#অন্ধকার_মানব(The unpredictable love)
#পর্বঃ২৭
লিখা✍️তাজরিয়ান খান তানভি
পাখিরা যদি বন্দিশালা থেকে মুক্তি পায় তাহলে কেমন অনুভূত হয়!!দ্বিধার আজ তেমনই মনে হচ্ছে।অনেকদিন পর সে আজ ভার্সিটিতে এসেছে।কেমন যেনো সব নতুন নতুন মনে হচ্ছে।
কলেজের মাঠে পৌছতেই রিপ্তি ওকে জড়িয়ে ধরলো।
“এতোদিন পর কলেজের কথা মনে পড়লো?
“কি করবো বল,পাপাই তো আসতে দিচ্ছিলো না।”
“তার মানে আঙ্কেল জাদ কে মেনে নিয়েছে?
“হুম।”
“বাহ!!ভালোই।”
দ্বিধার এদিক ওদিক তাকানো দেখে রিপ্তি আবার বলে—
“কাউকে খুজছিস?
“জাদ আসেনি?
“না তো।ও তো এ কয়েকদিন আসেনি।”
রিপ্তি ওর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি এনে আবার বলে–
“তুই যখন এসে পড়েছিস জাদ ও আসবে।”
তখনই রিপ্তির চোখ যায় দ্বিধার পিছনে কলেজের মেইন গেটের দিকে।
“ওই যে আসছেন আপনার হিরো।”
দ্বিধা পিছন ফিরে তাকাতেই জাদ কে দেখে পুরোই অবাক।গায়ে হালকা ব্রাউন রঙের শার্ট আর কালো জিন্স।
প্রথমবার যখন দ্বিধা জাদ কে দেখেছিলো মনে হয়েছিলো যেনো দিনের আলোয় আচ্ছাদিত এক অন্ধকার প্রদীপ শিখা যে জ্বলতে চায় কিন্তু তার তমসার জন্য পারছে না।কিন্তু আজ সম্পূর্ন বিপরীত।যেনো চাঁদের আলোয় সদ্য স্নান করে এসেছে জাদ।ওর আলোয় সমস্ত অন্ধকার আজ মিলিয়ে যাবে।
“কিরে এমন করে কি দেখছিস ওর দিকে?
রিপ্তির হাতে ধাক্কায় দ্বিধার চিন্তার ঢেউ স্থির হয়।
“কিছু নাতো।”
“জাদ কে কিন্তু আজকে ড্যাশিং লাগছে,তাই না বল?
“হুম,,,মানুষের মতো লাগছে।”
রিপ্তি ভ্রুক্রুটি করে বলে–
“মানে??
“কিছু না।”
এর মাঝেই জাদ এসে দাড়ায় সেখানে।
“কেমন আছো রিপ্তি?
“ভালো,তোমার এতো পরিবর্তন?আগে তো কালো কাপড় ছাড়া তোমাকে দেখাই যেতো না।”
“নতুন প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি।”
দ্বিধা আড়চোখে তাকায় জাদ এর দিকে।
“আচ্ছা তোরা কথা বল আমি আসছি।”
“ওকে।”
“আপনি একা যে,,,আপনার বডি গার্ড কোথায়?
আজকাল তাকে দেখাই যায় না।”
“ও মোটেও আমার বডিগার্ড নয়। ও আমার বন্ধু।”
“সে যাই হোক।তিনি এখন কোথায়?
“জানিনা।সকালে কোথায় যেনো গিয়েছে।আজকাল কোথায় যে থাকে কে জানে।রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ায়।আপনার মতো নিশাচর হয়েছে।”
“আমি নিশাচর??
“তা নয়তো কি!!
“তা এভাবে গিলে খাচ্ছেন কেনো আমাকে?জীবনে ছেলে দেখেন নি?
জাদ এর কথায় দ্বিধা বেশ লজ্জা পায়।
“এতো অসভ্য কেনো আপনি??
“আমি অসভ্য,,তাই না.,,..
বলেই দ্বিধা কে একটানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ওর অধরে নিজেকে ডুবিয়ে নেয়।দ্বিধা ছাড়াতে চাইলেও জাদ ওর ডান হাত নিজের বাম হাতে নিয়ে বুকের সাথে ধরে রাখে। আরেক হাত দিয়ে দ্বিধার বাম হাত পিছনের দিকে নিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ কর রাখে।
দ্বিধার অনবরত নাড়াচাড়া তে জাদ ওকে ছেড়ে দেয়।
দ্বিধা হাতের উল্টোপাশ দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বলে—-
“অসভ্য,বেয়াদব,লুচু কোথাকার।লজ্জা করে না আপনার??
