#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২৪
#তানিশা সুলতানা
এক আকাশ সমান অভিমান জমা হয়েছে ছোঁয়ার মনে। অভিমানের কারণটা জানা নেই তার।
সাদি খাইয়ে দিচ্ছে পরিকে। সিফাত রান্না করেছে৷ সিমি এখনো একই ভাবে পরির পাশে বসে আছে। ছোঁয়া জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি শূন্য আকাশের পানে।
“তোমাদের পবলেম কি? কি সম্পর্ক তোমাদের?
সাদি পরির মুখে নুডলস পুরে দিয়ে প্রশ্নটা করে। সিফাত ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে রুম ছেড়ে চলে যায়। এই প্রশ্নের উওর নেই ওর কাছে।
সিফাত চলে যেতেই সাদি সিমির দিকে তাকায়। সিমি মাথা নিচু করে লম্বা দম নেয়। ছোঁয়া আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সিমির দিকে তাকায় অধিক আগ্রহে।
” পরি আমার সন্তান
চোখ বন্ধ করে বলে সিমি। কেঁপে ওঠে ছোঁয়া। এটা কি শুনছে? সাদি পূর্ণ দৃষ্টিতে সিমির দিকে তাকায়৷ সিমির চোখ দুটো বন্ধ।
দীর্ঘ তিন বছর রিলেশনশিপ এ থাকার পরে হঠাৎ একদিন সিফাত আমাকে বিয়ে করার কথা বলে৷ খুব ভালোবাসতাম তাই আর দ্বিমত করি নি৷ পালিয়ে বিয়ে করে নেই আমরা।
কলেজের পাশেই একটা বাসা নেয় সিফাত। ওখানেই আমাদের সংসার শুরু হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একসাথে থাকতাম। বিকেলে আমি বাড়ি চলে যেতাম। আর ও ওর বাড়ি। এভাবেই পাঁচ মাস সংসার করি আমরা। হঠাৎ একদিন আমি ফিল করি আমি প্রেগন্যান্ট। শিওর হওয়ার জন্য চেকআপ করি। পজিটিভ আছে। আর সেদিনই সিফাত আমাকে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দেয়। আমার হাতে পায়ে ধরে রিকোয়েস্ট করে যাতে আমি ওর সাথে সম্পর্ক না রাখি।
কয়েক লাখ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।
গলা ধরে আসছে সিমির। পুরনো ঘাস তাজা হয়ে উঠেছে। হাউমাউ করে কান্না করে ফেলে সিমি। বোনের কথা শুনে আর কান্না দেখে ছোঁয়া নিজেকে আটকে পারে না। দুই হাতে মুখ চেপে কান্না করতে থাকে।
সাদি ছোট্ট পরির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা হয়ত কিছু বুঝতে পারছে না। বুঝলে নিশ্চয় কান্না করে ফেলতো। সাদি পরিকে বুকে চেপে ধরে। সিমিকে শান্তনা দেওয়ার ভাসা নেই।
“আর খোঁজ নেয় নি তোমার?
সাদি প্রশ্ন করে। সিমি কিছুটা সময় নিয়ে কান্না থামায়। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে।
” নিয়েছিলো তো। তার পাঁচদিন পরে কল করে বলেছিলো দুই ঘন্টার মধ্যে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে না দিলে আমাকে খুন করতেও দুবার ভাববে না।
তাচ্ছিল্য হাসে সিমি। সাদি চোয়াল শক্ত করে ফেলে। ভাইয়ের ওপর ঘৃণা হচ্ছে।
“দুই মিনিটে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে কোর্টে জমা করে দিয়েছিলাম।
হোস্টেলে থাকার কথা বলে সিফাতের সেই বাসায় উঠেছিলাম। দিনরাত ওখানেই পরে থাকতাম। কারণ আমার যাওয়ার মতো জায়গা ছিলো না। হাতে টাকাও ছিলো না যে অন্য বাসা নেবো। বাচ্চাটা নষ্ট করার মতো দুঃশাসন হয় নি আমার। বাবা মা বোন কারো সাথে শেয়ার করতে পারি নি। একা একা সামলেছি নিজেকে। কাউকে জানতেও দেয় নি।
তখন আমার অসহায় জীবনে হিমু আসে। একজন দায়িত্বশীল বেস্টফ্রেন্ডের মতো সামলেছে আমায়।
দম নেয় সিমি। কাঁদতে কাঁদতে ছোঁয়ার হেঁচকি উঠে গেছে। সাদি কপালে হাত ঠেকিয়ে সিমির কথা গুলো শুনছে। পরি সাদির বুকে ঘুমিয়ে গেছে।
” স্যার আমি এতোদিন জানতাম না পরি বেঁচে আছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেছিলো আমার পেট থেকে মরা মেয়ে হয়েছে৷ কিন্তু নাহহহ। এটা মিথ্যে ছিলো। আপনার ভাই আমার মেয়েকে চুরি করেছিলো।
আমি আমার মেয়েকে ফিরে চাই।
প্লিজ স্যার দয়া করুন একটু। আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।
হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বলে সিমি।
সাদি কি করবে বুঝতে পারছে না। এতগুলো বছর ভাইকে দেখেছে। এই পিচ্চিটাকে বুকে জড়িয়েই বেঁচে আছে সিফাত। পরি না থাকলে তো সিফাত বাঁচবে না।
“আমায় একটু সময় দাও সিমি। সবটা ঠিক করে দেবো আমি। প্রমিজ।
সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে সাদি।
সিমি করুন চোখে তাকায় সাদির দিকে।
” অবিচার করবো না এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো। তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে।
সিমি মাথা নিচু করে। সাদি পরিকে সিমির কোলে দেয়।
“তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে আমার। একটু সময় দাও আমায়।
পরির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় সাদি। ছোঁয়া পেছন থেকে জাপ্টে ধরে সিমিকে। দুই বোন আজকে মনের মধ্যে যত কান্না জমে আছে সব টুকু বের করে দিচ্ছে।
মনের মধ্যে জমানো পাহার সমান রাগ অভিমান না পাওয়ার কষ্ট সব কান্নার মাঝেই প্রকাশ করছে।
বইয়ের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় বিভোর ছোঁয়া। ছোট্ট মনে অনেক গুলো প্রশ্ন জমা হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নরও উওর জানা নেই।
” হেই!
