#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১৮
(৫৮)
অনেকক্ষণ যাবত আরিয়ানের নাম শুনে থ বনে ছিলেন শোয়েব রহমান। খুব কষ্ট হয়েছে উনার মিশরাতের কথা বিশ্বাস করতে। কিন্তু এভাবে কাঁদতে কাঁদতে নিশ্চয়ই মেয়েটা মিথ্যে কথা বলবে না? তাই তো সকল বিস্ময় দূরে সরিয়ে রেখে একরাশ চাপা ক্ষোভ মনে পুঞ্জীভূত করে শোয়েব রহমান চললেন আরিয়ানের উদ্দেশ্যে।
সেদিকে তাকিয়ে রইলো মিশরাত। শোয়েব রহমান চোখের আড়াল হতেই নিজের কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেলো মিশরাত। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো মোনা তার দিকে এক ক্রুর হাসি মুখে এনে তাকিয়ে আছে।
—-কেমন লাগছে মিশরাত বিনতে শোয়েব? খুব অহংকার না তোমার নিজেকে নিয়ে? আমাকে সেদিন কীভাবে অপমান করেছিলে মনে আছে? সেদিন এই আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে আর আজ? আজ সকলের সামনে তোমার নিজের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো। শুধু প্রশ্ন বললে ভুল হবে। সরাসরি চরিত্রহীন বলা হয়েছে। আর সেটা বলেছে কে? যার কাছ থেকে তুমি পাহাড় সমান ভালোবাসা আর সম্মান আশা করে বসেছিলে। ভীষণ মজা পাচ্ছি জানো? ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
জানো কাউকে নিজের আয়ত্তে আনার সবচেয়ে সহজ উপায় কী? তাকে ম্যানিপুলেট করা। আর সেটা খুব ভালো করে করতে পারি আমি। অন্য সবার ক্ষেত্রে না পারলেও আরিয়ানকে আমার থেকে ভালো ম্যানিপুলেট কেউ করতে পারে না, ট্রাস্ট মি? আমার মনে হয় তার মা বাবাও ততোটা পারবে না। আর হ্যাঁ, কাউকে ম্যানিপুলেট করার আগে তার বিশ্বাস অর্জন করা খুব বেশি জরুরী। যেটা আমি কোনো না কোনোভাবে আরিয়ানের কাছ থেকে অর্জন করেছি। তো এর ফল দেখতেই পেলে! তো এখন তোমার অনুভূতি কী একটু বলো? জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার। এই মুখ নিয়ে এই শহরে আর থাকতে পারবে? মাঠভর্তি মানুষের সামনে তো অপমান হয়ে এলে। এখন যার সামনে দিয়ে যাবে সে-ই তোমাকে বাঁকা চোখে দেখবে। চরিত্রহীন উপাধি পেয়েছো কীনা! বেশ জটিল একটা উপাধি কিন্তু!
শরীর দুলিয়ে হাসছে মোনা। সেই হাসিতে মোনার খুশি প্রকাশ পেলেও মিশরাতের কাছে সেই হাসি গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। কিছুক্ষণ হেসে হাসি থামালো মোনা। এরপর আশেপাশে তাকিয়ে বললো
—-তোমার আব্বু বুঝি আবার বিচার চাইতে গিয়েছে তোমার হয়ে? আহারে! কেন যেতে দিতে বলো তো উনাকে? নিজে তো অপমানিত হলে হলে এখন নিজের বাবাকেও অপমানিত হতে দিচ্ছো?
শোয়েব রহমানের কথা শুনে চমকে চোখ তুলে তাকালো মিশরাত। সেটা থেকে বাঁকা হেসে মোনা বললো
—-তুমি ছাড়াও তোমার বাবার ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি। বলতে পারো কোনো দিকে কমতি রাখিনি আমি। তো তোমার বাবার জন্য কী ব্যবস্থা করেছি সেটা জানতে চাও? শুধু একটু অপেক্ষা করো তোমার বাবা ফিরে আসার। এরপরেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। যাই হোক, চলি আমি। তোমার সাথে কথা বলার রুচি বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিলো না আমার। কিন্তু কী বলো তো? আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারছি যে তুমি আর এখানে এই শহরে লজ্জায় থাকতে পারবে না। আজ কালের মধ্যে চলে যাবেই। তো বলতে পারো আগেভাগে তোমাকে বিদায় দিতে এলাম। যাই হোক, একটা শিক্ষা অন্তত নিয়ে যাও। যার তার সাথে লাগতে এসো না ঠিক আছে? সারাজীবন যাতে আমাকে না ভুলতে পারো তার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম।
মিশরাতের দিকে মুখ রেখেই একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে মোনা। ডান হাত তুলে কয়েকটা আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বললো
—-টা টা বাই বাই আর যেন কখনো দেখা না পাই!
