অনুভূতিহীন পর্ব-১৮

0
3589

#অনুভূতিহীন (পর্ব ১৮)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

রিদ দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে। আরশিকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি এর আগে। নিশ্চুপে কাঁন্না করা মেয়েরা হয় মায়াবতি। এরা কাঁদার সময় যেনো আশে পাশের মানুষদের মাঝে মায়া ছড়াতে থাকে।
আরশির এভাবে কাঁন্না রিদের বুকটা হাহাকার করলেও চুপচাপ দরজার পাশে দাড়িয়ে আছে সে। যেন আরশি কাঁন্না নয়, মায়া ছড়াচ্ছে। থাকুক না কিছুক্ষন এই মায়া। কাঁদুক না সে। হালকা করুক নিজেকে। কাঁদলেই তো কষ্ট গুলো হালকা হয়। মেয়েটা এখনো কাঁদছে।

শহর জুড়ে বৃষ্টি নামুক, কষ্ট গুলো দিক ধুয়ে।
কাঁন্না শেষে ক্লান্ত হয়ে, পড়বে বুকে সে নুয়ে,,,

না একধমই মিলছে না। কিসব আহাম্মকের মতো বকছি। আচ্ছা আজ বৃষ্টি হচ্ছে না কেন?
রিদের উপস্থিতি হয়তো টের পেয়েছে হয়তো আরশি। তার কান্না থেমে গেছে।

আমি কাঁদছি, আর কেও আমার দিকে চেয়ে আছে। কিছু বলছে না। ব্যাপারটা আমার জন্য লজ্জা জনক। তাই কাঁন্না থামিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। রিদ আমার পাশে এসে সেও দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। আমি তাকে কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছি। সে আমায় বললো,
– মনের কষ্ট কমেছে?
আমি না বুঝার ভান করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার নিরবতা দেখে সে বললো,
– কাঁদলে তো কষ্ট গুলো হালকা হয়। তাই তো এতোক্ষন মন ভরে কাঁদতে দিয়েছি। তবে তোমাকে কিন্তু কাঁন্নায় খুব মায়াবি লাগে। আরেকটু কাঁদো না,,, আমি দেখবো। যাষ্ট একটু, বেশি না।

আমি তার দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে আছি। ওনি এমন ভাবে কথা গুলো বলছে, তাতে মনে হচ্ছে আমার এতোক্ষনের কাঁন্নায় অনেক মজা পেয়েছে সে। তাই আরেকটু মজা দেখানোর জন্য অনুরুধ করছে।
এবার আমি ভ্রু-কুচকে মুখ ফুটে বললাম,
– আমার কাঁন্না নিয়ে আপনি রসিকতা করছেন?
আমার কথায় সে হো হো করে হেসে উঠলো। মনে হয় এখানেও অনেক বিনোদন পেয়েছে। তারপর বললো,
– জানো আমি যেন কোথাও একটা কথা শুনোছিলাম যে, ছেলেরা সহজে কাঁদেনা। আর মেয়েরা তো লিপস্টিক হারিয়ে গেলেও কাঁন্না করে।
আমি সোজা সুজি ভাবে বললাম,
– আমাকে মোটেও ওসব মেয়েদের সাথে মিলাবেন না। আর আপনি ঘুমাতে যান আমায় একটু একা থাকতে দিন।
আমার কথা সে বললো,
– মানুষ তো মন খারাপের সময় একা থাকতে চায়। কিন্তু তোমার তো এখন মন ভালো হয়ে গেছে। এখন একা থাকতেও তোমার কাছে বিরক্ত লাগবে।
আমি তার দিকে চেয়ে বললাম,
– কিভাবে বুঝলেন?
– এই যে ফট ফট করে কথা বলছো, মন খারাপ থাকলে তো চুপ করে থাকতে।
ওনার কথায় নিজের মাঝে একটা প্রশ্ন জাগলো, সত্যি কি আমার মন ভালো হয়ে গেছে?
সে আবার আমার দিকে চেয়ে বললো,
– এই বাড়িতে সৌন্দর্য খুজতে গেলে প্রথমে আমাদের ছাট টাই চোখে পরবে তোমার। ছাদে চলো দেখবে মন অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ রইলাম। আমার নিরবতার মাঝে হয়তো সে সম্মতি খুজে নিয়ে উঠে আমার এক হাত ধরে হাটা ধরলো ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমি হাটছি তার সাথে সাথে। মানুষটা অদ্ভুত, হুট হাট নিজের রুপ চেন্জ করে ফেলতে পারে। আগের সে আর এখনকার সে, পার্থক্য টা অনেক।

