#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বড্ড প্রফুল্ল মনে ঠোঁটে হাসির রেখা ঝুলিয়ে বাসার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো খুশি। তবে সামনে দুকদম বাড়াতেই তার হাসি মুখটা হাওয়া বের হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। কারণ তার সামনেই তার মা জননী অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করে আছে। তা দেখেই খুশির অন্তরের পানি শুঁকিয়ে এলো। আজ যে ওর কপালে মঙ্গল বাদে আর সবদিনই আছে তা ভালোই বুঝতে পারছে ও। খুশি নিজের সাহায্য স্বরূপ ভাই আর বাবার দিকে তাকালো। কিন্তু তাদের করুন চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না তাদের কাছ থেকে কোন সাহায্যের আশা করা যায়। খুশি বেটা, আব তো তু গায়া কামছে।
সাহেলা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো।
–আসেন আসেন মহারাণী। আপনার আসার সময় হয়ে গেছে? এতো জলদি কেন আসলেন? রাত ১২ টার নাহয় আসতেন।
খুশি একটু জোরপূর্বক হেসে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি বলো মা? আমি এতো দেরি করে কি করে আসতে পার?।তুমিই তো তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলেছ তাইনা?আর তুমি তো জানোই আমি তোমার কতটা অনুগত সন্তান। তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই আমার একমাত্র কাজ।পৃথিবী উল্টে গেলেও তোমার কথার অমান্য হবে না। আমার মতো বাধ্য, সুশৃঙ্খল, ভদ্র,অনুগত,সহজ, সরল মেয়ে তুমি গুগলে সার্চ দিয়েও পাবে না। আরে আমার তো ফেবারিট গানও মাকে নিয়ে।
♬ আম্মাজান আম্মাজান চোখের মনি আম্মাজান
♬ জন্ম দিছেন আমায় আপনার দুগ্ধ করছি পান
♬ আম্মাজান আম্মাজান আম্মাজান আম্মাজান
–চুপ। একদম চুপ। ইয়ার্কি হচ্ছে আমাার সাথে? এটা তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো? কলেজ তো সেই কোন বেলায় শেষ হয়ে গেছে। তাহলে তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি হ্যাঁ? সত্যি করে বল কোথায় গিয়েছিলি তুই হ্যাঁ?
রাকিব হাসান একটু সাহস যুগিয়ে বলে উঠলেন।
–আরে মেয়েটা মাত্রই আসলো। ওকে একটু সময় তো দাও। আসতেই সওয়াল-জবাব শুরু করে দিয়েছ।
নিভানও বোনের সাপোর্টে বলে উঠলো।
–হ্যাঁ আম্মু দেখনা আপুর মুখটা কেমন শুঁকিয়ে গেছে। আগে একটু খেতে দাও আপুকে।
সাহেলা বেগম ধমকের সুরে বললেন।
–চুপ কর তোরা। তোদের আস্কারা পেয়েই আজ ও এমন উড়নচণ্ডী হয়ে গেছে। সবসময় শুধু ওর ওকালতি করার জন্য এগিয়ে আসিস। আজকে কেউ কথা বলবিনা। নাহলে সব কয়টাকেই আজ চরম শিক্ষা দিয়ে দিবো।
সাহেলা বেগমের রাম ধমকে ওরা দুজন দমে গেল। খুশি বুঝতে পারলো এভাবে কাজ হবে না। তাই ওর সো কল্ড মেলোড্রামা শুরু করে দিলো। নেকি সুরে দুখিয়ারী ভাব ধরে বলে উঠলো।
