#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে)
#পর্ব_৪৪
নির্ঝর কিঞ্চিত হেসে তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপারে। এতো গুলো বাচ্চার মাঝে মেহু আইসক্রিম’র জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছে আইসক্রিম ওয়ালা কে। নির্ঝর রাস্তার মাঝে পা রাখল। একবার এপাশে তাকাল আরেকবার ওপাশে। না কেউ নেই! রাস্তাটা প্রায় খালি। দু একটা রিক্সা চলাচল দেখা যাচ্ছে। নির্ঝর হেসে সামনে আগায়। হঠাৎ করেই একটা বাচ্চা এসে দাঁড়াল নির্ঝরের সামনে। তার হাতে বেলী ফুলের মালা। নির্ঝর তার হাত থেকে একটা মালা কিনল। মেয়েটা বলল ২০ টাকা দেন ভাইজান। নির্ঝর তার হাতে একশ টাকার নোট টা দিল। মেয়েটা হেসে বলল, ভাইজান ভাংতি নাই! নির্ঝর হেসে বলল, আমার কাছে আর কোন টাকা নেই। তুমি রেখো দাও পুরোটা।
মেহু আইসক্রিম নিয়ে আইসক্রিম ওয়ালা কে টাকা দিচ্ছে। অতঃপর পেছন ফিরে তাকাল। নির্ঝর ওপাড় থেকে আসছে! মেহুও রাস্তার এপাশে আর ওপাশে একবার তাকাল। পড়ন্ত বিকেলে মাথার উপর দিয়ে একদল পাখি উড়ে গেল। মেহু হেসে রাস্তার মাঝে পা রাখল। পেছন থেকে একদল খুদে বাচ্চার দল বেলুন হাতে দৌড়াচ্ছে। দূরে এক ঝালমুড়ির দোকানে ভিড় জমিয়েছে কলেজের কিছু মেয়ে। নির্ঝরের পেছনে এক প্রেমিক মানিয়ে যাচ্ছে তার প্রেমিকা। মেহু তা দেখে মুচকি হাসল। নির্ঝরের হাতে বেলী ফুলের মালা দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। হঠাৎ করেই গাড়ির হর্ণের আওয়াজ। দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে একটা ট্রাক। নির্ঝর মেহু বলে ডাক দিল। মেহু এক পা পিছিয়ে গেল। ট্রাক টা তার পাশ বেয়েই গেল। ট্রাক যেতেই সামনে তাকাল। নির্ঝরকে দেখে মুচকি হেসে পা বাড়াতেই কোথা থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিল নির্ঝর কে..
মেহু নিস্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ট্রাকের আ/ঘাতে ছিটকে এসে দূরে পড়ল সে। ট্রাক দাঁড়াল না। দ্রুত গতিতে সেখান থেকে প্রস্থান করল। হাতের বেলী ফুলের মালা টা র/ক্তে ভিজে উঠল। সময় যেন স্থির হয়ে গেল। মেহুর হাতের আইসক্রিম পড়ে গেল রাস্তায়। এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল নির্ঝরের দিকে। তার হাত নড়ছে দেখতে পারছে সে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো সে কোন নিজেকে আলাদা জগতে আছে। একটা নিছক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না। লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে তার কাছে। কিন্তু মেহু বোধহয় পা বাড়ানোর শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছে।
লোকজনের ধাক্কায় জ্ঞান ফিরল তার। দৌড়ে এলো নির্ঝরের কাছে। পুরো রাস্তায় ভিড় জমে গেছে। নির্ঝরের রক্তাক্ত দেহে কোলের মাঝে রেখে ডাকতে লাগল তাকে। চারদিক তাকিয়ে সাহায্য পেতে চাইলো। লোকজন অ্যাম্বুলেন্স কে কল করছে, তো কেউ পুলিশ কে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে থিতুনি দিয়ে। বার বার ডেকে যাচ্ছে নির্ঝর!
“নির্ঝর! নির্ঝর কথা বলুন না। নির্ঝর! নির্ঝর আমি মেহু!
