অনুভূতিতে তুমি 💖পর্ব-৩৭

0
2173

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে)
#পর্ব_৩৭

( পর্ব বড় হওয়ায় ফেসবুক লাইট দিয়ে শো নাও হতে পারে! )

মেহুর স্নিগ্ধ হাসির দিকে তাকিয়ে আছে নির্ঝর! তার হরিণী’র চোখে প্রেমে পড়ছে বার বার। অপলক দৃষ্টিতে সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষা পড়ার অযথা চেষ্টা করছে। নির্ঝর হাত বাড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলাল। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেল। নির্ঝর হেসে তার কানের কাছে চুল গুলো গুঁজে দিল। চুমু খেল বদ্ধ চোখে। ললাটে উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিতেই ধপাস করে বিছানা থেকে পড়ে গেল সে। চমকে উঠে বসল, কি হয়েছে তা বুঝতেই খানিকক্ষণ সময় লাগল তার। পাশে মেহুর পরিবর্তে কোলবালিশ কে কোলে তুলে নিল। মাথায় হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল লজ্জায়। মুখ লাল হয়ে গেল নির্ঝরের। বালিশ জড়িয়ে ধরে মেঝেতে’ই শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে। হুট করেই লাফিয়ে উঠল।

চারদিক তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এখানে এলো কিভাবে,? দু’হাত মাথায় দিয়ে ধপাস করে নিচে বসে পড়ল। গতকালের কিছু কিছু কথা তার মনে পড়ছে। মেহু কে বলা সব কথাই মনে পড়ছে ধীরে। এতো কিছু কিভাবে বলল সে। একদম উচিত হয় নি এসব বলার। দাঁড়িয়ে পাইচারি করতে লাগলো।না জানি মেহু কতোটা রেগে আছে। আজ তো তার একদিন করেই ছাড়বে। নির্ঝর বিছানার দিকে তাকাল। বেশ মনে আছে মেহু কে নিয়েই…

না না মানে মেহু তো বিছানায় নেই, কোথায় গেল তাহলে। নির্ঝর মিটিমিটি পায়ে ঘর থেকে বের হলো। আজ মনে হচ্ছে সবার আগে সেই’ই ঘুম থেকে উঠেছে। রান্না ঘর থেকে টুকটাক শব্দ এলো কানে। এর মানে সে আগে উঠেনি। রান্না’র শব্দ মানে মিস মারিয়া চা বানাচ্ছে। সে মেহুর ঘরে ছিল এর মানে মেহু তার ঘরে!

ঢোক গিলে ঘরের দরজা খুলল। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে মেহু! তার দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হুট করেই কেউ তার শার্ট টেনে ধরল। নির্ঝর নিচে তাকিয়ে দেখল অর্ণব দাঁড়ানো। অর্ণব বলে উঠল,

“ড্যাডি!

নির্ঝর আতঙ্কিত চোখে তাকাল। মেহু নড়েচড়ে উঠল। নির্ঝর দ্রুত অর্ণব নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল!

খাবার টেবিলে আর নিশ্চুপতা। মেহু কিছু বলছে না চুপচাপ খাবার খাচ্ছে আর অর্ণবকে খাইয়ে দিচ্ছে। নির্ঝর আতংকে আছে কখন যে মেহু কিছু বলে তাকে। কিন্তু মেহু কিছু না বলেই উঠে গেল। নির্ঝর অর্ণবের দিকে তাকাল।

ঘরে ঢুকল মেহু। পুরো ঘরের দিকে চোখ বুলাল সে। গতকালের ঘটনা তার সম্পূর্ণ মনে আছে। নির্ঝর তাকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। না একদম গভীর ঘুমে ছিল না সে। তার কন্ঠ দিয়ে শুধু একটা কথাই বাজছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি মেহু, খুব ভালোবাসি! তার গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল মেহুর ঘাড়ে। নিজেকে খানিকক্ষণ’র জন্য অসহায় মনে হচ্ছিল তার।‌ অতঃপর নিজেকে শক্ত করে নিল। নির্ঝর সরাল! ছুটে দরজার বাইরে চলে এলো। তখনও নির্ঝরের কন্ঠের মেহু ডাক তার কানে এসে বাজল। মেহেরিন থমকে গেল। পেছনে ফিরে দেখল নির্ঝর বিছনায় মাতাল অবস্থায় পড়ে আছে। এভাবে তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারল না সে। আবারো পিছুটান নিল। নির্ঝরের গায়ের স্যুট খুলে দিল। তাকে ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দিল। নির্ঝর তখন বলে উঠল,

“তোমাকে ভালোবাসি মেহু, আমি আগলে রাখবো তোমাকে, আমার অর্ণব কে। মেহু! আমার সহ্য হয় না তোমাকে অন্য কারো সাথে মেহু!

