অনুভূতির অন্বেষণ পর্বঃ১০

0
3396

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১০

(২৪)

নুজহাতের কাছ থেকে মিশরাত জানতে পেরেছে সেদিন পার্টিতে যেই মেয়েটি আরিয়ানের সাথে এসেছিলো তার নাম মোনা। আরিয়ান কেন তাকে মোনার ব্যাপারে কিছু বলেনি তা জানতে আবারও একদিন আরিয়ানের সম্মুখীন হয়েছিলো মিশরাত। জোরালো কন্ঠে প্রশ্ন করেছিলো

—-আপনি কেন আমাকে বলেননি যে আপনার জীবনে কেউ আছে?

—-প্রয়োজন মনে করিনি।

—-প্রয়োজন মনে করেননি মানে কী? আপনার পেছনে একটা মেয়ে এতোদিন ধরে ঘুরছে, তাকে সত্যি কথাটা একটাবার অন্তত বলার প্রয়োজন মনে করেননি আপনি!

—-কেন বারেবারে বিরক্ত করছো মিশরাত? শোয়েব আংকেলের মেয়ে বলে আমি তোমাকে কখনো বকাঝকা করিনি। ঠান্ডা মাথায় সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আজকে তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে ঠিক একবার বলতাম। এরপর এমন কিছু করতাম যাতে এভাবে বারেবারে একই কথা আমাকে বলার সাহস পেতো না। তোমাকে আমি এতোবার করে বলি তুমি বোঝো না যে আমি তোমাকে চাই না?

—-আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে আপনার মা,বাবা, বোন কেউ পছন্দ করে না সেটা জানেন আপনি?

—-এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো মিশরাত। আমার পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?

—-আমি নাক গলাচ্ছি না। নুজহাত আপু নিজে আমাকে বলেছে, আন্টি আর আপুর আপনার পছন্দ করা মেয়েকে পছন্দ হয়নি। আংকেলও পছন্দ করেননি। শুধু আপনার কথা বিবেচনা করে চুপ করে আছেন।

—-তো তারা যেহেতু চুপ করে আছে, তুমি তাহলে বকবক করছো কেন?

—-আপনি ওই মেয়েকে কী কারণে পছন্দ করেন একটু বলবেন?

—-সীমা অতিক্রম করো না মিশরাত। আমার রাগ হচ্ছে। আর রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখতে যেও না।

—-আমি শুধু কারণ জানতে চাইছি। আপনার রাগ উঠার মতো কী বললাম?

—-ধরো তুমি আমাকে পছন্দ করো। কিন্তু তোমাকে অন্য একটা ছেলে পছন্দ করে। সে তোমার পিছুপিছু ঘুরছে। এখন তুমি কী তাহলে নিজের পছন্দ বাদ দিয়ে অন্য কারোর পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে আমাকে ছেড়ে ওই ছেলেকে বিয়ে করবে? তার সাথে সম্পর্ক তৈরী করবে? ঠিক এই ব্যাপারটাই আমার সাথে একেবারে মিলে গেছে। আমি মোনা কে পছন্দ করি। তুমি আমাকে। এখন তোমাকে আমার পছন্দ না মানে না। আমি কী এখন নিজের পছন্দ করা মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়া বাদ দিয়ে যাকে আমি পছন্দ করি না তার সাথে সম্পর্কে যাবো? সহজ একটা কথা তুমি বুঝতে পারছো না?

—-সুইটহার্ট?

মেয়েলি কন্ঠ কানে আসায় মিশরাত আর আরিয়ান দু’জনে পেছনে ফিরে তাকালো। মোনা দাঁড়িয়ে আছে। মিশরাতের দিকে চোখ দু’টো ছোটছোট করে একবার তাকিয়ে চলে গেল আরিয়ানের কাছে

—-এতো কৈফিয়ত দেওয়ার কী আছে এই মেয়ের কাছে?

—-মোনা, তুমি এখানে আসতে গেলে কেন আবার? আমি তো যাচ্ছিলাম বাসায়।

—-এসে ভালোই করেছি। অনেকক্ষণ যাবত তোমাদের কনভারসেশন শুনছিলাম। হেই ইউ! তোমার সাহস তো কম না তুমি আমার উড বি এর দিকে নজর দাও?