–থাক তোরা কিছু বলিস না। এটাই আমার পাওনা। আম্মু তুমি কি একবারের জন্যও জানতে চেয়েছ আমার দেরি হলো কেন? তা কেন জানতে চাইবে? তোমার তো আমার ওপর কোন ভরসাই নেই। আরে আমি কি ইচ্ছে করে লেট করেছি নাকি? জানো আমিতো কলেজ ছুটে হতেই সোজা বাসায়ই আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখি একটা বাচ্চা রাস্তার ভেতর কাঁদছে। তাই আমি ওর কাছে গিয়ে জানতে পারলাম বাচ্চাটা নাকি ওর মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। তোমরা তো জানোই আমি কতো সেনসেটিভ। কারোর কষ্ট আমার সহ্য হয়না। তাই আমি ওই বাচ্চাটার মাকে খুজতে লাগলাম। অনেক খোঁজার পর অবশেষে তাকে পেয়ে তার কাছে বাচ্চাটাকে হস্তান্তর করে তারপরে না আসলাম। তারপর হলো আরেক ঝামেলা। রাস্তায় গাড়ি পেলাম না একটাও। পুরো রাস্তা হেঁটে হেঁটে এসেছি জানো? আমার পা দুটো তো ব্যাধায় টনটন করছে। কিন্তু তোমাদের সেদিকে খেয়ালই নেই। আসতেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলে। ভালো মানুষের দামই নেই এই যুগে।
কথাগুলো বলে খুশি নেকি কান্না করতে লাগলো। খুশির মেলোড্রামায় নিভান আর রাকিব হাসান যেন কেঁদে দেওয়ার উপক্রম। তারা তড়িঘড়ি করে খুশির কাছে এলো। খুশিকে ধরে সোফায় বসিয়ে বললো।
–আহারে আমার মামুনি টা কত কষ্ট পেয়েছে। আর তুমি কিনা ওকে আরও কথা শুনিয়ে যাচ্ছো? তুমি এতো কঠোর কিভাবে হতে পারো?
নিভানও করুন সুরে বললো।
–আপুর তোমার পায়ে অনেক ব্যাথা হচ্ছে বুঝি? দাঁড়াও আমি এক্ষুনি পেইন কিলার অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছি।
সাহেলা বেগমেরও এবার একটু অপরাধ বোধ হচ্ছে। মেয়েটা যে তার জনদরদী সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই ওর মিথ্যে কাহিনিকে অবিশ্বাস করতে পারলোনা। সে দ্রুত কিচেনে গিয়ে মেয়ের জন্য খাবার গরম করতে লাগলো। যাই বলুক মেয়েকে তো সেও কম ভালোবাসে না। তার প্রথম সন্তান খুশি। মা হওয়ার সৌভাগ্য সে খুশিকে দিয়েই পেয়েছিল। বিয়ের পর অনেক দিন বাচ্চা হচ্ছিল না তার। অনেক চিকিৎসার পর খুশি তার গর্ভে এসেছিল। খুশির যেদিন জন্ম হয় সেদিন ছিল সাহেলা বেগমের সবচেয়ে খুশির দিন। তাইতো মেয়ের নামও সে খুশি রেখে দিয়েছিল। তবে মেয়েটার জন্য একটু চিন্তা হয়।খুশির মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চলতা সাহেলা বেগমের চিন্তার কারণ। তাইতো সে একটু কড়া হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। ওর ভবিষ্যতের চিন্তা হয় সাহেলা বেগমের। নাজানি এই মেয়ে অন্যের ঘরে গিয়ে কিভাবে সংসার করবে? তারা কি ওকে এভাবে মেনে নিতে পারবে?
___
রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরলো প্রহর। জিদান তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–কিরে গাড়ির টায়ার পানচার হয়ে গিয়েছিল নাকি? আজ হঠাৎ একটু লেট করে ফিরলি মনে হয়। না মানে তুই তো আবার বাচ্চাদের মতো সন্ধ্যার আযানের সাথেই দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসিছ। তা রাতের অন্ধকারে ভয় পেলি নাতো?