কথাটা মেহেরিন’র মনে গাধল। আহ কতোদিন এই মধুর শব্দ শুনি নি সে। এক দৃষ্টিতে তখন তাকিয়ে ছিল নির্ঝরের দিকে। মনের মাঝে প্রশ্ন জাগল”কি করছিস তুই মেহু? এই নাকি ভালোবাসিস তুই ফাহান কে। তোর মনে তাকে ছাড়া আর কাউকে জায়গা দিলেই বা কি ভাবে। তুই কি ভালোবেসে ফেলছিস নির্ঝর কে?

আবার হুট করেই মনে হলো অন্য কেউ বলছে, “ঠিক করছিস না মেহু, দুনিয়ার সব পুরুষ মানুষ’ই এক। একজন যখন তোকে ঠকাতে পেরেছে অন্যজন কি পারবে না। এক বার ভালোবেসে ঠকেছিস আবারো সেই ভুল করবি তুই! ভুলে গেলি অর্ণবের কথা!

মেহু হাত সরিয়ে নিল। বলে উঠল, “না এ কখনো হয় না”
অতঃপর হেঁটে চলে এলো নির্ঝরের ঘরে। অর্ণব চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে এক কোনে। মেহেরিন তার পাশে এসে বসল। আঁকড়ে ধরল তাকে। আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছে এই একজন কেই আঁকড়ে ধরে বাঁচবে সে। এছাড়া আর কিছু হয় না!

—-

আজ প্রায় তিন দিন হতে চলল, অথচ মেহেরিন নির্ঝর কে একটা প্রশ্ন অবদি করল না। ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না তার। তার স্পষ্ট মনে আছে মেহু কে বলা কথা গুলো। এমনকি সিউর হবার জন্য ফরহাদ কে অবদি জিজ্ঞেস করেছে। ফরহাদ ও বলেছে খুব পাগলামি করেছে সেদিন। ঈশান তো বলল তাকে নাকি মেরে ফেলার চেষ্টা’ই করেছিল।

এতো বড় একটা ঘটনা কিন্তু মেহু তাকে একবার কিছু জিজ্ঞেস করল না এমনটা হতেই পারে না। কিছু না কিছুতো ব্যাপার আছেই। কি সেই ব্যাপার। মেহু ভালোবেসে ফেলল না তো আবার তাকে! কথাটা একবার মনে এলো আর নির্ঝর চেপে গেল। কারণ সেও জানে মেহু এতো সহজে মানবার পাত্র নয়। তাহলে কাহিনী কি?

নির্ঝর আর দাঁড়িয়ে রইল না, পা বাড়াল মেহুর কেবিনে। নিরব কে তার কেবিনে মাথা ধরে গেল তার। একগাদা বিরক্ত ভর করল তার মাথায়। তবুও বের হলো না। এসে বসল নিরবের পাশে। নিরব মেহেরিন কে কানাডার কোম্পানি নিয়ে কিছু বলছিল। নির্ঝর উঁকি দিয়ে তা দেখতে লাগল। মেহেরিন তার দিকে তাকাতেই সোজা হয়ে বসে ফোন বের করল।

পুরো ২০ মিনিট হয়ে গেল তবুও এই নিরব বের হওয়ায় নাম নিচ্ছে না। নির্ঝর দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকাল। দেখল মেহু খুব সুন্দর করে হেসে হেসে নিরবের সাথে কথা বলছে। নির্ঝর সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল।‌ বির বির করে বলল,

“আমার সাথে যখন কথা বলে তখন তো হাসে আর এখন কতো হাসছে !

