#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে)
#পর্ব_৪৫
সেবারের মতো সেদিনও নির্ঝরের ছোট খাটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ড্যাডের সাথে ঝগড়া করার পর শেষ রাতে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় সে। মাঝ রাস্তায় গাড়ির উপর বসে বিয়ার খায় সে। অতঃপর এমন মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে থাকে। গাড়িটা একসময় একটা গাছের সাথে বাড়ি খায়। এই ঘটনা টা আবছা আবছা মনে আছে তার। নির্ঝরের মতে সেই এক্সি*ডেন্ট’র পর আজ তার জ্ঞান ফিরেছে। এক্সি*ডেন্ট টা ছোটখাটো ছিল বলে রিদুয়ান চৌধুরী তখন এতো গুরুত্ব দেই নি। তিনি ভেবেছিলেন নির্ঝর না ইচ্ছে করেই এটা করেছিল যাতে কথার সাথে বিয়ে না করা লাগে। তাই নিজের সিদ্ধান্তের উপর’ই অটল থাকে তিনি।
নির্ঝর কে ডিসচার্ছ করা হয়েছে আজ সকালে। রিদুয়ান আর নীলিমা তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। নির্ঝরের মনটা কেমন খারাপ হয়ে আছে। সবার ব্যবহার কেমন জানি লাগছে তার কাছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। হাতের ফোনটাও নেই কাছে।
রিদুয়ান চৌধুরী গাড়ি থামাল। নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমে ভ্রু কুঁচকে গেল। কার বাড়ি এটা।
“মম আমরা কোথায় এলাম?
“তোর বাড়িতে..
“আমরা বাড়ি পাল্টালাম কবে?
ঘাড়ে হাত রেখে রিদুয়ান বলল,
“ভিতরে আয়..
অতঃপর নির্ঝর পা রাখল বাড়ির ভিতর। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলল একজন। নির্ঝর তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই মেয়েটা সেই মেয়ে যাকে চোখ মেলবার পর প্রথম দেখেছিল সে। মেহেরিন মুচকি হেসে সরে গেল। অর্ণব দৌড়ে এসে ড্যাডি ড্যাডি করতে করতে হাত ধরল নির্ঝরের। তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো। ঘরটা বেলুন দিয়ে সাজানো। নির্ঝর দেখল ফরহাদ, ঈশান আর আরিফ তিনজন’ই এখানে। পিছনে একটা ছেলেকেও দেখতে পাচ্ছে সে। তাকে কি চিনে সে! পুরো বাড়ি জুড়ে তার ছবি ফ্রেম বাঁধানো। তার একার নয়, এই মেয়েটা আর ছেলেটাকেও নিয়ে। এসব দেখে তার মাথা যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিল।
ফরহাদ এগিয়ে এসে বলল,
“ওয়েলকাম! আবারো বাড়ি ফিরে এসেছিস তুই!
অতঃপর তাকে জড়িয়ে ধরে সে। একে একে সবাই জড়িয়ে ধরে নির্ঝর কে। তাদের দেখাদেখি অর্ণব ও এসে সামনে দাঁড়াল। নির্ঝরের জামা টেনে তাকে ডাকে। নির্ঝর হাঁটু গেড়ে বসতেই অর্ণব জড়িয়ে ধরে তাকে। গালে চুমু খেয়ে বলে,
“ড্যাডি!
নির্ঝরের মুচকি হেসে অর্ণবের মাথায় হাত বোলায়। তবে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এখানে কি করছে সে। তবে কি সত্যি তার বিয়ে হয়ে গেছে এই মেয়েটার সাথে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! বিয়ে তো কথার সাথে হবার কথা ছিল তাহলে এই মেয়েটা মাঝে এলো কোথা থেকে। আর সে নিজেই কিভাবে রাজি হয়ে গেল বিয়েতে। সে তো ভালোবাসতো অনামিকা কে..
ফরহাদ ওরা এসে নির্ঝর কে সোফায় বসায়। তাকে মনে করানোর চেষ্টা করে। ঈশান অর্ণব কে নির্ঝরের কোলে বসিয়ে দেয়। নীলিমা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খায়। মেহেরিন হেসে রান্না ঘরের দিকে যায়। নিরব যায় তার পিছু পিছু। মেহেরিন আইসক্রিম সাজাচ্ছে নির্ঝরের জন্য। নিরব এসে মুচকি হেসে বলে,
“দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে!