আজ আকাশ পুরোপুরি পরিষ্কার। চাঁদ টাও জ্বল জ্বল করছে আজ। চাঁদের আলো চার দিকে ফুটে উঠেছে। ছদের এক পাশে সুইমিংপুল আর অন্য পাশে ফুল গাছে ভরা আর তার মাঝে একটা দোলনা।
আমরা দুজন দোলনাটায় পাশাপাশি বসে আছি। সে আমাকে অফার করে,
– চা না কফি?
আমি দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– ইচ্ছে করছে না।
সে যেন নাছোড়বান্দা’র মতো আবার বললো,
– না বললে তো হবে না। আড্ডা দেওয়ার সময় চা বা কফি হলে আড্ডার মাঝেও একটা ফিল থাকে। তুমি বসো আমি কফি’ই নিয়ে আসছি।
আমি মাথা কাত করানোর ভঙ্গি নিয়ে বললাম, আচ্ছা৷

সময় টা সুন্দর। সেই সাথে সুন্দর এখানে প্রতিটি মানুষের মন। সুধু অসুন্দর ছিলো মাঝখানে ঘটে যাওয়া কিছু মুহুর্ত।
হুট করে মনে হলো রিদ ভাইয়ার জন্য যত্ন করে তৈরি করা জিনিস টা তো এখনো দেওয়া হয় নি। আর ওর হয়তো কফি বানাতে তার পর আনতে সব মিলিয়ে একটু সময় লাগতে পারে। এই ফাকে নিয়ে আসি তা। কারণ এখন সময় টা সুন্দর। গভির রাতে ছাদে বসে একাকি দুজন। মাথার উপর চাঁদ টা জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে।
একটা গান মনে পরলো হুট করে। এখন তো সময় ভালোবাসার, এ দুটি হৃদয় কাছে আসার।

গানটা মনে পরলেও এমন কোনো আবেগ এই মুহুর্তে কাজ করছে না। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে রুমে আসলাম। বেগের ভেতর থেকে ভাজ করা পেইজ টা নিলাম।
খাটের উপর পরে থাকা ফোনটায় বার বার সবুজ বাতি জলে উঠছে। তার মানে হয়তো কেও ফোন বা মেসেজ করেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম আন নোন নাম্বার। কল ব্যাক করবো কি না ভাবতে ভাবতে আবার ফোন এলো। রিসিভ করে সালাম দিলাম। ওপাশ থেকে সালাম না নিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,
– তুই সব সময় আমায় এভাবে চমকে দিস কেন?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,
– পছন্দ হয়েছে?
– হুম খুব। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে।
আমি একটু ভ্রু কুচকে বললাম,
– কেন?
– কারণ তুই সব সময় আমায় দিয়ে এসেছিস সেই ছোট বেলা থেকে। আমি তো তোকে কখনো কিছু দিতে পারিনি।
সাবিহা ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে দেখে একটু হাসি পেলো আমার। আমি বললাম,
– তুই যেটা দিয়েছিস তা এসবের কাছে কিছুই না। আচ্ছা বাদ দে, নতুন সিম নাকি এটা?
– হুম,, বিকেলে বাসায় আসার পর বক্স খুলে দেখি ফোন। বাবা তো প্রথমে দেখে সেই ক্ষে/পেছে। ভাবলে কোন ছেলে না কোন ছেলে আমার ফোন কিনে দিয়েছে কথা বলার জন্য। পরে যখন বললাম, তুই দিয়েছিস তার পর আর কিছু বলেনি।
এতটুকু বলেই কিছুক্ষন হাসলো সাবিহা। আবার বললো,
– এর পর বাবাকে বললাম একটা সিম নিয়ে দিতে। তার পর বাবা সন্ধায় বাজারে গিয়ে সিমটা নিয়ে আসলো।
আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম,
– আচ্ছা। তো এতো রাত অব্দি জেগে আছিস কেন?
– রাতে বসে বসে ফোনটা টিপছিলাম, দেখছি কিছুই করতে পারছি না। এর পর পাশের বাড়িতে গিয়ে মাহিন ভাইয়াকে বললাম, সে সব কিছু সেটিং করে দিলো।
আমি একটু ধমকের স্বরে বললাম,
– তা কাল সকালেও তো করতে পারতি, এতো রাতে অন্য বাড়িতে যাওয়ার কি দরকার ছিলো? তাও আবার কোনো ছেলের কাছে?
– আরে ধুর, মাহিন ভাইয়া খুব ভালো, আমাকে নিজের বোন বলে ডাকে।
আমি আবারও বললাম,
– এভাবে জোসের বসে হুশ হারাস না। ফ্যামিলি ছারা কেও দুনিয়াতে আপন না। বাকি সবাই আসে আলগা দরদ দেকানোর জন্য। সুজুগ পেলে ঠিকই পেছনে ছু/রি বসায়। আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পর। কালকে সকালে ফোন দিবো তোকে।
– আচ্ছা,,,,