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে মিশরাত। অন্য কিছু নিয়ে আর চিন্তা করছে না সে। শুধু ভাবছে শোয়েব রহমানের কথা কী বলে গেল এগুলো মোনা?
অপরদিকে আরিয়ানের কাছে চলে গেল শোয়েব রহমান। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের এসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলছিলো আরিয়ান। দূর থেকে শোয়েব রহমানকে দেখতে পেলো সে। শোয়েব রহমান তার একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালেন। কন্ঠে যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বললেন
—-আমার মেয়ের সাথে এভাবে ব্যবহার করার দুঃসাহস তুমি কোথায় পাও আরিয়ান হক?
নিজের এসিস্ট্যান্টের দিকে একবার তাকিয়ে শোয়েব রহমানের উদ্দেশ্যে আরিয়ান বললো
—-ভেতরে চলুন।
—-কেন? ভেতরে কেন? এখানে এখন এই মুহুর্তে বলবে তুমি। আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করো তুমি? কে তুমি হ্যাঁ? সেই অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
—-যথেষ্ট সম্মান করি আপনাকে। তাই এখানে কিছুই বলতে চাচ্ছি না। ভেতরে চলুন।
আর কিছু না বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল আরিয়ান। তার পেছন পেছন গেলেন শোয়েব রহমান। নিজের রুমে গিয়ে থামলো আরিয়ান। শোয়েব রহমানও চলে এলেন সেখানে।
—-নিজের মেয়েকে খুব বেশিই আদর দিয়ে ফেলেছেন। অতিরিক্ত আহ্লাদ দিয়ে বিগড়ে দিয়েছেন।
—-এখন তুমি আমাকে শেখাবে কী করে মেয়েকে সঠিকভাবে বড় করে তুলতে হয়?
—-না, সেটা শেখানোর মতো যথেষ্ট জ্ঞান হয়তো আমার নেই। আপনার আছে, তবে মেয়েকে অতিরিক্ত মাথায় তুলে ফেলেছেন যার কারণে আজ আপনার মেয়ের এই অবস্থা। সে কোথায় কী করে না করে সেগুলো আপনি জানেন না, জানার প্রয়োজনও মনে করেননি। আপনি জানেন আপনাদের মেয়ে আমার পেছনে কতোদিন ঘুরঘুর করেছে? কখনো বলিনি সে বিষয়ে আমি। চাইনি আপনাকে লজ্জায় ফেলতে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আপনার মেয়ে আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দিনকে দিন তার উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েই চলেছে। আপনার সেদিকে নজর রাখা দরকার ছিলো। আপনি রাখেননি। এখন এসেছেন বিচার চাইতে? একটু জিজ্ঞেস করে দেখবেন আমার কথা বিশ্বাস না হলে যে আসলেই আপনার মেয়ে আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছে কীনা বেহায়ার মতো। আশা করি আপনার কাছে সে মিথ্যে বলবে না। আর একটা বললেই বাকীগুলো আপনা-আপনি বের হয়ে যাবে মুখ দিয়ে। আপনার মেয়ের শাসন দরকার। আমার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে সময় নষ্ট না করে সেই সময়টা নিজের মেয়েকে শাসন করতে ব্যয় করুন, তার বেহায়াপনা আশা করি কিছুটা হলেও কমবে।
আরিয়ান রুম থেকে বের হয়ে গেল। এখনো ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছেন শোয়েব রহমান। এতোটা লজ্জা কোথায় রাখবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। তার মেয়ে ছেলেদের পিছুপিছু ঘোরে? আরিয়ানের চোখে স্পষ্টতা দেখেছেন তিনি। আরিয়ান শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এতোগুলো কথা বললো কীভাবে?
ক্লান্ত পায়ে রুম থেকে বের হতে নিবেন শোয়েব রহমান। এরমধ্যেই তিনি দেখলেন দরজার সামনে আরিয়ানের বাবা আহনাফ হক দাঁড়িয়ে। উনার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন তিনি।
—-আপনারা বাপ মেয়ে মিলে তো দেখি ভালোই খেল দেখালেন মিস্টার রহমান?
আশ্চর্য হয়ে আহনাফ হকের দিকে তাকালেন শোয়েব রহমান। কখনো আহনাফ হক উনাকে “ভাইজান” ছাড়া অন্যকিছু বলে সম্বোধন করেননি। আর আজ মিস্টার রহমান?