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–বাবা তোমার মনে হয় না, তোমার একটু বেটার জোক্স ট্রাই করা উচিত? আই মিন বয়সের সাথে তোমার জোক্স গুলোরও ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাচ্ছে। আই থিংক তোমার একটু চর্চা করা উচিত।
–হাহ্ যার ছেলের জওয়ানি এক্সপায়ার হয়ে যাচ্ছে। তার জন্য জোক্স এক্সপায়ার হওয়াটা খুব একটা বড়ো ব্যাপার না। কদিন পর তুই নিজেই মানবজাতির জন্য পারমানেন্ট জোক্স হয়ে যাবি। তা ছিলি কোথায় শুনি?
–ফার্মহাউস গিয়েছিলাম। তাই দেরি হয়েছে।
–তুই আবার ওই বোরিং জায়গা টায় গিয়েছিলি? ওই ফার্মহাউস টা তোকে শেষ করে দিলো। কি আছে শুনি ওখানে? তাও যদি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য যেতি তবুও একটা কথা ছিল। তুই কি করিস? ওইসব পশুপাখির ন্যানি হয়ে যাস। আরে ভাই ওতো সুন্দর একটা ফার্মহাউস টাকে তুই চিড়িয়াখানা বানিয়ে দিয়েছিস। কোথায় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে ডেট করতে যাবি। তানা পশুপাখির পটি পরিস্কার করিস। ডিসকাস্টিং।
ডেট করার কথা শুনে প্রহরের হঠাৎ খুশির কথা মনে পড়ে গেল। তখন খুশিও এমনই বলেছিল।এখন ওর বাবাকে কি করে বলবে যে সে সত্যিই আজ ওখানে কোন মেয়েকেই নিয়ে গিয়েছিল। বাবা শুনলে নির্ঘাত এটা নিয়ে নতুন কাহিনি শুরু করে দিবে। একেতো নাচুনি বুড়ী, তারওপর ঢোলের বাড়ি হয়ে যাবে।না না বাবাকে খুশির কথা মোটেও বলা যাবে না। প্রহরের ভাবনার মাঝেই ওর বাবা আবার বলে উঠলো।
–বায়দা ওয়ে ফার্মহাউসে তো তুই ছুটির দিনে যাস। তো আজ হঠাৎ কি মনে করে? নাকি তোর ছাগল গরু বাচ্চা দিয়েছে। আর তুই দায়মা হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলি?
প্রহর একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–ওই এমনি আরকি। একটু যেতে ইচ্ছে করছিল তাই। তুমি এসব ছাড়না। অনেক ক্ষিদে লেগেছে। চলো ডিনার করে নেই।
প্রহর প্রসঙ্গ পাল্টে দ্রুত ফ্রেশ হতে চলে গেল। ব্যাপার টা কেমন সন্দেহজনক মনে হলো জিদান সাহেবের কাছে। আজকে প্রহরের গতিবিধি কিছুটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। আর তার সন্দেহর মাত্রা আরও বেড়ে গেল ডাইনিং টেবিলে বসে। আজ প্রহর বিনা কোন বাক্য ব্যায় করে চুপচাপ ঢেঁড়স খাচ্ছে। আর ওকে দেখে মনে হচ্ছে খাবারে ধ্যান নেই ওর। মন অন্য খেয়ালে ডুবে আছে। জিদান সাহেব গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রহরকে পর্যবেক্ষণ করছে।
প্রহরের মন সত্যিই এখন খাবার টেবিলে নেই। না চাইতেও বারবার খুশির কথা মনে পড়ছে। খুশির ওই কথাগুলো গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে ওকে। ফাহিম কি ঠিকই বলে? মেয়েটা কি সত্যিই অন্যরকম? ও কি সত্যিই ভালোবাসে আমাকে? প্রহরের হঠাৎ খুশির সেই ছাগলছানার সাথে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়তেই ঠোঁটের কোনে আবারও হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
ব্যাস এবার তো জিদান সাহেবে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এটা কি সত্যিসত্যিই তার ছেলে? নাকি তার ছেলের মাঝে কোন ভূত প্রেত ঢুকে গেছে? নাহ আর বসে থাকা যায় না। জিদান সাহেব ফোন বের করে দ্রুত ফাহিমের নাম্বারে ফোন দিয়ে বললো।
–এই ফাহিম বাবা জলদি ডাক্তার, ওঝা,কবিরাজ সব নিয়ে আসো। তোমার বন্ধুর কিছু হয়ে গেছে।
জিদান সাহেবের কথায় হকচকিয়ে উঠলো প্রহর। ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি বলছ বাবা? আমার আবার কি হবে?
