অনুভূতির অন্বেষণ পর্বঃ৬

0
3319

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ৬

(১৫)

আরিয়ানকে মিশরাত জানিয়ে দিয়েছে যে শুক্রবারে তার সাথে দেখা করবে। তবে মিশরাত এটা উল্লেখ করেনি সে কী একা যাবে নাকি কাউকে নিয়ে। আরিয়ান ধরেই নিয়েছে যে মিশরাত একা আসবে। সেই কারণে মিশরাতকে যেই রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলেছে সেটা পুরোপুরি বুক করে রেখেছে এবং আরাভের সহায়তায় অনেক সুন্দর একটা ডেকোরেশনের ডিজাইন ঠিক করেছে। সকাল থেকেই ফুরফুরে মেজাজে আছে আরিয়ান, সেটা তার মুখাবয়বে স্পষ্ট। বিকেলে মিশরাতের দেখা করতে আসার কথা কিন্তু আরিয়ান দুপুর খানিকটা পার হতেই সেখানে গিয়ে হাজির। পাছে না মিশরাত আবার তাকে না দেখতে পেয়ে চলে যায়! এতো কষ্ট করে রাজি করিয়েছে বলে কথা!

অপরদিকে মিশরাত সাদমানের গাড়িতে করে ইশরাত আর রেণু আক্তারকে নিয়ে রওনা হয়েছে আরিয়ানের বলা ঠিকানায়। ড্রাইভিং সীটে সাদমান বসেছে আর তার পাশে মিশরাত। পেছনে ইশরাত আর রেণু আক্তার।

গাড়িতে উঠার পর থেকেই ইশরাত মোবাইল ঘাটাঘাটি করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে তাকানোর যেন বিন্দুমাত্র সময় নেই তার। গাড়ির ভেতর থাকা মিরর গ্লাস ইশরাতের মুখ বরাবর করে রাখা। সেদিকে বেশ কয়েকবার গাড়ি চালাতে চালাতে আড় চোখে তাকিয়েছে সাদমান যা মিশরাতের নজর এড়ায়নি। সবকিছু মিশরাত চুপচাপ লক্ষ্য করে গেলেও কিছু বললো না।

আরিয়ানের বলে যাওয়া ঠিকানায় এসে গাড়ি থামালো সাদমান। আশেপাশে তাকিয়ে রেস্টুরেন্ট খোঁজার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু যতোটুকু চোখ যাচ্ছে, তাতে ওই নামের কোনো রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে না।

—-কী হলো বলো তো মিশরাত? রেস্টুরেন্ট কোথায়?

—-ঠিকানা যেহেতু এটা বলেছে তার মানে আশেপাশেই কোথাও না কোথাও থাকবে। তুমি এখানেই থাকো। আমি একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসি। আর এরপরেও না দেখতে পেলে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবো।

—-তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি?

—-না, না। কোনো সমস্যা নেই। যাচ্ছি আমি।

মিশরাত একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর সাদমান পাশ ফিরে দেখলো গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফোন টিপে যাচ্ছে ইশরাত। রেণু আক্তার সাদমানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।

—-আন্টি, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা আবেগে চলে বেশি। জানো তো?

—-হঠাৎ এই কথা বলছো কেন?

—-তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে কিন্তু মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়।

—-একটু পরিষ্কার করে বলবে?

—-তোমার ছোট মেয়ের উপর নজর রেখো আন্টি। গাড়িতে উঠার পর থেকে লক্ষ্য করেছো? সমানে মোবাইল টিপে যাচ্ছে। তোমার এতোটা খামখেয়ালী হলে কিন্তু চলবে না আন্টি।

—-ঠিক কথা বলেছো তো!

গটগট করে হেঁটে ইশরাতের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাথে সাথেই তার হাত থেকে মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেলেন রেণু আক্তার। ইশরাত চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

—-কী হলো আম্মু? ফোন নিয়ে টানাটানি করছো কেন?

