অনুভূতিতে তুমি 💖পর্ব-২৯

0
2488

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৯

আজকের দিনটা সুন্দর! সকাল থেকেই আকাশ টা পরিষ্কার। গত দিনের বৃষ্টি থেমেছে আজ ভোরবেলা। এরপর থেকেই আকাশ দেখতে চমৎকার লাগছে। সকালটা কেমন একটা শীত শীত ভাবও আছে। নিরব বিছানা ছেড়ে বের হয়ে এলো। আজকের দিনের অনেক প্ল্যান করে রেখেছে সে। আজ তার ভালোবাসার প্রকাশ করবে সে। যাই হোক না কেন আজ তাকে তা করতেই হবে। এতো দিন তাকে ছাড়া অন্য কোন ছেলে মেহেরিন’র জীবনে ছিল না বলেই এতোটা ভাবতে হয় নি। কিন্তু ওই ফাহান এবার বেশি বেশি করছে। কেন মনে হচ্ছে বার বার এই ফাহান তার থেকে তার মেহু কে কেড়ে নিবে।

সকাল থেকেই এর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। প্রপোজ তো করবে বিকেল বেলা আর এখন তো সবে সকাল। কিন্তু সাবধানের মার নেই। শেষ মুহূর্তে এসে যদি ভালোবাসি কথাটা বলতে না পারে তখন কি হবে। ১০৮ বার রিয়াসেল করল। যার মাঝে ১০০ বার’ই কথার মাঝে হোঁচট খেল সে। বাকি ৮ বার তাও যা একটু বলল তবে তার সেটা পছন্দ হলো না।

শাওয়ার নিয়ে এসে গরম কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করল। অতঃপর ভাবতে লাগল দিনটা শুরু কিভাবে করবে। আচ্ছা গোলাপ দিয়ে কি প্রপোজ করবে নাকি জবা! নাকি কোন গিফট বা আংটি। না না এটা বেমানান লাগবে। আংটি তো বিয়ের প্রপোজালে দেয়। সেটাই কি করবে নাকি।

“আহ আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না, যত’ই ভাবছি ততোই গুলিয়ে ফেলছি।”

হুট করেই বিছানার মাঝে লুকিয়ে পড়ল। ঘুম নেওয়া দরকার। ঘুমালে মাইন্ড ফ্রেস হবে। তখন আর সমস্যা হবে না। এই ভোর দুপুরে সূর্য উঠে গেছে মাথা বরাবর। তখন ঘুমানোর কথা ভাবাও যায় না। কিন্তু নিরব সেখানে ঘুমে মাতাল। তবে ঘুমের মাঝেই স্বপ্ন দেখলো মেহু কে নিয়ে। ঘুম তার ভালো লাগে এই একটাই কারণে। এখানে তার কল্পনার মেহু কে ভালোবাসতে পারে সে। এখানে ভালোবাসি বলতে হোঁচট খেতে হয় না। নির্ধিতায় বলা যায়।

বিকালে গাড়ি নিয়ে বের হলো নিরব। খান বাড়ির কাছে এসে গাড়ি থামাল নিরব। ফোন বের করে মেহেরিন কে কল করতে যাবে তখনই তার সামনে দিয়ে ফাহান আর মেহেরিন’র গাড়িতে উঠলো। নিরব ফোনটা হাতে রেখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।

ফাহান মেহেরিন কে গাড়িতে বসিয়ে নিজে বসল। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিল। নিরব তাদের গাড়ি ফলো করতে লাগলো। সন্ধ্যা অবদি নিরব তাদের ফলো করতে লাগলো। ফাহান সন্ধ্যা অবদি মেহেরিন কে নিয়ে ঘুরল। অতঃপর ফাহান এক জায়গায় গাড়ি থামাল। মেহেরিন গাড়ি থেকে নেমে মুখ খুলে শ্বাস নিয়ে বলল,

“অবশেষে কোথায় থামলে তুমি..

