#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৩০
সেহেরিশ এবং আফীফ দুজন দুজনের মুখোমুখি বসে আছে। একজনের চোখে রাগের আভাস অন্য জনের মাঝে হতাশার।
– সেহেরিশ?
আফীফ সেহেরিশকে ডাকছে কিন্তু তার হুশ নেই সে তার ভাবনায় মশগুল।
– সেহেরিশ?
এবারো সেহেরিশের রেস্পপন্স নেই।আফীফ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।সারা রুম জুড়ে পাইচারি করে আবার তার সামনে বসে।এবার সেহেরিশের দু’হাতে ঝাকিয়ে ডাকতে থাকে,
– সেহেরিশ?
– হাহ।
– কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?আমি ডাকছিলাম তোমায়।
– ওওওও।
– ওও কি?তোমার মাঝে এত উদাস ভাব কেন?আর বাচ্চাটার সমস্যা কি?দুনিয়াতে আসার নাম নিতেই তুমি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাইছ।এটা তো একটা মায়ের বৈশিষ্ট্য নয়।
সেহেরিশ শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে।আফীফের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলে,
– আমি মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখেছি।বাচ্চাটার কোন প্রয়োজন নেই।আমায় হাসপাতালে নিয়ে চলুন বাড়ির মুরব্বিরা জানার আগেই বাচ্চাটার চিহ্ন বিলীন করে দি।
সেহেরিশের কথা শেষ করতে দেরি হলো কিন্তু তার গালের চড়টা পড়তে মোটেও দেরি হয়নি।আফীফ ক্ষেপেছে তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার মাঝে ঘুমন্ত রাগান্বিত সত্তাটা আবার জেগে উঠেছে।হঠাৎ আক্রমণে সেহেরিশের মাথাটা যেন হ্যাং হয়ে গেছে।দীর্ঘ আড়াই বছর বিবাহিত জীবনে আফীফ তার ভুলের জন্য নানান ভাবে শাস্তি দিয়েছে কিন্তু কখনো চড়/থাপ্পড় মারে নি আর আজ সেটাও করে দেখালো।বোঝায় যাচ্ছে বাচ্চাটার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে আফীফ।
ফর্সা গালটায় তিন আঙুলের ছাপ স্পষ্ট।লালভাব ফোলা গালটার দিকে তাকিয়ে ‘ফস’ করে শ্বাস ছাড়ে আফীফ।নিজেকে স্থির করে সেহেরিশের দু-হাত নিজের মুঠোয় নেয়।
– তোমার সমস্যাটা কি বলবে আমায়?হঠাৎ এমন বিহেভিয়ারের মানে কি?
– আ..আমি যা বলছি ভেবে চিনতে বলছি।বাচ্চার প্রয়োজন নেই আমার।অন্তত এই বন্দি জীবনে একটা বাচ্চা সুস্থ ভাবে মানুষ হতে পারবেনা।
– তোমার কি ধারনা বাচ্চা আমার এখানে থাকবে?
– মানে?
আফীফ উওর দিল না। দাঁড়িয়ে রুমের চারিপাশে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বলে,
– মনে আছে সেদিন রাতের কথা,মারুফা ফুফুর কারনে বাড়ির সবাই ঘুমে তলিয়ে যায়।যার কারনে শক্রু পক্ষ হামলা করতে সুযোগ পায়।পুলিশ কেসেও যানতে চেয়েছিল ঘুমের ওষুধের প্রয়োগ কে করেছিল?আমি সেদিন সবার মুখ বন্ধ করে বলেছিলাম কাজটা শক্রু পক্ষের লোক করেছিল।ভাবতে পারছো?পুলিশদের যদি আমি সত্যিটা জানিয়ে দিতাম বর্তমানে তোমার বাবার যেটুকু সম্মান আছে তাও মাটিতে মিশে যেত।পুলিশ আগে তাদের হ্যারেসম্যান্ট করতো।এখন যদি আমি আবার পুলিশকে সত্যিটা বলি বিষয়টাকি ভালো হবে?
সেহেরিশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে আফীফ তাকে ব্লাকমেইল করছে।তাই সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।
আফীফ এবার তার পাশে বসে।সেহেরিশের কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– ব্লাক হাউজে আসার খুব শখ ছিল তোমার।আর তোমার শখ আমি অপূর্ণ রাখিনি।এবার বলো এই ব্লাক হাউজে থাকার দেড় বছরের অনুভূতি কী?