—-এসব কী ইশু? এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোন টিপছিস কেন? এতো কী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে ফোনে যে এখন এই অবস্থায় দাঁড়িয়েও তোর ফোন হাতে নিয়ে থাকা লাগবে?

—-আম্মু, এসব কোন ধরনের কথা বলছো বলো তো? ফোনে এখন কতো কাজ করা যায় তুমি জানো? আর তাছাড়া আজকে কী প্রথমবারের মতো আমি রাস্তায় এসে ফোন হাতে নিয়েছি নাকি? প্রায় সময়ই তো থাকে ফোন আমার হাতে। আজকে তোমার কী হলো?

—-আমি তো তোর উপর নজর রাখতে পারি না, তাই এমনটা হয়।

—-নজর? আম্মু, তুমি আমাকে সন্দেহ করছো!

—-করতেই পারি! এখন তোর উঠতি বয়স। এই বয়সেই তো অকাজ কুকাজ হয়। আমি তো এসবের দিকে খেয়ালই রাখিনি। সাদমান বললো বিধায়।

সেকেন্ডের মাথায় সাদমানের দিকে ফিরে তাকালো ইশরাত। ইশরাত তার দিকে তাকানোর প্রায় সাথে সাথেই অন্যদিকে তাকালো সাদমান।

—-ওর দিকে কী দেখছিস? আর এভাবে চোখ বড়বড় করে কেন তাকিয়ে আছিস? ভালো করে শুনে রাখ, এখন থেকে এতো ঘনঘন ফোন হাতে নেওয়া বন্ধ। যখনই ফোনের দরকার হবে, তখন আমাকে বা মিশরাতকে তোর পাশে বসিয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করবি। বুঝেছিস?

রাগে-দুঃখে কান্না চলে আসছে ইশরাতের। এখন তো সে ওই মানুষটাকে বিরক্ত করছে না। একটা কথাও বলেনি লোকটার সাথে। তাহলে নিজে থেকে এসে লোকটা ঝামেলা পাকাচ্ছে কেন? সাদমান থেকে চোখ ফিরিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে ইশরাত দেখতে পেল মিশরাত চলে এসেছে।

—-রেস্টুরেন্ট টা একটু সামনে। আমি দেখে এসেছি। গাড়িতে বসো সবাই। গাড়ি যেহেতু আছে, হাঁটার মানে হয় না।

(১৬)

রেস্টুরেন্ট অনেক বড় ছিলো। মিশরাত আশ্চর্য হয়ে গেল তখন, যখন রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর কাউকে দেখতে পেল না। আরিয়ান কী ফাজলামো করলো নাকি তার সাথে?

—-ওই ছেলে কোথায়?

—-আম্মু, তোমরা বসো। রেস্টুরেন্টে তো কয়েকজন ওয়েটার আছে, আমি একজনকে জিজ্ঞেস করে আসছি।

ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করায় ওয়েটার আমতা আমতা করে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো। ওয়াশরুমের কাছাকাছি যাওয়ার পরেই মিশরাত আরিয়ান আর একটা মেয়ের কন্ঠ শুনছিলো। মেয়েটা বিমোহিত কন্ঠে কী জানি বলছে। দরজা আবজা দেওয়া ছিলো। দরজা খোলার আগেই মিশরাতের হাত খানিকটা কাঁপছিলো। তবে দরজা পুরোপুরি খোলার পর সে যা দেখলো, তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। স্বল্পবসনা একজন নারীর সাথে খুব কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে আরিয়ান। সেই নারী কে তা বুঝতে মিশরাতের দেরী হয়নি। হ্যাঁ, মেয়েটি মোনা। আরিয়ানের হাত ধরে রেখেছে সে। দরজা খোলার পর আরিয়ান মিশরাতকে দেখতে পেয়েই মুখে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ভেসে উঠলো তার। সে খুশি, কারণ মিশরাত এসেছে। তবে যতোটা না খুশি, তার থেকে বেশি চিন্তিত। কারণ মিশরাত এমনিতেই তার উপর রেগে আছে। এখন আবার ভুল বুঝবে না তো?

