#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৪১
#তানিশা সুলতানা
বাড়িতে এসেও মন ভালে নেই ছোঁয়ার। মেঘলা আকাশের মতো কালো হয়ে আছে মুখখানা। এতদিন বাড়িতে আসার জন্য কত পাগল ছিলো। এখন সেই বাড়িটাই অসয্য লাগছে। সাবিনা বেগম ছোঁয়া দের বাড়িতেই নামিয়ে দিয়ে গেছে ওদের। এখানে দুই দিন থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে গেছে।
বাবা মায়ের সাথে কোনো রকমে একটু কথা বলে নিজের রুমে চলে এসেছে। বুকের বা পাশটায় অসম্ভব চিনচিন ব্যাথা করছে। সব কিছুই বিষ্ষন্ন লাগছে। ফোনের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। কিন্তু ফোনের আলোটাও জ্বলছে না।
এখনো জামা কাপড় পাল্টায় নি।
সাদির নাম্বারটাও নেই। এক বাড়িতে থাকলেও কখনো নাম্বার নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। বা সাদিও দেয় নি। ছোঁয়ার নাম্বারও হয় তো সাদির কাছে নেই।
তাহলে কি কথা হবে না?
আতঙ্কে ওঠে ছোঁয়া। চোখ দুটো ভিজে ওঠে। ফোনটা ছুঁড়ে মারে বিছানায়। নিজের কপালেও দু’চারটা থাপ্পড় দেয়।
কথা না বলে থাকবে কি করে? মনের গহীনে যে ওই লোকটার জন্য এক অকাশ সমান জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে শুধুই লোকটার বিচরণ।
সিমি এখনো বাবা মাকে বলে নি কিছুই। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া একটা কথাও বলে নি। বললে বাবা মা ভীষণ কষ্ট পাবে। নাজমা বেগম ভীষণ রেগে আছে সিমির ওপর বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সাইফুল রহমান একটুও রাগ করে নি। জীবনটা সিমির তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারটাও সিমির। কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না। ছোট মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে খুব বড় ভুল করেছে সেটা হারে হারে টের পাচ্ছেন উনি।
ওই টুকুনি মেয়ে যে মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে এটাই অনেক।
সাদি কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মেঘাকে কিছু বলার আগেই দৌড়ে চলে গেছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না সাদি। বাড়ি ফিরবে কি করে সেটাই ভাবছে। পুরো বাড়িটা ফাঁকা। এতদিন তো একা থাকারই অব্ভাস ছিলো সাদির। হঠাৎ করে পুচকে মেয়ের পাল্লায় পড়ে অব্ভ্যাসটা পাল্টে গেলো।
“সাদি আসবো?
ইভা নক করে বলে। কপাল থেকে হাত সরিয়ে নরে চরে বসে সাদি।
” আয়
বলেই কলম হাতে তুলে নেয় ফাইলে মনোযোগ দেবে বলে।
“শুনলাম বউ না কি চলে গেছে?
চেয়ার টেনে বসে বলে ইভা।
” চলে গেছে কেমন কথা? বাড়িতে গেছে।
কপাল রাগ দেখিয়ে বলে সাদি। ইভা ঠোঁট টিপে হাসে। খুব ভালো ভাবেই ফেসে গেছে সাদি এটা ভালোই বুঝতে পারছে।
“ওই একই হলো। গেছে তো?
হাত দিয়ে চুল গুলো নেরে এক গাল হেসে বলে ইভা।
সাদি ফাইল বন্ধ করে।
” ওই মেয়ে কি জাদু জানে না কি রে?
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে সাদি।
“তা তো একটু জানেই। নাহলে কি তোকে বশ করতে পারতো?
” মিথিও এতো ভালোবাসা ফিল করেও আমার মন গললো না। আর এই মেয়ের রাগ আর বদমাইশি দেখে পাগল হইলাম?
ইভার মনটা খারাপ হয়ে যায় মিথি নামটা শুনে। হাসিমাখা মুখটা কালো হয়ে যায়।
“ওর কথা কেনো তুলিস?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে ইভা।
” ইদানীং খুব মনে পড়ে। কালকে ওর বোনকে দেখলাম। বড় হয়ে গেছে।
সাদি উদাসীন ভঙিতে বলে।
“আচ্ছা বাদ দে। কথা বলেছিস ছোঁয়ার সাথে?