“লজ্জার কি আছে?আমি কি অন্য কাউকে চুমু খেয়েছি নাকি?আপনাকেই তো।”
জাদ নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট ঘষে বলে—
“আপনার ঠোঁটের স্বাদ কিন্তু ভীষন মিষ্টি।কি দেন ঠোঁটে বলুন তো?
“আপনি আসলেই একটা মিচকা শয়তান।এমন ভাব দেখান যেনো কিছুই বুঝেন না।
মেয়েদের ঠোঁটের স্বাদ নিয়ে তো বিশাল পি এস ডি করেছেন।ভালোই এক্সপেরিয়েন্স।”
“তাতো হাজার খানেক হবেই।”
জাদ এর কথায় দ্বিধার চোখ পুরোই গোল আলু।
“মানে??
“এই পর্যন্ত হাজারখানেক আস্বাদন তো করেছি,জীবনাবসান হতে হতে আরোও হাজার খানেকের এক্সপেরিয়েন্স তো হবেই।”
“ছিঃ,কেমন মানুষ আপনি?
মাঠের মধ্যখানে হঠাৎ কোলাহল শুনে ওরা সেখানে গিয়ে দেখে কয়েকজন শিক্ষার্থী জটলা বেধে আছে।
ওদের সরিয়ে দেখে রিপ্তি ভ্যা ভ্যা করে কাদছে।
“কি রে কি হয়েছে তোর?
“আমার পা টা গে লো রে,,,
শয়তান ছেলেগুলা আর বল খেলার জায়গা পেলো না।বলটা আমার পায়েই মারতে হইলো।”
“একটু দেখে হাটতে পারিস না?
রিপ্তি আবারও ভ্যা ভ্যা করে কাদতে লাগলো।জাদ দ্বিধা কে বলল—
“আপনি চুপ করুন।”
জাদ রিপ্তি কে কোলে তুলে নেয়।দ্বিধা অকস্মাৎ চোখ রাঙিয়ে বলে—
“কি হলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে??
“হসপিটালে,,,দেখছেন না ওর পায়ে ব্যথা পেয়েছে।”
“নিয়ে যাবেন ভালো কথা।ওকে কোলে নেওয়ার কি আছে?
“সুধানিধী,,আপনি এতো হিংসুটে কবে হলেন??
দ্বিধা ভ্রু বাকিয়ে বলে–
“কি বললেন আপনি??
“যা শুনেছেন তাই বলেছি।
আর আপনি এখানেই থাকুন।আমি না আসা পর্যন্ত কোথাও যাবেন না।”
জাদ রিপ্তি কে কোলে নিয়ে চলে যায়।
দ্বিধা সেখানে দাড়িয়ে দাঁত কটমট করে বলে—
“ইশশ,,,কোথাও যাবেন না।এমন ভাবে বলছেন যেনো আমি ওনার ঘরের বৌ।”
.
.
.
রিপ্তি কে পায়ের গোড়ালি তে প্লাষ্টার করে দিয়ে ডক্টর এনাম বলল—
“সামান্য ফ্র্যাকচার হয়েছে।কিছুদিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওকে ডক্টর।”
রিপ্তি জাদ কে কৃতজ্ঞতা জানায়।
জাদ রিপ্তির পাশেই বসে ছিলো।হঠাৎ জাদ এর হাত আর পা কাপতে শুরু করলো।মাথাটা ভিতর কেমন যেনো ঝনঝন শুরু করলো।ও চোখ বন্ধ করে কিছু একটা দেখতে এবং অনুভব করতে লাগল।ধুম করে চোখ খুলে হুট করে দাড়িয়ে ও রিপ্তি কে বলল–
“আমি আসি রিপ্তি।তুমি তোমার বাবা কে বলো তোমাকে নিয়ে যেতে।”
নিজের কথা শেষ করে জাদ আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সেখান থেকে চলে যায়।
.
.