সেহেরিশ উওর দিল না মাথাটা নুইয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো।আফীফ সেহেরিশের উওর না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ মনে মনে বলে,
– আপনি পাশে থাকলে এই ব্লাক হাউজে সারাজীবন পার করতে পারবো।
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেহেরিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায়।ঘুমন্ত অবস্থায় সে অনুভব করে সে ভাসছে।অল্প সময়ে চোখ খুলে তাকাতেই আফীফের কোলে নিজেকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
– আরে কি করছেন কি?
– ইসসস।কথা নয়।চোখ বন্দ করো ফুলপরী।
– কিন্তু কেন?
– চোখ বন্ধ করতে বলেছি চোখটা বন্ধ করো।এত প্রশ্ন করবে না।
সেহেরিশ চোখ বন্ধ করলো না উলটো আফীফের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে।তার আচরণে আফীফ বিরক্ত হয়ে কোল থেকে নামিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়।আফীফের কর্মকান্ড সেহেরিশের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– কি করছেন আপনি বলবেন আমায়?
– তোমায় এই ব্লাক হাউজের সবচেয়ে ভয়ংকর রুমটায় নিয়ে যাবো।যেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
সেহেরিশ ভয়ে আফীফের কলার চেপে ধরে।ভীতু কন্ঠে বলে,
– প্লিজ আফীফ আপনি এমনটা করবেন না।প্লিজ আমি আপনাকে ছাড়া আর কোথাও থাকবো না।
– চুপ থাকো তুমি।
আফীফের ধমকে চুপসে যায় সেহেরিশ।আফীফ সেহেরিশকে নিয়ে দেওয়ান বাড়ির বাসগৃহে প্রবেশ করে।সেখানে সেহেরিশের অপেক্ষায় সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে।দরজার সামনে সেহেরিশকে নামিয়ে দিতেই আমান সেহেরিশের গায়ে ফুল ছুড়তে থাকে।আফীফ সেহেরিশের চোখের বাধন খুলে দিতেই বাড়ির সবাইকে দেখে চমকে যায় ।তার কাছে এটি লোমহর্ষক ঘটনা।আমান সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে,
– ভাবী আগের বার আমি বরন করেছিলাম এবারো আমি করলাম।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।সে সবকিছু তাকিয়ে দেখছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে।আফীফ তার কানের সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আজ থেকে তবে এই বাড়িতেই সংসার শুরু হোক!
সেহেরিশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।তার আগমনে জুহি খুশী হয়ে জড়িয়ে ধরে।একে একে বাড়ির সবাই তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।হারানো দিন গুলো ফিরে পেয়ে সেহেরিশের চোখের কোনে পানি জমে গেছে।
.
আফীফের রুমে ফিরে আসতেই কাকাতুয়া পাখিটি সেহেরিশের ঘাড়ে চড়ে বসে।এতদিন আফীফের অনুপস্থিতিতে পাখিটি জুহির সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে।
– ফুলপরী ফুলপরী।
– হাহ!এতদিন তুমি তোমার ফুলপরীর খোঁজ নিয়েছিলে?
– রাজা ভালো নেই।রাজা ভালো নেই।
পাখিটি একমনে কথা গুলো বলতে বলতে আবারো উড়ে যায় সেহেরিশ পাখিটার কথার মানে বুঝলো না।আফীফ সেহেরিশের পেছনে এসে দাঁড়ায় এবং গমগম সুরে বলে,
– আজ থেকে আমরা এখানেই থাকছি।
– সত্যি?
– হুম।এই পুরো ঘরে তোমার চলাচলের অনুমতি দিলাম।তবে ঘরের বাইরে গেলে একমাত্র আমার সঙ্গে যাবে।ছাদে,বাগানে আমায় ছাড়া যেতে পারবেনা।
– ঠিক আছে তবে তাই হোক।
– এবার যাও রেস্ট নাও।কাঁচা ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিলাম তোমায়।
সেহেরিশ বিছানার কোনায় বসে যায়।পুরো রুমে চোখ বোলাচ্ছে এখানো সব আগের মতো আছে।আফীফ সেহেরিশের চিন্তিত মুখটা দেখে তারপাশে বসে যায়।কাধের উপর হাত তুলে দিয়ে ডানগালটা দিয়ে কাছে টেনে বাম গালে গাঢ় করে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।আফীফের চড়ের ব্যাথাটা এখনো রয়ে গেছে তার উপর এমন ছোঁয়ায় সেহেরিশ কুঁকড়ে উঠে।
– আহ্।আফীফ কি করছেন।
আফীফ ছাড়লো না।শেষ পর্যায়ে সেহেরিশ চুপচাপ আফীফের স্পর্শ অনুভব করতে থাকে।আফীফ মুখ তুলে তাকায় সেহেরিশের দিকে।
– চড় টা দেওয়ার জন্য ক্ষমা চাইবো না।যা বলেছো তার জন্য আরেকটা চড় তোর প্রাপ্য।তবুও নিজের মাঝে খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়েছে তাই আদর করে দিলাম।
_
চালের আড়তে আফীফ সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কি না দেখতে এসেছে।তখনি দোকানের একজন ছেলে এসে আফীফকে বলে,
– ভাইজান আপনার শশুড় আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।
– আসতে বল।
খুরশীদ আনওয়ার বর্তমানে চন্দনপুরেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন।এদিকে অনন্তপুরের জমিগুলোর কাগজ যে আফীফের দখলে ছিল তা জানতে পেরে আফীফের কূটকৌশল সম্পর্কে প্রশ্নংসা না করে পারলেন না।
– আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিচ্ছিস না কেন?
