#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ৫
(১২)
আজকে রাতে খাবার খেতে অনেকটা দেরী হয়েছে। তার কারণ আরিয়ানকে নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে মিশরাত, ইশরাত, সাদমান আর রেণু আক্তারের মধ্যে। সাদমান তার বাসায় গিয়েছে প্রায় রাত সাড়ে নয়টায়। এরপর খাবার-দাবার সেরে মিশরাত আর ইশরাত নিজেদের রুমে আসতে আসতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে বত্রিশ মিনিট। মিশরাত একটু ফোন ঘাটাঘাটি করছিলো। আশেপাশে কিছু লক্ষ্য করেনি প্রথমে। কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে পাশে তাকিয়ে দেখলো ইশরাত আলমারি খুলে নিজের জামাকাপড় দেখছে একটা একটা করে।
—-কী হয়েছে রে ইশু? এতো রাতে আলমারি থেকে কাপড়চোপড় নামাচ্ছিস কেন?
—-ড্রেস চয়েজ করছি আপু।
—-কীসের জন্য?
—-ওই যে ট্যুরে যাবো তো। সেখানে কোন কোন ড্রেস নিয়ে যাওয়া যায় সেটাই ভাবছি।
—-সে তো এখনো প্রায় পনেরো দিনের মতো সময় বাকি। এতো আগে এসব করার কী দরকার? বরং এখন ঘুমোতে চলে আয়। রাত হয়েছে।
ইশরাত প্রায় বারো মিনিট পর বিছানায় আসলো। মিশরাতের পাশে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো
—-কবে দেখা করতে যাবি আরিয়ান হকের সাথে?
—-ভাবছি শুক্রবারে যাই। যেহেতু আমি তোদের নিয়ে একসাথে যাচ্ছি, বিশেষ করে সাদমানও যাচ্ছে। তাহলে উইকএন্ড হলেই ভালো হবে।
—-ওই লোক কে জানিয়ে রেখেছিস?
—-না, এখনো বলিনি কিছু। তবে বলে দেবো।
—-আমার এখনো সন্দেহ হচ্ছে আপু। আসলেই কী আরিয়ান সত্যি কিছু বলতে চাইছে? এগুলো নাটক নয়তো?
—-আব্বু কিংবা আম্মুর নামে কসম কেটে আমরা কখন কিছু বলতে পারবো বল তো? যখন সেই কথায় বিন্দুমাত্র খাঁদ থাকবে না। একটুও মিথ্যে থাকবে না। প্রত্যেকের বাবা-মা তাদের সন্তানের কাছে কী সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বাস কর ইশু, আরিয়ান যখন কান্না করে যাচ্ছিলো তখনও আমি মনকে এটাই বোঝাচ্ছিলাম যে সে বানোয়াট কথা বলছে। কিন্তু যখন আন্টির কসম দিলো, তখনই না আমি কেমন থমকে গেলাম!
—-যদি আরিয়ান এসে তোর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে তাকে ক্ষমা করে দিবি?
—-ওই যে একটু আগে বললাম, যার যার বাবা-মায়ের কদর তার তার কাছে। আরিয়ান আমাকে অপমান করেছে সেটা আমি ভুলিনি ইশু। কিন্তু শুধু অপমানটা আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হয়তো আমি ক্ষমা করে দেওয়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু এখানে আমার আব্বুর সম্মানও জড়িয়ে আছে যে! আব্বুকে করা অপমান আমি ভুলতে পারবো না চাইলেও। তবে এই পয়েন্টে এসেও আমার আরেকটা খটকা লাগছে এখন।
—-কী?
—-আব্বুকে আরিয়ান কী বলেছে আমি বা তুই সেটা শুনিনি। কারণ সেটা আমাদের কারোর সামনে বলেনি। আমাকে মাঠভর্তি মানুষের সামনে যা বলার বলেছে সেটা মানছি। কিন্তু আব্বুকে আমার ব্যাপারে আরিয়ান যা কিছুই বলে থাকুক না কেন সেটা সকলের অজান্তে। কিন্তু এটা কেন করলো?
—-হয়তো গুরুজন বলে?
—-আরও একটা প্রশ্ন আছে।
—-কী?
—-আরিয়ানকে আমি একবার নয়, একাধিকবার এটা বলেছিলাম যে আমি তাকে পছন্দ করি। একটাবারও কিন্তু সে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি। মানছি বারেবারে ফিরিয়ে দিয়েছে ধমকে। কিন্তু কটুবাক্য করেনি কিন্তু। সেদিনের ঘটনাটা তোর মনে আছে?
