে পারলো না কেউ।ইভান বুঝতে পারলো এই ঘরের ভিতরই হয়তো বাহিরে পালানোর রাস্তা আছে।সেজন্য সে ঘরটি ভাঙ্গার পারমিশন দিলো।এদিকে মুহিব সাহেব এই ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।তিনি যখন দেখলেন এই ঘরটা সবাই ভাঙ্গার চেষ্টা করছে তখন তিনি কোনো উপাই না দেখে তিনজনের উপর গুলি তাক করে বাহিরে বের হয়ে আসলেন।
অতশী, মৌরি আর ইভানের আম্মুর চোখ মুখ বাঁধা ছিলো।তারা না কিছু দেখতে পারছে না কিছু বলতে পারছে।মুহিব সাহেব ওদের মাথায় গুলি তাক করে বললো, আমাকে বাহিরে যেতে দাও সবাই।তা না হলে এক শুটে তিনজনকেই শেষ করে ফেলবো।
ইভান সেই কথা শুনে এক পা দুই পা করে মুহিব সাহেবের দিকে এগোতে লাগলো।মুহিব সাহেব তা দেখে চিৎকার করে বললো, ইভান কাছে আসবি না খবরদার।খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।ইভান সেই কথা শুনে থেমে গেলো।এদিকে পিছন দিক থেকে দিশান গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।মুহিব সাহেব সাথে সাথে বলে উঠলো খবরদার দিশান কাছে আসবি না।দিশান সেই কথা শুনে পিছিয়ে গেলো।এদিকে মুহিব সাহেব মৌরি আর তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে শুধুমাত্র অতশীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে ধরলো।ইভান তখন মৌরি আর তার মাকে উপরে তুললো আর তাদের চোখের বাঁধন খুলে দিলো।
এদিকে মুহিব সাহেব অতশীকে নিয়েই পালাচ্ছে।ইভান তখন সবাইকে আদেশ দিলো দূরে সরে যাও।আর ওনাকে পালাতে দাও।মুহিব সাহেব সেই কথা শুনে তার নিজের গাড়িতে উঠলো। আর অতশীকেও ওঠালো গাড়িতে।হঠাৎ পিছন দিক থেকে একজন মুহিব সাহেবের বন্দুক কেড়ে নিলো।তারপর তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো।ইভান জানে মুহিব সাহেব এইভাবে পালিয়ে যেতে ধরবে।সেজন্য সে আগেই মুহিব সাহেবের গাড়ির ভিতরে লোক ঢুকে রেখেছে।
মুহিব সাহেব নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক জোরাজোরি করতে লাগলো। আর তখনি দিশান দৌঁড়ে গিয়ে মুহিব সাহেব কে গাড়ি থেকে টেনে নামালো।আর তার হাত দুটি শক্ত করে ধরলো।সাথে সাথে পুরো টিম এগিয়ে এসে মুহিব সাহেব কে ধরে ফেললো।
এদিকে অতশীর চোখ মুখ বাঁধা থাকায় সে কিছু দেখতে পারছিলো না।ইভান সেজন্য তাড়াতাড়ি করে অতশীর চোখ মুখের বাঁধন খুলে দিলো।অতশী সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলো।কারণ তার শরীরে কোনো শক্তি ছিলো না।একদম দূর্বল হয়ে গেছে সে।ইভান তা দেখে তাড়াতাড়ি করে অতশীকে কোলে তুলে নিলো।আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এম্বুল্যান্স কে খবর দিলো।
এদিকে মুহিব সাহেব তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সবার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।সাথে সাথে এক ঝটকায় সবাই মাটিতে পড়ে গেলো।আর মুহিব সাহেব তখন একজন পুলিশের হাতের গুলি কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের মাথায় শুট করলো।কারণ মুহিব সাহেব জানে এখন তার ফাঁসি নিশ্চিত। সেজন্য তিনি নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেললেন।