চোখ মেলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। চোখ বুজে আসছে তার। ঝাপসা দেখছে সে চারদিক। শেষ নিঃশ্বাস যদি প্রেয়সীর কোলে নেয় তবুও আফসোস নেই তার। ভোরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলেছিল সে, তার নিশি কন্যা’র সমস্ত বিপদ যেন তার জন্য হয়ে আছে। নিশিকন্যা যেন সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে। হয়তো দোয়া কবুল হয়েছে এরচেয়ে খুশির আর কি হতে পারে।তবুও প্রেয়সীর কান্নার আওয়াজ কষ্ট দিচ্ছে তাকে। তবু মূহুর্তে সেই শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে। কান্নার আওয়াজ আর আসছে না কানে। পানির খুব পিপাসা পাচ্ছে। প্রেয়সীকে কি বলবে একগ্লাস পানি এনে তাকে খাওয়াতে। হাতের মাঝে কার যেন হাতের উপস্থিত পাচ্ছে। হাতটা চিনতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল এটা তার প্রেসয়ীর হাত। শেষবার তাকে দেখার খুব চেষ্টা করল। মুখ তুলে তার মুখটা দেখার চেষ্টা। আহ কি ব্যাথা। মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। মেহু কে কি বলবে একটিবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কেন এতো কষ্ট হচ্ছে তার। মুখের সামনে মা আর বাবার মুখটা ভেসে উঠছে। কি হবে আমি চলে গেলে? চোখ সত্যি বুঝে আসছে এবার। শেষবারের মতো নিশি কন্যা’র মুখটা দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো না তার। ঝাপসা ঝাপসা দেখতে লাগছিল সবকিছু!
নির্ঝরের জ্ঞান হারানোর পর’ই পাগল হয়ে মেহু। পাগলের মতো তাকে ডাকতে লাগল। হঠাৎ বেলী ফুলের তীব্র ঘ্রাণ নাকে আসছে তার। অশ্রু ভেজা চোখে সামনে তাকাতেই নিরু কে দেখতে পেলো। বুক ধক করে উঠলো তার। মৃত্যু মানুষ কে এসময় দেখা কোন সংকেত দিচ্ছে তাকে..
—
রক্তে ভিজে গেছে গায়ের জামা। নিস্তব্ধ হয়ে বসে ওপারেশন থিয়েটারের সামনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারছে না সে। এই তো সকালেই জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। তার হৃৎস্পন্দন চেক করছিল সে। আর এখন.. কি হবে এখন? আর কি কখনো তার হৃৎস্পন্দন চেক করবে না কেউ। ইশ, সে তো একটি বারও নির্ঝরের হৃৎস্পন্দন চেক করে নি। মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। চেক করা দরকার ছিল। কেমন হবে তার হৃৎস্পন্দন’র শব্দ। সত্যি কি সে কখনো শুনতে পারবে না। মূহুর্তে’ই মনে পড়ল, কিসব আলবতাবল ভাবছে সে। না এমন কিছু হবে না, এমন কিছু হতে দিবে না। কিছু হবে না নির্ঝরের কিছু না। চোখের অশ্রু এসে পড়ল হাতের উপর। মেহুর হাতের দিকে তাকাল। কেউ আসছে দৌড়ে। মুখ ফিরে পাশে তাকিয়ে দেখল নীলিমা দৌড়ে আসছে। মেহু দাঁড়িয়ে গেল। নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে এসে মেহুর সামনে দাঁড়াল। তার গালে হাত রাখতেই মেহু মা বলে জড়িয়ে ধরল তাকে। হু হু করে কাঁদতে শুরু করল সে। কি বলে সান্তনা দেবে তার ভাষা খুঁজে পেলো না। রিদুয়ান চৌধুরী দৌড়ে এলো অর্ণবের হাত ধরে। ওপারেশন থিয়েটারের সামনে এগিয়ে গেল সে। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। অর্ণব দূরে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহুর কাছে আসতেও ভয় করছে তার। মাম্মির গায়ের জামা কেমন লাল লাল হয়ে গেছে। সে জানে রক্তের রং লাল হয়। তবে মাম্মির গায়ে কেন এতো রক্ত। তার রক্ত কি তবে শরীর থেকে বের হয়ে গেছে। রক্ত বের হলে তো মানুষ বাঁচে না। মাম্মি কি তাহলে বাঁচবে না।
ছোট্ট মনটা হতাশ হয়ে গেল। তার মুখে গম্ভীরতা। মেহু তার কাছে এগিয়ে ছোঁয়ার আগেই নিরব অর্ণব কে টেনে নিজের কাছে নিল। মেহুর দিকে তাকিয়ে শুধু এতো টুকু বলল,
“আমি অর্ণব কে নিয়ে যাচ্ছি!
