#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ৯
(২২)
অনেক ভেবেচিন্তে ইশরাত ঠিক করলো সাদমানের সাথে তার সরাসরি কথা বলা প্রয়োজন। যদিও তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই সাদমানের সাথে কথা বলার। কিন্তু এখন পরিস্থিতির চাপে পড়ে করতেই হবে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরেই চলে গেল সাদমানের বাসার উদ্দেশ্যে। শুধু লিফট দিয়ে তিন তলা উপরে উঠতে হয়েছে এই যা।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আগেভাগে নিজের মনকে শান্ত এবং শক্ত করে নিলো ইশরাত। মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা রাখতে হবে। যতো বিরক্তিকর পরিস্থিতিই উৎপন্ন হোক না কেন, ট্যুরে যাওয়া নিশ্চিত করতে হলে এই বান্দাকে রাজি করাতেই হবে। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে আবার ছাড়লো ইশরাত। কলিংবেল বাজালো। কয়েকবার বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রমহিলা। হ্যাঁ, ইনি সাদমানের আম্মু।
—-আরে ইশরাত যে! আয় আম্মু। তুই তো কতোদিন ধরে আমাদের বাসায় আসছিস না। আমি তো ভেবেছিলাম আমাদের বোধহয় ভুলেই গিয়েছিস। তোর এই মা এর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না বুঝি?
—-আন্টি, আসলে পরীক্ষা চলছিলো তো এতোদিন। তাই একটু ব্যস্ত ছিলাম গো।
—-আমি জানি তোর পরীক্ষা প্রায় দশ-বারো দিন আগেই শেষ। এখন আমার সাথে মিথ্যে কথা বলতে শিখে গিয়েছিস?
জ্বিভে দাঁত দিয়ে কামড় দিলো ইশরাত। সেটা দেখেই হেসে ফেললেন পারভীন সুলতানা। ইশরাতকে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন উনি। সাদমান উনার একমাত্র সন্তান। খুব শখ ছিলো উনার একটা মিষ্টি মেয়ে সন্তানের। কিন্তু সেটা আর উনার কপালে ছিলো না। তাই মিশরাত এবং ইশরাত দু’জনকে তিনি অত্যাধিক স্নেহ করেন। তবে মিশরাত থেকে ইশরাতের প্রতি টান বোধহয় একটু বেশিই উনার। তুই ছাড়া সম্বোধন করেন না একদমই। এমনকি এটাও বলে দিয়েছেন যাতে উনাকে মা বলে মনে করে ইশরাত আর মিশরাত। যদিও দু’জনের কেউ-ই এখনো মা বলে সম্বোধন করতে পারেনি। তবে পারভীন সুলতানাকে দু’জনে ভীষণ ভালোবাসে। এতোদিন পর্যন্ত প্রায় সময়ই ইশরাত সাদমানের বাসায় এসে বসে থাকতো। কোনো কারণ না থাকলেও বসে থাকতো। পারভীন সুলতানার সাথে অনেক কথা বললেও মূল উদ্দেশ্য ছিলো সাদমানের জন্য। তাকে দেখার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য। তবে সেদিনের পার্কের ঘটনার পর থেকে সেসব সবকিছুই করা ছেড়ে দিয়েছে ইশরাত। অনেকদিন পর আজ সে এই বাসায় এসেছে শুধু সাদমানের সাথে ট্যুর নিয়ে কথা বলার জন্য। কিন্তু তার মাঝে এই পরিবর্তন কেন ঘটলো অর্থাৎ হুট করেই কেন সাদমানদের বাসায় আসা বন্ধ করে দিলো তা পারভীন সুলতানা জানেন না বলেই তাকে উক্ত প্রশ্নটা করলো।
—-ধরা পড়ে এখন চুপ করে গিয়েছিস? থাক, আর লজ্জা পেতে হবে না। মায়ের কাছে আবার লজ্জা কীসের?
—-ইয়ে মানে আন্টি, সাদমান ভাই কী বাসায় আছেন?
—-দরজা খুললাম আমি। তোকে প্রশ্ন করছি আমি। আর তুই সাদমানের কথা জিজ্ঞেস করছিস?