–কি হবে মানে? আরে তুই হাসছিস। তাও আবার আপন মনে। এটা কি তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আরে যে তুই কাপিল শার্মা শো,আর টক শো এর মাঝে পার্থক্য খুজে পাস না।সেই তুই আজ হাসছিস এটা কোন নরমাল ব্যাপার না। নিশ্চয় তোর মাঝে প্রেতাত্মা ঢুকে গেছে।
প্রহর একটু থতমত খেয়ে বললো।
–তুমিও না বাবা তিল কে তাল বানিয়ে ফেলো। এমন কিছুই না আমি একদম ঠিক আছি।
–মোটেও না। তোর শিরায় শিরায় পরিচিত আমি। সত্যি করে বল ঘটনা কি?
–ঘটনা হলো তোমার মাথা গেছে। ইউ নিড ডক্টর।
কথাটা বলেই প্রহর ওর বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য তড়িঘড়ি করে ওখান থেকে কেটে পড়লো। ওর বাবার তীক্ষ্ণ নজর। তার কাছ থেকে সহজে কোন কিছু লুকানো যায় না। তাই এখান থেকে চলে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করলো সে। যেতে যেতে ফাহিমকে ফোন করে আসতে মানা করে দিলো। ওটা আবার আরেকজন। দেখা যাবে সত্যি সত্যিই চলে আসবে।
___
পরেরদিন যথা সময়ে খুশি হেলেদুলে যাচ্ছে প্রহরের কাছে। তখনই মেয়েলি কন্ঠে কেউ ওকে ডাক দিল। খুশি পাশে তাকিয়ে দেখলো, দুহাত দূরে ক্যাফেটেরিয়ায় একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা হাতের ইশারায় ওকে ডাকছে। খুশি একটু অবাক হলো। কারণ সে মেয়েটাকে চিনে না। অপরিচিত মেয়েটা ওকে কেন ডাকছে? তারওপর মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর। এতো সুন্দর মেয়ে হয়তো এর আগে দেখেনি ও। একেবারে ফেইরি প্রিন্সেসের মতো দেখতে।মেয়েটার ডাকে খুশি সেদিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটার সামনে গিয়ে বললো।
–জ্বি আপু কিছু বলবেন?
মেয়েটা নরম সুরে বললো।
–হ্যাঁ কিছু বলতাম। আগে বসনা প্লিজ?
খুশি সামনের চেয়ার টেনে বসলো। তারপর মুচকি হেসে বললো।
–আপু একটা কথা বলবো? আপনি কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। ফিল্মের হিরোইন দের থেকেও বেশি সুন্দর। সত্যিই বলছি।
নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হওয়ার কথা হলেও, মেয়েটির চেহারায় তার ফলশ্রুতি তেমন দেখা গেল না। মেয়েটি মলিন হেঁসে বললো।
–কি লাভ হলো এতো সুন্দর হয়ে? সেইতো অবহেলিত হতেই হলো।
–মানে?