বলেই মুখ ভেংচি কাটে। মেহেরিন আবার তাকায় তার দিকে। নির্ঝর দ্রুত চোখ নামিয়ে নিয়ে ফোনের দিকে নজর দেয়।‌ অবশেষে নিরব বের হলো কেবিন থেকে। মেহেরিন ল্যাবটপের দিকে নজর দিয়ে নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কিছু বলবেন?

নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। এসে ল্যাবটপ বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ কথা আছে।

“বলুন!

মেহেরিন’র চেয়ারে হাত দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল,
“তুমি কেন আমাকে কিছু বলছো না!

“কোন ব্যাপারে বলুন তো?

“মেহু, দেখো রাগ জমিয়ে রেখো না।

“আমি রাগ করে নেই তো..

নির্ঝর বলতে নিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ থমকে গেল। জিজ্ঞেস করল,
“কি বললে তুমি? তুমি রাগ করে নেই, এতো বড় ঘটনার পরও রাগ নেই তুমি!

মেহেরিন নির্ঝর কে সরিয়ে দিল দাঁড়িয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে কেবিনের ওপাশে গেল। একটা ফাইল চেক করতে করতে বলল,

“হুম!

নির্ঝর এসে মেহেরিন’র সামনে দাঁড়াল! অবাক চোখে দেখছে তাকে। মেহেরিন ফাইল বন্ধ করে বলল,

“ব্যাপার কি বলুন তো, এভাবে কেন দেখছেন আমাকে!

নির্ঝর মুখ টিপে হাসতে লাগলো। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে বলল,

“আপনি লজ্জা কেন পাচ্ছেন, এমন কি ঘটল?

নির্ঝর মুখ খুলে শ্বাস নিল। বলল,
“তুমি জানতে চাও!

“মানে..

নির্ঝর মেহেরিন’র হাত ধরে হুট করেই দেওয়ালের সাথে ঠেকাল। মেহেরিন আতংকে উঠল। নির্ঝর দেওয়ালে এক হাত রেখে মেহেরিন’র কাছে আসল। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে নিল। নির্ঝর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

“তুমি এর মানে টা বুঝতে পারছো?

“কিসের মানে?

“তুমি আমার উপর রাগ করো নি!

“হ্যাঁ!

“এতো বড় ঘটনার পরও রাগ করো নি!

মেহুর কপালে ভাঁজ পড়ল। নির্ঝর হেসে বলতে নিল এর মাঝেই নিরব দরজা খুলে বলল,

“মেহু এই ফাইল..

থমকে গেল, তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। নির্ঝর বিরক্ত আর রাগের চোটে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“কথা বলছি, যা বলরা একটু পরে বলো!

নিরব অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হেসে দরজা বন্ধ করে দিল। নির্ঝর হালকা কেশে বলল,

“আমি জানি কোথায় ছিলাম?

“ওই একই জায়গায় আটকে আছেন।

“ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তার মানে মেহু তুমি আমার প্রেমে পড়ে গেছো।

“কিহহ?

“হ্যাঁ, তা না হলে এতো বড় ব্যাপার নিয়ে আমাকে কিছু বললে না। এর মানে তো এটাই তাই না! আয়ি ঠিক ধরেছি বলো না। এবার একটু মুখেও বলো দাও ভালোবাসি!

মেহু হাসল। তার দেখাদেখি নির্ঝরও হাসল। মেহেরিন বলে উঠল,

“ভুল ভাবছেন,‌পাগল হয়ে গেছেন।

“হ্যাঁ তা তো তোমার প্রেমে পড়ে অনেক আগেই হয়ে গেছি।

“আসলেই, মাথার তার দু একটা ছিঁড়ে গেছে। নাহলে এতো আলতু ফালতু চিন্তা করেন কিভাবে? মিঃ নির্ঝর চৌধুরী এমন কিছু না যা আপনি ভাবছেন?

নির্ঝর চমকে বলে উঠে,
“মানে!

“মানে এটা আপনি একটা গর্দভ! ( একটু জোরেই বলল)

ওপাশ থেকে আড়িপাতা নিরব হেসে উঠল। মুখ টিপে হাসতে লাগল সে। মেহেরিন নির্ঝর কে বলল,

“শুনুন নির্ঝর, আমি সেই রাতের ঘটনা ভুলে যাই না তা না। শুধু গুরুত্ব দেই নি। কারণ আপনি ড্রিংক করে ছিলেন!