মেহেরিন মুচকি হাসে। রিদুয়ান এসে হাজির হয়। মেহেরিন’র মাথায় হাত রেখে বলে, “আমার এই পাগল ছেলেটাকে একবার মানুষ করেছিলে তুমি। আবারো সেই কাজ নতুন করে করতে হবে তোমায়!
“বাবা!
“মন খারাপ করো না, ওর মনে পড়ে যাবে সবটা!
“কিন্তু তোমার ওকে এখানে আনা কি ঠিক হলো।
“এখানে থাকলেই ওর স্মৃতি ফিরে আসবে। তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও। দেখবে ও আবারো মনে করবে তোমায়।
মেহেরিন ঢোক গিলল। বলল,
“আমি আইসক্রিম দিয়ে আসি!
মেহেরিন এসে আইসক্রিম রাখল নির্ঝরের সামনে। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে একবার তাকাল ওর দিকে। অতঃপর মুখ ফিরিয়ে নিল। আইসক্রিম’র দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, তার প্রিয় আইসক্রিম’র কথা এই মেয়েটা কিভাবে জানে…
মেহেরিন আনমনে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যেতে নেয়। নিরব এসে তাকে ধরে বলে, “মেহু!
নির্ঝর চমকে তাকায় ছেলেটার দিকে। কপালে ভাঁজ পড়ে তার। এই স্বর আগে কোথায়ও শুনেছে সে!
—-
“ড্যাড তুমি চাইছো আমি এখানে, এই বাড়িতে এই মেয়েটার সাথে থাকি!
“ও কোন মেয়ে না, তোর বিয়ে করা বউ। এখন তুই মানলেও তোর বউ আর না মানলেও।
“ড্যাড, যাকে আমার মনে নেই তাকে নিয়ে আমি কিভাবে সংসার করবো বলো তো।
“মনে করানোর জন্য’ই এখানে রেখে যাচ্ছি। গত ১ বছর এখানেই ছিলি তুই। পুরো বাড়ি জুড়ে তোর স্মৃতি! সবটা মনে পড়ে যাবে তোর দেখিস।
“মম!
“আমার কিছু বলার নেই রে..
“বাহ! এই আমি তোমাদের ছেলে! এভাবে শত্রুতা করছো আমার সাথে!
নীলিমা এসে ছেলের মাথায় হাত বুলান।
“তুই আমাদের ছেলে আর মেহেরিন আমাদের মেয়ে। কোন অংশে তাকে কমিয়ে দেখে না আমরা। তোর কষ্ট যেভাবে বুঝি ঠিক সেভাবেই মেহেরিন’রটা বুঝি। একবার তুই বুঝে দেখ তো বাবা। আমার কথাটা একবার শোন। একবার ভাব ওই বাচ্চা ছেলেটার কথা যে সারাক্ষণ তোর চারদিকে ড্যাডি ড্যাডি বলে ঘুরে বেড়ায়!
“ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করা বন্ধ করো তো মম!
“করছি, আর আমি বলছি তুই এখানেই থাকবি ব্যস। আমি প্রতিদিন এসে দেখে যাবো তোকে। বুঝতে পারলি তুই!
বলেই বের হয়ে গেলেন নীলিমা। তার পিছু পিছু বের হয়ে গেলেন রিদুয়ান। নির্ঝর রেগে লাথি মারল বিছানায়। রাগে ফুস ফুস করতে করতে ঘরের চারদিক তাকাল। কি আছে এই ঘরে বোঝার চেষ্টা করছে সে! বিছানায় ধপাস করে শুইয়ে পড়ল সে। চোখ গেল বিছানার পাশে ল্যাম্পশেডের কাছে থাকা ছোট একটা ছবির ফ্রেমের দিকে। ছবিতে সে আর মেহেরিন। ছবিটা হাতে নিল নির্ঝর। নির্ঝর মেহেরিন কে জড়িয়ে ধরে ঘাসের উপর বসে আছে সে। ছবিটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। কিছু একটা ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। ফুটবল দিয়ে খেলছে অর্ণবের সাথে সে। মেহেরিন অর্ণবের দলে। তাকে জিতিয়ে দিতে বার বার চিটিং করছে সে। মাথায় অসহ্য ব্যাথা করছে। নির্ঝর ছবিটা ছুড়ে মেরে মাথায় হাত রেখে মেঝেতে বসে পড়ল। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেল তবু তাকাতে ইচ্ছে করল না।
মেহেরিন নিচে থাকা ছবি টা দেখল। সামনে তাকিয়ে দেখল নির্ঝর নিচে বসে আছে। দৌড়ে নির্ঝরের কাছে এলো সে।
“নির্ঝর! নির্ঝর কি হয়েছে আপনার। ঠিক আছেন তো আপনি। মাথায় কি খুব ব্যাথা করছে!