কথা বলতে বলতে ছাদে এসে বসলাম। ফোন টা রেখে দিলাম। সাবিহা খুব আনন্দে আছে সেটা তার কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে।
আমি পেইজ টা খুলে ছবিটা একবার দেখে নিলাম। তখনি হাতে দুইটা কফির মগ নিয়ে রিদ ভাইয়ের আগমন ঘটলো। আমার পাশে বসে একটা কপির মগ এগিয়ে দিলো। আমি তার দিকে কাগজটা এগিয়ে দিলাম।
তাতে ছিলো একটা ছবি। ওইদিনের বৃষ্টি পড়া, আর সে আমাকে কোলে নিয়ে ছাউনি তলে যাওয়ার দৃশ্যটা। আমি নিজেই এঁকেছি। এটা হতে পারে আমার একটা প্রতিভা। ছোট থেকে যা একবার দেখতাব বা অনুভব করতে তা ই আমি এঁকে ফেলতে পারতাম
রিদের মুখের ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলাম, সে বুঝে নিয়েছে এটা কিসের দৃশ্য। কারণ ছবিটা যে খুব যত্ন করে মনোযোগ দিয়ে আঁকা। পাঁচ দিন সময় ব্যয় হয়েছে এই ছবির পেছনে।
সে অবাক ভঙ্গিতে বললো,
– তুমি এঁকেছো, নিজ হাতে?
আমি মাথা নারালাম। সে হাস্যজ্জল মুখে বললো,
– এই দৃশ্যটা ফ্রেম বানিয়ে আমাদের খাটের মাথা বরাবর দেওয়ালে লাগিয়ে দিবো।
আমি কিছু বললাম না, কফির মগে চুমুক দিলাম। কফি শেষে মগটা রেখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পাশ থেকে সে বললো,
– তখন কাঁদছিলে কেন? বাবা মায়ের কথা মনে হচ্ছে?
আমি মন খারাপ করে বললাম,
– হুম, আর একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম।
সে একটু আগ্রহ দৃষ্টি নিয়ে বললো,
– কি?
– ওই দৃশ্য টা। কতগুলো ছেলে আমায় তু/লে নিয়ে যাচ্ছে, আর আমি চিৎ/কার করছি। কিন্তু কেও আমায় বাচাতে আসছে না। আবারও মনে হচ্ছিলো আমি আপনার থেকে হারিয়ে যাচ্ছি। এবার বোধ হয় ফিরতে পারবো না আপনার কাছে।
আমি কথা শেষ করার আগেই সে আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নিলো। তার এমন কান্ডে একটু অবাক হলেও আমি একধম শান্ত ভাবে চোখ বুজে নিলাম।