–হায়, আমি রুশা।দেখ তোমাকে কিছু বলতে চাই। তুমি যে কিছুদিন যাবৎ প্রহরের পিছনে ছুটছ সেটা আমি দেখেছি। তো আমি বলবো তুমি এসব ছেড়ে দাও। কারণ তুমি কখনোই সফলতা পাবে না। যার দরুন তোমার কোমল মনটা একসময় ভেঙে যাবে। তাই তোমার ভালোর জন্যই বলছি। নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করে ওর পিছে পিছে ঘুরোনা। প্রহর একটা পাথর। ওর মাঝে কোন অনুভূতি নেই। ও কখনোই তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। ভেবনা এসব আমি বানিয়ে বলছি। আমি এসব নিজের অবিজ্ঞতা থেকে বলছি। এইযে তুমি বললে আমি কতো সুন্দর। কিন্তু জানো এই আমিও ওর কাছে অবহেলিত হয়েছি। আমিও একসময় তোমার মতো পাগল হয়ে পড়ে থাকতাম ওর পেছনে। কিন্তু ওর মন গলাতে সক্ষম হইনি। বরং সে আমাকে উল্টো অপমানিত করে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর আমিও আর সাহস পাইনি। কারণ নিজের সেল্ফরেসপেক্ট কে আর ছোট করতে পারছিলাম না। তাই তোমাকেও বলবো নিজেকে কষ্ট দিতে না চাইলে ওই পথ থেকে ফিরে আসে। ঐ পথের কোন মঞ্জিল নেই। ওর কাছে শুধু অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পাবে না।
খুশি স্মিথ হেঁসে বললো।
–আমার জন্য এতটা ভাবলেন তার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এখন আমি আপনাকে কিছু কথা বলি। প্রথমত আমাকে যতোটা অবুঝ ভাবছেন আমি ততটাও কিন্তু না। মানুষকে পরখ করার যথাযথ বুদ্ধিমত্তা আমার আছে। আর একটা কথা কি জানেন সত্যিকারের ভালোবাসায় অপেক্ষা,অবহেলা দুটোই হয়তো আছে। তবে ব্যার্থতা নেই।আমি জানি না আপনার ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল। আপনার ভালোবাসা যদি সত্যিই এতটা গভীর হতো তাহলে আপনি সফলতা অবশ্যই পেতেন। এতো সহজে হার মেনে নিতেন না। আর হ্যাঁ সেল্ফরেসপেক্ট আর অবহেলার কথা বলছিলেন না আপনি? আমার মতে আত্মসম্মান ক্ষয় বা অবহেলিত তখনই হয়, যখন কেউ আপনাকে আশা দিয়ে আবার দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু এখানে প্রহর কখনো এমন কোন আশাই দেয়নি।সেতো আমাকে এসে বলেনি যে, এসো আমাকে ভালোবাসো। আর আমিও তাকে জিজ্ঞেস করে ভালোবাসিনি। আমি যেমন আমার ইচ্ছেই ভালোবাসেছি।সেও তেমন তার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে মানা করতেই পারে। তাহলে আত্মসম্মান ক্ষয় যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথাথেকে? তবে হ্যাঁ তার না কে হ্যাঁ তে পরিবর্তন করার যথার্থ চেষ্টা করতে আমি পিছু হটবো না। এতে আমার যতো এফার্ট করতে হয় করবো।সহজলভ্য কোন জিনিসের দাম থাকে না। সেখানে এটাতো ভালোবাসা। এতো সহজে পেয়ে গেলে কি আর তার মূল্য থাকবে? আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তারপরও যদি অপারগ হই। তাহলে ভাববো আমার ভালোবাসাতেই কোন কমতি ছিল। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন। এখন আমি আসি ভালো থাকবেন।
কথাটা বলে খুশি উঠে চলে গেল। আর রুশা খুশির যাওয়ার পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা যেন আজ ওকে ভালোবাসার নতুন সঙ্গা বুঝিয়ে গেল।
___
–এই এই আসছে আসছে তাড়াতাড়ি এক্টিং শুরু করে দে। ভালো করে করবি কিন্তু। ধরা পড়লে খবর আছে কিন্তু তোর।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খুশি ওর ক্লাসের বন্ধু শাহিন কে এসব কথা বলছে। ওরা আজ প্রহরের সামনে একটু এক্টিং করতে চায়। যেখানে সে প্রহরকে বুঝাতে চাইছে যে,কেউ তাকে হ্যারেস করছে। আর সেটারই প্রাকটিস করছে তারা। শাহিনের কাপড়চোপড় আর লুক সেভাবেই রাস্তার বখাটে ছেলেদের মতো করে দিয়েছে। তবে শাহিন বেচারা একটু ভীতু স্বরে বললো।
–আরে দোস্ত আমার না ভয় লাগছে। না মানে জিজু যদি সব বুঝে যায় তাহলে কিন্তু আমাকে ওয়ান পিচে বাসায় ফিরতে হবে না। জিজুর যে বডি। একখান পাঞ্চ পরলেই আমার কাম তামাম। বলছি কি আইডিয়া টা ড্রপ করলে চলে না?