ফাহান মুচকি হেসে মেহেরিন’র হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করল। অতঃপর তাকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। মেহেরিন বিনা বাক্যে ফাহানের হাত ধরে হাঁটতে লাগল। মনে হলো কোন একটা গোলক ধাঁধা’র মাঝে তারা ঢুকে পড়েছে। চারপাশের গাছ গাছালিতে লাইটিং করা। মেহেরিন এসব দেখছে আর অবাক হচ্ছে। ফাহান মেহেরিন কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ভালো লাগল এসব!

মেহেরিন মুচকি হেসে বলে,
“খুব সুন্দর!

“আসল সারপ্রাইজ এখনো বাকি!
বলেই মেহেরিন’র হাত ধরে দৌড়াতে থাকে সে। মেহেরিনও দৌড়াচ্ছে তার সাথে। এক পর্যায়ে ফাহান হাত ছেড়ে দেয় মেহেরিন। মেহেরিন এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। মাথার উপরে জুড়ে লাইটিং করা। চারদিকে অন্ধকারের মাঝে এই আলো অভিভূত করল তাকে। মেহেরিন ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি রেখে এসব দেখতে থাকে। অতঃপর পিছনে ঘুরে ফাহান যেই না ফাহান কে কিছু বলতে যাবে, ওমনি সে থমকে গেল। দেখল ফাহান তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার হাতে লাল রঙের একটা তাজা গোলাপ। ফাহান বলে উঠল,

“ভালোবাসি তোমায় মেহেরিন! ভালোবাসবে কি তুমি আমায়?

মেহেরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এদিকে ফাহান খুব নার্ভাস। কি হবে না হবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওদিকে নিরব নিশ্চুপ ভাবে দাড়িয়ে আছে। কি হবে এখন, মেহেরিন কি স্বীকার করবে এই ভালোবাসা! দেখার জন্য অস্থির তার মন।

মেহেরিন মুচকি হাসল। তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে ফাহানের হাত থেকে ফুল টা নিয়ে ফাহানের গাল দুটো আকড়ে ধরল। অতঃপর তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,

“ভালোবাসি!

মেহেরিন’র মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনে নিরবের মলিন মুখের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।‌ ফাহান হেসে উঠে দাঁড়াল।‌‌ মেহেরিন দুটো হাত আঁকড়ে ধরে বলল,

“তুমি জানো না আজ কতোটা খুশি আমি।

মেহেরিন একগাল হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফাহান মেহেরিন’র চোখের দিকে তাকাল।‌ অতঃপর ধীরে তার দুই হাত দ্বারা তার গাল আকড়ে ধরল।‌ চুমু খেল তার ঠোঁটে। মেহেরিন হুট করে কেঁপে উঠলো। তার শরীরের জ্যাকেট আকড়ে ধরল সে।‌ ফাহান কে চুমু খেতে লাগল।
নিরব কঠিন মুখ করে মুহূর্তে’ই সেখান থেকে চলে এলো। দ্রুত হেঁটে বের হয়ে এলো সে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।‌গাড়ির কাছে এসে গাড়ির দরজা খুলে আর ভেতরে ঢুকতে পারল ন সে। গাড়ির সামনেই ধপাস করে বসে করল। চোখের অশ্রু বাঁধ মানতে চাইছে না।‌ একসময় তা চোখ বেয়ে পড়ে গেল। মেহুর জন্য রাখা গোলাপটা জ্যাকেটে পকেট থেকে বের করল‌ সে। গোলাপের দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ হয়ে। প্রিয় মানুষ কে হারিয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। খুব দেরি করে ফেলেছে । যদি আরো আগেই মেহু কে বলে দিত ভালোবাসার কথা হয়তো আজ এই দিন দেখা লাগতো না তার।

——

নিরব খুব জোরেই গাড়ি ব্রেক কসল। বুকের মাঝে হাত ধরল। হুট করেই কেন আজ এতো ব্যাথা হচ্ছে। অতীতের কথা খুব মনে পড়ছে আজ তার। সেই দিনের কষ্টের অনুভব আজও হচ্ছে তার। কেন তার জানা নেই, তবে কি আবারও মেহু কে হারাতে চলল সে।
গাড়ির কাচ নামিয়ে বাইরে তাকাল সে। খান বাড়িতে এসেছে সে।‌ কিন্তু মেহুর জন্য না। মেহু এখন অফিসে। আজ এসেছে নির্ঝরের জন্য। নির্ঝর তাকে ফোন করে আসতে বলেছে। কি জন্য তাকে আসতে বলেছে তার জান নেই। তবুও খুব অস্থির সে।