—-না, না। সেরকম কিছু না আন্টি। তোমাকে আর কী জিজ্ঞেস করবো বলো তো? তুমি সবসময় এতোটা হাসিখুশি হয়ে থাকো, যে কিছু জিজ্ঞেস করার আর বাকি থাকে না। যা কিছু হয়ে যাক না কেন, তোমার এই মুখের হাসি সবসময় বজায় রাখো তুমি। তাই তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করারও থাকে না। কারণ আমি জানি, আমার আন্টি সবসময় বিন্দাস থাকে!
—-হয়েছে পাকামো। আয়, সোফায় গিয়ে বস। দুপুরের খাবারটা খেয়ে যা।
—-আন্টি, আমি মাত্র খেয়ে এসেছি। পেট একেবারে ভরা। বিশ্বাস করো, একটুও জায়গা নেই।
—-তা বললে তো হবে না। আমার বাসায় এসে তুই খালি মুখে যেতে পারবি না। কিছু হলেও তো খেতে হবে।
—-ঠিক আছে। অল্প করে একটু ভাত আনবে। যা-ই রান্না করেছো, সেখান থেকে যেকোনো একটা পদ আনবে। ভাত ঠিক এক মুঠো।
—-আচ্ছা, রান্না আরেকটু বাকি আছে। তুই বস। না হয় সাদমানের সাথে দেখা করে আয়। তার কথা জিজ্ঞেস করছিলি তখন।
—-উনি রুমেই আছেন?
—-হ্যাঁ, আছে তো রুমেই। কিন্তু এখন কী করছে জানি না। গিয়ে দেখে আয়।
পারভীন সুলতানা রান্নাঘরে চলে গেলে সাদমানের রুমের দিকে অগ্রসর হলো ইশরাত। দরজা কী বন্ধ না খোলা বুঝতে পারছে না। কয়েকবার টোকা দিলো৷ কেউ খুললো না দরজা। হ্যান্ডেল ধরে একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ইশরাত বুঝতে পারলো সাদমান দরজা আবজা দিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেও কাউকে দেখতে পেল না ইশরাত। ওয়াশরুমের ভেতর পানির আওয়াজ হচ্ছিলো। ইশরাত আসার পরপরই বন্ধ হয়ে গেল।
সাদমান কী তবে গোসল করছে? কথাটা মাথায় আসতেই রুম থেকে বের হতে উদ্যত হলো ইশরাত। তবে তার আগেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। ট্রাউজার পরে উন্মুক্ত বক্ষে মাথার চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বের হচ্ছে সাদমান। সেদিকে তাকিয়ে কয়েকবার ঢোক গিলে আবার অন্যদিকে ফিরে গেল ইশরাত। তাড়াতাড়ি দরজার সামনে চলে গেল রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে এরমধ্যেই কানে এলো সাদমানের কন্ঠ
—-এই, এই! দাঁড়াও! তুমি আমার রুমে এখন কী করছো? সাহস তো কম না? পারমিশন নিয়ে ঢুকেছো আমার?
দপ করে ইশরাতের ঠান্ডা মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তবে নিজেকে শান্ত রেখে সাদমানের দিকে না তাকিয়েই সে জবাব দিলো
—-পারমিশন নেওয়ার জন্যও একটা মানুষের দরকার লাগে। আমি কী আপনার রুমের বিছানা আর টেবিল চেয়ার থেকে পারমিশন নেবো? নক তো করেছিলাম ঢোকার সময়। কোনো রেসপন্স না পেয়ে দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।
—-আমার রুমে এসেছো কীসের জন্য?
—-আপনার সাথে একটু কথা বলার ছিলো।
—-তো বলো? ওইদিকে ফিরে তাকিয়ে আছো কেন?
—-একটাবার আয়নায় নিজেকে দেখুন। এরপর আশা করি আমাকে আর এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হবে না।
—-হ্যাঁ দেখলাম আয়নায় নিজেকে। তো?
দাঁতে দাঁত পিষে ইশরাত বললো
—-একটা টি-শার্ট বা কিছু পরে নিন দয়া করে।
—-তোমার জন্য এখন নিজের বাসায় একটু স্বাচ্ছন্দ্যেও থাকতে পারবো না?
—-মানে?
—-মানে প্রচুর গরম পড়েছে আজকে। আমি এখন যেভাবে আছি, সেভাবেই ছিলাম সারাদিন। আর বাকি সময়টুকু এভাবেই থাকবো।
—-তাহলে আমি যেভাবে আছি সেভাবে থেকেই কথা বলবো। ঠিক আছে?
—-ওকে। অ্যাজ ইউর উইশ! বলো কী বলবে?