খুশি দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–ওই শাহিন্যা মাঝপথে এসে ব্যাক আউট করলে কিন্তু তোর খবর আছে। আর দিয়ার লাইগ্যা যে পরাণ ডা উথালপাতাল করে। ওইডা কিন্তু ঠুস করে ফাটাই দিমু আমি। মনে রাখিস আমারে ছাড়া কিন্তু তোর পিরিতের রেলগাড়ী চালু হইবো না।
শাহিন অসহায় কন্ঠে বললো।
–দোস্ত তুই এতো ডমিনিটিং ক্যারে? কথায় কথায় এতো হুমকি দেস ক্যা? আমিতো চেষ্টা করছি।
প্রহরকে ভার্সিটির বাইরে আসতে দেখে খুশি তড়িঘড়ি করে বললো।
–ওই দেক আসছে। নে তাড়াতাড়ি শুরু কর।
খুশি নিজের হাত শাহিনের হাতের ভেতর দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে প্রহরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো।
–নেহিইই, ছেড়ে দে সয়তান। আমাকে ছেড়ে দে। বাঁচাও আমাকে কেউ বাঁচাও দয়া করে।
শাহিনও খুশির হাত ধরে ভিলেনি হাসি দিয়ে ওকে টিস করার এক্টিং করছে। প্রহররা দূর থেকে এসব দেখতে পেল। প্রহর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। খুশি সেটা দেখে মনে মনে আনন্দে লাফাচ্ছে। ওর প্ল্যান কাজ করছে। প্রহর নিশ্চয় আমাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই আসছে ইয়েএএএ। প্রহর ওদের কাছে এসে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। খুশি ওকে দেখে বলতে লাগলো।
–প্রহর দেখোনা এই গুন্ডা টা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ বাঁচাও আমাকে।
প্রহর এক ভ্রু উঁচিয়ে ছেলেটাকে দুই আঙ্গুলের ইশারায় কাছে ডাকলো। বেচারা শাহিনের তো ভয়ে কলিজা শুঁকিয়ে যাচ্ছে। তবুও ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল প্রহরের কাছে। প্রহর এক হাত উঠিয়ে শাহিনের কাঁধে রাখলো। শাহিনের ভয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। প্রহর চোখের সানগ্লাস টা খুলে ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–আচ্ছা তোমার মাথায় কি উপর ওয়ালা কিছু দেয়নি? মানে তোমার কি নিজস্ব কোন বুদ্ধিমত্তা নেই?
শাহিন ভয়ে ভয়ে ঘাড় কাত করে বললো।
–জ্বি জ্বি আছে তো।
–তাহলে তুমি এই পাগল মেয়েটার সাথে কি করছ?
প্রহরের কথায় খুশি চোখ বড়বড় করে তাকালো। প্রহর আরও বললো।
–শোন তোমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দেই। কান খুলে শুনে রাখো। যদি নিজের জীবনের ফালুদা করতে না চাও তাহলে এই পাগল মেয়েটার থেকে দূরে থাকো। আর হ্যাঁ এরপর যদি আবারও এসব নওটাঙ্কি করতে দেখেছি। তাহলে সত্যি সত্যিই দুজনকেই পাগলা গারদ পাঠিয়ে দিবো বুঝেছ?