মুখ খুলে দম ফেলে গাড়ির থেমে নামল সে। বাড়ির ভিতরে যেতে নিবে অমনি পেছন থেকে নির্ঝর ডাকল। নিরব তার দিকে ফিরতেই নির্ঝর তাকে আসার জন্য ইশারা করল। নিরব তার পিছু পিছু গেল। বাগানের কাছে এসে বসল নির্ঝর। নিরব কে বসতে বলল চেয়ারে। অতঃপর কাপে চা ঢেলে তার সামনে রেখে বলল,

“তোমার টাইমসেন্স খুব ভালো!

নিরব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বলল,
“আমাকে ডেকেছ কেন?

“অবশ্যই ডেকেছি আর কোন কারণেই ডেকেছি।

নিরব ভ্র কুঁচকে বলল,
“কি কারণে?

নির্ঝর শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নিরব বলে উঠল,
“অর্ণব কোথায়?

“ঘুমাচ্ছে!

“ওহ আচ্ছা!

নির্ঝর এবার নিরবের দিকে ঝুঁকল। নিরব ভ্রু কুচকালো। নির্ঝর বলে উঠল,

“মেহু আর ফাহানের বিচ্ছেদের কারণ কি?

নির্ঝরের কথায় নিরবের উপর কোন প্রভাব পড়ল না। সে স্বাভাবিক ভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুচকি হেসে বলল,

“দেখ নিরব, আমি জানি তোমার আর আমার বনে না। তবে এটা আমার জন্য জানা খুব দরকার। আমি জানো তুমি এটা জানো!

“আমি কেন তোমাকে বলবো!

“কেন? তুমি চাইবে না মেহু ভালো থাকুক!

নিরব মুখ খুলে শ্বাস নিল। নির্ঝর তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নিরব মুখটা কঠিন করে বলল,
“এই ফাহান কে কখনোই আমার পছন্দ ছিল না।

“তাহলে কি এই বিচ্ছেদের কারণ তুমি? তুমি বিচ্ছেদ করিয়েছিলে তাদের!

নিরব উপহাস করে হাসল। বলে উঠল,
“মেহু যেদিন ফাহান কে স্বীকার করে নিয়েছিল সেই দিন’ই আমি মেহু থেকে দূরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও শান্ত হতে পারছিলাম না। তাই মেহুর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। চলে গেলাম কানাডায়। ভাবলাম হয়তো মেহু কে ভুলে যাবো। কিন্তু এর মাঝেই জানতে পারলাম তারা দুজন আলাদা হয়ে গেছে।

“কিন্তু কেন? মেহু তো খুব ভালোবাসতো না ফাহান কে!

নিরব মুচকি হাসল। শান্ত ভাবে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“সব ভালোবাসার যেমন প্রকাশ হয় না তেমনি প্রকাশ করার পর সব ভালোবাসা টিকে না। ভালোবাসা কথাটা এতো সহজ সরল হলেও তা টিকিয়ে রাখা বড্ড কঠিন। অনেক টানাপোড়েন আর তিক্ততা দিয়ে এই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে হয়। তবে সবাই সেটা পাড়ে না। মেহুর জীবনে ভালোবাসার দরকার ছিল। দরকার ছিল এমন একজনকে যে তাকে আগলে রাখবে সারাজীবন।

বলেই দম নিল নিরব। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“মেহুর মনে হয়েছিল এই ভালোবাসা হয়তো ফাহান তাকে দেবে। কিন্তু ওই যে বললাম তিক্ততা আর টানপড়োনে সব ভালোবাসা টিকে থাকে না।

নির্ঝর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এই টানপোড়েন আর তিক্ততা’র কারণ কি ছিল?