“তো, তুমি জানো ড্রিংক করলে মানুষ সত্যি কথা বলে!

মেহেরিন দাঁত বের করে হেসে বলে,
“না, ভুলভাল বলে। আর আমি তা ভুলভাল ভেবেই নিয়েছি আপনিও তাই করুন। আর যদি চান, সেদিনের রাতের ঘটনার ওপর রিয়েক্ট করি.. ( নির্ঝরের কাছে এসে, চোখে চোখ রেখে বলল ) ভয়ংকর বিপদে পড়বেন। তাই চেষ্টাও করবেন না। ( কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল ) বের হন এখান থেকে!

নির্ঝর কেঁপে উঠল। দ্রুত বের হলো কেবিন থেকে। গলার টাই লুজ করে দেওয়ালে লাথি মারল। নিরব তখন ফাইল হাতে সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে মুখ টিপে হাসল। নির্ঝর রেগে তার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে নিরব বলে উঠে,

“এতো সহজ না!

নির্ঝর থমকে গেল। নিরবের দিকে ফিরল। নিরব বলল,
“মেহু’র ভালোবাসা পাওয়া এতো সহজ না।

নির্ঝর কঠিন গলায় বলল,
“সেই কঠিন কেই আমি সহজ করে নেব। আর হ্যাঁ দরজায় আড়ি পাতা বন্ধ করো!

বলেই নির্ঝর হন হন করে চলে গেল। নিরব বিরক্ত কাটিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল।

—-

নিরব আজ রাতে খাবারের জন্য মেহেরিন, অর্ণব আর নির্ঝর কে ইনভাইট করেছে। নির্ঝর একগাদা বিরক্ত নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে। তার কোন সাধ ছিল না এখানে আসার। গাড়ির আয়নায় তাকিয়ে দেখল মেহেরিন বেশ খুশি। অর্ণব কে ধরে বসে আছে সে। অর্ণবের মুখটাও খুব গম্ভীর!

নির্ঝর গাড়ি থামাল নিরবের বাড়ির সামনে। নিরব বাড়িটা বেশ বড় না আবার বেশ ছোটও না। মাঝারি রকমের একটা বাড়ি। তার মা বাবা দুজনেই দেশের বাইরে থাকে তাই থাকতে বলতে নিরব একা। তবে এই বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো। বাগান আর ফুল গাছ দিয়ে বাড়িটা খুব ভালো করেই সাজানো। রাতের আঁধারেও চারদিক আলোকিত! ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নির্ঝর আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টির সময় এখন না তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। লোকে বলে এই বৃষ্টি শীত নামাবে। তবে কি তাই’ই হবে। অতঃপর আবারো এসে পড়বে বৈশাখ! মুহুর্তে তার বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব হলো। মেহু কে হারিয়ে ফেলার সময় এসে পড়ছে। খুব দ্রুত মনে হচ্ছে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

মেহেরিন অর্ণব কে নিয়ে বের হলো গাড়ি থেকে। বাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক সে। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বাড়িটা খুব সুন্দর তাই না অর্ণব!

অর্ণবও মাথা নাড়ল! গাড়ির আওয়াজে সার্ভেন্ট বের হয়ে এলো। তাদের কে ভিতরে আসতে অনুরোধ করল। ভেতরে এসে তার সবাই অবাক। বাড়িটা বেশ সাজানো গোছানো ভেতর থেকে। বাড়ির ভেতর আসতেই স্নিগ্ধ এক ধরনের আভাস পাওয়া গেল। এই অনুভূতি টা দারুন।‌কেমন‌ যেনো মনটা শান্ত হয়ে গেল। অর্ণব এসে নির্ঝরের হাত ধরল। মেহেরিন দেখল নিরব রান্না ঘরে। মেহু কে দেখে হেসে বলল,

“ওয়েলকাম!

“থ্যাংকু, কিন্তু তুই কি করছিস!

“রাধছি তোদের জন্য, রান্না প্রায় শেষ তোরা বস!

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকাল নিরবের দিকে। নিরব তাকেও বেসেও বসার জন্য অনুরোধ করল। মেহু না বসে হাঁটা ধরল রান্না ঘরের দিকে। নিরব কি রাঁধলো তা দেখছে সে। নিরব কে এবার কাছ থেকে দেখে ফিক করে হেসে দিল। নিরব ভ্রু কুচকালো।‌ মেহু হেসে বলল,

“তুই রাধছিস না অন্যকিছু, নিজের কি হাল করেছিস!