মুহিব সাহেব সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলো।আর মাটি মুহিব সাহেবের রক্তে রঞ্জিত হলো।সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো।কি হলো এটা?এতো কষ্ট করে ধরে তাহলে কি লাভ হলো?ইভান নিজেও শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।তার আজ একটুও খারাপ লাগছে না।মনে হলো মুহিব সাহেব তার নিজের পিতা নয়।কোনোকালেই তিনি ইভানের কোনো আপনজন ছিলো না।মুহিব সাহেবের প্রতি ইভানের এতো ঘৃনা জন্মিয়েছে যে সে একটিবার ছুঁয়েও দেখলো না তার বাবাকে।মুহিব সাহেব কিছুক্ষনের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
ইভানের মা আর মৌরিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। মুহিব সাহেবের এই দুর্দশা দেখে তাদের কষ্ট হলেও তারা সেটা বুঝতে দিলো না।তবে ইভানের মা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না।দৌঁড়ে মুহিব সাহেবের লাশের পাশে গিয়ে কাঁদতে লাগলো।তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তখন কিছু মহিলা পুলিশ ইভানের মাকে উপরে ওঠালো।তারা মুহিব সাহেব কে কিছুতেই ধরতে দিলো না।
এদিকে ইভান অতশীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই মিডিয়ার লোক তাকে ঘিরে ধরলো।ইভান কোনো কথাই বলতে পারলো না।দিশান তখন সবাইকে সরিয়ে দিলো। আর বললো এ নিয়ে আমরা পরে কথা বলছি।এখন আমরা ব্যস্ত আছি।
অতশীর চিকিৎসা চলছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে আসলো।তবে সে স্বাভাবিক হতে পারলো না। অতশী কেমন যেনো অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। সে কেমন যেনো ছটফট করতে লাগলো।কারণ এতোদিন ধরে সে মুহিব সাহেবের এই অমানবিক কান্ড দেখে আসছে।মুহিব সাহেব তার চোখের সামনেই মানুষ খুন করতো।তাদের কে টুকরো টুকরো করে সেই পুকুরে ফেলে দিতো।আর সাথে সাথে মাছেরা সেই মাংসের টুকরা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো।যা অতশী কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
ইভান সবকিছু বাদ দিয়ে অতশীর সাথে সাথে থাকলো।সে আর কিছুতেই তাকে একা ছাড়লো না।কারণ সে অতশীকে অনেক বেশি অবহেলা করে ফেলেছে।অতশীকে ঠিকভাবে সময় পর্যন্ত দেয় নি।অতশীকে হারিয়ে ফেলার পর সে বুঝতে পেরেছে, অতশী ছাড়া সে কতটা নিঃশ্ব।তার জীবনটা একদম শূন্যতায় ভরে গিয়েছিলো।
ইভান অতশীর হাত ধরে তাকে শান্ত্বনা দিতে লাগলো। অতশী তবুও শান্ত হলো না।ইভান ব্যাপার টা ডক্টর কে জানালে ডক্টর বললো,ভয়ের কোনো কারণ নেই।রোগী বর্তমানে একটু আতংকের মধ্যে আছে,এজন্য এরকম করছে।কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।এদিকে ইভানের মা আর মৌরিও পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে।ইভান তাদেরকেও নানা ভাবে শান্ত্বনা দিতে লাগলো।
সকল সন্ত্রাসীদের আটক করা হলেও অয়ন কে ছেড়ে দেওয়া হলো।কারণ তাকে আহসান ব্লাকমেল করে এই পেশায় নিযুক্ত করেছে।শুধু অয়ন না,অয়নের মতো অনেকেই বাধ্য হয়ে এই পেশার সাথে যুক্ত আছে।তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হলো।