—-আপনি অনেক ভালো মানুষ। আপনার মতো এমন মানুষ আমি পৃথিবীতে এই পর্যন্ত আর কাউকে দেখেনি। আপনি অসাধারণ, আপনি সেরার সেরা। আপনার তুলনা হয় না কারোর সাথে। আপনি মানুষ না। বিশ্বাস করুন, মানুষ আপনি হতেই পারেন না। এটা কখনোই সম্ভব নয়।
—-কীহ্!
—-ইয়ে মানে বলতে চাইছিলাম যে আপনি মানুষ না শুধু, মহৎ মানুষ।
—-তা আমি কী এমন করলাম যে তুমি আমাকে মহৎ বানিয়ে দিলে?
—-আরে এতো কারণ বলে শেষ করা যাবে? আপনার তো গুণের অন্ত নেই।
—-দু’একটা বলা যাবে সেগুলোর মধ্যে থেকে?
বিড়বিড় করে ইশরাত বললো
—-এই রে! এটা তো ভেবে আসিনি। এমন প্রশ্ন করবে তো বুঝিনি। ভেবেছিলাম প্রশংসা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে যাবে।
—-কিছু বললে?
—-না। আসলে আপনি অনেক ভালো।
—-তাই? হুট করে তোমার এমনটা কেন মনে হলো যে আমি ভালো?
—-এই যে আপনি আম্মুকে আবার রাজি করিয়ে দেবেন ট্যুরে যেতে আমাকে অনুমতি দেওয়ার জন্য, তাই।
—-আমি বলেছি এমনটা করবো? সবকিছু নিজে নিজে ভেবে নিচ্ছো কেন?
—-অবশ্যই ভাববো। আপনি মানুষটা দারুণ। একটা মানুষের যতো রকম ভালো গুণ থাকা দরকার, তার থেকে কয়েকশত, কয়েক কোটি গুণ আপনার মধ্যে আছে। আপনি একজন রত্নগর্ভা।
—-কীহ্!
—-ইয়ে মানে, আন্টি একজন রত্নগর্ভা। আপনাকে গর্ভে ধরেছে বলে কথা! আপনার মতো অমানুষ ইয়ে মানে মহৎ মানুষকে।
মুখে বাম হাত চেপে নিঃশব্দে হাসছে সাদমান। মেয়েটা যে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে তার প্রশংসা করার, এটা বোঝাই যাচ্ছে। বেশ মজা লাগছে সাদমানের নিজের কাছেও। কিন্তু এতো সহজে সবকিছু মিটমাট করার ইচ্ছে তার নেই।
—-যাক, তোমার মুখ দিয়ে কারোর প্রশংসা বের হয়, সেটা জানতে পেরে এবং শুনতে পেরে ভালো লাগলো। এখন যেতে পারো।
ইশরাত আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। যেতে পারো মানে কী? এতোক্ষণ যাবত এতোকিছু কী সে এমনি এমনি বলেছে নাকি? এবার আর লাজ লজ্জার ধার ধারলো না ইশরাত। সাদমানের দিকে ফিরে তাকালো। এরপর রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।
—-ওই, জোর পূর্বক এতোক্ষণ ধরে আপনার মিথ্যে প্রশংসা আমি এমনি এমনি করেছি? কেন করেছি আপনি জানেন না? বললাম না আমি ট্যুরে যাবো? আম্মুকে রাজি করান?
—-সেদিন রাতে আমার সাথে বেয়াদবি করেছিলে। মনে আছে? বেয়াদবির শাস্তি তো পেতেই হবে।
—-কীসের বেয়াদবি হ্যাঁ? আপনি আমাকে কামরুলের কথা বলে শাসাচ্ছিলেন। তো আমি পাল্টা উত্তর দেবো না? এতোদিন ধরে চুপ ছিলাম বলে সারাজীবন চুপ থাকবো, সেটা একদম ভাবতে যাবেন না।
—-আমি তোমাকে কোথায় শাসিয়েছি? শুধু বলেছিলাম কামরুল তোমাকে ফোনে বিরক্ত করছে সেটা কাউকে বলোনি কেন। এখানে শাসানোর কী দেখলে?