শাহিন ভীতু স্বরে বললো।
–জ্বি জ্বি জিজ,,আই মিন ভাই বুঝতে পারছি। আর এমন ভুল হবে না।
–ওকে যাও এখন।
কথাটা বলে প্রহর আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো।উল্টো ঘুরে সানগ্লাস পড়তে পড়তে তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো আবারও হাসির রেখা। খুশির বোকার মতো কাজকর্ম দেখে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।
কিন্তু খুশি দমে যাওয়ার পাত্রী না। সে দ্রুত পায়ে প্রহরের সামনে এসে তেজী কন্ঠে বললো।
–এই এই এক মিনিট, তুমি আমাকে পাগল বললে কেন? আমাকে কোনদিক দিয়ে তোমার পাগল মনে হয়? হ্যাঁ আমি তোমার প্রেমে পাগল দিওয়ানি হতে পারি। তাই বলে আমার রুফ টপ একেবারে ফিট আছে বুঝেছ। তাই আমাকে পাগল বলার শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট রাবিশ? কিসের শাস্তি?
–হ্যাঁ শাস্তি। আর শাস্তি হলো এখন আপনি আমাকে ফুচকা খাওয়াবেন। তারপর আমাকে বাসায় ড্রপ করে দিবেন।
প্রহর দায় শাঁড়া ভাবে বললো।
–ইন ইউর ড্রিমস। আই উইল নেভার ডু দ্যাট।
–করবে নাতো?
–নেভার
প্রহর সোজা ওর গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। দ্যা গ্রেট খুশি তার ওভারঅল মেলোড্রামা শুরু করে দিলো। রাস্তার মাঝে ঠাস করে বসে পড়ে মরা কান্না শুরু করে দিলো। তারপর আহাজারি করতে করতে বললো।
–হায় আমার কি হবে এখন? আমার জামাই আমারে ছাইড়া চইলা যাইতাছে গো? কেউ কিছু করো। কেউ আমার বিচার করো।
খুশির আচমকা এ্যাকশনে তব্দা খেয়ে গেল প্রহর। আশেপাশের সব লোকজনও তাকিয়ে রইলো। প্রহর খুশির সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–হোয়াট দ্যা হেল? হোয়াট ইজ দিস ননসেন্স? স্টপ দিস রাইট নাও। গেট আপ খুশি। গেট আপ রাইট নাও।
খুশি তার ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিলো। আশেপাশের লোকজন এসে বলতে লাগলো।
–কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?
খুশি দুখিয়ারি কন্ঠে বলে উঠলো।
–কি কমু দুঃখের কথা খালা। আমার জামাই আমারে রাস্তার মধ্যে ফালাইয়া চইল্যা যাইতাছে। আমি অহন কি করুম? আপনেরা একটু এই অবলার বিচার করেন। তারে একটু কন আমারে যেন এমনে ফালাইয়া না যায়।
একজন মহিলা প্রহরের সামনে এসে বললো।
–এইযে বাবা তুমি তোমার বউয়ের সাথে এমন করতাছ কেন? দেখছ কতো কানতাছে মাইয়াডা? তোমার কি মায়াদয়া নাই?