—-হ্যাঁ। তোকে নিজে থেকে সবার সামনে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। এরপর হাসিমুখে বলছিলো তোর মনে আরিয়ানকে নিয়ে কী আছে। তুই তখন সেটা বলার পরেই তো একগাদা কথা শুনিয়ে দিলো।
—-সেটাই! সে হুট করে আমার উপর এতো রেগে গিয়েছিলো কেন? কী এমন হয়েছিলো তার? এই প্রশ্নগুলো এতোদিন আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু আজকে কেন জানি এসব কথা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।
—-এগুলো সব শুক্রবারে দেখা করতে গেলে তাকে জিজ্ঞেস করবি। সব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার।
—-হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।
—-আম্মুর কথা ভাবছি আমি। সেখানে গিয়ে আবার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করবে না তো? বুঝতে পারছিস এই কথা কেন বলছি?
—-কেন? আরিয়ানকে দেখে?
—-আরে না! আরিয়ান সেখানে থাকবে এটা তো আম্মু জানেই। কিন্তু মনে কর সেখানে যদি আম্মুর সামনে আরিয়ান আবার তোকে চেয়ে বসে?
—-তাই তো! এটা তো আমার মাথায়ই আসেনি। ধুর! এই এক চিন্তা যেতে না যেতেই আরেকটা এসে উদয় হয়!
কিছুক্ষণ দু’বোন চুপচাপ রইলো। এরপর হুট করে মিশরাত বললো
—-তুই না খুব সেজেগুজে গিয়েছিলি আজকে? তোর চোখের কাজল তাহলে লেপ্টে ছিলো কেন? আর চোখ-মুখের অবস্থা কেমন যেন ছিলো তখন। কারণ কী রে? কিছু হয়েছে নাকি?
—-না, কিছু হয়নি। শুধু একজনের হাতের চড় খেয়েছি আজকে।
মিশরাত প্রথমে বললো
—-ওহ।
প্রায় পরের মুহূর্তেই চমকে উঠে বললো
—-হ্যাঁ?
—-হুম। অনধিকার চর্চা যাকে বলে, সেটাই করেছে সেই মানুষটা। অথচ তখন আমি কিছু বলতে পারিনি। তবে এখন আর চুপ থাকবো না।
—-তুই কী বলতে চাইছিস বল তো?
—-সাদমান হাসান আমাকে চড় মেরেছে আপু।
—-কী! সে তোকে চড় মারতে যাবে কেন?
—-সে অনেক কাহিনী। তবে এতোটুকু বলতে চাই, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। আমার মা-বাবা আর বোনের থেকে বেশি আদর আর কেউ করে আমাকে? এর চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসে আমাকে? বাসে না তো। কই তাদের থেকে তো আমি এভাবে এতো জোরে কখনো চড় খাইনি? তাহলে সাদমান হাসান কে যে আমাকে চড় মারবে? কোন অধিকারে মারবে?
—-অবশ্যই এটা উচিত হয়নি। আমি নিজে কথা বলবো সাদমানের সাথে। কিন্তু একটা কথাই বুঝলাম না আসলে। সাদমান তো এতো বদমেজাজী নয়। যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার মানুষ। কী এমন হলো যে তোকে সরাসরি চড় মেরে বসলো?
—-তুই আমাকে সন্দেহ করছিস আপু?
—-এক লাইন বেশি বুঝিস না। আমি শুধু একটু আশ্চর্য হলাম সেটা বলেছি। যাই হোক, তার সাথে তো আমার এটা নিয়ে কথা বলতেই হবে।
—-না আপু। তুই ওই মানুষকে আর কিছুই বলবি না।
—-এবার বুঝি অভিমানের পাল্লাটা বেশি ভারী হয়ে গিয়েছে?
—-আমার অভিমানের ভাগীদার হওয়ার মতো যোগ্যতাও এই লোকের নেই।
—-মানে? সাদমান কী তোকে কিছু বলেছে?
—-বেশ বোকা ছিলাম আমি জানিস তো আপু? এতোদিন ভাবতাম উনি বুঝি একটা নিরেট বোকা মানুষ। আমার অনুভূতি কিছুই বোঝেন না। আর আজকে বুঝলাম, উনি সবই বোঝেন। কিন্তু ইচ্ছে করে আমার অনুভূতির সাথে পরিচিত থেকেও মজা করে গিয়েছেন। ঠাট্টা তামাসা করে গিয়েছেন দিনের পর দিন।
—-ইশু, সাদমান কী তোকে অপমান করেছে?
