#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২
#তানিশা সুলতানা
রুমের মধ্যে আরেকটা রুম। একটা মেরুন রঙের পর্দার আড়ালে আরেকটা দরজা।
“লোকটা নিশ্চয় বাচ্চাদের ধরে এনে পাচার করে দেয়। তাই রুমের মধ্যে রুম বানিয়েছে। বাচ্চাদের ধরে এনে এই রুমেই বন্ধ করে রাখে।
ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে ছোঁয়ার। ও নিজেও তো বাচ্চা। তাহলে এই লোকটা ওকে পাচার করে দেবে?
ভয়ে ভয়ে এক পলক তাকায় সাদাতের দিকে। লোকটা একই ভাবে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ঘোরে আবার নাকাও ডাকছে।
আশ্চর্য ছোঁয়া ধপ করে শব্দ করে পড়ে গেলো আর পড়ে গিয়ে এত জোরে চিৎকার করলো, আবার বাচ্চাটাও এতে জোরে কান্না করছে তবুও লোকটার ঘুম ভাঙলো না?
মরে টরে গেলো না কি? মরে গেলে কি মানুষ নাক ডাকে?
নিজের মনের এরকম বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে নিজেই বিরক্ত হয় ছোঁয়া।
” ছোঁয়া তুই না সাইন্সের স্টুডেন্ট। স্মার্ট সুন্দরী টেলেন্টেট। তোর মনে এরকম বোকা বোকা প্রশ্ন মানায় না। এই রাহ্মসটা মরবে? কখনোই না।
নিজেকে ধাতস্থ করে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে দরজাটা খুলে ছোঁয়া।
দরজাটা খুলেই অবাক হয়ে যায় তুলতুল বিশাল বড় রুম। ধবধবে সাদা দেয়াল ফ্লোরও সাদা। বা পাশে কিচেন ডান পাশে ওয়াশরুম। রুম টার ঠিক মাঝখানে একটা নীল রংয়ের দোলনা। তাতে বসে আছে দুই তিন বছরের একটা পরির মতো বাচ্চা মেয়ে। কেঁদে কেঁদে মুখটা লাল করে ফেলেছে।
ধবধবে সাদা বিছানার চাদর বালিশ। খাটের রংটাও সাদা সেখানে সাদা একটা কুকুর আর সাদা বিড়াল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে।
মানে শুধুমাএ কুকুর বিড়ালের জন্য এতো সুন্দর খাট? ভাবা যায়?
ছোঁয়াকে দেখে বাচ্চাটা কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দেয়। হকচকিয়ে ওঠে ছোঁয়া। মায়া হয় বাচ্চার প্রতি। গাড়ো নীল রংয়ের একটা ফ্রক পড়ে আছে। হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো চুলগুলো অধখোলা হয়ে আছে।
ছোঁয়া বাচ্চার দিকে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে দিতেই বাচ্চাটা ঝাপ দিয়ে ছোঁয়ার কোলে আসে। ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।
“আমার ময়নাটা কাঁদে না।
বাবুটার পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে ভাঙিতে বলে ছোঁয়া। বাচ্চাটা শান্ত হয়ে যায়। আশ্চর্য হয়ে যায় ছোঁয়া। মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি।
” নাম কি তোমার বাবু?
আদুরী গলায় বলে ছোঁয়া।
বাচ্চাটা অস্পষ্ট ভাষায় বলে
“পরি
” খিধে পেয়েছে সোনা? খাবে?
পরি ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। সামনের সব গুলো দাঁত উঠেছে। হাসলে দুই গালে টোল পড়ে।
দারুণ একটা বাচ্চা।
ছোঁয়া বুঝে যায় বাবুটা খাবে। এই তো কাঁদ ছিলো আর এখনি হেসে ফেললো?
পরিকে কোলে করেই কিচেনে যায়। চুলায় আগে থেকেই দুধ দেওয়া ছিলো। একটুখানি গরম করে নেয় ছোঁয়া।
ফিটারে দুধ ভরে পেছনে ঘুরে দেখে কুকুর আর বিড়াল ছোঁয়ার পা ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে।
“কি বড়লোক কুত্তা বিলাই?