চাঁদের কিরণে আরশিকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে রিদ। দুই চোখ বুঝে চুপটি মেরে আছে আরশি। রিদ তার মাথায় হাত নারাচারা করতে করতে বললো,
– তোমার মনে আছে? সেই ছোট্ট বেলায় আমি তোমাদের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। আমাকে খুব ভয় পেতে তুমি। কোনো ভুল করলেই ভয়ে গিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে। প্রথম প্রথম খুজে পেতাম না। কিন্তু পরে তুমি লুকালে বুঝে যেতাম কোথায় আছো। কারণ সব সময় এক জায়গাতে গিয়েই লুকাতে। তবুও আমি খুজে না পাওয়ার ভান করে তোমাকে খুজতাম। আর তা দেখে হাসতো আরিশা। এর পর ভয় কেটে গেলে আবার আমার কাধে এসে ভর করতে। ভয়ে যখন কাঁন্না করে দিতে, তখন খুব মায়ামনি লাগতো তোমায়। চোখ মুখ লাল করে ফেলতে কাঁন্না করে। তাই বার বার ইচ্ছে করেই কাঁদাতাম। এর পর দুষ্টুমিতে যখন আমায় জ্বালিয়ে মারতে তখন মনে হতো, পৃথিবির সবচেয়ে দুষ্টু মেয়েটা বোধ হয় তুমি। এর পর বাসায় আসার পর খুব মিস করতাম তোমাকে। তুমি দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলে তা মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যেত আমার। এর পর তোমাদের বাসায় আর যাওয়া হতো না। তবে সেই ছোট বেলা থেকেই মা কে বলতাম তোমাকে আমার বৌ বানিয়ে নিবো। আর দেখো সেটাই হলো। তুমি আমার খুব কাছে, অথচ এখনো মনে হয় সেই বাচ্চাই আছো। তাই তো তুমি কাঁদার সময় দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার সামনে বসে আমার সেই পিচ্চি আরু কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলছে।

এতটুকু বলেই আরশির দিকে তাকালো রিদ। মুহুর্তেই একটা দির্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। আজও বলা হলো না মনের কথা গুলো। ভেবেছিলো অনেক রাত জেগে আজ আরশিকে তার মনের কথা গুলো বলবে।
কিন্তু আরশি যে তার আলতো পরশ পেয়ে অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।
,
,
এর পর কেটে গেলো কয়েকদিন। সকাল বেলায় নাস্তা শেষে পত্রিকা নিয়ে বসলো রুদ্র চৌধুরী। আজও একটা হতাশার খবর চোখে ভেষে উঠলো। শহরের বড় বড় বিজনেসম্যান গুলো কয়দিন পর পর একটা একটা আত্ম/হ/ত্যা করছে। আর ম/রার আগে সব প্রোপার্টি কেও একজনের নামে করে দিচ্ছে।
আজও পত্রিকার পাতার তার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু আবরাহাম এর লা/শ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এই মাসের ভেতরেই দুইজন বিজনেসম্যান এর আত্ম/হ/ত্যা।
আর আজ আবরাহাম রাজিবের সাথে এমন হওয়ায় পত্রিকাটা ফেলে কপালে হাত রাখলেন সে।
কারণ কয়দিন আগে তার সাথে ২০০ কোটি টাকার একটা ডিল ফাইনাল করেছিলো।
,
,
আমি তখন ফুলের টব গুলোতে পানি দিচ্ছিলাম। আর তখনই সাবিহার ফোন। রিসিভ করতেই শুনলাম মেয়েটা কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে বললা,
– কিরে কি হলো তোর, এভাবে কাঁদছিস কেন?
– আমি ধ/রা পরে গেছিরে আরু। বাবা আমার বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে। অথচ সাব্বিরও এখনো কিছু করতে পারেনি।
আমি একটা শ্বাস নিয়ে বললাম,
– এখন কি করবি?
– আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।
বলেই এক নাগারে কেঁদে চলছে সাবিহা। আমি ফোন হাতে চুপচাপ তার কাঁন্না শুনছি। কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।

To be continue,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here