প্রহর দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–হোয়াট রাবিশ। কার বউ?কিসের বউ? সি ইজ নট মাই ওয়াইফ।
খুশি আরও জোরে জোরে আহাজারি করে বললো।
–হায় হায় দেখছেন আপনেরা? অহন আমারে সে বউ বইলাও স্বীকার করবার চায়না। অহন মোর কি হইবে? আমার মরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এবার আশেপাশের লোকজন প্রহর কে বলতে লাগলো।
–আরে ভাই এমন করছেন কেন? নিজেদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা বাসায় গিয়ে সলভ করুন। এভাবে রাস্তার ভেতর তামাশা করাটা কেমন দেখায়? প্লিজ ভাই আপনার বউকে সাথে করে নিয়ে যান।
প্রহর পড়ে গেল মহা বিড়ম্বনায়। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর। মেয়েটা কি নাটক শুরু করে দিয়েছে। এখন এই লোকজনকে কিভাবে বুঝাবে? শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে খুশির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–চলো,,
ব্যাস খুশির সব কান্না শেষ। ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ চলো সোয়ামালাই।
খুশি যেতে যেতে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করে গেল।
__
খুশি ওর কথা অনুযায়ী প্রহরকে নিয়ে ফুচকার দোকানে এলো। রাস্তার পাশে এভাবে খোলা দোকানে এই প্রথম প্রহর আসলো। অস্বস্তিতে শরীর ছেয়ে যাচ্ছে ওর। এখানকার আনহায়জেনিক খাবার দেখে নাক কুঁচকে আসছে ওর। প্রহর খুশির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো। –তুমি এখানকার এই আনহায়জেনিক খাবার খাবে? জানো এসব খাবারে কতে ব্যাকটেরিয়া আছে? ফুচকা খেতেই হয় কোন ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাও।
–আরে কি বলছো তুমি? ফুচকার আসল মজা তো এসব রাস্তার স্টল গুলাতেই। আর এই মামার ফুচকা সবচেয়ে বেস্ট। একবার খেয়ে দেখ সারাজীবন মুখে লেগে থাকবে।
–ওহ প্লিজ। আমি আর এইসব স্ট্রিট ফুড? ডোন্ট ইভেন থিংক। তোমার খাওয়া লাগে তাড়াতাড়ি করে খাও আর আমাকে ছাড়।
–কিহ? তারমানে তুমি কখনো ফুচকা খাওনি? তুমি তো জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া মিস করেছ বস। আরে ফুচকা শুধু ফুচকা না। এটা হলো অমৃত। যা খেলে জীবন ধন্য হয়ে যায়। আরে জীবনে একবার ফুচকার স্বাদ না নিলে, তুমি মরে গেলেও মুক্তি পাবে না। তোমার অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে। বুঝতে পেরেছ?
–দরকার নেই আমার ধন্য হওয়ার। তুমি খেলে খাও। নাহলে আমি চলে গেলাম।
খুশি বাঁকা হেসে মনে মনে বললো, আজ তো তোমাকে অমৃতর স্বাদ গ্রহণ করিয়েই ছাড়বো। খুশি ফুচকার অর্ডার দিলে ফুচকা ওয়ালা মামা ওকে এক প্লেট ফুচকা দিল। খুশি দু তিনটে খাওয়ার পর হঠাৎ প্রহরের হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে দিল। প্রহর ব্যাথার বহিঃপ্রকাশ করার জন্য মুখ খুলতেই খুশি ফট করে একটা ফুচকা প্রহরের মুখের ভেতর পুরে দিলো। মুখে পুরে দিয়েই মুখের ওপর হাত চেপে ধরে বললো। –দেখ ফেলে দিবে না কিন্তু। নাহলে কিন্তু আমি আবারও এখানে কান্নাকাটি শুরু করে দিবো। প্লিজ খাওনা শুধু একটা। আমার জন্য প্লিজ….
শেষের কথাটা অনেক টা অনুনয়ের সুরে বললো খুশি। প্রহরের হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল। সে কেন যেন খুশির কথা ফেলতে পারলোনা। তাই অগত্যা ফুচকা টা কোনরকমে গিলে নিলো সে। প্রহরের ফুচকা খাওয়া দেখে খুশি অসামান্য কোন কিছু পাওয়ার মতো অমায়িক এক হাসি হাসলো। সে হাসিটায় যেন অন্যরকম এক মোহনীয়তা ছিল। একদম নিস্পাপ সেই হাসি। আমাকে ফুচকা খাইয়ে কি এমন খুশি পেল এই মেয়েটা? যার প্রতিফলন স্বরূপ সে এমন করে হাসছে। যে হাসিটা প্রহরের গড়ে তোলা শক্ত দেয়ালে সজোরে আঘাত হানছে। তবে কি এই খুশি নামের বুলডোজার টা সত্যিই ওর দেয়াল ভেঙে গুড়িয়ে দিবে?
চলবে…….
গল্পের লেটেস্ট আপডেট পেতে আর গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে জয়েন হওয়ার আমন্ত্রণ রইল। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। 👇
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/