তোরাও কি বড়লোকি দুধ খাবি না কি?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে ছোঁয়া। কুকুরটা হালকা ঢেউঢেউ করে ওঠে। আর বিড়ালটাও জীভ বের করে।
ছোঁয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
এ কেমন কিডনাপার রে ভাই? কুত্তা বিলাই পুচকে একটা বাচ্চা আর আমার মতো একটা কিউট বাচ্চাকেই কিডন্যাপ করলো।
লোকটার মতলব ভালো না।
বাকি দুধটুকু একটা বাটিতে করে কুকুর বিড়ালকে দিয়ে দেয়।
বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়িয়ে দেয় ছোঁয়া। সাদা রংয়ের একটা কাবাড আছে। সাহস করে সেটা খুলে ছোঁয়া। চেঞ্জ করা দরকার। এরকম বধু বেশে আর কতখন থাকবে?
কাবাড খুলতেই অবাক হয়ে যায় ছোঁয়া। সেখানে শুধু শাড়ি শাড়ি আর শাড়ি।
দারুণ দারুণ ডিজাইনের সব শাড়ি। কিন্তু এগুলো পড়ে রাতে ঘুমবে কি করে?
তারপর কাবাডের নিচের পাট্টা খুলে। সেখানে সব ধরনের ড্রেস আছে। ছোঁয়া গাড়ো নীল রংয়ের স্কার্ট আর সাদা টিশার্ট নেয়।
সেটা পড়ে ফ্রেশ হয়ে পরির পাশে শুয়ে পড়ে।
কুকুর বিড়াল ছোঁয়ার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ে।
জানালার পর্দা ভেদ করে এক ঝলক সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় ছোঁয়া। বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। কিন্তু তাতে বেচারি সূর্যের কোনো হেলদোল নেই। সে তার আঁচ কমাবে না।
আড়মোড়া ভেঙে লম্বা হাই তুলে উঠে বসে ছোঁয়া। পুরোপুরি চোখ খুলে সামনে তাকাতেই চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায় ছোঁয়ার।
কেনোনা কাল রাতের সেই রাহ্মসটা পরিকে করলা ভাজি দিয়ে রুটি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পরি মুখে নেওয়া তো দুর তকিয়েও দেখছে না। মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুখ খিঁচ বন্ধ করে আছে।
পাশেই কুকুর বিড়াল লেজ গুটিয়ে শুয়ে আছে। তাদের সামনেই করলা ভাজি দিয়ে রুটি ছোট ছোট টুকরো করে মাখানো।
ছোঁয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারা।
“এই যে মিস্টার রাহ্মস এরা করলা ভাজি খাবে না। সবাই কি আপনার মতো করলা না কি?
মনে মনে বলে ছোঁয়া মুখে বলার সাহস নেই। যদি আবার কাল রাতের মতো অভদ্রতা শুরু করে দেয়।
পরি ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে মাম্মা বলে ডাকে।
ছোঁয়া চমকে ওঠে। সাদাত ভ্রু কুচকে ছোঁয়ার দিকে তাকায়।মুহুর্তেই সাদাতের চোখ মুখের রং পাল্টে যায়। ফর্সা মুখটা লাল হতে থাকে।
চোয়াল শক্ত করে ফেলে।
ছোঁয়া আতঙ্কে ওঠে। রেগে যাচ্ছে কেনো উনি?
খাবারের প্লেট ঠাস করে টেবিলে রেখে হনহনিয়ে ছোঁয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সাদাত।
” এই মেয়ে তোমার সাহস হলো কি করে এই রুমে আসার?
ছোঁয়ার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে সাদাত। রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
ভয়ে বুক টিপটিপ করছে ছোঁয়ার। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। রাহ্মসটা হঠাৎ হ্মেপে গেলো কেনো?
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে ছোঁয়া।
“সাহস পেলি কোথা থেকে এই ড্রেস পড়ার?