—-কেন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে যাবেন? কে আপনি? আপনার কাছে কোনো কিছু নিয়ে জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই।
—-অবশ্যই বাধ্য। সেটা তুমি এখন না বুঝলেও পরে বুঝবে।
—-কোনো পরে না। আজকেই সব বোঝাপড়া হয়ে যাক। সেদিন রাস্তায় আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। কেন? আমি শুধু বলেছিলাম যে যেকোনো ছেলের পাশে গিয়ে বসবো। এখানে আপনাকে অপমান করেছি কোনোভাবে? তাহলে কোন অপরাধে আপনি আমাকে মেরেছিলেন? এখন কামরুলকে নিয়ে পড়েছেন। আম্মুকে কী বুঝিয়েছেন আল্লাহ মালুম। এখন ট্যুরে যাওয়া বন্ধ করতে চাইছেন। কেন? কী সমস্যা আপনার?
(২৩)
গতকাল রাতে সেই যে ফোন বন্ধ করেছিলো, আর অন করা হয়নি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু টিভি দেখে মোবাইল হাতে নিলো মিশরাত। অন করতেই দেখলো অসংখ্য মেসেজ এবং কল। আরিয়ানের নাম্বার থেকে সবগুলো এসেছে। যতোগুলো মেসেজ পাঠিয়েছে, তার সবগুলোর মূল কথা একটাই। যাতে মিশরাত একটাবার তার সাথে দেখা করে, তাকে ভুল না বোঝে। সেসব দেখে এখন আর কোনো ভাবান্তর হলো না মিশরাতের। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে নজর রাখলো সে৷ আবারও ফিরে গেল অতীতে।
***
—-আমি তোমাকে কোনোভাবে কোনোদিনও এই কথা বলেছি যে আমি তোমার উপর ইন্টারেস্টেড? তাহলে তোমার কী করে মনে হলো তুমি এসে আমাকে প্রপোজ করবে আর আমি রাজি হয়ে যাবো?
পরিকল্পনা অনুযায়ী আজকে সুযোগ পেয়ে আরিয়ানকে নিজের মনের কথা বলে ফেললো মিশরাত। লাজুক ভঙ্গিতে আরিয়ানের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করে নিচে তাকিয়ে ছিলো মিশরাত। আরিয়ান বেশ কিছুক্ষণ তাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে এই কথাটা বললো। তাতে মিশরাতের মনে জমে থাকা সকল লজ্জা উবে গিয়ে যেন মন খারাপের জন্ম দিলো। করুন চোখে সে তাকালো আরিয়ানের দিকে
—-আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি?
—-পৃথিবীতে সকলের সকলকে পছন্দ হবে এমন কোনো কথা আছে কী?
—-কেন? আমি দেখতে ভালো না?
—-কাউকে পছন্দ করার মতো এটাই একমাত্র কারণ হতে পারে না।
—-তাহলে?
—-তুমি এখনো ইম্যাচুয়র মিশরাত। এসব তোমার আবেগ ছাড়া আর কিছুই না।
—-আমি সত্যি আপনাকে মন থেকে ভালোবাসি।
—-তুমি একটা মিষ্টি মেয়ে। তোমাকেও আমি পছন্দ করি। কিন্তু এই পছন্দ সেই পছন্দ নয়।
—-কেন? আপনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন?
—-আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা তোমার সাজে না মনে হয়।
—-বলুন না? আপনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন?