—-মোনা, আমি হ্যান্ডেল করছি তো।

—-এতো ভদ্রভাবে এই মেয়ের সাথে কথা বলার কী আছে? সরাসরি থাপ্পড় দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারছো না? থার্ডক্লাস যত্তসব মেয়ে কোথাকার! এসব শিখে আসে নাকি পরিবার থেকে?

—-মোনা, কথা একটু ভেবেচিন্তে বলো। তার পরিবারকে এখানে টেনে আনছো কেন? আংকেল আন্টি যথেষ্ট ভালো মানুষ। মিশরাতের পরিবারের সাথে আমাদের বহু পুরনো দিনের সম্পর্ক।

—-তাই বুঝি তুমি তাকে কিছু বলতে পারো না? বেশ, তোমার বলতে সমস্যা। আমার তো নেই। আমি কেন চুপ থাকবো?

আরিয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনে একটা কল আসলো তার। একবার মোনা আর মিশরাতের দিকে তাকিয়ে ফোন কানে লাগিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা সামনে চলে গেল।

—-এই মেয়ে, তুমি জানো তুমি যাকে প্রপোজ করতে এসেছো, যোগ্যতায় তার কাছেধারেও তুমি নেই? আরিয়ান হক কোনো যেই সেই ছেলে না যে তোমার মতো একটা রাস্তার মেয়েকে বিয়ে করতে যাবে। অবশ্য তোমাদের মতো মেয়েদের তো কাজই হচ্ছে কী করে আরিয়ানের মতো ছেলেকে পটানো যায়। সেই ধান্দা নিয়েই তো ঘুরতে থাকো সারাদিন। তোমার মতো মেয়েরা এসব করেই নিজেদের অবস্থান শক্তপোক্ত করে। বেহায়া মেয়ে কোথাকার!

পরিবারকে নিয়ে কথা তোলায় মিশরাতের মেজাজ এমনিতেই তুঙ্গে। সে তখনই একটা জবাব দিতো। তবে তার আগে আরিয়ান জবাব দিয়ে দিয়েছিলো বলে সে তখন চুপ ছিলো। তবে এবার আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না মিশরাত

—-রাস্তার মেয়ে কারা জানেন? আর সভ্য পরিবারের মেয়ে কারা জানেন? প্রথমটা আপনি আর দ্বিতীয়টা আমি। শুধুমাত্র ছোটখাটো জামাকাপড় পরলে, হাই হিল পরলে, মুখে আটা ময়দা ঘষে রাখলে আর অতিরিক্ত স্মার্ট সাজতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে ফেলা মেয়েরা রাস্তার মেয়ে হয়। অবশ্য আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে আপনাকে রাস্তার মেয়েদের সাথে তুলনা করে আমি তাদের অপমান করছি। রাস্তাঘাটে অনেক মেয়ে দেখবেন যারা ঠিকঠাকমতো পোষাক পরতে পারে না। ছেঁড়া ফাড়া পোষাক পরে। কারণ তারা পরতে বাধ্য হয়। তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই বলে। অথচ আফসোস, আপনার মতো মেয়েরা ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ভিখারিদের মতো পোষাক পরেন।

একটু আগে কী বললেন? আমি আরিয়ানকে পটানোর ধান্দায় আছি? আমার মতো মেয়েরা এসব করেই নিজের অবস্থান শক্তপোক্ত করে? হাসালেন! শরীর দেখিয়ে কে কাকে পটানোর ধান্দায় আছে সেটা একজন নিরপেক্ষ, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে এখানে এনে জিজ্ঞেস করুন। জবাব পেয়ে যাবেন। বয়সে আমার থেকে বোধহয় কমপক্ষে তিন-চার বছরের বড় হবেন। অথচ আপনার পোষাক আশাক একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চার মতোন। লজ্জা লাগে না আমাকে বেহায়া বলতে? আপনি নিজেকে একবারও আয়নায় দেখেছেন?