পুরো ড্রয়িং এর জিনিষপত্র উলোট পালোট করে অগ্নিচোখে তাকিয়ে আছে রিশাল মি.আর মিসেস ইন্দ্রিয়াজ এর দিকে।ক্ষরস্রোতা নদীর মতো উত্তাল কন্ঠে রিশাল বলে উঠে—
“আজ আপনাদের আমার হাত থেকে কেউ বাচাতে পারবেনা।”
আইভান আর ফ্রিদা ভয়ে সংকুচিত হয়ে দাড়িয়ে আছে।
আইভান চিৎকার করে বলে–
“তুমি ভুল করছো রিশাল।”
রিশাল তার হাতে থাকা একটি বোতল থেকে পবিত্র পানি ওদের গায়ে ছিটাতে গেলেই জাদ ওর হাত চেপে ধরে।
“এইসব কি হচ্ছে রিশাল?
“কি হচ্ছে বুঝতে পারছিস না?
রিশাল তার দু হাত দিয়ে জাদ এর গলা চেপে আবার বলে—
“কেন মারলি আমার বাবাকে?কেনো কেড়ে নিলি তাকে আমার কাছ থেকে?
জাদ অবাক দৃষ্টিতে বলে—
“মানে,,;কি বলছো তুমি?
কে তোমার বাবা?
রিশাল জাদ কে ঝাকিয়ে বলে–
“রায়হান,,
রায়হান আজাদ।”
“তুমি রায়হান আজাদ এর ছেলে?
“হ্যাঁ,,,আমি তার ছেলে।যাকে তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস?
“ভুল করছো রিশাল।আমি তোমার বাবাকে মারিনি।”
রিশাল ওর হাত এ থাকা একটা ডায়েরি ভাজ খুলে জাদ দিকে ধরে যেখান জাদ এর একটা স্কেচ বানানো আর তার নিচে ছোট ছোট করে ইংরেজিতে কিছু লিখা।
“এখনো বলবি তুই আমার বাবা কে মারিস নি?
“সত্য কখনো বদলায় না রিশাল।সেদিন আমি শুধু তাকে সাবধান করতে গিয়েছিলাম যেনো তার তৈরিকৃত ওই পবিত্র পানি যেনো তিনি আমাদের বিপরীতে ব্যবহার না করে।কিন্তু তোমার বাবা তার আগেই আমাকে মারার জন্য ফাদঁ তৈরি করে।সে চেয়ছিল ল্যাবে আগুন লাগিয়ে দিতে।কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত শর্টসার্কিট থেকে তার আগেই আগুন লেগে যায়।আমাকে মারার জন্য নিয়ে আসা দাহ্য পদার্থ সেখানে থাকায় মুহূর্তেই সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।আর তুমি ভালো করেই জানো আগুনে আমাদের কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায়।তাই ইচ্ছে থাকা সত্তেও আমি তাকে বাচাতে পারিনি।”
“মিথ্যে বলছিস তুই।”
“তোমার যদি মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি,,.
তাহলে আমি এখানেই দাড়িয়ে আছি।তোমার যা ইচ্ছে আমার সাথে করতে পারো।”
রিশাল কিছুটা নিস্প্রভ চোখে তাকায় জাদ এর দিকে।সেখানে এক ধরনের আপনজন হারানোর বেদনা ছিলো।
“আমি যাচ্চি,,কিন্তু আমি আপনাদের কাউকে ছাড়বো না।”
“জাদ তুমি ওকে কেনো যেতে দিলে?ওর সাহস কি করে হয় আমাদের উপর হামলা করার?
“নো ড্যাড।সাহস নয়,ভালোবাসার জোর।
ও আমাদের কেনো মারতে এসেছিলো জানেন,,,,
কারন ও তার বাবাকে ভালোবাসতো।তাই তার মৃত্যুর বদলা নিতে এসেছিলো।
আর আমাদের কেনো ছেড়ে দিয়েছে জানেন,,,
কারন ও নবনীযুক্তা কে ভালোবাসে।আর ও জানে ওকে বাচাতে হলে আমাকে ওর প্রয়োজন।
আপনারা ভালোবাসার শক্তি বুঝবেন না।আপনাদের আছে শুধু হিংস্রতা।”
.
.
.
.
একটা অন্ধকার ঘর।কাচের জানালার ফাকগলিয়ে বিকেলের অর্ধ ডুবে যাওয়া সূর্যের আবছা আলো বিছিয়ে যাচ্ছে পুরো রুম জুড়ে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাটুর উপর মাথা দিয়ে কাদছে দ্বিধা।
ধীর পায়ে কেউ একজন দ্বিধার সামনে এসে আসন পেতে বসে।
“আপনি কাদছেন মায়াপরী?