বলেই অর্ণব কে কোলে তুলে নিল। মাম্মি কে ছেড়ে কেন চলে যাচ্ছে সে। মাম্মির কাছে থাকবে সে। ড্যাডি কোথায়? অর্ণব মুখ ফুটে ড্যাডির নাম নিল। নিল মাম্মির নাম। মেহু মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগলো। নিরব চোখ মুখ শক্ত করে বাচ্চা ছেলেটা কে নিয়ে দ্রুত চলে গেল! ফরহাদ, আরিফ আর ঈশান ওরা এসে সামলাতে লাগল তাদের। ফরহাদ মেহু কে নিচ থেকে উঠাল। ঈশান এসে দাঁড়াল নীলিমার পাশে। আরিফ রিদুয়ান চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিলো।
মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ার কারণে সার্জারি করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আউট অফ ডেঞ্জার তবে জ্ঞান না ফিরা অবদি কিছু বলা যাচ্ছে না। মেহু তাকিয়ে নির্ঝরের দেহের দিকে তাকাল। চঞ্চল মানুষটা কিভাবে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাথায়, হাত পায়ে ব্যান্ডেজ করা। নীলিমা তার হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেহু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ডাক্তারের সাথে। রিদুয়ান ছেলের কাছে বসে আছে নিশ্চুপ ভাবে।
“জ্ঞান ফিরবে কতোক্ষণ লাগবে!
“সঠিক বলতে পারছি না, একদিন, দুদিন কিংবা এক দু মাসও লাগতে পারে। আর না হলে কোমায় চলে যেতে পারে পেশেন্ট!
মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ডাক্তার তার পাশ বেয়ে চলে গেলেন। সন্তানের দুই পাশে থাকা মা বাবাদের কি বলবে সে খুঁজে পেল না। কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল সে। কোন কিছু বলার সাহস নেই তার। দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘাড়ে কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকাল। নিরব কে দেখতে পেয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে নিল সে।
নির্ঝরের পাশে তার হাত ধরে বসে আছে তার প্রেয়সী। হাতটা নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে কাঁদছে সে। তার চোখের পানিতে ভিজে উঠেছে হাতখানা। আজ ২০ দিন হয়ে গেল নির্ঝরের মুখ থেকে মেহু ডাকটা শুনতে পারছে না সে। নির্ঝরের অর্ণব সোনা প্রতিদিন এসে ড্যাডি ড্যাডি বলে ডেকে যায়।তবুও সাড়া দেয় না পে। নীলিমা আর রিদুয়ান বসে থাকে সারাদিন। যদি ছেলেটা হঠাৎ করে জেগে উঠে। আশা বাঁধে বুক ভরে। বন্ধুরা এসেও পাশে বসে থাকে খানিকক্ষণ। শুধু শুধু কথা বলেই যায়। ভাবে কখন কিছু একটা বলে জেগে উঠবে। মেহু জোড় করে মা বাবাদের বাড়িতে পাঠিয়েছে। দিন রাত না ঘুমিয়ে এখানে থাকার কারণে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। পুরো কেবিনে একাই বসে আছে মেহু। তাকিয়ে আছে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। যা হয়েছে এখনো মেনে নিতে পারছে না সে। কেন হলো এটা? কেন? কি যে সেই কষ্টের পরিমাণ বলে বোঝানো যাবে না তা। মনটা বার বার’ই হু হু করে কেঁদে উঠে। রাতের পর রাত জেগে থাকে এই ভেবে নির্ঝর কবে চোখ মেলবে? কবে তার সাথে একটু হেসে কথা বলবে। সবকিছু স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে তার।
চোখের পানি মুছে নেয় সে । হঠাৎ করেই মনে হয় হাতটা নড়ে উঠল। মেহু প্রথমে তার ভ্রম ভাবলেও মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এবার চোখের পাতা নড়ছে। আশা বাঁধছে তার মনে। উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সে। উষ্ণ গলায় ডেকে যাচ্ছে,
“নির্ঝর! নির্ঝর!