বলেই নিজের রুমাল বের করে কপাল মুছতে লাগল। কপালে খানিকটা মসলা লেগে ছিল। নির্ঝর দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অর্ণব একবার মেহুর দিকে তাকাল, একবার নির্ঝরের দিকে। নিরব হাসল। মেহু বলে উঠল,

“তুই যেই সুইট, যে তোর বউ হবে না খুব ভাগ্যবতী হবে বুঝলি! তাই না নির্ঝর!

বলেই নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর হেসে মাথা নাড়ল।

নিরব হেসে বলল,
“আমি ভাগ্যবান হবো না!

মেহু নিরবের কপালে বাড়ি মেরে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ খুব সুন্দর আর কিউট বউ জুটবে তোর কপালে দেখিস।

নিরব নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম তা তো জানি!

নির্ঝর দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নিল সব! খাবার টেবিলে বসে পড়েছে সবাই। নির্ঝরের পাশে অর্ণব, তার পাশে মেহেরিন। নিরব এতোক্ষণ সবাইকে খাবার সার্ভ করে নিজে এসে মেহুর পাশে বসল। অর্ণব আর নির্ঝর দুজনেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

মেহু খাবার মুখে দিয়ে বললো,
“দারুন হয়েছে খেতে!

অতঃপর অর্ণবের মুখে খাবার দিলো। অর্ণব খাবার খেয়ে হেসে মাথা নাড়ল। নিরব হেসে বলল,

“ধন্যবাদ!

নির্ঝর খাবার মুখে দিয়ে বলল,
“হুম ঠিকঠাক’ই আছে!

নিরব ভ্র কুচকালো। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।‌ হেসে বলল,

“খুব মজা হয়েছে রান্না!

নির্ঝর হেসে মাথা নাড়ল। রাগে’ই পেট ভরে গেছে তার। অর্ণব আর মেহেরিন খুশি মনে খাচ্ছে। আর নিরব! সে তো তাকিয়েই আছে মেহেরিন’র দিকে। নির্ঝর দাঁতে দাঁত চেপে শুধু দেখেই যাচ্ছে!

নিরব এগিয়ে এলো মেহেরিন, অর্ণব আর নির্ঝর কে বিদায় দেবার জন্য। বাড়ি থেকে বের হতে পাড়ায় নির্ঝর যেন হাফ ছেড়ে বাচঁল। মেহেরিন এখনো দাঁড়িয়ে প্রশংসা করে যাচ্ছে নিরবের। অর্ণব নিশ্চুপ দর্শকের মতো শুনে যাচ্ছে।
হঠাৎ নিরব একটু সিরিয়াস হয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে মেহেরিন কে বলল,

“মেহু! তোর সাথে আমার কথা আছে।

“হুম বল!

“না আজ না! কাল বলবো, খুব ইম্পর্ট্যান্টে!

নির্ঝরের কপাল কুঁচকে গেল। নিরবের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল কি বলবে সে মেহু কে। মেহু অবাক কন্ঠে বলল,

“খুব ইম্পর্ট্যান্টে হলে বল এখানে, অসুবিধা নেই তো!

নিরব হেসে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সব কিছুর একটা সময় থাকে আর আমার মতে সেই সময়টা কাল হবে। তুই আমাকে সময় দিতে পারবি না। শুধুমাত্র এক ঘণ্টার জন্য বেশি না! বিকেলে একটু সময় দিবি আমায়!

মেহেরিন হেসে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে কাল বিকালে দেখা হচ্ছে!

নিরব বলল,
“হুম!

নির্ঝর দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল,
“কাল অফ ডে! অফিসে পাবে না মেহু কে তাই বিকালে দেখা করতে চাইছে। কিন্তু কেন? কি এমন বলবে? কোন কথা বলার সময় হয় নি তার ? কি হবে কালকে? নিরব কি করবে?

হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। নির্ঝর তাকিয়ে আছে নিরবের দিকে। নিরব তাকে চোখে ইশারা করছে কিন্তু কেন? বোধ হলো সবাই গাড়িতে বসে গেছে শুধু সে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়ির দিকে রওনা দিল। পেছন ফিরে দেখল নিরব মুচকি হাসছে। নিরব কে মোটেও সুবিধার লাগছে না তার কাছে!