– আরে আব্বা আসসালামু আলাইকুম!
– রসের আলাপ করতে আসিনি।আমার মেয়েকে ফেরত দে।
– আরে আজব আপনার মেয়েকে আপনি কী আমার কাছে বন্ধক রেখেছেন?যে বললেন আর আমি দিয়ে দেবো।সে আমার বিবাহিত স্ত্রী।
– শুনো ছেলে অনেক জ্বালিয়েছো আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।তোমার এইসব খেলা এবার বন্ধ করো।
– আসলেই জানেন আব্বা আমারো আর ভাল্লাগছে না এমন।কিন্তু আমার যে পুরোনো হিসাব বাকি।আমার সাথে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে কেন এত পায়ঁতারা তা কিন্তু আমি জানি।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।যদি সবটা স্বাভাবিক ভাবে হতে দিতেন আমার শশুড় হিসেবে আপনার মানসম্মান রক্ষার্থে আমি নিয়োজিত থাকতাম যেহেতু আসল দোষটাই আপনি করেছেন তাই আমি আজ হাত পা বন্দি।
– তোমার কাছে আমি জ্ঞান নিতে আসিনি।আমি আমার মেয়ের খোঁজে এসেছি।
– আলহামদুলিল্লাহ আপনার মেয়ে ভালো আছে।আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি নানাভাই হতে চলেছেন।সেহেরিশ প্রেগন্যান্ট।
আফীফের শেষ বাক্যটা খুরশীদ আনওয়ারের কানে বজ্রের ধ্বনির মতো লাগলো।
– কি বলছো এইসব?
– আরে বাপ ব্যাটি দেখি এক স্বভাবের সু সংবাদ শুনলে আগে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে হয় আর এদের মাথায় যেন বজ্র পড়ে।
– এটা কোন সু সংবাদ নয়।আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাবো।ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবো।
খুরশীদ আনওয়ারের কথা শুনে স্থির থাকতে পারলো না আফীফ।দু’পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাত চেপে রুষ্ট কন্ঠে বলে,
– যদি সেহেরিশকে নিয়ে যাওয়ার সাহস করেন তবে আমার লাশের উপর দিয়ে নিতে পারবেন তার আগে নয়।
খুরশীদ আনওয়ার আর কিছু বললেন না। চুপচাপ চলে গেলেন নিজ গন্তব্য।
.
কেটে গেলো পাঁচ মাস।সেহেরিশের পাগলামো দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। আফীফ সারাক্ষণ তার খোঁজ খবর রাখতে ব্যস্ত।কিন্তু যখনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় জুহির আমানতে রেখে যায় তাকে।সেহেরিশের একটাই কথা সে বাচ্চাটা রাখবে না।আফীফের ভাবতেই কলিজা ফেটে যাচ্ছে সেহেরিশের জন্য কোন সুযোগ সুবিধার সে কমতি রাখেনি,ভালোবাসার কমতি রাখেনি, এই বাড়ির কোন সদস্য তাকে অনাদর করছে না।তবে সে এমন বিহেভিয়ার করার কারনটা কি?
– সেহেরিশ তুমি এমন করার কারন কি?তুমি যা চাইবে তাই দেবো তুমি শুধু আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে অবহেলা করবে না প্লিজ।
– এইসব ন্যাকাবোকা কথা রাখুন আপনার কাছে। বাচ্চা আমার প্রয়োজন নেই।যদি একান্ত আমাকে আপনার প্রয়োজন হয় তবে একান্ত আমি আপনার জীবনে থাকবো বাচ্চার কি প্রয়োজন?