নিরব কঠিন মুখ চোখ করে বলল,
“অর্ণব!

নির্ঝর অবাক কন্ঠে বলল,
“অর্ণ!

নিরব শব্দ করে শ্বাস নিল। নিজের দুটো হাত একত্রে করে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ফাহানের মনে হয়েছিল মেহুর জীবন থেকে তার প্রত্যেকটা প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাবার একমাত্র কারণ অর্ণব। সে কোনভাবেই চায় নি অর্ণবের সাথে থাকতে। তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। সেদিন মেহু আমাকে কল করে সেই বিয়ের কথাই বলছিল। খুব এক্সাইটেড ছিল সে এই বিয়ে নিয়ে! হঠাৎ করেই…

অতীতে,

“কনগ্রেচুলেশন! অবশেষে বিয়ের তারিখ টা ঠিক করেই ফেললি। তবে এতো লেট কেন?

“আসলে, সেদিন আমার আর ফাহানের প্রথম দেখা হয়েছিল। তাই…

নিরব মেহুর কথায় মুচকি হাসল। মনে মনে এই প্রার্থনা করতে লাগলো,

“যদি এমনটা হতো তোর আর ফাহানের কখনো দেখাই হতো না, তাহলে আজ তুই আমার’ই হতি মেহু!

ওপাশ থেকে মেহেরিন বলে উঠল,
“কি ব্যাপার কথা বলছিস না যে?

“হ্যাঁ বল!

“বলছি দ্রুত দেশে চলে আয়। আমার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু তুই’ই করবি!

নিরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হুম তাই তো..

হঠাৎ করেই অর্ণবের কান্না’র আওয়াজ এলো। মেহেরিন নিরব কে বলে উঠল,

“এই অর্ণব হয়তো কাঁদছে, তুই একটু লাইনে থাক আমি আসছি..

বলেই ফোন টা ঘরে বাইরে বের হলো সে। এদিক নিরব কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে ল্যাবটবের কাজে মনোযোগ দিল। মেহেরিন বাইরে এসে দেখল অর্ণব গাড়ির কাছে নিচে বসে কাঁদছে। সে দ্রুত অর্ণব কে কোলে তুলে নিল।

“বাবা, কাঁদছো কেন? অর্ণ সোনা কি হয়েছে মাম্মি কে বলো। কেউ কিছু বলেছে তোমায়?

অর্ণব কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়িয়ে সামনে দেখাল। মেহেরিন এতোক্ষণে সামনে তাকাল। ফাহানের গাড়ি দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল তার। ফাহান গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ফাহানের কানে ব্লুটুথ! গাড়ির চাকার নিচে অর্ণবের খেলনা চুরমার হয়ে গেছে। ফাহান মেহেরিন কে এভাবে দেখে হতচকিয়ে গেল। দু”কান থেকে ব্লুটুথ সরিয়ে বলল,

“মেহেরিন!

মেহেরিন চোখ সরিয়ে নিল। ফাহান কে কিছু না বলেই ভিতরে চলে গেল। ফাহান পিছনে ফিরে দেখল। গাড়ির চাকা’র নিচে খেলনা। এটা অর্ণবের ছাড়া আর কারো নেই। এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কি না মেহেরিন তার সাথে এমন করল।

ফাহান রেগে বাড়ির ভেতরে গেল। মেহেরিন এতোক্ষণে অর্ণব কে শান্ত করিয়ে ফেলেছে। তাকে সোফায় বসিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। ফাহান রেগে এসে মেহেরিন’র সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

“মেহেরিন!

তার উচ্চস্বরে অর্ণব কেঁপে উঠলো। মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। অর্ণব এসে লুকাল মেহেরিন’র পিছনে। ফাহান বলে উঠল,

“সমস্যা কি তোমার? এমন ব্যবহার কেন করছো তুমি!

“প্রথমে তুমি ধীরে কথা বলো, অর্ণব ভয় পাচ্ছে।

ফাহান পিছনে ফিরে দেখল অর্ণব মেহেরিন’কে আকড়ে ধরে আছে। তার অসহ্য লাগল। সে মেহেরিন কে বলে উঠলো,

“ঘরে আসো!