চোখ মেলে তাকানো যেন দায় হয়ে পড়েছে। ইশ! কি যন্ত্রণা! মাথা ব্যাথায় বোধহয় ফেটে যাচ্ছে। কারো শব্দ এসে কানে বাজছে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে দেখছে সামনে কেউ দাঁড়ানো। কে এই রমনী! পুরোপুরি ভাবে চোখ মেলে তাকালো নির্ঝর। মেহু বোধহয় প্রাণ টা ফিরে পেল। খুশি আর কান্না মুখে মিশে গেছে তার। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে হাতের মুঠে নিয়ে চুমু খেতে লাগল। অচেনা এক রমণী’র এই আচরণ বিভ্রান্ত সৃষ্টি করল নির্ঝরের মনে। উঠে বসতে চাইলো সে। তার সাহায্য নিয়ে উঠে বসল। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সেই রমণী। কিসব বলতে লাগল যার কোন মানে বের করতে পারল না নির্ঝর। নির্ঝরের এমন দৃষ্টি মেহুর মনে হতাশা সৃষ্টি করল। মুখটা মলিন হয়ে গেল। তবুও হেসে বলল,
“এখন ভালো লাগছে তো নির্ঝর, কোথায় কি কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা আমি ডাক্তার কে ডাক দিচ্ছি!
বলেই ডাক্তার কে ডেকে আবারো নির্ঝরের কাছে আসল সে। তার হাতটা আবারো ধরল। হুট করেই মনে হলো হাতটা সরে গেল তার। মেহু নিশ্চুপ হয়ে গেল। নির্ঝর মুখ ফুটে শুধু এতটুকুই বলল,
“কে আপনি!
কথাটা শোনামাত্র মনে হল পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে।আবার ভাবল নির্ঝর মজা করছে না তো। হেসে বলল,
“নির্ঝর আমি মেহেরিন! আপনার মেহু। আপনি চিনতে পারছেন না আমায়!
“না, আমি চিনি না আপনাকে?
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মুহুর্তে। আহত হরিণীর মতো যন্ত্রণায় কাতর সে। পা পিছিয়ে গেল তার। ডাক্তার আর নার্স সারি সারি এসে কেবিনে ডুকল। নির্ঝর দৃষ্টি এখনো সেই রমণীর উপর। মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি কেঁদে দেবে। ভ্রু কুন্চিত হলো নির্ঝরের। জিজ্ঞেস করতে চাইলো কেন কাঁদছে সে। কিন্তু তার আগেই দরজার কাছে চিরচেনা মায়ের আওয়াজ শুনল সে। মুখ ফিরে তাকার নীলিমার দিকে। মেহু কান্না লুকিয়ে বের হয়ে এলো কেবিন থেকে। নির্ঝর মোটেও মজা করছে না। তার চোখ দেখেই এটা টের পেয়েছে সে। চোখে কেমন এক অচেনা দৃষ্টি। মেহু কে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এলো নিরব। হেসে বলল,
“কাঁদছিস কেন? নির্ঝরের জ্ঞান ফিরেছে তো!
নিরবের দিকে ফিরল সে। কান্না চাপিয়ে রাখল। নিরব মাথায় হাত রেখে বলল,
“কি হয়েছে মেহু!
কান্নায় ভেঙে পড়ল মেহু। শুধু বলল “নির্ঝর আমাকে চিনতে পারছে না নিরব”! অতঃপর ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল। নিরব সেখানেই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভালোবাসার মানুষটিকে ভালো দেখার জন্য ছেঁড়া আসা কি তবে সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে দাঁড়াল তার! কান্নার আওয়াজ নিতে পারছে না সে। কি করবে এখন?
“মাথার আঘাত টা খুব গভীর ছিল। মনে হচ্ছে এর প্রভাব তার ব্রেইনেও পড়েছে যার কারণে তার জীবন থেকে কিছুটা সময় হারিয়ে ফেলেছে সে!
মেহু শক্ত করে টেবিলের উপর হাত রাখল। রিদুয়ান চৌধুরী মেহুর ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
“শান্ত হও মা। ডাক্তার ওর স্মৃতি কি ফিরে আসবে না।
“এটা সঠিক বলতে পারছি না। আসতে পারে আবার নাও আসতে পারে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরব বলল,কতোদিন লাগবে ফিরে আসতে!
“আসলে এসব কেসে স্মৃতি ফিরে আসাটা খুব রেয়ার। তবুও যদি ধরা হয় তাহলে কিছু বলা যায় না। ১ মাস দু মাস কিংবা ১ বা ৩ বছর। কিছুই বলা যায় না। তবে হ্যাঁ পুরনো স্মৃতি মনে করানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। মানে আগে যা করতো তা তা যদি করা হয় তাহলেই এটা সম্ভব। কিন্তু এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে। এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ না। তাই ব্রেইনে বেশি চাপ পড়লে হিতে বিপরীত হতে পারে।
মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে চলে এলো কেবিন ছেড়ে। ড্যাডির জ্ঞান ফিরেছে শুনে অর্ণব দৌড়ে কেবিনে এলো। নির্ঝরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ড্যাডি…
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নীলিমা আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে আছে। অর্ণব আবারো হেসে বলল,
“ড্যাডি!