আরিয়ানের ধারণা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে মিশরাত অশ্রুসিক্ত নয়নে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর ঠোঁট কামড়ে এক দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে। টেবিলে সাদমান, ইশরাত আর রেণু আক্তার বসে ছিলেন মিশরাতের অপেক্ষায়। তবে তাকে এভাবে দৌড়ে বের হয়ে চলে যেতে দেখে তারা একেকজন যেন বোকা বনে গিয়েছে। মিশরাতের পিছু পিছু তারাও ছুটলো।

গাড়ির সামনে এসে মিশরাত মুখে হাত দিয়ে কাঁদছিলো।

—-আপু, কী হয়েছে? এভাবে দৌড়ে এলি কেন তুই?

—-আমি বাসায় যাবো। সাদমান প্লিজ বা…বাসায় নিয়ে চলো?

—-কী হয়েছে সেটা তো বলবে মিশরাত?

হালকা উঁচুস্বরে মিশরাত চেঁচিয়ে উঠে বললো

—-এতো প্রশ্ন কীসের তোমাদের? বলেছি না আমি বাসায় যাবো? তোমরা না গেলে এখানেই থাকো। আমি চললাম।

মিশরাত বড় বড় কদম ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সাদমান তার পিছু নিয়ে সেখানে যাবে তার আগেই পেছন থেকে দৌড়ে এসে মিশরাতের সামনে চলে গেল আরিয়ান। ঝটপট তার বাম হাত আগলে ধরে তাকে আটকালো।

—-মিশু, আমার কথাটা শোনো মিশু। একটাবার আমার কথা শোনো।

—-হাত ছাড় আমার!

—-না মিশু। আমি তোমাকে এখানে ডেকেছিলাম আমাদের মধ্যে দূরত্বের কারণ যেইসব ঘটনাগুলো, তা পরিষ্কার করতে। এখন এখানে এসে তুমি আমাকে উল্টো ভুল বুঝে যেতে পারো না মিশু।

—-তোকে হাত ছাড়তে বলেছি আমি। ভুলে যাস না এটা রাস্তা। তুই কে, তুই কী, সেটা আমি কিন্তু গ্রাহ্য করবো না এখন! যথেষ্ট শান্ত রূপ দেখেছিস আমার। আমি সহজে কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করি না। করতে পারি না। আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে তোকে সেদিনই চড় মারতো যেদিন তুই তোর গাড়িতে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলি। কিন্তু আমি কিচ্ছু করিনি। তবে আমিও একটা মানুষ। আমারও খারাপ লাগা আছে। আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আবারও বলছি হাত ছাড়!

—-বলো মিশু। আমাকে যা ইচ্ছে হয় তা-ই বলো। মারবে আমাকে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবার সামনে মারবে? তো মারো। আমি কিছু বলবো না। শুধু আমার কথাটা একটাবার শুনে যাও?

নিজের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আরিয়ানের ডান গালে একটা চড় মারলো মিশরাত।

—-অসভ্য, নোংরা, জানোয়ার কোথাকার! নিজের মায়ের নামে মিথ্যে কসম কাটতে তোর এতোটুকুও বাঁধলো না বিবেকে? শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য ওই অসুস্থ বয়স্ক মহিলাটার নামে কসম কাটলি? তবে কী জানিস তো? ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এতোকিছু করেও, এতো মিথ্যে বলেও শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েই গেলি। আমি একটু আগেই চলে এসেছি তাই না? মোনা কে রেস্টুরেন্ট থেকে চলে যেতে বলার সময়টুকু দেইনি তাই না? তোর প্রাইভেসি নষ্ট করেছি তাই না?