নির্ঝর চোখ তুলে তাকাল মেহেরিন’র দিকে। এখন খুব চেনা চেনা লাগছে এই মুখটা। তার চোখের দিকে নজর গেল তার। কোথায় যেনো দেখেছে এই চোখ সে। মেহেরিন নির্ঝরের গালে হাত রাখল। নির্ঝরের বোধ হল। হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কঠিন গলায় বলল,
“ঠিক আছি আমি!
“কিছু লাগবে আপনার
“না!
“লাগলে আমাকে বলবেন।
“আচ্ছা নিজেকে কি মনে করো তুমি বলো তো। আমার মা আর বাবা কে নিজের দলে টেনে নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
“এটা কি রকম কথা বলেছেন আপনি।
“যেটা সত্যি সেটাই বলছি।
“নির্ঝর মনে করার চেষ্টা করুন, আমাকে আপনাকে অর্ণব কে। একবার দেখুন তো।
“আমার মনে পড়ছে না মেহেরিন। কিছু মনে পড়ছে না। না তোমাকে আর সেই বাচ্চা কে। কাউকে… তুমি দয়া করে বের হয়ে যাও আমার ঘর থেকে।তুমি থাকলে আমি শ্বাস নিতে পারি না।
মেহেরিন হাসার চেষ্টা করল। তার মন ক্ষত*বিক্ষত হয়ে গেছে। নির্ঝরের মুখে মেহেরিন ডাক শোনার অভ্যাস নেই তার। নির্ঝর নিজেই বলতো এতো বড় নাম ধরে ডাকতে পারবে না সে। কিন্তু আজ কি অনায়াসে ডেকে ফেলছে সে। মানুষ কতোটা বদলে যেতে পারে। ল্যাম্পশেডের কাছে ফোনটা রেখে বলল, “আপনার ফোন! এটা দিতে এসেছিলাম
নির্ঝর শব্দ করে শ্বাস ফেলল। মেহেরিন এসে নিচের ছবি টা উঠাতে লাগল। কাঁ*চের টুকরো তে হাত কেটে গেল তার। আহ বলে উঠলো সে। নির্ঝর পা বাড়িয়ে তার কাছে আসতে নিল। মেহেরিন সেদিকে ফিরতেই নির্ঝর থেমে গেল। মেহেরিন মুচকি হাসল। নির্ঝর বলে উঠল,
“এসব কেন তুলছো তুমি।
“এগুলো আমার কাছে অমূল্য নির্ঝর।
“মানুষের জীবনের চেয়ে আর কি মূল্যবান হতে পারে। এসব ভাঙা ছবি উঠিয়ে লাভ নেই। ফেলে দাও!
মেহেরিন কথা বাড়াল না। কাটা হাত মুখে দিয়ে আবারো হাত লাগাল ছবির মাঝে। নির্ঝর বিচলিত হয়ে তাকেই দেখছে। মেহেরিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এদিকে আসবেন না, সার্ভেন্ট পাঠিয়ে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করছি আমি।
নির্ঝর হালকা কাশল। মেহেরিন পিছু ঘুরে বলল, কিছু বলবেন?
“অর্ণব কি সত্যি আমার ছেলে।
“না!
নির্ঝর অবাক হলো। মেহু বলল, বাইয়োলজিকালি সে আপনার সন্তান না আমার সন্তান। কিন্তু আপনি কথায় কথায় তাকে নিজের ছেলে বলতেন। খুব ভালোবাসতেন। আর অর্ণবও আপনাকে ড্যাডি বলেই ডাকতো!