নির্ঝর হাসল। বলে উঠল,
“আমি তোমার ড্যাডি না বাবু, তুমি হয়তো ভুল কেবিনে চলে এসেছো!
অর্ণব মাথা নাড়িয়ে না না করে বলল,
“ড্যাডি , ড্যাডি!
বিরক্ত হয়ে গেল নির্ঝর! কিছু না বলতে পেরে নীলিমার দিকে ফিরে বলল,
“কে এই বাচ্চা!
নীলিমা কি বলবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ মেহেরিন ঢুকল কেবিনে। অর্ণব কে নির্ঝরের সামনে লাফিয়ে ড্যাডি ড্যাডি করতে দেখে দ্রুত তাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। আবারো সেই রমণীর মুখোমুখি হলো নির্ঝর। কি যে নাম মেয়েটার। হ্যাঁ মনে পড়েছে ম দিয়ে শুরু তবু পুরোটা মনে পড়ছে না। নীলিমা কে জিজ্ঞেস করল মেয়েটার ব্যাপারে। কিন্তু তার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হলো না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রিদুয়ান বলল,
“ওর নাম মেহেরিন! মেহেরিন বর্ষা খান।
“ওহ আচ্ছা।
বলেই আপেল খাওয়ায় মনোযোগ হলো নির্ঝর। আর কিছু জিজ্ঞাস করল না সে। রিদুয়ান ভেবেছিল হয়তো কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে, যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলে দিবে মেহেরিন ওর স্ত্রী। কিন্তু নির্ঝরের বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখে হতাশা হলেন তিনি। বিষণ্ণ মন নিয়ে এসে বসলেন নির্ঝরের পাশে!
নির্ঝরের এখানে থাকতে মোটেও ভালো লাগছিল না। কেন সে এখানে এটা জিজ্ঞাস করা হয় নি মম কে। জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। শুধু এতো টুকু মনে আছে বাসায় তার ড্যাড’র সাথে খুব ঝগড়া করেছিল সে। ঝগড়ার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কথা। কথা কে বিয়ে করবার জন্য তার ড্যাড তাকে পাগল করে ফেলছে। শেষ রাতে নির্ঝর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। ব্যস এতো টুকুই। কিন্তু এরপর কি হলো? ফরহাদ থাকলে জিজ্ঞেস করা যেতো। কিন্তু তাদের দেখতে পারছে না সে। এটা কি করে হয়। সে অসুস্থ ফরহাদের তো উচিত ছিল তাকে এসে একবার একা। আরিফ আর ঈশান ওরাই বা কোথায়? ফোন কোথায় তার! অনামিকা কে একটা ফোন করা উচিত। এ কি রকম গার্লফ্রেন্ড সে। বয়ফ্রেন্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বসে আছে অথচ তার দেখা নেই।
ড্যাডির কাছে যাবার জন্য জোড় করছে অর্ণব।মেহেরিন তাকে ধমক দিয়ে চুপ করাল। অর্ণব এবার কেঁদে উঠল। ফরহাদ এসে আগলে ধরল তাকে। ঈশান বলে উঠে,
“বকছ কেন ওকে? কি হয়েছে?
“ড্যাডি! ড্যাডি!
“হ্যাঁ অর্ণব আমি ড্যাডি কাছে যাবো। তুমি যাবে।
“চলো আমাদের সাথে।
“না ও কোথায় যাবে না।
“কেন মেহেরিন!
“যাবে না বলছি যাবে না। ভালো লাগছে না আমার কিছু
বলেই হন হন করে চলে গেল। চোখের পানি মুছিয়ে দিল ফরহাদ। আরিফ হাত ধরে নির্ঝরের কেবিনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। পথ আটকে দাঁড়াল নিরব!
—–
ফরহাদ কে দেখতে পেয়ে ঔষধের বোতল ছুঁড়ে মারল নির্ঝর।ভাগ্যিস তা ধরে ফেলতে সক্ষম হলো সে। এসে টেবিলে রাখল। মুখ ভার নির্ঝরের। কারো সাথে কথা বলবে না সে।
“কেমন লাগছে এখন?