—-আপনি কী বলছেন এগুলো ভাইজান?
—-একদম না! খবরদার, একদম না! কোনো বেঈমানের মুখ থেকে আমি ভাইজান ডাকটা শুনতেও চাই না।
—-বেঈমান! কে? কাকে বেঈমান বলছেন আপনি?
—-বেঈমান নিজে জিজ্ঞেস করে কাকে বেঈমান বলছি! বাহ্! আরে মানুষ এভাবে ভালোমানুষির মুখোশ পরে থাকে? আমাদের পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি আপনাদের হয়েছে এটা বলতে পারবেন? অথচ আপনারা কী করলেন? লজ্জা করলো না এমনটা করতে?
—-কী করেছি আমি সেটা তো বলবেন?
—-আরে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েও নাটক করছেন আপনি? নাটক? অবশ্য এতোদিন তো সেটাই করে এসেছেন। আপনার নাটকের ব্যাপারে তো আরিয়ানকে এখনো কিছু বলিনি আমি। আপনার বড় মেয়েকে নিজের পরিবারের সদস্য মনে করেছিলাম আমরা। একেবারে নিজের রুপ দেখিয়ে দিলো। ছেলেটা আমার সেই বিষয় নিয়ে এখনো পড়ে আছে। তার উপর আপনার বেঈমানীর কথা এখন তাকে বলি কী করে বলুন? একেবারে ভাব দেখালেন যে আপনি আমাদের কোম্পানিতে রাতে গিয়েও থাকবেন নিজের পরিবার ছেড়ে। আমরাও সহজ সরল মনে এটার বাহবা দিতে লাগলাম। আর এর পরিণাম? নিজেই টাকা সরাতেন কোম্পানি থেকে। আর ভাব দেখাতেন যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেন না?
—-ভাইজান!
—-ভাইজান ডাকবেন না আমাকে খবরদার! ভাইজান শব্দটার মানে জানেন আপনি? আরে আপনারা তো গিরগিটির থেকেও অধম! এখন আর কথা ঘোরাতে পারবেন না। সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।
কতোগুলো মিথ্যে বানোয়াট প্রমাণ দেখানো হয়েছিলো শোয়েব রহমানকে। বেশ কিছু কাগজ যাতে প্রমাণ করতে পারে শোয়েব রহমান নিজে কোম্পানির টাকা আত্মসাৎ করতো। কয়েকবার শোয়েব রহমান বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এসব কিছুই মিথ্যে। তবে সেদিকে কেউ কান দেয়নি। কেউ শোনেনি উনার কথা। একটা সময় হাল ছেড়ে দিলেন শোয়েব রহমান। চুপ করে গেলেন। এরকম ভয়ানক বাস্তবতার সম্মুখীন কখনো হতে হবে উনি ভাবতে পারেননি। আহনাফ হক উনাকে আজীবনের জন্য হক কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করে দিলেন শাস্তিস্বরূপ।
ঠিক এভাবেই পুরোপুরিভাবে দুই পরিবারের মধ্যে থাকা সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। শোয়েব রহমান পুরো পরিবারকে নিয়ে চলে আসেন সেই শহর ছেড়ে। অতীত ভোলেনি কেউ-ই। এখনো সেই অতীতকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। সময় এগিয়ে গেছে। এই শহরে এসে চাকরী জুটেনি শোয়েব রহমানের। পেয়েছেন খুবই দূরে। তাই তো পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয় উনাকে। মিশরাত সেই ঘটনার পর থেকে আর কখনো পিছু ফিরে তাকায়নি। নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে পড়াশোনা এবং পরিবারের প্রতি। দ্বিতীয়বারের মতো আর কোনো ছেলের চিন্তা সে মাথায়ও আনেনি। সেদিন শোয়েব রহমান জিজ্ঞেস করায় মিশরাত সব সত্যি কথা বলে দিয়েছিলো। সে আরিয়ানকে পছন্দ করতো সেই কথা। তবে শুধু ততোটুক ছাড়া যে বাকী সব অপবাদ মিথ্যে এবং আরিয়ান নিজে কৌশলে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে জনসম্মুখে অপমান করেছে, সেটাও শোয়েব রহমান শুনেছেন। পড়াশোনা শেষ করে ভালো রেজাল্ট থাকার কারণে মিশরাতের চাকরী মিলে যায়। সৌভাগ্যক্রমে সাদমান যেই অফিসে চাকরী করে সেই অফিসেই মিশরাতের চাকরী হয়। সাদমানের সাথে মিশরাতের পরিচয় এখানে আসার পর থেকেই। তবে তখনো ততোটা গভীর বন্ধুত্ব তাদের মধ্যে গড়ে উঠেনি। যখন থেকে তাদের বাসার ঠিকানার সাথে সাথে চাকরীর ঠিকানাও মিলে গেল, তখন থেকে তাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হতে লাগলো। বয়সে মিশরাত সাদমানের থেকে চার বছরের ছোট। তবে বয়সকে বন্ধুত্বের মাঝে আসতে দেয়নি সাদমান। মিশরাতের জীবনে আরিয়ানের অবস্থান নিয়ে ভালোই অবগত সাদমান। আর তাইতো শক্ত হাতে মিশরাতকে সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলো সে। সামলে গেছেও। সেই থেকে দু’জনের মধ্যে এক চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
***
অতীতের চিন্তা থেকে মিশরাতকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করলো ইশরাত। ধপাস করে এসে বিছানায় শুয়ে গিয়েছে তার পাশে। সেদিকে তাকিয়ে মিশরাত প্রশ্ন করলো
—-কী রে? আজকে এতো তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে এলি যে? পড়াশোনা শেষ?
