#অনুভূতিহীন (পর্ব ১১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
সকাল ৮ টার গাড়িতে রওনা দিবো আমরা। গতকাল থেকেই মনটা বিষণ্ন আমার। আজ যেন মনাকাশ জুড়ে শ্রাবনের কালো মেঘ ভেষে উঠেছে।
বেলকনিতে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে রিদ ভাই। আর তার কাধে মাথা রেখে চুপটি করে বসে আছি আমি। চার দিকে আজানের ধ্বনি ভেষে উঠলো। আকাশ টাও ধিরে ধিরে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
পাশে বসে থাকা রিদ ভাই ঘুমিয়ে আছে। আর আমি তার বাম হাত টা আকড়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে আছি। আজ সারা রাত এক মুহুর্তের জন্যও ঘুম হয়নি আমার। মনে হচ্ছিলো এই ঘুমিয়ে গেলেই সকাল হয়ে যাবে আর বাবা মা আমায় নিয়ে চলে যাবে। আর থাকা হবে না তার পাশে।
নিজের মাঝে একটা প্রশ্ন জাগে বার বার। আমি মেয়েটা তো এতোটাও আবেগি ছিলাম না। নিজের মতো থাকতাম সব সময়। এতো ছেলে পেছন ঘুরেছে, লাভ লেটার দিয়েছে, কিন্তু কারো প্রতি’ই কখনো বিশেষ কোনো অনুভূতি কাজ করেনি আমার।
তাহলে এই ১০-১২ দিনে আমার মাঝে কি হয়ে গেলো, যে আমার এতো কষ্ট হচ্ছে?
আমার পাশে বসে থাকা মানুষটার মাঝে তো বিশেষ কোনো কারণ ও নেই। অন্য আট দশটা মানুষের মতোই তো মানুষ। তবুও কেন আমার কাছে মনে হয় সে আমার কাছে সবার চেয়ে আলাদা? কেন তাকে আমার এতো ভালো লাগে? কেন তাকে আমি এতো ভালোবাসি? এই কারণ টা খুজতে খুজতে হয়তো আমার বাকি জীবনটাই কেটে যাবে।
ভালোবাসা হয়তো এমনই হয়। কেও পরে রুপের মায়ায়, কেও পরে হাসির মায়ায়। কিন্তু এই মায়া কতোদিন থাকে? আজ রুপে এসিড পরুক কাল ভালোবাসা শেষ। আজ তার হাসির সৌন্দর্যটা চলে যাক কাল ভালোবাসা শেষ। সৌন্দর্যের মায়ায় পরে ভালোবাসা গুলো অনেক সময় সৌন্দর্যের সাথে সাথেই ক্ষয় হতে শুরু করে।
তবে কিছু ভালোবাসা এমনও হয় যে, আমি মানুষটাকে ভালোবাসি। তবে কেন বাসি তা আমি জানিনা। সারাক্ষন শুধু কারণ খুজে যাই। আর এই কারণ খুজতে খুজতে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি। তারপর ওই কারণ খুজতে খুজতে মানুষটার সাথে সারা জীবন ফুরিয়ে যায়, তবে ভালোবাসা থেকে যায় আগের মতোই। বৃদ্ধ বয়সে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি মানুষটাকে কেন এতো ভালোবেসেছো? তার মাঝে এমন বিশেষ কিছু কি ছিলো?
উত্তর টা তখন পাওয়া যায়, মানুষ টার মাঝে বিশেষ কিছু না থাকলেও ব্যক্তিত্বটা ভালো ছিলো। বিশেষ কিছু না থাকলেও মানুষ টা বড্ড ভালো ছিলো। হয়তো এটাই তার প্রতি ভালোবাসার কারণ।
তেমনই আমার প্রিয় মানুষটাকে আমি কারণে নয়, অকারনেই ভালোবাসবো।
,
,
সকালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। দু’চোখ লাল হয়ে আছে আমার। রাতে ঘুম না হওয়ায় শরির টাও ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। ওয়াশ রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হলাম শরির টা একটু হালকা হতে।
তখন ৭ টা বাজে। কাপর গোছাচ্ছি আমি। বাবা-মা, মামা-মামি তারা নাস্তা শেষে এখন গল্পে মেতে উঠলো।
কাপর গোছালো শেষ হলেই অনুভব করি কেও একজন এসে আমার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। তার স্পর্শে বার বার সারা শরির কেঁপে উঠে আমার।
আমিও চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। কিছুক্ষন পর আবার কি মনে করে আমার ছেরে একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো। আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম। তার কাছাকাছি গিয়ে বললাম,
– আমায় মিস করবেন?