আরিয়ানকে আমি ভালোবাসি। তাকে ভালোবেসে জয় করতে চাই। আপনার মতো ছোটখাটো পোষাক পরে শরীর দেখিয়ে নয়। আপনি কেমন মেয়ে সেটা আমি খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছি। আরিয়ান আপনার কয় নাম্বার?

—-মা…মানে!

—-মানে আপনি আরিয়ানের কাছে প্রথম এসেছেন সেটা যে নয় এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আপনার মতো সস্তা পোষাক পরিহিতা মেয়েদের দিকে ছেলেরা তো ঘেঁষবেই। তাদের তো একার দোষ দিয়ে লাভ নেই।

মোনা চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভাব নিয়ে এসেছিলো মিশরাতকে কিছু বলবে বলে। কিন্তু এখন সব হাওয়া। মিশরাত তার বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। কয়েক কদম এগিয়ে হুট করে থেমে গেল। এরপর মোনার দিকে পেছন ফিরে তাকালো

—-একটা কথা জেনে রাখবেন,
মিশরাত বিনতে শোয়েব চাইলেই ছোটখাটো পোষাক পরে আপনার থেকে বেশি ছেলেদের নিজের পেছনে ঘুরাতে পারে। কিন্তু সে এটা কখনোই করবে না। কারণ তার পরিবার থেকে সে এই শিক্ষা পায়নি। আমি চাইলেই আপনি হতে পারি। কিন্তু আপনি কখনোই চাইলে আমি হতে পারবেন না। কারণ লজ্জা নারীর ভূষণ। নারীর সম্ভ্রম তার অহংকার। আর সেই সম্ভ্রম একবার চলে গেলে, সেটা আর কখনোই ফিরে আসে না।

(২৫)

—-মিশরাত, তোমার কী মন খারাপ? কয়েক দিন ধরে তোমাকে দেখছি কেমন মনমরা হয়ে থাকো? আগের মতো হাসিখুশি দেখি না।

—-না আপু, আসলে সামনে ইয়ার ফাইনাল এক্সাম তো, তাই।

আরিয়ানদের বাসার ছাদে উঠে বসে আছে মিশরাত আর নুজহাত। দুজনের হাতেই বাদামের ঠোঙা। নুজহাত বাদাম খাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে।

—-আপু, কী হয়েছে বলো তো? তোমার মুখে স্নিগ্ধ, মিষ্টি এই হাসির রেশ কীসের?

হাসিমুখে মাথা নত করে না বোধক মাথা নাড়লো নুজহাত।

—-আপু, কিছু তো একটা হয়েছেই। বলো না গো? প্রেমে টেমে পড়লে নাকি আবার?

কথাটা নিতান্তই মিশরাত আন্দাজে বলেছিলো। তবে তার আন্দাজ বোধহয় মিথ্যে না। বাদামের ঠোঙা পাশে রেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো নুজহাত।

—-আপু! সত্যি! কে, কে? বলো না?

মুখ থেকে হাত নামাচ্ছে না নুজহাত।

—-ও আপু, বলো না গো? প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ?

—-ইশতিয়াক।

—-সত্যি! ইশতিয়াক ভাইয়া জানে?

—-উঁহু। আমি বলিনি এখনো। সে তো না-ই। আমি অপেক্ষা করছি তার থেকে সংকেত পাওয়ার। আমার নিজের থেকে বলতে লজ্জা লাগে।

—-ইশতিয়াক ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে? মানে তোমরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করো?

—-আমি তো ইশতিয়াক কে-ই চাই। কিন্তু তার মনের খবর তো জানি না রে!

—-এই কথা আর কাউকে জানিয়েছো?

—-উঁহু। তুমিই প্রথম। আব্বু আম্মুকে বলতে সাহস পাচ্ছি না। ভাইয়াকে বলে দেখবো কিনা ভাবছি।

—-নুজহাত?

সম্বোধন কানে আসায় মিশরাত আর নুজহাত ফিরে তাকালো ছাদের দরজা বরাবর। আরিয়ান টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে প্যান্টের দু’পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ানো।

—-কী ভাইয়া?