মেঘের মতো গর্জন তুলে বলে সাদাত। ছোঁয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। হাত দুটো ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো বড় পাথরের নিচে চাপা পড়েছে।
“কেনো পড়েছিস বল? কেনো পড়লি? তোকে এখন খুন করতে ইচ্ছে করছে আমার।
মুখটা আরও একটু এগিয়ে নেয় ছোঁয়ার দিকে।
ওদের ঝগড়া করতে দেখে পরি কেঁদে ওঠে। ভয় পেয়ে গেছে বেচারি।
পরির কান্নার শব্দ শুনে ছেড়ে দেয় সাদাত।
ছোঁয়ার রাগে দাঁতে দাঁত চাপে। চোখের পানি মুছে ফেলে।
সাদাত পরিকে কোলে নিতে গেলে পরি সাদাতের কোলে যায় না।
দৌড়ে ছোঁয়ার বুকের মাঝে লুকিয়ে পড়ে। ভীষণ ভয় পাচ্ছে সাদাতকে। রীতিমতো কাঁপছে বাচ্চাটা। দুই হাতে পরিকে আগলে নেয় ছোঁয়া।
” একটা ড্রেসের জন্য ছোটলোকের মতো করার কি আছে? আমার পড়ার মতো কোনো ড্রেস ছিলো না বলেই পড়েছি। আপনার মতো অসভ্য অভদ্র লোকের ড্রেস পড়ার কেনে ইচ্ছে ছিলো না আমার।
সামান্য একটা জামা পড়েছি হিরে গহনা চুরি করি নি।
পরিকে দুই হাতে আগলে নিয়ে কড়া গলায় বলে ছোঁয়া। এখনো চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে। হাত দুটোও ব্যাথা হয়ে গেছে।
কথা গুলো বলার পর দাঁত দিয়ে জিভ কাটে ছোঁয়া, হায় হায় কি বলে ফেললাম?
এখন এই বন্ধ ঘরে খুন করে ফেললেও কেউ বাঁচাতে আসবে না।
এই রাহ্মসটা এখন টুপ করে গিলে খাবে ছোঁয়াকে।
সাদাত বুকে হাত গুঁজে চোয়াল শক্ত করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে। সাদাতের চাহনি দেখে শুনে ঢোক গিলে ছোঁয়া।
“এই মেয়ে আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস একদম দেখাবে না বলে দিলাম। নাহলে মেরে পুঁতে ফেলবো।
আবারও চিৎকার করে বলে। পরি আর ছোঁয়া ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। পরিকে ভয় পেতে দেখে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে সাদাত।
এই ড্রেস এখনি খুলে ফেলবা। এন্ড ভালো করে কেঁচে স্ত্রী করে যেভাবে ছিলো সেভাবেই রেখে দিবা।
টাইম 30 মিনিটস।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে সাদাত।
” পারবো ন
বলতে বলতে সাদাতের দিকে তাকায় ছোঁয়া। চাহনি দেখে কথা আটকে যায়।
“পারবো
মেকি হেসে বলে ছোঁয়া।
” ননসেন্স
পরি চলে এসো খাবে।
বলে সাদাত খাবার আনতে যায়। এই ফাঁকে ছোঁয়া পরিকে কোলে নিয়ে এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
একদম রুমের বাইরে এসে থামে। পেছনে তাকিয়ে দেখে কুকুর আর বিড়াল আসে নি।
নিশ্চয় ওই রাহ্মসটা আসতে দেয় নি।
করলা ভাজি খেলে তো মরেই যাবে ওরা।
পরি ছোঁয়ার গলা জড়িয়ে ধরে মিটমিট করে হাসছে। পরির হাসিতে থেমে যায় ছোঁয়া।
“কে এই মেয়ে? এখানে কেনো? সাদাতের সাথে এর কি সম্পর্ক? মেয়ে তো হবেই না। কারণ পাক্কা খবর আছে ছোঁয়ার কাছে সাদাত ঠিক এক সপ্তাহ আগে বিদেশ থেকে এসেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রেম করে এতে বড় মেয়ে যাওয়া তো কোনোভাবেই পসিবল না।
তাহলে কে এই মেয়ে?
ছোঁয়া পরির মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে।
(সাদাত আর ছোঁয়া হলো এই গল্পের মূল চরিত্র।)
চলবে