বলেই ঘরের দিকে চলে গেল। মেহেরিন মিস মারিয়া’র কাছে অর্ণব কে রেখে ঘরের দিকে গেল। তার পিছু পিছু অর্ণব ও এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। মিস মারিয়া তার পিছনে দাঁড়িয়ে তাকে ধরে রইল। ফাহান ঘরে এসে পায়চারি করছে। মেহেরিন এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“এতোটা বোকামি কিভাবে করো তুমি!

“আমি বোকামি করেছি!

“তা নয়তো কি? আরেকটু হলেই গাড়ির নিচে তুমি অর্ণব কে.. ( বলেই থেমে গেল মেহেরিন! )

“এটা কি আমার দোষ। অর্ণব কি করছিল গাড়ির কাছে।

“খেলছিল। বাচ্চা মানুষ! খেলতে খেলতে গাড়ির কাছে চলে এসেছিল। কিন্তু তুমি তো বাচ্চা নও। এসব খেয়াল রেখে গাড়ি চালাতে পারলে না। সেদিনও তুমি এমন করেছিলে, শপিং মলে অর্ণব কে রেখে চলেছিল। বেচারা ভয়ে এক কোনে বসে দাঁড়িয়েছিল। একটু দেখেশুনে রাখতে পারলে না তুমি ওকে।

বলেই ফাহান কে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে এলো মেহেরিন। ফাহান নিশ্চুপ হয়ে রইল। মেহেরিন বলে উঠল,

“ফাহান! অর্ণব একটা বাচ্চা মানুষ। আর বাকি বাচ্চা’র মতো না সে। তুমি কেন ওকে একটু বেশি কেয়ার করতে পারো না বলো। এতোটা কেয়াললেস কিভাবে হয় তুমি!

ফাহান শব্দ করে শ্বাস ফেলল। বলে উঠল,
“একটা কথা বলো তো মেহেরিন!

মেহেরিন কিছু বললো না। শুধু বিরক্ত হয়ে দুই হাত বাহুতে গুজল। ফাহান হুট করে এসে মেহেরিন’র দুই বাহু চেপে ধরে তার দিকে ঘুরাল। বলে উঠল,
“আচ্ছা বলোতো, আমাদের সন্তান হলে তখন কাকে তুমি বেশি কেয়ার করবে।‌ অর্ণব কে নাকি তাকে…

মেহেরিন’র কপালে ভাঁজ পড়ল। ফাহানের চোখের দিকেই তাকিয়ে বুঝল সে খুব সিরিয়াস। সে শান্ত গলায় বলল,

“এসব কোন ধরণের কথা ফাহান!

“তুমি উওর দাও।

“অর্ণব আমার সন্তান ফাহান।

ফাহান বিরক্ত হয়ে গেল। হুট করে ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“আমি জানতাম, আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে!

“ফাহান!

“কি ফাহান‌‌ ফাহান করছো? তুমি বুঝতে পারছো তুমি তোমার পৃথিবী জুড়ে শুধু অর্ণব কে নিয়েই আছো।

উচ্চস্বরে কথা গুলো বলল ফাহান। তার তার চোখের দিকে তাকাল। নিজেকে শান্ত রেখে ফাহানের দুই গালে হাত রেখে বলল,

“ফাহান শান্ত হও। তুমি তো জানো অর্ণবের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কে সামলাবে তাকে।

মেহেরিন’র হাত খানা সরিয়ে দিল সে। বলে উঠল,

“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। এই অর্ণব, অর্ণব আর অর্ণব। মেহেরিন তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া অবদি অর্ণব। তোমার সব জায়গায় তুমি অর্ণব কে চাও। একবারও ভেবে দেখেছ তোমারও একটা ভবিষ্যত আছে।

“ফাহান আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব রেগে আছো। কিন্তু আমার কথা…

“মেহেরিন আমি রেগে নেই। রেগে নেই আমি! যা বলছি সুস্থ আর স্বাভাবিক ভাবেই বলছি। তুমি শুধু এইটা বলো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবছ কখনো। নাকি সারাজীবন ভেবেছ এই অর্ণব নিয়েই কাটিয়ে দেবো।

মেহেরিন হেসে বলল,
“আমার দুই পৃথিবী জুড়ে শুধু তোমরাই আছো ফাহান। আর কে আছে এখানে..