—-তোকে আম্মু ডাকছে। জলপাইয়ের আচার খাবি নাকি বলেছিলি? আম্মু বানিয়ে রেখেছে।

নুজহাত হাসি মুখে ছাদ থেকে চলে গেল। মিশরাত আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে। মিশরাতের চোখে চোখ পড়ায় আরিয়ান মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে নিলো।

—-আরিয়ান?

থমকে দাঁড়ালো আরিয়ান। মিশরাত তার নাম ধরে সম্বোধন করছে!

আরিয়ানের সামনে গিয়ে তার মুখ বরাবর দাঁড়ালো আরিয়ান। সূর্যের তীব্রতা এখনো পুরোপুরি যায়নি। সেই তীব্রতায় আরিয়ান মিশরাতের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলো তার চোখ দু’টো ছলছল করছে।

—-শুধু একটাবার বলে দাও না প্লিজ? মোনাকে তুমি কোন এমন কারণের জন্য ভালোবাসো যেটা আমার মধ্যে নেই?

—-তোমার স্পর্ধা দেখে আমি স্তম্ভিত না হয়ে পারছি না এবার। নাম ধরে ডাকছো তুমি আমাকে, তা-ও তুমি বলে!

—-এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।

—-মোনার সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে এবং আমি একজন আরেকজনকে ভালো বুঝি। আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং অনেক ভালো। তার সাথে আমার বৈবাহিক জীবন সুখের হবে বলে আমি আশাবাদী। হয়েছে? পেয়েছো তোমার উত্তর?

—-সবসময় আমরা যা দেখি, যা বুঝি বা যা শুনি তা হয়তো সত্য হয় না আরিয়ান। দৃশ্যমান সত্যের পেছনে কখনো কখনো অদেখা কোনো সত্য থাকতে পারে।

জানো তো? আব্বু সবসময় তোমার প্রশংসা করে। তোমার ব্যক্তিত্ব নিয়ে।
আমিও ভাবতাম এতোদিন সেটা সত্যি। কিন্তু এখন প্রশ্ন উদয় হয় মনে। সন্দেহ হয় তোমার ব্যক্তিত্বের উপর।

—-হাউ ডেয়ার ইউ! আসলেই মোনা ঠিক বলেছে। তোমাকে আমি কখনো কড়া ভাষায় কিছু বলিনি বলে তুমি যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছো। যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছো। আমার ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করার তুমি কে?

—-বাস্তবেই যদি তোমার প্রখর ব্যক্তিত্ব থাকতো, তাহলে মোনার মতো মেয়ে হয়তো তোমার পছন্দের তালিকায় থাকতো না। ছোটখাটো পোষাক পরে দেখে বুঝি…

মিশরাত কথা শেষ করতে পারেনি। তার আগেই নিজের গালে হাত চলে গিয়েছে তার। প্রচন্ড জোরে পড়েছে থাপ্পড় টা।

—-যথেষ্ট হয়েছে। আমি একবার বলেছি কথা কানে যায়নি? মোনার সাথে আমার বোঝাপড়া ভালো, তাই তাকে নিজের জীবনে চাইছি। সেটাকে পোষাকের ভিত্তিতে বিচার করার সাহস কোত্থেকে পাও তুমি? এতোদিন চুপ থেকেছি শুধু আংকেল আন্টির দিকে তাকিয়ে। আর নয়। এবার যদি আর একদিনও আমাকে বিরক্ত করো, তাহলে সোজা আংকেলের কাছে বিচার চলে যাবে। মাইন্ড ইট!

গটগট করে হেঁটে সিঁড়ির কাছে চলে গেল আরিয়ান। সিঁড়িতে পা ফেলার আগে শুধু কয়েকটা কথা তার কানে গিয়েছিলো

—-সময়ের কাজ সময়ে না করলে পস্তাতে হয়, জানো তো? এতোবার করে এতোকিছু বললাম তোমাকে। শুনলে না তুমি। হয়তো একদিন আসবে, যেদিন তুমি আমার কাছে এসে আমার থেকেও দ্বিগুণ আকুলতা নিয়ে আমাকে চাইবে। তখন হয়তো আর আমাকে পাবে না।

***

—-মিশু?