আজ সবার আনন্দের দিন।সবাই সবার আপনজন কে ফিরে পেয়েছে।ইভানের আম্মু যদিও মুখে কিছু বলছে না,তবে মুহিব সাহেবের মৃত্যু তে তিনি বেশ কষ্ট পেয়েছেন।এতোদিন মুহিব সাহেব তাদের আটকিয়ে রাখলেও কোনো অযত্ন করে নি।ইভানের আম্মু মনে করেন মুহিব সাহেবের একটাই অপরাধ তিনি তার সন্ত্রাসী পেশাটাকে ছাড়তে পারেন নি।এতো সুন্দর একটা পরিবার থাকা সত্ত্বেও তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে এই পেশার সাথে জড়িত ছিলেন।তবে তিনি কখনোই তার উপর কোনো অত্যাচার করেন নি।বা কোনো খারাপ ব্যবহার করেন নি।একটা মানুষের সাথে এতোবছর ভালোভাবে সংসার করার পর যখন তার আসল চেহারা টা সামনে আসে সেটা মেনে নেওয়া সত্যি খুব কষ্টের।ইভানের আম্মুরও সেইরকম কষ্ট হচ্ছে।তিনি এই ব্যাথা কাউকে বোঝাতে পারছেন না।তিনি ভাবতেই পারছেন না মুহিব সাহেব এতো বড় একজন সন্ত্রাসী।
ইভান সবার মন ভালো করার জন্য ভ্রমনে বের হলো।কারণ সবার মন মানসিকতা ঠিক করার জন্য খোলামেলা কোনো জায়গা,পাহাড় বা সমুদ্রে যাওয়া এখন ভীষণ জরুরী। সবাই কোনো না কোনোভাবে ভীষন আপসেট হয়ে আছে।সবাইকে পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র শুভ্রর পরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।এজন্য শুভ্রর ভীষণ মন খারাপ।তবে তার বিশ্বাস তার বাবা মা বোন ঠিক বেঁচে আছে।আর তার কাছে একদিন না একদিন ফিরে আসবেই।মুহিব সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো জানতে পারা যেতো তারা আসলে বেঁচে আছে না মরে গেছে?
ইভান অতশীকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে চলে গেলো। আর তাকে এদিক ওদিক দেখাতে লাগলো।অতশী চুপচাপ ইভানের কথা শুনছে।সে কিছুতেই সেই ভয়ানক ঘোর কেটে উঠতে পারছে না।ইভান তখন অতশীর হাত দুটি মেলে ধরে বললো,অতশী তোমাকে কি একটুও ভালো লাগছে না?
অতশী মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো ভালো লাগছে।ইভান সেই কথা শুনে বললো তাহলে কিছু বলছো না কেনো?এভাবে চুপচাপ আছো কেনো?আমরা আনন্দ করতে এসেছি।এভাবে চুপচাপ থাকলে কি ভালো লাগে?
অতশী সেই কথা শুনে বললো, আচ্ছা ইভান আমাকে যদি খুঁজে না পেতে তখন কি হতো?বা আমি যদি মারা যেতাম তখন কি হতো?
ইভান তখন অতশীকে জড়িয়ে ধরে বললো,মৃত্যু কে কেউ আটকাতে পারে না।যার যে অবস্থায় মরণ আছে সে সে অবস্থাতেই মারা যাবে।তবে এটা ঠিক তোমার সাথে খারাপ কিছু হলে আমি নিজের কাছে সারাজীবন এর জন্য দোষী হয়ে থাকতাম।কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।আমি যদি সেদিন তোমার কথা শুনতাম তাহলে তোমাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হতো না।
অতশী আবার চুপ হয়ে রইলো।আবার তার মুখ টা মলিন হয়ে গেলো।ইভান তখন অতশীর মুখ টি উপরে তুলে তার কপালে একটা কিস করলো আর বললো সবকিছু ভুলে যাও অতশী।মানুষের জীবনে খারাপ সময় ভালো সময় দুটোই আছে।এখন আমাদের আনন্দের দিন।প্লিজ অতশী আবার আগের মতো হয়ে যাও।তোমার দুষ্ট মিষ্টি কথাগুলো খুব মিস করছি।
অতশী সেই কথা শুনে বললো, তাহলে তোমার ভালোবাসার কথা আজ নিজের মুখে প্রকাশ করো।কখনোই তো নিজের মুখে কিছু বলো নি।
–কি বলবো?কিভাবে বলবো?