দ্বিধা ওর হাটু থেকে মাথা উচিয়ে আরো জোরে কাদতে থাকে।
“কেনো আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন?প্লিজ আমাকে যেতে দিন প্রফেসর।”
ইতাফ ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলে—
“প্রফেসর নয়।ইতাফ বলুন,,মায়াপরী।”
“এইসব কেনো বলছেন?
ইতাফ ওর হাত দিয়ে দ্বিধা মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল কানে গোড়ায় গুজে দেয়।দ্বিধা অঝোরে কাদছে।
“আচ্ছা বলুন তো এমন কি পেলেন আপনি জাদ এর মাঝে যা আমার মধ্যে নেই?”
দ্বিধা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ইতাফের দিকে।
ইতাফ আবার গর্জে উঠে বলে–
“কি হলো বলুন,,,,
কি আছে ওর মাঝে যা আমার মাঝে নেই।কেনো যান আপনি ওর কাছে?
ইতাফ দুহাত দিয়ে দ্বিধার মুখ উচু করে বলে–
“জানেন,,,ও যখন আপনাকে স্পর্শ করে তখন আমার কি করতে ইচ্ছে করে,,
ওকে জাস্ট মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে,আর নয়তো আপনাকে।
আপনি তো আমার জন্য ফিরে এসেছেন।তাহলে কেনো বারবার ওর কাছে যান আপনি??
ইতাফের প্রত্যেকটা কথার আওয়াজ দ্বিধার হৃৎপিন্ড কাপিয়ে তুলছে।”
ইতাফ উঠে দাড়ায়।সারা রুম জুড়ে একবার পায়চারি করে।
দ্বিধার কান্নার আওয়াজ ক্ষীন হয়ে এসেছে।শ্বাসনালী কাপিয়ে হেচকি তুলে ফুফিয়ে যাচ্ছ সে।ইতাফের কোনো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না।সে শুধু এখান থেকে মুক্তি চায়।
ইতাফ আবার ওর সামনে এসে বসে।নিজের দুহাত
দ্বিধার সামনে গুছিয়ে বলে–
“এই দুহাতে করে আপনাকে আমি এই পৃথিবীতে এনেছি।আপনাকে প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিন থেকে ভালোবেসেছি।
আপনার জন্য আমি আমার ভয়ংকর রুপও আপনার বাবার সামনে নিয়ে এসেছি।আর আপনি কি না আমাকে ছেড়ে ওই জাদ কে ভালোবেসেছেন।”
বলেই এক ঘুসি মারে দ্বিধার ঠিক কানের পাশে দেয়াল।পুরো অন্তর আত্না কেপে উঠে দ্বিধার।
ইতাফের এমন বিভৎস রুপ সে আগে কখনো দেখেনি।গলা পুরো শুকিয়ে গিয়েছে।এখন আর কান্নার শব্দ বের হচ্ছে না।শুধু শীতল পানি বেয়ে পরছে আর হেচকি উঠছে।
“আমি তো আপনাকে ভালোবেসেছি মায়াপরী।আপনি কেনো পারলেন না আমাকে ভালোবাসতে?
আমিতো আপনাকে অন্য কারো হতে দিবো না।
যদি আপনি আমার না হন তাহলে আমি আপনাকে মারতেও দুবার ভাববো না।”
দ্বিধা ওর শুকনো গলায় ফ্যাসফ্যাসিয়ে বলে—
“আমাকে যেতে দিন।প্লিজ,যেতে দিন।”
“কি করে দেই বলুনতো।আপনি তো আবারও জাদ এর কাছে চলে যাবেন।ও আবারো আপনাকে স্পর্শ করবে।
না,না,না আমি আর ভাবতে পারছি না।আপনাকে যে আমার হতেই হবে,মায়াপরী।
না হলে আমি যে সত্যিই আবার আপনাকে মেরে ফেলবো।”
“আমাকে যেতে দিননননপননন,,,
ইতাফ দ্বিধার দু হাত দেয়ালে চেপে ওর গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলে—
“আজ যে আপনাকে আমার হতেই হবে,মায়াপরী।”
দ্বিধা একমনে প্রার্থনা করে যাচ্ছে,সময় যেনো আজ এখানেই থমকে যায়।
চলবে,,,