—-আমি মোনাকে এখানে ডাকিনি মিশু। বিশ্বাস করো। আল্লাহর কসম!

—-চুপ! একদম চুপ! মায়ের নামে কসম কেটে মন ভরেনি এখন এসেছিস আল্লাহর নামে কসম কাটতে? তোর জ্বিভ খসে পড়ে না কেন!

—-মিশু!

রেণু আক্তার বুঝতে পারলেন অবস্থা খুবই খারাপ। খুব বাজে কিছু একটা ঘটেছে। নয়তো মিশরাত এভাবে রেগে যাওয়ার মতো মেয়ে না। উনি তাড়াহুড়ো করে মিশরাত আর আরিয়ানের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।

—-আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাও। তোমাকে আমি এমনিতেও আমার মেয়ের জীবনে আসতে দিতাম না। কিন্তু মিশু বললো তুমি নাকি তোমার মায়ের নামে কসম কেটে বলেছো। তাই মিশুর কথায় রাজি হয়ে আমি এবং আমরা এসেছি। তোমরা আমাদের পূর্ব পরিচিত মানুষ ছিলে। তোমার মা জোহরা বেগম খুবই ভালো মনের মানুষ। আপার সাথে একসময় আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। যদিও এখন এই সবকিছুই অতীত। আমি ভাবতে পারছি না তুমি তোমার মায়ের নামে মিথ্যে কসম কাটলে? এতো কিছু করার পরেও তুমি কীভাবে আশা করো যে আমার মেয়েকে আমি তোমার হাতে তুলে দেবো? চলে যাও। আর কখনো আমার মেয়ের আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি!

মিশরাতকে গাড়িতে উঠতে বলে রেণু আক্তার নিজেও উঠতে নিলেন গাড়িতে। তখনই রাস্তায় সবার সামনে উনার পায়ে ধরে ফেললো আরিয়ান।

—-আন্টি, প্লিজ আন্টি। এভাবে বলবেন না। আমি আমার আম্মুকে অনেক ভালোবাসি আন্টি। আমি কী করে তার নামে মিথ্যে কসম কাটবো? ওইদিন মিশু আমার কথা কোনোমতেই বিশ্বাস করছিলো না। তাই বাধ্য হয়ে আমার আম্মুর কসম কাটতে হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আন্টি, আমি একটুও মিথ্যে বলিনি আম্মুর কসম কেটে।

নিজের পা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন রেণু আক্তার। মিশরাত ইতোমধ্যেই গাড়িতে উঠে বসে গিয়েছে। রেণু আক্তারও তার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। আরিয়ান আবারও দৌড়ে গাড়িতে মিশরাত যে পাশে বসেছে, সে পাশে চলে গেল।

—-মিশু, আমি আমার সবকিছু ছেড়ে এইখানে এসে পড়ে আছি শুধু তোমার কাছে আমার অতীতের অবস্থানটা একটু পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। এতোটা নিষ্ঠুর হয়ো না মিশু।

আরিয়ান কথা বলতে বলতেই ইশরাত গাড়িতে উঠে বসে গিয়েছে এবং সাদমান গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আরিয়ান কথাটা শেষ করার পরপরই গাড়ি তার চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল।

হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসে পড়লো আরিয়ান। নিজের কাছে নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে। বাম হাতে চোখ দু’টো ঢেকে রেখে কেঁদে যাচ্ছে আরিয়ান। রাস্তার সবাই এখন সেদিকে তাকিয়ে আছে প্রবল কৌতুহল নিয়ে। পুরোটা ঘটনা তারা শুরু থেকে দেখে এসেছে। এক জোড়া পা এরমধ্যেই দৌড়ে এলো আরিয়ানের কাছে।

—-আরিয়ান, রাস্তায় বসে এভাবে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? মিশরাত কোথায়? আসেনি?