কিঞ্চিত হেসে কথা গুলো বলল মেহেরিন। নির্ঝর কথার জবাব না দিয়ে মুখ ঘুড়িয়ে নিল। মেহেরিন নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। ঘরের চারদিক ঘুরে দেখল নির্ঝর। দেওয়ালের এক পাশেও তার, মেহু আর অর্ণবের ছবি ফ্রেম বাঁধানো। নির্ঝর ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করল। ইচ্ছে তো করল এগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে। অতঃপর মেহেরিন’র কথা মনে পড়ল। ভাঙা কাঁচের এই ছবি গুলো তুলতে গিয়ে হাত কেটেছিল সে। এগুলো তার কাছে মূলবান! নির্ঝর আর হাত বাড়াল না। হেটে চলে এলো বেলকনির কাছে। দীর্ঘ দিনের চেনা বেলী ফুল তার নজরে পড়ল। নির্ঝর হাত দিয়ে ছুয়ে দেখল তা। মেহেরিন এতো দিন খুব যত্ন করেছিল গাছটার। প্রতিদিন এসে পানি দিয়ে গেছে। নিজের বেলী ফুলের গাছটা চিনতে কষ্ট হলো না তার। এটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে নির্ঝর এখানেই থাকতো। হ্যাঁ এখানে আগেও এসেছিল সে। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকাল। কি করা উচিত তার, বুঝতে পারছে না। নিজের মনের কাছে গিয়েই ঠেকে যাচ্ছে সে।
—
“খোঁজ পেয়ে গেছি! ইচ্ছে করেই ট্রাকটা নির্ঝরের দিকে এসেছিল। আর কাজটা..
“রাফির!
নিরব মাথা নাড়ল। মেহেরিন হেসে বলল,আমি জানতাম। তার ছাড়া আর কারো কাজ না এটা। আমাকে নিঃস্ব করে দেবার প্ল্যান। ভুলটা আমার’ই ছিল। বোঝা উচিত ছিল শান্ত হয়ে বসে থাকবে না সে।
“কি করবি এখন..
“কিছু না শুধু শেষ চাল চালবো!
নিরব এসে সামনে দাঁড়াল। এক হাত দিয়ে তার হাত ধরল। অপর হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি সবসময় আছি তোর সাথে। যখন দরকার পড়বে শুধু বলিস। আর একদম মন খারাপ করবি না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেহেরিন হাসল। “নে তোকে এগিয়ে দিয়ে গেলাম। সাবধানে যা কেমন!
দূরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে এসব দেখল নির্ঝর। নিরবের হাত মেহেরিন’র মাথায়। খুব কাছে সে মেহেরিন’র। কেন মনে হতে লাগল এরকম আগেও হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়েই দেখেছে সে এসব। বুকের মাঝে হটাৎ তীব্র ব্যাথা অনুভব করল। বুকে হাত রেখে নিচে বসে পড়ল নির্ঝর। নিরব উপরে তাকাল কিন্তু বেলকনির কাছে তখন কাউকেই দেখতে পেলো না। সে চেয়ে ছিল নির্ঝর এসব দেখুক। এগুলোর প্রভাব পড়বে তার উপর এটা সে জানে!
এই ব্যাথার উৎপত্তি কোথায় জানে না নির্ঝর। কিন্তু এই ব্যাথা খুব কষ্ট দিচ্ছে তাকে। কেন এই ব্যাথা এতো তীব্র। আগেও অনুভব করেছিল এই ব্যাথা সে!
—-
নীলিমা এসে খাবার রাখল মেহেরিন’র সামনে। তাকে খেয়ে নিতে বলছে। মেহেরিন মাথা নাড়ল কিন্তু খাবার ছুঁয়েও দেখল না। নীলিমা ব্যর্থ হয়ে অর্ণব কে খাইয়ে দিতে লাগল। মেহেরিন’র ভাবছে নির্ঝরের কথা। তার রাগ কি এখনো কমেনি। খাবার খাওয়া উচিত তার এরপর ঔষধ তো আছে। একবার কি যাবে তার কাছে!
হঠাৎ করে তার সামনে কেউ কাগজ ছুড়ে মারল। মেহেরিন কাগজ টা উঠালো। পেছনে ফিরে দেখল নির্ঝর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মিস মারিয়া দ্রুত এসে অর্ণব কে নিয়ে চলে গেলেন। নীলিমা রেগে বলেন, এ কেমন ব্যবহার নির্ঝর!
“যা ঠিক তাই করছি। তুমি না বললে আমি এই মেয়েটা কে বিয়ে করেছি, কিন্তু তোমরা কি জানতে বিয়ে টা একটা কন্ট্রাক ছিল। যা একবছরের জন্য ছিল। এরপর আমাদের আলাদা হয়ে যাবার কথা ছিল। তাই নয় কি মেহেরিন বর্ষা খান
নীলিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রিদুয়ান এগিয়ে নির্ঝর কে কিছু বলার আগেই মেহেরিন দাঁড়িয়ে বলল,
“হুম বিয়েটা একটা কন্ট্রাক ছিল!