রেণু আক্তারের কন্ঠ কানে আসায় জানালা থেকে নজর সরে গেল মিশরাতের। তার সাথে সাথে অতীতের স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে এলো।

—-বলো আম্মু?

—-ইশু কোথায়? সাদমানের বাসা থেকে এখনো আসেনি?

—-না। হয়তো পারভীন আন্টির সাথে কথাবার্তায় মশগুল। এসে যাবে।

(২৬)

ইশরাতের কথার কোনো জবাব না দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে রেখেছে সাদমান।

—-আম্মুকে আপনি বোধহয় কালো জাদু করে বশ করে রেখেছেন। তবে চিন্তা করবেন না। আমি আজকেই আব্বুর সাথে কথা বলবো এই ব্যাপারে।

—-কেন? আংকেল কে-ও তো সাদা জাদু করতে পারি!

কিছুক্ষণ রাগে বিড়বিড় করলো ইশরাত। সেগুলো সাদমানের কানে গেলেও সে চুপচাপ বসে রইলো আগের মতো।

—-আব্বুকে বলে দিবো বললাম!

তৎক্ষনাৎ সাদমানের মুখে চিরচেনা সেই বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।

—-ওকে। বেস্ট অফ লাক।

—-আপনি হাসছেন? আপনার কী মনে হচ্ছে আমি মজা করছি আপনার সাথে? আমি কিন্তু সিরিয়াস! আপনি আমাকে অহেতুক বিরক্ত করছেন সেটা কিন্তু আমি বলে দেবো!

—-বললাম তো ওকে। এক কথা বারেবারে বলছো কেন তুমি? কানে শুনতে পাও না, নাকি?

—-গতকাল আমার ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজের মধ্যেই আমাকে প্রপোজ করেছে ওই ছেলে।

ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে গিয়েও থেমে গেল সাদমান। সরাসরি নজর দিলো ইশরাতের দিকে।

—-কখন? কী লিখেছে সেই ছেলে? ছেলের নাম কী?

রুমে থাকা বুকশেলফ থেকে একটা বই হাতে নিয়ে বিছানায় বসে খুব মনোযোগী পাঠিকার ভঙ্গিতে পড়ছে ইশরাত।

—-এই কথা কানে যায়নি? কে মেসেজ দিয়েছে?

—-দিয়েছে কামরুলের ভাই জামরুল।

—-কীহ্! এই, ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে?

—-আপনি যা করেন তার তুলনায় কিছুই না।

—-হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বলবে না বলছি ইশরাত! সত্যি করে বলো কে মেসেজ দিয়েছে?

—- আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করি। অবশ্য সে কলেজে পড়ে না। আমার থেকে পাঁচ বছরের সিনিয়র।

—-পছন্দ! কবে থেকে হলো এসব?

—-সদ্য প্রেম জন্মেছে মনে। আপনার পেছনে ঘুরঘুর করতে গিয়ে বেশ শিক্ষা হয়েছে বুঝলেন? এই যে আপনার মতো একটা বুড়ো, হ্যাংলার পেছনে ছুটছিলাম। আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়। কোথায় আমি একটা কচি মেয়ে। আর কোথায় আপনি এক পরিপক্ব বুড়ো। আপনার সাথে আমার যায়? তাছাড়া আপনি তো চোখে দেখতে পান না ঠিকমতো। এই যে সবসময় চোখে চশমা পরে থাকেন। আমার চোখে কোনো ডিফেক্ট নেই। এই যে আপনি তাল গাছের মতো লম্বা। কোনো সাইজ আছে? আমাকে দেখুন তো কতো পারফেক্ট? সবদিক থেকে আমি ঠিকঠাক। তাহলে আপনার পেছনে কেন মূল্যবান সময় নষ্ট করবো নিজের? আজ পর্যন্ত কতোগুলো প্রপোজাল পেয়েছি আপনি জানেন? চেনেন তো ওই শুধু এক কামরুলকে।