আরিয়ান কিছু বলছে না। শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। এরমধ্যে এতোক্ষণ যাবত সবকিছু লক্ষ্য করে যাওয়া একজন পথচারী বললেন

—-একটা মেয়ে উনাকে চড় মেরেছে। কড়া ভাষায় শাসনও করেছে। মেয়েটির আম্মুকে দেখলাম উনাকে কতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। উনি নাকি উনার মায়ের নামে মিথ্যে কসম কেটেছেন।

আরাভ পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে কী হয়েছে ঘটনাটা। মূলত, পুরোটা সময় আরিয়ানের সাথে থাকলেও মিশরাত আসার একটু আগে আরাভ চলে গিয়েছিলো রেস্টুরেন্ট থেকে। কারণ সে ভেবেছিলো মিশরাত একা আসবে। আর তাদের দু’জনকে একটু স্পেস দেওয়া দরকার। এখানে আরাভের থাকাটা ভালো হবে না। তাই রেস্টুরেন্টের আশেপাশেই সে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলো। হঠাৎ যখন লক্ষ্য করলো আরিয়ান রাস্তায় বসে কাঁদছে, তখনই সে এখানে চলে এলো।

—-আরিয়ান, এভাবে বসে কেঁদে কোনো লাভ হবে না। তা-ও মাঝ রাস্তায়। সবাই দেখছে আরিয়ান। এভাবে রাস্তার মানুষদের কাছে নিজেকে হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলিস না। উঠে পড়। আয় আমার সাথে।

আরাভের কথা শুনে আরিয়ান চোখ থেকে হাত সরালো। আরাভ বেশ খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। কারণ রাগে এবং কান্নায় আরিয়ানের চোখ দু’টো ঈষৎ লাল হয়ে গিয়েছে। নিজের হাতে কামড়ে ধরলো আরিয়ান।

—-আরিয়ান, আমার সাথে আয়। তুই আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়ছিস। এটা তোর বাসা না আরিয়ান। রাস্তাঘাটে পাগলামো করিস না।

—-মোনা…

শুধু এতোটুকু উচ্চারণ করেই আরিয়ান আবারও রেস্টুরেন্ট বরাবর চলে গেল।

রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখলো চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে হাতে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে বিয়ার ঢেলে একটু একটু করে চুমুক দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে সেটা খাচ্ছে মোনা। আরিয়ান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পর গ্লাস টেবিলে রেখে মোনা কেবল উঠতে যাবে, তার আগেই তার চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে চেয়ার থেকে তাকে উঠিয়ে দাঁড় করালো আরিয়ান।

মোনা কিছু বুঝে উঠার আগেই এলোপাতাড়ি অনেক গুলো চড় মারলো তার দু’গালে। ঠোঁটের বাম দিকে একটু কেটে গিয়েছে মোনার। হালকা রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। আবারও তার চুলে ধরে টেবিলে ক্রমাগত মাথা ঠেকিয়ে বাড়ি দিতে লাগলো আরিয়ান। চিৎকার করে যাচ্ছে মোনা।

—-কেউ আছো? ওয়েটার? দেখতে পারছো না আমাকে মারছে?

একজন ওয়েটার সামনে এগিয়ে আসলে ডান পা দিয়ে তার পেট বরাবর একটা লাথি দিলো আরিয়ান। আঘাতে আঘাতে মোনার কপাল ফেটে গিয়েছে। এবার মোনা কে ছেড়ে আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো আরিয়ান। মোনা কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে আর কালবিলম্ব না করে দৌড়ে পালাতে নিলো। তবে তার আগেই আবারও তাকে পাকড়ে ফেললো আরিয়ান। এবার মোনার চোখ দু’টো সত্যিই বড় হয়ে গিয়েছে ভয়ে। প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম। কারণ আরিয়ানের হাতে একটা চাকু। মোনা বুঝতে পারলো আরিয়ান তাকে মারার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। তার চিৎকার চেঁচামেচি করা আরও বেড়ে গেল।

—-বাঁচাও! মরে গেলাম আমি! হেল্প!