সেহেরিশের অর্থহীন কথায় আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।ইচ্ছে করছে কষে একটা চড় মারতে কিন্তু সে পারবেনা।ভুলেও না।
– সেহেরিশ তোমার জীবনে আমি সব কিছু ফিরিয়ে দেবো তুমি শুধু বাচ্চাটার খেয়াল রেখো।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলোনা।ভারী শরীরটা নিয়ে পাশ কাটিয়ে শুয়ে যায় আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
সকালের আলো ফুটেছে অনেক আগেই।এখন দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়।আফীফের অনেক আগে ঘুম ভাঙ্গলেও সেহেরিশের ঘুম ভাঙ্গেনি।আফীফ তার কপালে চুমু এঁকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।বেলা এগারোটা যখন পার হয়ে যাচ্ছে তখনি সেহেরিশের ঘুম ভাঙ্গে।আড়মোড়া কাটিয়ে উঠতে নিলেই মুখের উপর তপ্ত শ্বাসে নড়ে উঠে।তার দিকে ঘোরে তাকিয়ে আছে আফীফ।
– কি হয়েছে এমন তাকিয়ে আছেন কেন?
– মাতৃত্বকালীন নাকি মেয়েদের রূপ বেড়ে যায়?সৌন্দর্য দিগুন বাড়ে তাদের মাঝে ভর করে কোমলতা পবিত্রতা।আমার সেহেরিশকেও এখন দেখতে তেমন লাগছে।ইসস আমার কোমল মতি।
– সাত সকালে আপনার বকবক শুরু হয়ে গেলো।
– হুম।আল্লাহ আমার প্রতিটি দিন যেন, আমার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে শুরু করার তৌফিক দান করেন!
চুপচাপ সেহেরিশ আফীফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।আফীফ তাকে একটানে তুলে বসায়।চিরুনিটা হাতে নিয়ে সেহেরিশের চুল আছড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,
– আরেহ কি করছেন কি?সকাল সকাল চুল নিয়ে পড়লেন কেন?
– পাগলীর মতো লাগছে তোমায়।দেখলে তুমি দেড় বছরে আমার যত্নে তোমার চুল এখন কোমড় ছুঁয়ে গেছে।
– হুহ।আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বেলু হয়ে যাই।অসহ্য লাগে।
– চড় তবে একটাও ডানে বামে যাবে না।নিশানা ঠিক ঠাক থাকবে।
দুপুরের খাওয়ার শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বারান্দায় যেতেই সেহেরিশের কানে আসে পরিচিত কারো কন্ঠ।ঘুরে তাকাতে নিজের মাকে দেখে দু’চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না সে।ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে আছে সে স্থির দৃষ্টিতে তার চোখ দেখে মনে সে যেন অবাস্তব কিছু বাস্তবে পরিনত হতে দেখেছে।
– মামনি?
– তোর মাকে জড়িয়ে ধরবি না?
– তুমি সত্যি এসেছো?
– আমরা সবাই এসেছি।
সেহেরিশ দেরি করলো না ঝাপিয়ে পড়লো তার মায়ের বুকে।জোরে জোরে কাদঁতে কাদঁতে একটা সময় স্থির হয়ে হয়ে গেলো।চোখ তুলে মায়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।ফর্সা কোমল ঘেরা মায়ের মুখটা কেমন যেন তার কাছে ফ্যাকাশে লাগছে।মা হাসতে চেষ্টা করলেও মনে হচ্ছে বেশ কয়েকবছর মা হাসেন নি।
– মামনি তুমি ভালো আছো?
সেহেরিশের এমন প্রশ্ন ফাহমিদার কাছে হাস্যকর লাগলো।মেয়ে ছাড়া ভালো থাকবেন কি করে তিনি?
– ভালো।তুই?
– হুম ভালো।বাবা, ফুফু,সামী কই?