“মেহেরিন, আমার কথা শুনো। ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করো। বলো ভালোবাসো আমাকে।

“খুব!

“আর কয়েকমাসের মধ্যেই বিয়ে করছি আমরা তাই না বলো। আমি কথা দিচ্ছি খুব খেয়াল রাখবো তোমার। অনেক ভালোবাসবো তোমায়। কিন্তু তুমি..

“আমি..

“তুমি যেকেনো একজন কে বেছে নাও।

“মানে..

ফাহান শ্বাস নিল। অতঃপর ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

“মানে মেহেরিন! তুমি হয়তো আমার সাথে থাকবে নাহলে অর্ণবের সাথে। আমি আর পারছি টলোরেট করতে।‌

মেহেরিন হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে কি বলবে তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও শান্ত গলায় বলে উঠল,

“ফাহান! তোমরা কেউ আমার কাছে ওপশন নও।

“কিন্তু তোমাকে করতে হবে মেহেরিন। বেছে নাও হয়তো আমি নাহলে অর্ণব!

মেহেরিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখের কোনে অশ্রু জমছে। ফাহান জড়িয়ে ধরল তাকে। তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“মেহেরিন আমি জানি তুমি অর্ণব কে খুব ভালোবাসো। কিন্তু আমি চাই না অর্ণবের সাথে আমাদের নতুন জীবন শুরু করতে। তুমি বুঝতে পারছো না আমার ভয় হয়। মনে হয় অর্ণব থাকলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। মেহেরিন তুমি’ই‌ বলো, আমাদের নতুন জীবনে আমি থাকবো তুমি থাকবে। আর কিসের অভাব করবে তুমি।

মেহেরিন হেসে বলল,

“অভাব করবো না ফাহান!

ফাহান ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মেহেরিন শুধু বলে উঠল,

“তখন আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো, সবকিছুই হারিয়ে যাবে। তখন আর কিসের অভাব থাকবে।

ফাহান শব্দ করে দম ছাড়ল। মাথায় হাত রেখে বলল,
“তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমি, আসলে তুমি বুঝতেই চাইছো না। তোমার কি মনে হয় না অর্ণব আসার আগে তোমার জীবনের সবকিছু ঠিক ছিল। সে আশার পর পর’ই সবকিছু তোমার থেকে হারিয়ে গেল তাই নয় কি!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। উপহাসের হাসি হেসে বলল,
“ফাহান, ও একটা বাচ্চা। তুমি এমনটা ভাবতে পারো কিভাবে! এতোটা নিম্ন তোমার চিন্তা ধারা। আমি জানি তুমি ওকে পছন্দ করো না তাই বলে এভাবে ওর উপর দোষারোপ দিতে পারো না।

ফাহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমার চিন্তাধারা নিম্ন!

“ফাহান..

“মানে তুমি বলতে চাইছো আমার চিন্তা ধারা নিম্ন। অর্ণবের জন্য তুমি আমাকে এই কথা বলছো ( চেঁচিয়ে উঠলো সে )

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“দেখো মেহেরিন তুমি এভাবে আমাকে বলতে পারো না। একটা কথা শুনে রাখো, আমার অর্ণব কে ভালো লাগে না। সহ্য করতে পারি না আমি ওকে। ওর উপস্থিত আমাকে রাগিয়ে তুলে। আর এতো সিমপ্যাথি তুমি দেখাচ্ছ কেন? ও তো তোমার নিজের সন্তান ও নয়। তোমার মৃত বোনের সন্তা….