আরিয়ান তার গলা বরাবর চাকু নিয়েছে সবে, এরমধ্যেই আরাভ এসে তাকে পেছন থেকে ধরে ফেললো।

—-আরিয়ান, পাগলামো বন্ধ কর।

—-আমাকে ছাড় আরাভ! নয়তো আমি ভুলে যাবো তুই কে।

—-খুনাখুনি করা কোনো সমাধান নয় আরিয়ান। প্রকাশ্যে একটা মেয়েকে জানে মেরে ফেলতে চাইছিস তুই! বুঝতে পারছিস তুই কী করতে যাচ্ছিস?

আরিয়ানকে কোনোভাবেই কিছু বলে মানাতে পারছে না আরাভ। আর না পেরে তার হাতে টান দিলো। একটু ছাড়া পেতেই সেখান থেকে দৌড়ে পালালো মোনা। প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারাটা এখন তার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার।

মোনা চলে গেলে আরিয়ানের রাগ আরও বেড়ে যায়। হাত থেকে চাকু ফেলে আরাভের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে আরিয়ান।

—-তোর সাহস হলো কী করে ওই মেয়েকে বাঁচানোর, হ্যাঁ?

—-আমি ওই মেয়েকে নয়, তোকে বাঁচিয়েছি। আরিয়ান, তোর দিকে তাকিয়ে আন্টি আংকেল বসে আছে। তোর যদি জেলে পড়ে সারাজীবন কাটানো লাগে, তাহলে উনাদের কী হবে একটু ভেবে দেখেছিস? মোনা কী করেছে আমি জানি না। কিন্তু তাকে শাস্তি দেওয়ার কোনো না কোনো উপায় আমরা অবশ্যই বের করবো। তাই বলে তুই নিজেকে খুনিদের কাতারে ফেলতে যাবি কেন?

হঠাৎ করেই সমস্ত রাগ দূরে ঠেলে আবারও কান্না করতে শুরু করলো আরিয়ান। চেয়ারে বসে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে

—-আমার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল আরাভ। মিশু আর আসবে না কখনো আমার কাছে।

—-শান্ত হ আরিয়ান। খুলে বল আমাকে কী হয়েছে।

—-মিশুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি। তুই চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি একটু ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। সেখানে গিয়ে দরজা বন্ধ করার আগেই হুট করে মোনা কোথা থেকে জানি চলে আসলো! আমার কাছাকাছি ঘেঁষছিলো বারবার। আমি যেভাবে পারছিলাম তাকে দূরে সরিয়ে রাখছিলাম। কিন্তু আমি তাকে যতো দূরে সরাচ্ছিলাম, সে ততো কাছে চলে আসছিলো। আমাকে সিডিউস করার চেষ্টা করছিলো। এরমধ্যেই মিশু চলে এলো। আর আমাদের ওই অবস্থায় দেখে দৌড়ে চলে গেল। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি আটকানোর। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি আরাভ, কেউ না। আমি এখন কী করবো আরাভ? আমি এখন কী করবো!

—-ওই মেয়ে কী তাহলে প্ল্যান করে এরকম টা করেছে? সে কী করে জানবে আজকে তুই কোথায় আসবি? সে কী করে জানবে আজকে এখানে মিশরাত আসবে? সে কী করে একেবারে মোক্ষম সময়ে চলে এলো গন্ডগোল বাঁধাতে?

আরাভের মনে একঝাঁক প্রশ্ন। কিন্তু আরিয়ান এখন কোনো কিছু চিন্তা করার অবস্থায় নেই। তীব্র আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই আসছে না তার ভেতর থেকে। একেবারে অন্তঃসারশূন্য লাগছে। মিশরাতকে কী সে আর পাবে না? নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগও দেবে না জীবন তাকে?

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here