—-বাদ দে না আপু। যেই মানুষটাকে নিয়ে আমি আর কোনো চিন্তা করাই বাদ দিয়ে দিয়েছি, তাকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা করতে চাই না।
—-ইশু, আমি কিন্তু জানতাম তুই কী অনুভব করিস সাদমানকে নিয়ে।
—-এটা আমিও বুঝতে পেরেছি আপু। একাধিক বার তোর কাছে নানানভাবে ধরা পড়ে গিয়েছি আমি। সামনের বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবো। অথচ যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন থেকেই মানুষটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। ইঁচড়েপাকা ছিলাম সেটা অস্বীকার করছি না। তবে উনার প্রতি আমার সত্যিই মন থেকে একটা টান ছিলো। আশ্চর্য হয়ে যেতাম, এতো বার এতোভাবে বলার পরেও কী ওই লোকটা কিচ্ছু বোঝে না? বিগত তিন-চারটা বছর ধরে আমার অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েও উনি কেমন রুক্ষ ব্যবহার করতো! আর আজকে পার্কে তো বুঝেই গিয়েছি উনার কথায়, উনি সব বুঝেও এতোদিন না বোঝার ভান করে ছিলেন। বাদ দে আপু, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পাড়িয়ে দে।
এতোবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল আজ। অথচ ইশরাত কতোটা স্বাভাবিক আচরণ করছে। মিশরাত ভেবেছিলো সাদমান যদি কোনো কারণে তাকে না করে দেয় তাহলে ইশরাত অনেক ভেঙ্গে পড়বে। মিশরাতের তাকে সামলানো লাগবে। অথচ এই ছোট্ট মেয়েটার ধৈর্য্য দেখে সে আশ্চর্য না হয়ে পারছে না। আরিয়ান যখন তাকে প্রত্যাখান করেছিলো তখন তার বয়স একুশ বাইশ বছর। তখনই সে কতোটা আবেগ নিয়ে থাকতো। আরিয়ানের কাছ থেকে অপমানিত হওয়ার পর তার নিজেকে সামলাতে অনেক কষ্ট হয়েছিলো। শুধু সে একা তা করতেও পারেনি। তার পরিবার ছিলো তার সাথে। অথচ এই সতেরো বছর বয়সী মেয়েটার সহ্যক্ষমতা দেখে সে বারংবার অবাক হতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েটা তার সামনে একটাবারও কাঁদেনি। হয়তো গোপনে কেঁদেছে, কিন্তু কাউকে সে কান্না দেখায়নি।
(১৩)
লাঞ্চ টাইম চলছে এখন। সাদমান আর মিশরাতের ডেস্ক কাছাকাছিই। প্রায় সময়ই গল্প বা অফিসিয়াল কোনো ব্যাপারে আলোচনা করতে করতে লাঞ্চ শেষ করে দু’জন। তবে আজকে এমনটা কিছুই হলো না। অফিসে আসার সময়ও মিশরাতের মুখ বেশ গম্ভীর ছিলো। পুরোটা সময় জুড়ে এমনই ছিলো। এখন দুপুরে খাবারের সময়ও চুপচাপ নিজের টিফিনবাক্স বের করে খেয়ে চলেছে মিশরাত। এই সবগুলো কথা ভেবে ব্যাপারটা একেবারেই স্বাভাবিক লাগলো না সাদমানের কাছে। তাই নিজে থেকেই তার খাবার নিয়ে চলে গেল মিশরাতের কাছে।
—-কী হলো মিশরাত? তোমাকে এতোটা চুপচাপ লাগছে কেন আজকে? আরিয়ানের সাথে দেখা করতে গেলে কী হবে সেটা ভাবছো?
—-না, আরিয়ানকে নিয়েই আমার চিন্তাভাবনার গন্ডি সীমাবদ্ধ নয়। ভাববার মতো আমার জীবনে অনেক কিছুই আছে।
—-আমাকে কী দুই একটা বলা যায় যদি খুব বেশি পার্সোনাল কিছু না হয়?