“আপনি কি ঠিক আছেন নির্ঝর!

সিটবেল্ট বেঁধে নির্ঝর বলল,
“হুম!

“না অনেকটা অন্যমনস্ক লাগল তাই!

নির্ঝর আয়নায় তাকিয়ে আছে মেহুর দিকে।

অর্ণব ডাকল,
“ড্যাডি!

নির্ঝর হেসে পেছন ফিরে বলল,
“একদম ঠিক আছি অর্ণব সোনা, এখন বাসায় যাওয়া যাক!

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল! বাসায় ফিরতে ফিরতে মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়ল অর্ণব। নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমে তাকে কোলে নিল। মেহু বলল, সে নিবে! কিন্তু নির্ঝর হেসে বলল,”অসুবিধা নেই চলো!

মেহু হেসে তার পিছন পিছন যেতে লাগলো। অর্ণব কে বিছানায় শুইয়ে দিল নির্ঝর তার গায়ে চাদর টেনে মেহু কে বলল,

“তুমি ফ্রেস হয়ে নাও!

বলেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। অর্ণবের প্রতি এই স্নেহ দেখে কিঞ্চিত হাসল মেহু!

নির্ঝর বেশ টেনশনে আছে। ফ্রেস হয়ে এসে আয়নায় সামনে দাঁড়াল। বুঝতে পারছে না আগামীকাল কি হতে চলেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবল নিরব কেই জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু নিরব তো তাকে কিছুই বলবে না। রেগে ফোনটা বিছানায় ফেলে দিল। বিরক্ত নিয়ে আয়নায় বসে পড়ল। নিরবের কথাটা সিরিয়াস ছিল। তার মানে নিশ্চিত সিরিয়াস কিছু বলতে চলেছে মেহু কে। কি বলবে, ভালোবাসি! আহহ না এটা তো ধরে পারে না। কিন্তু মেহু যদি হ্যাঁ বলে দেয়। নির্ঝর বুকে হাত রাখল। এখন যখন তখন হার্ট অ্যাটাক করবে সে। কিন্তু যদি এমন কিছু না হয় তখন। নির্ঝর মেঝেতে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। অস্তিত্ব লাগছে আর তার সাথে অস্থিরও‌ ! কি করবে বুঝতে পারছে না। আচ্ছা মেহু কে জিজ্ঞেস করবো,পাগল হলাম নাকি। মেহু কি করে জানবে। যদি জানতো তবে কি নিরব বলতো আগামীকাল বলবে। না নির্ঝর এবার সত্যি পাগল হয়ে যাবে। আর ভাববে না এই নিয়ে। একা ঘুমাবে আজ। ভেবেই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
চোখ বন্ধ করতেই নিরবের কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। কি হবে কাল! না নির্ঝর আর পারবে না। উঠে বসল। ঘুম আসবে না আজ রাতে। ঘুম পালিয়ে গেছে তার। এক বালিতে হতাশা নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। দেখল মেহু উপরের দিকে পা বাড়াচ্ছে। মানে ছাদের দিকে। এতো রাতে ছাদে!

নির্ঝর পা বাড়াল রান্না ঘরের দিকে। আজ রাত মেহুর সাথে গল্প করে কাটাবে। খুব সুন্দর করে এক কাপ কফি বানাল সে। দুই হাতে কফি মগ নিয়ে পা বাড়াল ছাদের দিকে।

ছাদের গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে মেহেরিন। প্রকৃতি বলে দিচ্ছে বৃষ্টি হবে কিন্তু আবহাওয়া বলছে উল্টোটা। শীত শীত একটা ভাব এসে পড়ছে। শীত চলে এলো। এই সময়টা খুব ভালো লাগে তার। হুট করে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল তাকে। মেহেরিন’র শরীর কাঁটা দিয়ে গেল। দুই হাত দিয়ে গুটিয়ে নিল শরীর‌। কিঞ্চিত হাসল। বলে উঠল,

“একা কাটানোর জন্য সময় টা দারুন!

পেছন থেকে নির্ঝর বলে উঠল,
“তাহলে তার মধ্যে আমি এক বালতি জল ফেলে দিলাম মনে হচ্ছে!