সে কিছু বললো না চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আমিও বুঝে নিলাম, কারণ কখনো কখনো নিরবতাই সম্মতির লক্ষন।
আমি আবার বললাম,
– আমিও খুব মিস করবো আপনাকে। কষ্টও হবে আমার। চলেন না আমার সাথে ওখানে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবেন।
আরশি আর রিদের মাঝে এই একটাই পার্থক্য। রিদ ভালোবাসলেও নিজের আবেগ কন্ট্রোল করতে পারে। আর আরশি একটুতেই নিজের সব আবেগ এলোমেলো করে ফেলে। খুবই আবেগি মেয়েটা।
– আজ থেকে আপনাকে আর কেও জ্বালাবে না। কেও বিরক্ত করবে না। খুব স্বাধিন ভাবে আগের মতো করে থাকতে পারবেন।
আমার কথা শুনে সে কিছু বললো না, চুপচাপ রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আমি তার হাত ধরে নিলাম। তার দিকে চেয়ে বললাম,
– গত কালকেরে মতো আমার একটু জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ।
সে এখনো কিছু বললো না চুপচাপ এসে আমার জড়িয়ে ধরলো। কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
– নিজের যত্ন নিও। আর হ্যা আবেগ গুলো একটু কন্ট্রোলে রাখতে শিখো। নাহলে এতো আবেগ তোমাকে শুধু ডিপ্রশনের দিকেই নিয়ে যাবে। পরিক্ষা টা ভালোভাবে দিও। এর পর একেবারে নিয়ে আসবো সারা জীবনের জন্য।
আর কিছু না বলে চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। আমি তার দিকে চেয়ে আছি। ইচ্ছে করছে জীবন টা এখানেই থামিয়ে দিতে।
,
,
আমার বাবা মায়ের কোনো পার্সনাল গাড়ি নেই। দুর রাস্তা বাসেই চলাচল করে তারা। তাই আগেই বাসের টিকেট কেটে রেখেছে। মামা বলেছিলো ড্রাইভারকে বলে বাড়ি অব্দি পৌছে দিতে। বাবা নিলো না। আর টিকেট আগেই কেটে রেখে এসেছে।
বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম আমরা। রিদ ভাই গাড়ি করে বাসস্টপ পর্যন্ত নিয়ে গেলো।
বাবা রিদ ভাইয়ের সাথে কি যেন বলছে। আমি মায়ের সাথে দাড়িয়ে ছিলাম। বোরকা, হিজাব, হাতে মুজা পরা। শুধু চোখ দুটু দেখা যাচ্ছিলো। আগে হাতে মুজা পরতাম না। গরমে বিরক্ত লাগতো আমার। কিন্তু সকালে রিদ ভাই আমার হাতে দিয়ে বললো, আমার হাতও যেন কেও না দেখে। নিজেকে হেফাজত রাখতে।
আমি শুরু থেকেই নিজের আবেগের কন্ট্রোট হারিয়ে ফেলেছি। কার কাছে আবেগ লুকিয়ে রাখবো? এই মানুষটাই তো এখন আমার সব।
আর কিছু ভাবতে পারছি না, তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। যে যা ভাববে ভাবুক। কষ্ট টা তো আর কেও বুঝবে না।
বাবা মা গাড়িতে উঠে গেলো। তার থেকে বিদায় নিয়ে আমিও উঠে গেলাম গাড়িতে। একটু পরই গাড়ি ছেড়ে দিলো। জানালার পাশে সিট আমার। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে।
তিনি একটু মুচকি হেসে হাত নাড়িয়ে আমায় বিদায় জানালো। সোজা রাস্তা, গাড়ি কিছুটা দুরে চলে এসেছে। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে আছি, যতক্ষন না তাকে দেখা যাচ্ছে। পাশ থেকে মা বলল,
– এবার মাথাটা ভিতরে নিয়ে আয়, না হলে অপর পাশ থেকে গাড়ি এসে মেরে দিবে।
আমি মাথা ভিতরে এনে বসে রইলাম চুপচাপ। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। এই কয়দিনে খুব আপন হয়ে গেছে এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ।
,
,
বাস থেকে নেমে একটা সি’এন জি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চললাম। গ্রামিন রাস্তা, দুই পাশে সারি সারি গাছ। দুই পাশেই সবুজ ধান ক্ষেত।
মেইন রোড, তীব্র গতিতে গাড়ি চলছে, মনে হচ্ছে বাতাস বইছে খুব জোড়ে। আজ দশ-বারো দিন পর নিজ এলাকায় ফিরে এসেছি।
একটু দুড়েই একটা ছোট খাটো মার্কেট। ওই মার্কেট পার হলেই কলেজ। আর কলেজের একটু পাশেই তার বাড়ি।
কিছুটা আসতেই দেখি কিছু মানুষের ভির। রাস্তার পাশে অনেক গুলো মানুষ ভির করে চেয়ারম্যান এর সাথে কথা বলছে। তার একটু দুরেই বাইকের উপর বসে কার সাথে ফোনে কথা বলছে আসিফ। তার সাথে আরো অনেক গুলো ছেলে। অনেক গুলো বাইক দিয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে ছেলেগুলো। আর একটু দুরেই চেয়ারম্যান চাচা কথা বলছে অন্যান্য মানুষদের সাথে।
আসিফ কে দেখেই আমার বুকটা ধুক ধুক করতে শুরু করলো। আমি সি’এন জি এর মাঝে মাথাটা লুকিয়ে নিজেকে একটু আড়াল করার চেষ্টা করলাম। সারা শরির কাপছে আমার। হয়তো আমার এমন ভয়ের কারণ টা বাবা বুঝতে পেরেছে। আমার একটা হাত ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিলো কিছু হবে না। বাবা আমার হাত টা ধরতেই আমি যেন একটু ভরসা পেলাম। তবুও ভয় হচ্ছে খুব।
To be continue….