“যেমন’ই লাগুক তোকে কেন বলবো, কেমন বন্ধু তোরা। আমি হসপিটালে এডমিট হয়ে বসে আছি অথচ একবার দেখতে এলি না।
“গত ২০ দিন ধরে ২ বার এসে চক্কর কেটে যাচ্ছি
“কি আমি ২০ দিন ধরে এখানে। আর অনামিকা! অনামিকা একবারও দেখতে এলো না আমাকে।
“তুই অনামিকার কথা কেন বলছিস নির্ঝর.
“নাহলে আর কার কথা বলবো। গার্লফ্রেন্ড’র কথাই তো বলবো না। তোরা সবগুলো ধান্দা বাজ বুঝলি। অসুস্থ হয়ে সবাইকে চেনা হয়ে গেছে আমার।
ফরহাদ হেসে বলল,
“এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো তোর।
“জানি না। সেদিন ড্যাড’র সাথে ঝগড়া করে বের হয়ে এসেছিলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই
“কত তারিখ?
“কি জিজ্ঞেস করছি আলতু ফালতু কথা। আর তোরা দুজন কেন? আরিফ কোথায়। তাকে কি ইনভাইট করে আনতে হবে নাকি।
“নির্ঝর! তোর কি সত্যিই কিছু মনে নেই।
“কি মনে রাখার কথা বলছিস বল তো।
“মেহেরিন’র কথা, অর্ণবের কথা।
“কারা এরা। এদের কাউকে আমি চিনি না.. এই দাঁড়া কি নাম বললি মেহেরিন। হ্যাঁ এই মেয়ে টা দেখেছিলাম। এখানেই ছিল সে। আমার কাছে পাগল মনে হলো তাকে। গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে একটা। কি ভাবে যে আমার গায়ে পড়ল দেখলে হা হয়ে থাকতি।
রাগে শরীর জ্বলছে ফরহাদের। যাকে পাগলের মতো এতোটা ভালোবাসতো আজ কি না তাকেই পাগল বলছে সে। ঈশান ফরহাদ কে সামলালো। নির্ঝর এখন কমলা খাচ্ছে। একটা হাদলো ফরহাদ কে। মুখ ফিরিয়ে নিল সে। নির্ঝর মুখ ভেংচি কেটে নিজের কমলা নিজেই মুখে দিল। খেতে খেতে বলল,
“আচ্ছা, কিন্তু এই মেহেরিন মেয়ে টা কে বলতো। আর জানিস আরেকটা কান্ড ঘটেছে। একটা বাচ্চা ছেলে এসে আমাকে ড্যাডি, ড্যাডি বলে ডেকেছে। আমার কি মনে হয় জানিস এটা হসপিটাল না পাগলা গারদ। সবাই আমাকে পাগল বানানোর ধান্দা করছে। এই না কেউ এসে বলে আমি তার শশুড়।
বলেই হাসতে লাগল নির্ঝর। ফরহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“মেহেরিন বর্ষা খান তোর বিবাহিত স্ত্রী নির্ঝর! আর ওই বাচ্চা ছেলেটা হলো অর্ণব তোর ছেলে! নিজের ছেলে!
থমতম খেয়ে গেল নির্ঝর। খানিকক্ষণ পরেই হো হো করে হেসে উঠল।
“মনে হচ্ছে আমার মাথা খারাপ হবার আগেই তোদের টা খারাপ হয়ে গেছে।
“নির্ঝর মজা করছি না, মেহেরিন সত্যি তোর বউ।
“এই রাখ তো। প্রাঙ্ক করার চেষ্টা করিস না আমার সাথে। বোকা না আমি। এই মেয়ে নাকি হবে আমার বউ। হুহ! গায়ে পড়া মেয়ে একটা।
ফরহাদ দাঁড়িয়ে গেল। উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“নির্ঝর!
ভ্রু কুঁচকে গেল তার। রাগে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। আবারো সেই ডাক।
“ড্যাডি!
মুখ ফিরল নির্ঝর। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাচ্চা টার দিকে। স্নিগ্ধ মুখখানায় কেমন একটা ভয় ভয় কাজ করছে। কোথায় যেন দেখেছে তাকে। মাথায় হঠাৎ কিছু ভেসে উঠল। আবছা আবছা কিছু ভেসে উঠলো চোখের সামনে। এই বাচ্চাটা কে কোলে বসে খেলছে সে! মাথায় হাত রেখে কুকড়িয়ে উঠল। আরিফের শার্ট টা আকড়ে ধরল অর্ণব। ফরহাদ আর ঈশান ব্যস্ত নির্ঝর কে সামলাতে..
#চলবে….