বলার আগেই ফাহান চুপ হয়ে গেল। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল মেহেরিন’র দিকে। তার বা গাল’টা এর মাঝেই লাল হয়ে গেছে। কি হয়েছে তা ভাবতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার। মেহেরিন ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। বলে উঠল,

“অর্ণব আমার সন্তান, আমার নিজ সন্তান বুঝলে তুমি! ( চেঁচিয়ে উঠলো )

“মেহেরিন তুমি আমাকে..

“আর একটা কথাও না। বের হও!

“মে..

“আই সে গেট আউট! বের হও। আমি আমার জীবন বেছে নিয়েছি‌।

ফাহান কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল। তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। কিছু না বলেই বের হয়ে গেল সে। মেহেরিন দ্রুত’ই ধপাস করে বসে পড়ল মেঝেতে। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
ফাহান দরজা দিয়ে বের হতেই অর্ণব কে দেখতে পেলো। রাগি দৃষ্টি’তে তাকাল তার দিকে। অর্ণব দ্রুত’ই লুকিয়ে পড়ল মিস মারিয়া’র আড়ালে। মিস মারিয়াও কেঁপে উঠলো সাথে সাথে। ফাহান হন হন করে হেঁটে চলে গেল। সে যেতেই অর্ণব দৌড়ে আসল মেহেরিন’র কাছে। সামনে দাঁড়াল তার। ঝাপসা ঝাপসা চোখে অর্ণব কে দেখে জড়িয়ে ধরল সে তাকে। অর্ণব তার গালে চুমু খেল। তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বলে উঠল,

“মাম্মি!

মেহেরিন তাকিয়ে দেখল অর্ণবের চোখেও পানি জমতে শুরু করেছে। সাথে সাথে নিজের কান্না বন্ধ করে দিল সে। হেসে বলে উঠল,

“আহ আমার অর্ণব কাঁদছে কেন? কি হয়েছে! কিছুই হয় নি। চকলেট কেক খাবে অর্ণব। মাম্মি বানিয়ে দিবে নিজ হাতে।

ততোক্ষণে অর্ণবের চোখ গড়িয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মেহেরিন তা মুছে দিয়ে তার মাথায় চুমু খেল। অর্ণব তার ছোট্ট কোলখানা দখল করে নিল। গুটিসুটি মেরে বসে রইল তাতে!

নিরব হালকা কেশে বলে উঠল,
“শুধু তখন ফোনের লাইনে আমি ছিলাম বলেই সবটা জানতে পেরেছি। নাহলে হয়তো কিছুই জানতাম না আর না কখনো মেহু বলতো। এসব বলার মেয়ে সে না। তবুও নিজের জীবনে একজন কেই ভালোবেসে ছিল। এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া কারো পক্ষে’ই সম্ভব না। ওদের বিয়েটা হবার কথা ছিল ২৭ মে। এই দিন’ই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের। মেহু সেই তারিখ টা চেঞ্জ করে নি। বিয়েটা সেদিন’ই করেছে। তবে ফাহান কে না তোমাকে…

নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ব্যাপার টা এখন পরিষ্কার। এই কারণেই বিয়ের ডেট পিছায় নি নির্ঝর। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েও যেন শ্বাস নিতে পারছে না সে। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। নিরব এর মাঝেই উঠে দাঁড়াল। নির্ঝর কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

“আমি একবার তাকে হারিয়েছি, এবার আর না। এক বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ হলেই মেহু কে নিজের করে নেবো আমি।

নির্ঝর নিরবের দিকে ফিরল। শীতল গলায় বলে উঠল,

“সেটা সময় বলবে!

নিরবের ভ্রু কুঁচকে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে হন হন করে বেরিয়ে গেল সে। নির্ঝর বুকে হাত রেখে ধপ করে বসে পড়ল নিচে। হঠাৎ করেই ব্যাথা হচ্ছে হচ্ছে খুব। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে বসে রইল। “আহ” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। কোথায় খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তার। মেহেরিন’র কি তবে এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল নাকি আরো বেশি। তার কষ্টটা অনুভব করার শক্তি নেই তার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগল নির্ঝর। চোখ দুটো বন্ধ করতেই মেহেরিন’র হাসি মাখা মুখ ভেসে উঠলো তার সামনে!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here