—-না রে আপু, মাথাটা ভার হয়ে আছে মনে হচ্ছে। আপাতত আর লোড নিতে পারছি না। একটু ঘুম প্রয়োজন। ফজরের নামাজ পড়েই আবার পড়তে বসে যাবো। এখন ঘুমোবো। ঘুম পাড়িয়ে দে।
বোনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো ইশরাত। এরমধ্যেই হুট করে বলে উঠলো
—-আব্বুকে বলেছিলাম এই ফ্ল্যাট ছাড়ার কথা। আব্বু পাত্তাই দিলো না আমার কথাটা মনে হলো।
—-কেন? হঠাৎ ফ্ল্যাট ছাড়ার কী হলো?
—-এই ফ্ল্যাটে একজন এলিয়েন থাকে জানিস না? যার আমাকে দেখলেই অহেতুক খোঁচা মারা লাগে? অসহ্যকর!
মিশরাত বুঝতে পারলো ইশরাত কার কথা বলছে। মুখ টিপে হাসছে সে। শুধু চিন্তায় আছে একটা বিষয় নিয়েই, হুট করে বিয়ের কথা শুনে ইশরাতের মুখভঙ্গি কেমন হবে তা নিয়ে।
(৫৯)
দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় সাত মাস। ইশরাতের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্টও এসেছে, সকলের মনঃপুত হয়েছে। সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। এখন ভর্তি পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করছে। বেশিরভাগ পরীক্ষাগুলোই সামনের মাসে। সর্বমোট দুই মাসের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ হবে তার।
ইশরাত আর সাদমানের বিয়ের বন্দোবস্ত করে রাখা হবে এরপরেই। এরমধ্যে শোয়েব রহমান থেমে নেই মিশরাতের ছেলে দেখার ক্ষেত্রেও। কমপক্ষে হলেও প্রায় বারো পনেরো জন ছেলের পক্ষ থেকে মিশরাতের বিয়ের জন্য প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি। বেছে বেছে অবশেষে একজন তার মনঃপুত হলো। ছেলের নাম নিশান হোসেন। আগামীকাল মিশরাতকে দেখতে আসার কথা ছেলের। তার জন্য শোয়েব রহমান ছুটি নিয়ে এসেছেন। যদি পারেন তাহলে ইশরাতের বিয়ের কিছুদিন পরেই মিশরাতের বিয়ে দিয়ে দেবেন বলে মনঃস্থির করেছেন তিনি। ছেলের কথা মিশরাতকে জানানোর পর মিশরাত কেবল স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়েছে। আর কিছুই বলেনি সে।
(৬০)
হালকা শীত শীত পড়ছে চারিদিকে। অথচ আরিয়ান এখন নিজের রুমে এসি অন করে ফ্যান চালিয়ে শুয়ে আছে। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। বাম হাত মাথার উপর রেখে উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে সে। চোখ দু’টো লালচে হয়ে আছে।
রুমের দরজা আবজা দেওয়া ছিলো। দরজা টেনে ভেতরে ঢুকলো আরাভ। সিগারেটের ছাই এখনো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কয়েকটা মদের বোতল বিছানায় রাখা। আর কয়েকটা খালি বোতল ফ্লোরে রাখা।
—-খাবার বেড়েছি। খেতে চল।
—-খাবো না। তুই খেয়ে নে।
—-এক কাজ কর, বিষ খেয়ে মরে যা। মরবি? বল, মরবি? প্রমিজ করছি, বিষ আমি নিজে নিয়ে আসবো তোর জন্য। শুধু একটাবার বলে দেখ আমায়। কারণ তোর হাবভাব দেখে ভালোই বুঝতে পারছি যে তুই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবি না। আর এই ছাইপাঁশ খেয়ে নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থেকে তিলে তিলে মরে যাওয়ার চেয়ে বিষ খেয়ে মরে যা। এতে আমাদের সবার উপকার হবে।
ঠোঁট কাঁপছে আরাভের। রাগে, কষ্টে। আরিয়ানের এই অবস্থা আর দেখতে পারছে না সে। বিগত সাতটা মাস ধরে ছেলেটার এই অবস্থা। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটদু’টো কালো হয়ে গিয়েছে তার৷ আরাভের কথা শুনে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না আরিয়ানের মধ্যে।
—-ফোনটা অন্তত এবার চার্জে দে? যতোক্ষণ পর্যন্ত সজাগ থাকিস ফোন নিয়ে পড়ে থাকিস। কয়েক ঘন্টার জন্যে চোখ বন্ধ করলেও মোবাইল হাতে নিয়ে ঘুমাস। এর কোনো মানে হয়?