—-প্রথমত, ব্যাপারটা খুবই পার্সোনাল। আর দ্বিতীয়ত, তোমাকে বলে এর কোনো সমাধান আমি পাবো না। কারণ সমস্যা তুমি নিজেই।
—-অ্যাঁ? আমি? আমি কী করলাম আবার?
—-তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু সাদমান। বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে বলে, তার থেকেও যদি বেশি কিছু থাকে, তাহলে সেটা তুমি। আমার জীবনে তোমার অবস্থানটা অনেক বিশেষ। কিন্তু ভুলে যেও না ইশু আমার ছোট বোন। তাকে আমি ছোট বোন কম বরং নিজের মেয়ের মতো আদর করি বেশি।
—-তুমি বলতে কী চাইছো?
—-ইশুর গায়ে হাত তোলার মতো অধিকার তোমার আছে বলে মনে হয় সাদমান? আমার বোন কোন কারণে তোমার হাতের চড় খাবে? কীসের জোরে তুমি আমার বোনের গায়ে হাত তুলবে?
—-নালিশ চলে গিয়েছে ইতোমধ্যে?
—-না সাদমান, নালিশ ইশু করেনি। ইনফ্যাক্ট, ইশু আমাকে কিছু বলতে চায়নি। আমি কথা বের করেছি তার মুখ থেকে। আমার বোন কী এমন করেছিলো সাদমান যে তুমি তাকে মারলে?
—-সে বলেনি তোমাকে কিছু এই ব্যাপারে?
—-সে আমার সাথে তোমার ব্যাপারে আর কোনো আলোচনাই করতে চায় না। আমাকে বললো যাকে নিয়ে ভাবা বাদ দিয়ে দিয়েছি, তাকে নিয়ে আলোচনা করার দরকার নেই। বুঝেছো তুমি?
সাদমান, আমার বোন তোমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবে তা তুমি জানো? ক্লাস এইট থেকে। এতোদিন পর্যন্ত সে তোমার মুখ থেকে একটু হ্যাঁ শোনার অপেক্ষায় ছিলো। তুমি তাকে না করেছো ভালো কথা, তাই বলে চড় মারবে?
—-আমি তাকে চড় এই কারণে মারিনি যা তুমি ভাবছো। আমার তার কথা শুনে ভীষণ রাগ উঠেছিলো।
—-তোমাকে কী এমন বলেছে সে? হয়তো বলেছে ভালোবাসে বা কিছু? তাই বলে তুমি তাকে অপমান করবে? সহজে না করে দিতে পারতে না? তুমি তাকে অপমান না করলে সে এতোটা দুঃখ নিয়ে নিশ্চয়ই এই কথা বলতো না। আর অপমান তো করলে করলে, তার উপর আবার মারলেও?
—-ওর সাহস কী করে হয় আমাকে এই কথা শোনানোর যে সে যে কোনো ছেলের পাশে গিয়ে বসবে?
—-কী, কী? কী বললে তুমি?
—-তোমার বোন যেই সেই ছেলের পাশে গিয়ে বসবে বলেছে, কথাটা শুনে তোমার রাগ হচ্ছে না? তাহলে আমার হবে না কেন?
—-প্রথম কথা হলো, আমার বোন কোনো কারণ ছাড়া হুট করেই এমন একটা কথা বলার মেয়ে নয়। আর দ্বিতীয়ত, আমার বোন সে। তাই আমার রাগ হতে পারে। কিন্তু তোমার রাগ হওয়ার কারণ কী? তোমার সাথে তো তার কোনো সম্পর্ক নেই? শুধু মাত্র বেস্ট ফ্রেন্ডের বোন হওয়ার অধিকারে তুমি তাকে মারতে পারো না।
আর কোনো কথা না বলে সাদমান চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে। মিশরাত ব্যাপক আশ্চর্য। হচ্ছে টা কী এসব!
(১৪)
গোসল শেষ করে দুপুরের খাবার খেতে সবেমাত্র আরিয়ান বসেছে চেয়ারে। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ কানে এলো। উঠে গিয়ে মিরর গ্লাসে চোখ দিয়ে যেই মানুষটাকে সে দেখলো, তাতেই চোখ বড় হয়ে গেল তার। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো।
—-তুই এখানে?
—-তো কী করতাম? তুই তো মনে হয় প্রতিজ্ঞা করে বসে আছিস যে মিশরাতের সাথে কথা না বলে তুই যাবি না। আর ওইদিকে যে আন্টি আর আংকেলের তোর চিন্তায় ঘুম খাওয়া সব লাটে উঠেছে সেই ধারণা আছে তোর?