রিদুয়ান আর নীলিমা দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল মেহেরিন’র দিকে। মেহেরিন হেসে কাগজ গুলোর দিকে তাকাল।
“বিয়েটা একটা কন্ট্রাক’ই ছিল নির্ঝর, হ্যাঁ এটা আমিই করছিলাম। আপনিও রাজি ছিলেন। বিয়ের আগেই আমরা এই কন্ট্রাক পেপারে সাইন করেছিলাম। সব মনে আছে আমার। কিন্তু আপনার এটা কি মনে আছে আমরা আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন আমরা নতুন করে আবার বিয়ে করবো।
নির্ঝর ঢোক গিলল। মেহেরিন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারছে না। রিদুয়ান বলে উঠল, কিন্তু মেহেরিন তোমরা কেন এই কন্ট্রাক করেছিলে। তুমি নিজেই তো বিয়ে করতে চেয়েছিলে নির্ঝর।
“কিন্তু নির্ঝর। উনি তো চান নি। তাই এই কন্ট্রাক ছিল। বাবা আমি বিয়েটা শুধু করেছিলাম আমার অর্ণবের জন্য। আর কোন কারণ ছিল না। কিন্তু যখন কারণ হয়ে দাঁড়াল তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম…
“তখন যখন কোন কারণ ছিল না এখনো নেই।
“নির্ঝর আপনি ছিলেন সেই কারণ!
“আমি বললাম তো না। আর এখন যখন আমার কিছু মনেই নেই তাহলে আমি তো হহেই গেল। আমি আর থাকছি না এখানে। মম চলো।
মেহেরিন কিছু বলতে গেল। তবু থেমে গেল। নিঃশ্বাস নিল। অতঃপর কঠিন গলায় বলল, দাঁড়ান নির্ঝর!
নির্ঝর পেছনে ফিরল। মেহেরিন হেসে বলল, কন্ট্রাক এক বছরের ছিল আর এক বছর হতে আরো ১০ দিন বাকি।
“এই ১০ দিনের মূল্য কি?
“অনেক মূল্য। নিশ্চিত চাইবেন না আপনার কোম্পানী ডুবে যাক। হয়তো পুরো কাগজটা পরে দেখেন নি। কন্ট্রাক অনুযায়ী আপনার কোম্পানীর ৫০% শেয়ারের মালিক আমি। মানে বুঝতে পারছেন…
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকালো। রাগে তার শরীর জ্বলছে। মেহেরিন পায়ের কাছ থেকে আরেকটা পেপার উঠলো। নির্ঝরের কাছে দিয়ে বলল, আর কোন বাড়ি ছেড়ে যাবেন আপনি। বাড়িটা আপনার নামে নির্ঝর। এটা আপনার বাড়ি! আর আপনি এখানেই থাকবেন মানে এখানেই। আমার কথার নড়চড় হবে না।
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কাগজ গুলো সোফার কাছে রাখল। নীলিমা কে বলল, সরি মা!
অতঃপর সিড়ি বেয়ে উপড়ে উঠতে নিল। নির্ঝর বলে উঠল, ঠিক ১০ দিন! ঠিক ১০ দিন পর আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তোমাকে ছেড়ে যাবো।
মেহেরিন দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা কথা শুনল। কষ্ট দুঃখ তার কাছে নতুন কিছু না। তবু প্রভাব ফেলে। কিঞ্চিত হেসে আবারো পা বাড়াল উপরের দিকে।
—-
মল্লিক ম্যানশন বাড়ির সামনে দাঁড়ানো মেহেরিন। বাড়ির দিকে তাকাতেই তার সেই রাতের কথা মনে পড়ে। সেই কালো রাতের কথা মনে পড়তেই বুক আতংকে উঠল তার। বাড়িটার প্রতিচ্ছবি অনেকটা পাল্টে গেছে। আগে যেমন ছিল এখন আর তেমন নেই। তার জীবনের মতো অনেক কিছুই বদলে গেছে এক রাতে।
মেহেরিন আজ লুকিয়ে ঢুকবে বাড়ির ভেতর। আজ সে কি করতে যাচ্ছে সে জানে। তবে এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। রাগের বশে রাফি মল্লিক কে খু/ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এবার তা প্রতিফলন’র পালা। গার্ডের চোখ ধোঁকা দিয়ে খুব সহজেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল সে। সিড়ি বেয়ে উপরে যেতে যাবে ওমনি কারোর নামার শব্দে পিছিয়ে গেল সে। রিতা নামছে। তাকে দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেল তার। সব নষ্টের মূল এই রিতা। বিবাহিত জানার পর একজন ছেলের পিছনে কিভাবে লাগে এই মেয়ে। মেহেরিন কোমরে থাকা ছুরি টা বের করল। প্রথমে এটাকেই শেষ করবে সে।