কী করে চেনেন সেটাও অবশ্য একটা প্রশ্ন। তবে আপাতত সেসব ভাবছি না। যেটা ভেবেছি সেটা হলো যে, এতোগুলো ছেলে যেহেতু আমার পেছনে পড়ে আছে, তাই বেছে বেছে একজনকে পছন্দ করাই যায়। তো সবকিছু মিলিয়ে ভেবে দেখলাম জামরুলকে, ইয়ে মানে নওশাদকে আমার ব্যাপক মনে ধরেছে। কলেজ ছেড়ে কয়েক মাসের মধ্যেই ভার্সিটিতে উঠে যাবো। গায়ে একটু হাওয়া লাগাতে হবে না বলুন? ভাবলাম এই শহরের কোনো এক ভার্সিটির স্টুডেন্টকে ধরি। তাহলে প্রেম করতে বেশ সুবিধা হবে। আমার আবার এই শহর ছেড়ে, আব্বু, আম্মু আর আপুকে ছেড়ে কোথাও পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। এই শহরেই থেকে পড়ার ইচ্ছে। তাহলে আমার বুদ্ধিটা জমপেশ হলো না বলুন?

এতোক্ষণ যাবত বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সবগুলো কথা বলছিলো ইশরাত। সাদমান একটা কথাও বলেনি। তাই ইশরাত ধরেই নিয়েছে যে সাদমান এবার আচ্ছা জব্দ হয়েছে। নিজেকে এখন বিজয়ী ঘোষণা করছে ইশরাত মনে মনে। কথা বলা শেষ করে বিজয়ের হাসি হেসে কেবল মাথাটা একটু উঁচু করে সামনে তাকালো সে। সাথে সাথেই হাসির ছিটেফোঁটাও মুখ থেকে উবে গেল। দু’টো রক্তিম চোখ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রাগের বহিঃপ্রকাশ করার জন্য মুখের মধ্যে আলাদা কোনো ভঙ্গি নেই। খুবই সাধারণ মুখভঙ্গি বিদ্যমান। তবে এই সাধারণের মাঝে যে ভয়ংকর কিছু লুকিয়ে আছে সেটা ইশরাত শুধু মানুষটার চোখ দেখেই বুঝতে পারছে। আঁড়চোখে একবার দরজার দিকে তাকালো সে। দরজাটা খোলা আছে কিনা সেটা দেখতে। তাহলো তার একটু পালাতে সুবিধা হতো। কারণ এখানে এই রুমে এই মানুষটার সাথে আর খুব বেশি একটা সময় যে বসে থাকা যাবে না, তা ইশরাত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হচ্ছে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে রুমের মধ্যে থাকা সবকিছু। সাদমানের মনের মধ্যে সুপ্ত যেই ঝড় আছে, তার জেরে। তবে ঝড়ের তো পূর্বাভাস থাকে। এখন ঠিক সেই পূর্বাভাসই অনুমান করতে পারছে ইশরাত।

মুখের মধ্যে নিষ্পাপ একটা ভাব আনলো। চোখে নিষ্পাপ চাহনি। আর ঠোঁট প্রসারিত করে বোকাসোকা একটা হাসি। হাত থেকে আস্তে করে বইটা বিছানায় রেখে কেবল দরজা বরাবর দু’কদম ফেলেছে তার সাথে সাথেই বাম হাতে ইশরাতের চিকনচাকন ঘাড় চেপে ধরে আবজা দেওয়া দরজা ডান হাত দিয়ে পুরোপুরি লাগিয়ে দিলো সাদমান। ইশরাত চিৎকার করার উদ্দেশ্য কেবল মুখটা হা করেছিলো। তৎক্ষনাৎ দরজা বন্ধ করে ডান হাত দিয়ে ইশরাতের মুখ চেপে ধরলো সাদমান। এক ধাক্কায় দেয়াল বরাবর ঠেসে ধরলো। ইশরাতের নিজের কাছে নিজেকে এখন একটা অসহায় হরিণের মতো লাগছে আর সাদমানকে? হিংস্র বাঘ!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here