—-মিশু যদি আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলে তাহলে তো ফোন করেই বলবে তাই না? ফোন পাশে না রাখলে আমি জানবো কী করে?
—-সাত মাস ধরে সেই মেয়ে তো তোকে ফোন দিয়ে আসছে তাই না? শালা গবেট কোথাকার! বেহায়া হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিস। না, শুধু চূড়ান্ত পর্যায় কেন বলছি? মনে তো হচ্ছে সকল সীমা পরিসীমা অতিক্রম করতে বসেছিস।
—-একদিন যাকে বিরক্তিকর, অসহ্যকর বলে দূরদূর করতাম, আজ তার কাছেই আমি বিরক্তির কারণ।
একদিন যাকে সবার সামনে বেহায়া বলেছিলাম, আজ তার জন্য বেহায়া নিজে হলাম।
একদিন যাকে সকলের সামনে অপমান করেছিলাম, আজ ঠিক তারই জন্য সকলের সামনে নিজে অপমানিত হচ্ছি।
একদিন যাকে চড় মারার মতো জঘন্য অপরাধ করেছিলাম, আজ তার হাতের চড় লাথি খেয়েও তারই আশায় বেঁচে আছি।
একদিন যাকে পায়ে ঠেলে দিয়েছিলাম, আজ তার কাছ থেকে কুকুরের মতো ব্যবহার পেয়ে যাচ্ছি।
প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকই নিয়ে নেয়, তাই না রে?
—-বুঝতেই যখন পারছিস তখন কী আশায় বসে আছিস আরিয়ান? ফিরে চল আমার সাথে? তুই তো তোর চেষ্টার কোনো কমতি রাখিসনি, তাই না? এখন কেউ যদি তোর ভাগ্যে না থাকে তাহলে তুই কী করবি বল? ভুল করেছিলি, তার শাস্তিও তো পেয়েছিস, পেয়ে যাচ্ছিস। এখন সব ভুলে চলে আয় আমার সাথে।
—-আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে রে আরাভ। গত ছাব্বিশ ঘণ্টা যাবত ঘুমাইনি। যদি মিশু ফোন করে তাহলে আমাকে ডেকে দিস একটু, কেমন?
রাগে গা জ্বলছে আরাভের। সে বারেবারে কেন যে এই পাগলটাকে বোঝাতে যায় সেটা নিজেই বুঝে না। দাঁত কিড়মিড় করে বললো
—-হ্যাঁ, আসবে তো ফোন। অবশ্যই আসবে। যখন নিজের বিয়ের দাওয়াত দিবে, তখন ফোন করবে তোকে। গিয়ে ওই মেয়ের বিয়ের দাওয়াত খেয়ে আসিস। ঠিক আছে? শালা মর তুই!
ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল আরাভ। অথচ কেউ দেখলো না, দু’চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে লাগলো এক অসহায় প্রাণীর!
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)
[যারা পড়বেন তারা রেসপন্স করবেন অবশ্যই। পরীক্ষার জন্য সপ্তাহে কেবল দু’দিন গল্প দেই, তবুও যথেষ্ট কষ্ট হয় লিখতে। যথারীতি পরবর্তী পর্ব শুক্রবারে পাবেন আবার। আর হ্যাঁ, গল্পে নতুন চরিত্রের আগমন ঘটতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই। জানেন তো?]