—-কেন? শরীর খারাপ করেছে নাকি তাদের? আমি তো সকালেও ফোনে কথা বললাম।
—-শরীর খারাপ করেনি। কিন্তু করতে কতোক্ষণ? এভাবে অনিয়ম করলে সুস্থ মানুষের শরীরই খারাপ করবে। আর উনারা তো বয়স্ক মানুষ।
—-তো তুই এখানে আমাকে এই কথাটা বলতে এসেছিস?
—-তোর কী আমাকে এতোটা ফালতু মনে হয়? এটা বলার জন্য তো ফোন ছিলো। আর ফোনে তো তোকে আমি কম বলিনি এসব। কানের তলা দিয়েও তো কথা নিসনি। তাই আংকেল আন্টিকে নিশ্চিন্ত রাখার জন্য আমার এখানে আসতে হলো!
—-মানে? তুই কী আমার বডিগার্ড নাকি?
—-বডিগার্ড না হলেও আমাকে বোধহয় আংকেল আন্টি নিজ দায়িত্বে তোর পিএ বানিয়ে দিয়েছে। উনাদের ধারণা আমি থাকলে তোকে দেখেশুনে রাখবো। তুই এখানে নিজের খেয়াল একদমই রাখবি না নাকি।
—-আর তোর কাজ?
—-কাজ তো সেই তোদের সাথেই করি। আংকেল বলেছে ম্যানেজ করে নেবে। আমি উনার ছেলেকে ম্যানেজ করি, আর উনি আমার কাজ ম্যানেজ করে রাখবে।
—-দারুণ ডিল তো! আব্বু যে কী করে! পুরো নবজাতক বানিয়ে দিলো ইয়ার!
—-বাবা-মায়ের কাছে আমরা সন্তানেরা নবজাতকই। এটা নতুন কিছু না। এখন কাজের কথা বল।
—-কী কথা?
—-যার জন্য এখানে পড়ে আছিস, সেই কাজটা কী কিছুটা হলেও আগাতে পেরেছিস?
—-আমি মিশুকে বলেছি আমার সবগুলো কথা শোনার জন্য। কিন্তু সে এখনো আমাকে কিছু বলেনি। তবুও আমি আশা ছাড়ছি না। হয়তো খুব দ্রুত ফোন দিয়ে কিছু একটা বলবে?
—-সঠিক সময়ে যদি সঠিক কাজটা করতি, তাহলে তোর আজকে এই অবস্থা হতো না। তোর দোষের পরিমাণ আমার কাছে ব্যাপক মনে হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাটা বিবেচনা করতে গেলে তোর জন্য কষ্টও হয়। তবে আমি তোকে একটা কথা বলে রাখি আরিয়ান, যদি কোনো কারণে মিশরাত না চায় তোর কাছে ফিরতে, তাহলে তাকে জোর করিস না প্লিজ।
—-দুপুরে খেয়ে এসেছিস? বাড়তি রান্না করা আছে।
—-আমি তোকে কিছু বলেছি আরিয়ান। শুনেছিস আমার কথা?
—-আসলেই মারাত্মক খিদে পেয়েছে রে। খেতে বসে যাই।
হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে আরাভ। ঠিক এই জায়গায় এসে ছেলেটা আর কিছু শুনতে চায় না।
আরাভ দুপুরে নাকি খেয়ে এসেছে। তাই আরিয়ানের সাথে আর খায়নি। তবে আরিয়ান খাচ্ছিলো বিধায় খাবার টেবিলে বসেই হাতে জুস নিয়ে এটা সেটা নিয়ে কথা বলছিলো আরিয়ানের সাথে। এরমধ্যেই আরিয়ানের ফোন বেজে উঠলো। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো আরিয়ান। কিন্তু ফোন ধরছে না।
—-কী রে? ফোন রিসিভ কর?
—-হুম, করছি। আসলে আননোন নাম্বার তো। তাই মিলিয়ে দেখছিলাম এটা কোনো পরিচিত মানুষের নাম্বার কিনা। ভাবলাম ভুলে আবার সেভ না করে রেখেছি কিনা।
ফোন রিসিভ করে কানে লাগিয়ে আরিয়ান কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই অপর পাশ থেকে শোনা গেল একটা মেয়েলি কন্ঠ।
—-কেমন আছো হ্যান্ডসাম?