আরিয়ান কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলো সেদিন। তবে মিশরাত এতো সহজে হাল ছাড়েনি। সেদিন প্রথমবারের মতো আরিয়ানের কাছে নিজের মনের কথা প্রকাশ করে পাত্তা না পেলেও এরপর আরও অনেকবার চেষ্টা করেছে মিশরাত। আরিয়ান প্রত্যেকবার তাকে এটা সেটা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু মিশরাত সেসব কানের তলে দিয়েও নিতো না।
দেখতে দেখতে কলেজ ছেড়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেল মিশরাত। সময় পরিবর্তন হতে লাগলেও মিশরাতের মনে আরিয়ানের জন্য থাকা ভালোবাসা একটুও পরিবর্তন হয়নি।
মিশরাতকে আরিয়ানের পরিবারের সবাই খুব আদর করতো৷ আরিয়ানের ছোট বোন নুজহাত মিশরাতের থেকে দুই বছরের বড় ছিলো। তবে তাদের দু’জনের মধ্যে সবসময় একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো।
সে বছর নুজহাতের জন্মদিনে মিশরাতের পুরো পরিবার নিমন্ত্রিত ছিলো। মিশরাত যতোটুকু সম্ভব নিজেকে পরিপাটি করে জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলো। নজর শুধু তার একজনের দিকেই ছিলো। আরিয়ান। মানুষটা যদি একটু তার দিকে তাকায় চোখের পলকে, তবুও যেন মিশরাতের অন্তর জুরে প্রশান্তি ছেয়ে যায়।
তবে সেদিন তার প্রশান্তির জায়গাটা অশান্তি দিয়ে ভরে গিয়েছিলো। কারণ যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন বুনে চলেছে মনের মধ্যে নিশিদিন, তার হাত ধরেই অন্য একটি মেয়ে পার্টিতে এসেছিলো। মিশরাত জানতো না আরিয়ানের জীবনে কেউ আছে। কারণ সে দু-তিনবার আরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেও আরিয়ান এর কোনো সঠিক উত্তর দেয়নি।
মেয়েটা আরিয়ানের হাত ধরে পার্টিতে আসার পরপরই নুজহাতের কাছে চলে এলো। কথাবার্তায় অতিরিক্ত মর্ডান হওয়ার ভাব আনতে গিয়ে সেটা উল্টো কেমন জানি বেখাপ্পা লাগে শুনতে। বহিরাবরণ কৃত্রিমতাপূর্ণ। মুখে মেক-আপ এর ছড়াছড়ি। এখানে যে সকল মেয়েরা আছে তারা কেউ শাড়ি তো কেউ থ্রি পিস পরে আছে। শুধু এই মেয়েটাই ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে এসেছে।
—-হেই নুজ! কেমন আছো?
নুজহাত খানিকটা হেসে মাথা নাড়িয়ে জানালো ভালো আছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না নিজে থেকে। মেয়েটি রীতিমতো ক্যাট ওয়াক করতে করতে চলে গেল জোহরা বেগমের কাছে। সেখানে গিয়ে কী বলছে তা মিশরাত শুনেনি। শুধু আহত চোখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু আরিয়ান ছিলো ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত।
—-নুজহাত আপু, মেয়েটা কে? তোমার ভাইয়ের কিছু হয়?
—-হুম। উড বি ওয়াইফ।
বুকটা যেন ধক করে উঠলো মিশরাতের।
—-তোমরা জানতে এই ব্যাপারে?
—-না রে। ভাইয়ার বিয়ের কথা কয়েকদিন ধরে তুলছিলো আব্বু আম্মু। দিন দশেক আগে ভাইয়া এসে হুট করেই বললো তার একটা মেয়েকে পছন্দ আছে। কবে থেকে সম্পর্ক জিজ্ঞেস করায় বললো বছর তিনেকের।
—-তিন বছর! আমাকে তো বললো না?
—-কিছু বললে?
—-হ্যাঁ? না, কিছু না। তোমাদের সবার বুঝি ওকে খুব পছন্দ হয়েছে?
—-তোমার পছন্দ হয়েছে?
—-মানে?
—-বলো না? তোমার পছন্দ হয়েছে?
—-না, আসলে…
—-আমতা আমতা করে বলার দরকার নেই। তোমার পছন্দ হয়নি। ঠিক আমাদেরও তাই। এই মেয়ের ছবি যখন দেখলাম তখনই আম্মু আর আমি বলেছিলাম একজন আরেকজনকে, যে এই মেয়েকে ভাইয়া কী দেখে যে পছন্দ করলো! অতিরিক্ত ঢং করে কথা বলতে গিয়ে বাংলা ভাষাটা কে-ই বিকৃত করে ফেলে। আব্বুও তেমন একটা পছন্দ করেনি। তবে ভাইয়ার পছন্দের উপর কখনোই আব্বু জোর করেনি। আম্মুও ছেলের পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আমি আর কী-ই বা বলবো বলো?
—-আমার শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। আমি বাসায় যাই?
—-সেকি! কেক কাটা হলো না এখনো। কোনো সেলিব্রেশই করা হলো না। তুমি চলে যাবে কেন? তুমি না থাকলে আমার ভালো লাগবে বলো?
—-আসলে শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে। মাথাটা কেমন জানি করছে।
—-তাহলে আমার রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আসো?
—-না আপু। আমি চলি গো।
একপ্রকার দৌড়ে সেদিন সেখান থেকে চলে এসেছিলো মিশরাত। মনে হচ্ছিলো তার বুকে ক্রমাগত কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করছে।
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)