মেহু চট করেই পিছন ফিরল। নির্ঝর এক গাল হেসে বলল,
“কফি! ঠান্ডা পরিবেশে ভালো লাগবে!

মেহু হেসে হাত বাড়িয়ে নিল। বলে উঠল,
“থ্যাংকু!

নির্ঝর এসে তার পাশে দাঁড়াল। মেহু চুমুক দিল কফিতে। নির্ঝরের নজর তাতে। মেহেরিন বলে উঠল,

“খুব ডালো হয়েছে!

নির্ঝর লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।‌মেহু হেসে বলল,

“আমি কোন কথা বললেই আপনি এত লজ্জা কেন পান!

“জানি না!

“আপনি আবারো লজ্জা পেলেন নির্ঝর!

নির্ঝর হেসে কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল,
“ঘুমাবে না!

“না ঘুম আসছে না, তবে জানেন এই পরিবেশে কিন্তু ঘুম দারুন হয় অথচ আমার ঘুম আসছে না।

“আমারো একি অবস্থা!

মেহেরিন হেসে আকাশের দিকে তাকাল। অতঃপর কফি মগে চুমুক দিল। নির্ঝর মেহুর দিকে তাকিয়ে বলল,

“কতো মিল না তোমার আমার মাঝে!

মেহেরিন চোখ ফিরল নির্ঝরের দিকে। বলে উঠল,
“আমরা দুজন বিপরীত দুটি মানুষ নির্ঝর!

নির্ঝর মুচকি হাসল। নিঃশব্দে দুজনেই কফি মগ টা শেষ করল। মেহেরিন’র কাছে এখন ভালোই লাগছে। একবার ফিরল নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর তাকিয়ে আছে এই অসীম আকাশের দিকে। নির্ঝরকে খারাপ লাগে না তার কাছে। তবু সে ভয় পায় নিজের ভাগ্য কে। আর যাই হোক ভাগ্য কে বিশ্বাস করা যায় না। থাকুক না এমন কিছু, যাকে ভালো লাগে সেই ভালো লাগা টা হয়েই থাকুক! ফাহানের কথাটা খুব মনে করছে, সে বলেছিল নির্ঝর নাকি আমার জন্য ঠিক।‌ সত্যি কি তাই!

নির্ঝর এখনো নিশ্চুপ। মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নির্ঝর আমি যাচ্ছি। আপনিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, অনেক রাত হয়ে গেছে।

বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিল। নির্ঝর তখন তার হাত ধরে বলল। মেহু অবাক হয়ে তাকাল হাতের দিকে। নির্ঝরের দিকে ফিরতেই নির্ঝর তার হাত ছেড়ে দিল। এসে দাঁড়াল তার সামনে। মেহু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর ঢোক গিলল। কিছু বলার প্রয়াস তবু বলতে পারছে না। তবুও উষ্ণ গলায় বলল,

“মেহু আমি ভালোবাসি তোমায়!

মেহু অবাক হলো না। শুধু শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল,
“এরপর এটা নিয়ে আর কখনো কথা হবে না নির্ঝর!

বলেই চলে যেতে নিল। নির্ঝর পিছ থেকে বলে উঠলো,
“আমি তোমার অতীত জানি মেহু!

মেহেরিন থমকে গেল। কথাটা তার কানে এখনো বাজছে। তবুও হেসে পিছন ফিরে বলল,

“ততোটুকু আপনার জন্য যথেষ্ট কি?

নির্ঝর মেহেরিন’র দিকে ফিরল। নিজেকে মানসিক ভাবে শান্ত রাখছে। তার মন অস্থির। ইচ্ছে করছে না বলতে তবুও আজ বলবে সে।‌ হারাতে চায় না মেহু কে। বোঝাতে চায় খুব ভালোবাসে তাকে। নির্ঝর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহুর দিকে। এক পা এগিয়ে এলো সে। তার মুখ চোখ স্থির। যন্ত্রের মতো বলে উঠল,

“আমি জানি ফাহানের কথা!

মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। মেহু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। মনের কোনে পুড়নো ক্ষত যেন জেগে উঠল। কেঁপে উঠলো তার বুক। ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল। তবুও স্থির চোখে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। অতঃপর…

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here