সাদি বিছানায় বসে ল্যপটপে নিজের কাজ করছে। আর ছোঁয়া টেবিল চেয়ারে বসে পড়ছে৷ অনেকখন ছোঁয়াকে অনমোনা দেখে কয়েকটা ডাক দেয় সাদি। কিন্তু ছোঁয়ার কোনো হুম নেই৷ তাই হাতের কাছে থাকা কলমটা ছুঁড়ে দেয়।
হকচকিয়ে ওঠে ছোঁয়া। চোখ তুলে তাকায় সাদির দিকে।
“কিছু বলবেন?
ছোঁয়া রিনরিনিয়ে বলে।
” বইয়ের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছো?
সাদি ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে।
ছোঁয়া বই বন্ধ করে রেখে বিছানায় গিয়ে গোল হয়ে বসে। ততখনে সাদি আবার ল্যপটপে মন দিয়েছে।
“আজকেও আপনাকে বেলি ফুল কে দিয়েছে?
ছোঁয়া মাথা নিচু করে প্রশ্ন করে।
” কিনে এনেছি। সাদমান চৌধুরী কারো কাছ থেকে কিছু নেয় না।
সাদি ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে।
ছোঁয়া সাদির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আপনিও কি আমাকে ছেড়ে দেবেন?
সাদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ছোঁয়া। সাদি কপালে তিনটে ভাজ ফেলে সরু চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
” কত বয়স তোমার? ছেড়ে দেওয়ার কি বুঝো তুমি? ইডিয়েট একটা।
ধমক দিয়ে বলে সাদি। ছোঁয়া চমকায় না। সাদির চোখ থেকে চোখও সরায় না।
“আমার না মনে হচ্ছে আমি আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। ভালো লাগে আপনাকে।
খুব বেশি দুর্বল হওয়ার আগেই না হয় আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপির মতো কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারি না। আর কষ্ট পেতেও চাই না।
শান্ত গলায় বলে ছোঁয়া। চোখের কোণে এক বিন্দু পানি জমেছে।
সাদি কিছুখন তাকিয়ে থাকে ছোঁয়ার দিকে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়। ছোঁয়ার কথার উওর দেয় না।
” ছেড়ে দেবেন?
আবারও বলে ওঠে ছোঁয়া।
“হয়ত
সাদি কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে ছোঁয়ার দুই বাহু ধরে শুয়িয়ে দেয় ছোঁয়াকে। তারপর গলা ওবদি কম্বল টেনে দেয়।
” তুমি ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
ছোঁয়ার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে বলে সাদি। তারপর আবারও কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে থাকে। আর অন্য হাত দিয়ে ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
“আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে আমি আপির মতো অপেক্ষা করবে না। সাথে সাথে আপনার থেকেও দ্বীগুন কিউট ছেলেকে বিয়ে করে নেবে।
আপনার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। হনুমান একটা।
মুখ বাঁকিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি বাঁকা চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া ভেংচি কেটে পেছন ফিরে শয়।
” আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে না। আপনাকে আমার সয্য হয় না।
সাদির হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কাজে মন দেয়। অযথা তর্ক করার মুড নাই।
সিফাত একটার ওর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। এতদিন মেয়ের জন্য সিগারেট খেতো না। সিমির সব কথাই শুনেছে সিফাত। আর সাদির বলা কথাও শুনেছে। সাদি যখন সিমিকে কথা দিচ্ছিলো “তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে” তখন সিফাতের বুকের ভেতর রক্ত খরণ হচ্ছিলে। কি করে থাকবে মেয়েকে ছাড়া? আর পরিও তো সিফাতকে ছাড়া থাকতে পারে না। কি হবে এবার?
হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট নিজের হাতে ঠেসে ধরে সিফাত। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে।
ছোঁয়া ঘুমিয়ে যেতেই সাদি আবার ছোঁয়ার মাথায় হাত রাখে। খুব যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
চলবে