কন্ঠ চিনতে আরিয়ানের এক মিনিট সময়ও লাগলো না। আরাভ লক্ষ্য করলো মুহুর্তের মধ্যেই আরিয়ানের চেহারার নকশা পুরো পাল্টে গিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে আছে সে। কপালের রগ হালকা ফুলে উঠেছে। পুনরায় মেয়েলি কন্ঠটা শোনা গেল
—-কথা বলছো না কেন সুইটহার্ট? আমার সাথে রাগ করে আছো এখনো? আচ্ছা, আই এম স্যরি তো। তুমি কী তোমার মোনার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে? পারবে না তো। কতোদিন তোমাকে দেখি না বলো তো? ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে ফেললে কেন? কতো কষ্টে তোমার নাম্বার জোগাড় করেছি জানো? একটু ভিডিও কলে আসো না প্লিজ?
হাতের সামনে থাকা খাবারের প্লেট রাগে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো আরিয়ান। বল প্রয়োগ বেশি করায় তা সরাসরি ফ্লোরে পড়ে গেল মধ্যম পর্যায়ের একটা আওয়াজ তুলে। ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফ্লোরে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আরিয়ান বললো
—-লজ্জা করে না তোর? এতোটুকুও লজ্জা করে না? বেহায়া বেশরম মেয়ে কোথাকার! এই মুখ নিয়ে আবার আমার কাছে ফোন দিস?
—-সরি তো জান। ভুল হয়ে গিয়েছে।
—-ভুল? তোর ভুল হয়েছে? ইচ্ছে করে জেনেশুনে সব করেছিস। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছিস। এখন বলছিস তোর ভুল হয়েছে?
আরাভ বুঝতে পারলো কে ফোন দিয়েছে। কিন্তু এতোদিন পরে ওই মেয়ের ফোন দেওয়ার কী দরকার পড়লো সেটা আরাভের মাথায়ও আসছে না। ভীষণ বাজে ভাবে গালিগালাজ করছে ওই মেয়েকে আরিয়ান। অপর পাশে কী হচ্ছে কে জানে! কিন্তু আরিয়ান সমানে ওই মেয়েকে গালিগালাজ করেই যাচ্ছে। যেকোনো মানুষ হুট করে এসে আরিয়ানের কথাগুলো বা মুখের ভাষাগুলো শুনলে নিঃসন্দেহে আরিয়ানকে ছোটলোক বলে সম্বোধন করবে। কিন্তু আরিয়ান যেসব পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, আর এই মেয়ের আসলেই চরিত্রের যা অবস্থা, তাতে এরকম ভাষায় তার সাথে কথাগুলো বলা তেমন একটা অযৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে না আরাভের কাছে।
প্রায় পনেরো মিনিট পর ফোন রাখলো আরিয়ান। এখনো সে রাগে কাঁপছে।
—-দোস্ত, একটু ঠান্ডা হয়ে বস। এভাবে উত্তেজিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। তা-ও আবার ওই মেয়ের কারণে।
—-তার সাহস হয় কী করে আবার আমাকে বলার তার কাছে ফিরে যেতে?
—-আরিয়ান, মাথা ঠান্ডা কর। ওই মেয়েকে যা বলার তো বলেছিস। এবার রাগটাকে একটু কমা।
—-আমার পুরো জীবনের মোড় পাল্টে দিলো। ছন্নছাড়া করে দিলো সব। এখন আমি আমার করা ভুলগুলো ঠিক করতে এসেছি, এতো কষ্ট করে মিশুকে খুঁজে পেয়েছি, আর ঠিক এখনই আমার জীবনে আবার উদয় হতে হলো ওই মেয়ের।
—-আচ্ছা, চিন্তা করিস না। আমরা সামলে নেবো সবকিছু। এখন তো আমি আছি তোর সাথে।
—-জানি না আমি। কিচ্ছু জানি না। শুধু এতটুকু জানি, যদি ওই মেয়ে আবার আমার আর মিশুর মধ্যে কোনোরকম সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করে, তাহলে একেবারে খুন করে ফেলবো একে। এরপর যা হওয়ার হোক!
রাগে এবার নিজের হাত কামড়াতে শুরু করেছে আরিয়ান। সেই পুরোনো অভ্যাস। তাকে থামাতে হবে তাড়াতাড়ি। তাই আরাভ আর এক মিনিটও দেরী করলো না।
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)