–তা আমি কি করে জানবো?
ইভান সেই কথা শুনে অতশীর মুখটি স্পর্শ করে বললো,
মুখটি তোমার ফুলের মতন,চাঁদের মতোন হাসি।
সেই কারনে ওগো প্রিয়া,তোমায় ভালোবাসি।
দু চোখ ভরে দেখি শুধু তোমার মুখখানা।
পাগল হয়ে দেখি আঁখি,পলক আর পরে না।
গোলাপ তোমার ঠোঁটগুলো,নয়ন তোমার সাগর।
এমন সুন্দর রুপখানি দেখিনি আর কারোর।
এই বলে ইভান অন্য দিকে তাকালো।
অতশী সাথে সাথে ইভানকে তার দিকে ফেরালো,আর বললো মেয়ে মানুষের মতো এতো লজ্জা পাও কেনো?আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।
ইভান এবার আর অন্য মুখ হলো না।সে অতশীর চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলো,
তোমার দুটি ডাগর চোখে আমার মনের ছবি।
এসো প্রিয়া কাছে এসো দেখে যাও সবই।
বাতাসে ভেসে বেড়ায় প্রেম প্রেম গন্ধ,
ভাবনাতে শিহরিত,আছে যত রন্ধ্র।
নয়নে আঁকা তোমার প্রেমময় ছবিটা,
শব্দের মালা গেঁথে লিখি আমি এই কবিতা।
তোমার নামের মালা জপি,আমি প্রেম যোগী।
স্বর্গ সুখ লাভ হয়, তোমায় যখন দেখি।
“অনুভবে তুমি প্রিয়,অনুভবে তুমি।
অতশী ইভানের মুখে এই প্রথমবার কোনো প্রেমের সংলাপ শুনলো। এই প্রথমবার ইভান নিজের মুখে তার ভালোবাসা প্রকাশ করলো।এতোদিন শুধু চিরকুটের মাধ্যমেই প্রকাশ করেছে।
ইভান আর অতশী দুইজন দুইজনার দিকে অপলক দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকলো।মনে হচ্ছে হাজার বছর পর এই চোখের দর্শন পেলো তারা।ইভান সাথে সাথে অতশীকে কোলে তুলে নিলো।আর তাদের রুমের দিকে চলে গেলো।
ইভান আর অতশী অনেকদিন পর দুইজন দুইজনকে এতো কাছে পেলো।কিছুতেই যেনো তাদের ভালোবাসা শেষ হচ্ছিলো না।তাদের ইচ্ছা করছে এইভাবেই যদি হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারতো। মুহুর্তের মধ্যে হোটেল রুমটি এই প্রেমিক যুগুলের ভালোবাসার সৌরভে সুরভিত হলো।এই পবিত্র বন্ধন যেনো সারাজীবনের জন্য অটুট থাকে।কোনো বিপদ যেনো তাদের ভালোবাসায় ফাটল ধরাতে না পারে।ইভান আর অতশী মনে মনে এই দোয়া করতে লাগলো।
সমাপ্ত
কেমন লাগলো গল্পটি অবশ্যই জানাবে সবাই।আর ভুল ত্রুটি হলে অবশ্যই ধরিয়ে দেবে।গল্পটি দেরি করে দেওয়ার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত।আমি চেষ্টা করি রেগুলার দেওয়ার জন্য,কিন্তু পারি না।বর্তমানে ভীষণ ব্যস্ত আছি।সবার আগ্রহ থাকলে নেক্সট টাইম অন্য আরেকটা গল্প দিবো।সবাই ভালো থাকবে।আল্লাহ হাফেজ।