– তারা আছে নিচে চল।
সেহেরিশকে নিয়ে নিচে চলে গেলো ফাহমিদা।আফীফ সবার সাথে হাসিখুশি কথা বলছে কিন্তু খুরশীদের সাথে মোটেও কথা বলেনি।বাড়ির সবার মাঝে আবারো আত্নীয়তা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।সেহেরিশের পরিবার সন্ধ্যার পরেই চলে যায়।এই পুরো সময়টাতে সেহেরিশের আশেপাশে নানান উচিলায় থেকেছে আফীফ।
সেহেরিশের হাসিখুশি মুখটা দেখে আফীফের মাঝে প্রশান্তি সঞ্চার ঘটে।
– আমি জানতাম তোমার পরিবারের জন্য তুমি এতটা ভেঙ্গে ছিলে তাই তাদের আবার ফিরিয়ে এনেছি।তোমাকে খুশি করতে সব করতে পারি শুধু তোমায় ছাড়তে পারবো না।
অন্যদিকে আফীফ সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে আর তা বুঝতে পেরে সেহেরিশ মনে মনে বলে,
– জানতাম এমনটাই হবে।বাচ্চার জন্য যে আপনি কতটা পাগল তা আমি আগেই বুঝেছিলাম।সেদিন আমার প্রেগন্যান্সির শিওর হয়ে আমি খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলাম।কিন্তু আপনাকে আমার খুশি মুখটা দেখাই নি।অভিনয় করে গেছি।বলেছি বাচ্চা আমার চাইনা।আমি জানি আমার দেখা শোনার জন্য আপনি আমায় দেওয়ান বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন কিন্তু আমার বাবা-মাকে না।বাচ্চা রাখবো না বলে ফোর্স করতে করতে একটা সময় যখন আমি মনমরা হয়ে যাই তখনি বাবা-মাকে হাজির করে আমাকে খু্শি করার ব্যবস্থা করলেন।আমি যেমন আপনাকে ভালোবাসি তেমন আমার পরিবারকে তাই অতীতের সমাপ্তির জন্য হলেও নাটক আমায় চালিয়ে যেতে হবে।
সেহেরিশ শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে।দিন দিন ক্লান্তিটা বেড়েই যাচ্ছে।
_
সেহেরিশকে রুমে রেখে আফীফ বাড়ির সকলের সঙ্গে একসাথে রাতের খাওয়ার খেতে বসে।আহনাফ দেওয়ান সহ বাড়ির সবাই সেহেরিশের পরিবার সম্পর্কে আলাপচারিতা করতে ব্যস্ত।সবার কথার মাঝে মুনিফ আফীফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– দেখ আফীফ ভাই যাই করেছিস তোর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সেহেরিশকে ভালোবাসা।এই মেয়েটা অভিশাপ তোর জীবনে আশার পর থেকেই একের পর এক ধ্বংস লিলা শুরু হয়েছে।
মুনিফের কথায় ধমকে উঠে আহনাফ দেওয়ান।কিন্তু তাতে পাত্তা দিলো না সে।আফীফ চুপচাপ ভাত মাখছে আর মুনিফের কথা হজম করছে।
– সেহেরিশের বাবা মাকে আবার এই বাড়িতে এনে মোটেও ভালো করিস নি।সব বেইমানের দল।যত্তসব ফালতু লোক।
মুনিফ থামে এবারেও আফীফ কিছু বলেনি।চন্দনা নিজের ছেলের দিকে কিড়মিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।তিনি জানেন আফীফের নিরবতা মানে ঝড়ের পূর্বাভাস।মুনিফ আবার বলে,
– আফীফ ছোট হলেও তোকে একটা এডভাইস দিচ্ছি সেহেরিশকে ছেড়ে দে এইজীবনে তোর জন্য মেয়ের অভাব হবেনা।তুই তো সেহেরিশের পরিবারকে শাস্তি দিতে চাস তাই না?তাহলে এখনি উপযুক্ত সময় সেহেরিশকে ডিভোর্স দে।সে না পারবে বাচ্চাটাকে মারতে আর না পারবে কলঙ্ক দূর করতে।
মুনিফের কথা শেষ করতে দেরি হলো কিন্তু তার উপর আফীফের আক্রমণ করতে দেরি হলোনা।মুনিফের কলার চেপে আফীফ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,
– অনেক সহ্য করেছি তোর লুকোচুরি নাটক।সেহেরিশের গায়ে কলঙ্ক লাগবে কেন?সে আমার বিবাহিত স্ত্রী আর আমার বৈধ সন্তান তার পেটে।তোর খেলা আর নয় এবার সমাপ্তি। আসল কালপিট যে তুই আমি ভালো করেই জানি শুধু চুপ ছিলাম।তবে এবার আমার কলিজায় আঘাত দিলি তুই এবার শেষ।
আফীফ টানতে টানতে মুনিফকে নিয়ে ব্লাক হাউকে যায়।অন্ধকার একটি রুমের দিকে তাকে ছুড়ে মেরে বাকা হেসে বলে,
– ওয়েলকাম টু মাই ব্লাক হাউজ!
#চলবে
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