রিতা রান্না ঘরে এসে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে খেল। অতঃপর পিছু ফিরতেই কেউ তার মাথায় খুব ভারী জিনিস মারল। রিতা মাথায় হাত রেখে সামনে তাকাতেই লাগলো। সবকিছুই ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। চোখ বুজে আসছে তার। প্রায় কিছুক্ষণ’র মধ্যেই মেঝেতে পড়ে গেল রিতা। মেহেরিন আশপাশ দেখল। না কেউই আসে নি। পা বাড়াল রাফির ঘরের দিকে।
ঘরের ভেতর এসে দেখে পুরো ঘর খালি। কেউই নেই! মেহেরিন আশপাশ তাকাল। না কেউই নেই। কিন্তু রাফির ঘর এটাই। ওয়াশরুমে নেই তো। আড়ি পাতল সেখানে। হঠাৎ করেই তার গলায় কেউ ছুরি ধরল। মেহেরিন থমকে গেল। তার সামনে থাকা আয়নায় তাকাল সে। মুখটা স্পষ্ট! রাফি এটা। কুৎসিত ভাবে হাসল সে। মেহেরিন’র কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“মাই ডিয়ার শালিকা! কি ভাবলে তুমি,এতো সহজ রাফি কে মা*রা!
মেহেরিন নিজের ছুরি বের করার আগেই রাফি ওর হাত ধরে ফেলল। ছুরি টা নিজের আয়ত্তে করে নিল। মেহেরিন’র কাছে আর কোন পথ খোলা রইল না। ছুরি’র আঘাত লাগল গলার নিচে। খানিকটা কেটে গেল। রাফি আবারো মারল তাকে। মেহেরিন ছিটকে মেঝেতে এসে পড়ল। রাফি হেসে বলল, “তুমি এই কাজে এখনো খুব ছোট শালিকা!
মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। রাফি কে মারার চেষ্টা করার আগেই রাফি তার মুখের সামনে স্প্রে করল। মেহেরিন মূহূর্তে জ্ঞান হারালো। গার্ডদের কল করে মেহেরিন কে অন্যত্র নেবার ব্যবস্থা করল!
নির্ঝর মাঝরাতে নিজের ঘর ছেড়ে উঠল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। অর্ণব অনেকক্ষণ এসে তার কাছে বসে ছিল। ঘুমাতেও চেয়েছিল কিন্তু মেহেরিন তাকে জোড় করে নিয়ে গেছে। মেহেরিন তার বউ অথচ তার প্রতি কোন আবেগ নেই তার। কোন প্রকার ভালোবাসা নেই তার মনে। কিভাবে তাকে মেনে নিবে সেই। এর মাঝেই কি না তার বিয়েটা একটা কন্ট্রাক ছিল। ১০ দিন পর তো মেহেরিন কে ছেড়ে দিতেই হবে তাকে। হঠাৎ ঘরের দরজা কেউ নক করল। নির্ঝর বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেখল অর্ণব হাতে একটা পুতুল হাতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলে উঠল, “ড্যাডি!
নির্ঝর হাটু গেড়ে বসল। “তুমি এখানে কেন, এতো রাতে।
“মাম্মি!
“মাম্মি ঘরে নেই তোমার!
অর্ণব মাথা নেড়ে না না করল। অতঃপর এসে নির্ঝর কে জড়িয়ে ধরে বলল, “ড্যাডি!
নির্ঝর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মাম্মি কোথায় যায় নি, দেখো ওয়াশরুমেই আছে।
নির্ঝরের দিকে ফিরে আবারো মাথা নেড়ে না না করল সে। অর্ণব কে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এলো নির্ঝর। অর্ণব তার কোলে মাথা নেড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নির্ঝর তার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। আর ভাবছে, মেহেরিন’র কথা। কোথায় গেল এই মেয়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দুটো বাজে। এতো রাতে এই মেয়ে গেল কোথায়?
#চলবে….