” রাতে কল করবো। এতখনে ছটফট করুক।
মৃদু হেসে বলে সাদি।
“বাবা হাসাতেও শিখে গেছিস দেখি।
ভেঙিয়ে বলে ইভা। সাদি খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়। কখনো এভাবে হাসা হয় নি। কিন্তু ইদানীং খুব হাসি পায়। আবার কারো সামনে হাসতেও লজ্জা করে।
লজ্জা পাওয়া নিয়েও অনেকখন হাসে ইভা। তারপর দুজনে মিলে বেশ কিছুখন গল্প করে সাথে কাজও করে নেয় গল্পের ফাঁকে।
দুপুরে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে ছোঁয়াকে ওর বাবা। খাবারের প্রতি কেনো নজর নেই ছোঁয়ার৷ খালি সাদির কথা মনে পড়ছে। উনি খেয়েছে? কি করছে? আমাকে মিস করছে?
মনের মধ্যে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে আরও বেশি বিরক্ত ছোঁয়া। এত মনে কেনো পড়বে? ওনার তো মনে পড়ছে না। উনি তো দিব্যি ভালো আছে।
নাজমা বেগম খাবার বেরে দিচ্ছে। সিমি পরিকে খাওয়াচ্ছে আর নিজে খাচ্ছে। পরির মনটা খারাপ। বাবাকে দেখে না দুই ঘন্টা হয়ে গেলো। কি করছে বাবা?
সিমি মুখে খাবার গুঁজে দিচ্ছে আর পরি মন মরা হয়ে চিবচ্ছে।
সিমি পরির মনের কথা বুঝতে পারে।
” খাওয়া শেষ করে বাবার সারকথা বলিয়ে দেবো।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে সিমি। হাসি ফুটে ওঠে পরির মুখে।ফোঁকলা দাঁত বের করে এক গলা হাসে। পরির হাসি দেখে সিমি আর ছোঁয়াও মুচকি হাসে।
রাত দশটা বাজে। আজকে ছোঁয়া একা থাকবে জেদ ধরেছে। সিমি বলেছিলো ওদের সাথে থাকতে কিন্তু ছোঁয়া থাকবে না।
কোনো রকমে খাবার খেয়েই নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। নাজমা বেগম আর সাইফুল এসে দরজা ধাক্কিয়েছে অনেকখন কিন্তু দরজা খুলে নি।
কথাও বলে নি।
বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে ছোঁয়া। রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। উনি কল দেবে না এটা জানা ছোঁয়ার। কিন্তু নিজে কি করে পারলো নাম্বার আনার কথা ভুলে যেতে?
নাম্বার আনলে তো কল করতে পারতো। খবরটা জানতে পারতো।
বুক ফেটে কান্না আসছে ছোঁয়ার। হারে হারে টের পাচ্ছে ওই লোকটাকে ছাড়া ওর একটা দিনও চলবে না।
বেশ কিছুখন কান্না করার পরে বুঝতে পারে ওর ফোন বাজছে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। প্রভা আর শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ কল করে না ওর ফোনে। ভেবে নেয় ওরাই হয়ত কল করেছে।
ভীষণ বিরক্ত হয়। কান্না করেও শান্তি নেই। কান্নার মাঝেও বাঁধা দেবে এরা।
দুই বার কল দেওয়ার পরে সাদি কটমট চোখে তাকায় ফোনের দিকে। দুপুরে খাওয়া হয় নি রাতেও খায় নি এখনো। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই কল করেছে। কিন্তু ইডিয়েটটার কল ধরার নামই নেই। সারা বাড়ি খুঁজে ছোঁয়ার একটা জামা পায় না সাদি। এতে আরও বেশি বিরক্ত হয়। সব কিছু নিয়ে যাওয়ার কি আছে?
বেলকনিতে ফ্লোরে গোল হয়ে বসে সাদি। এখন কল না ধরা ওবদি কল দিতেই থাকবে।
ইচ্ছে করছে ঠুস করে কানের নিচে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে।
আবার কল দেওয়া শুরু করে। এবার ছোঁয়ার বিরক্ত আকাশ ছুঁই ছুঁই। ধাপ করে উঠে বসে ফোনটা ধরে
“সমস্যা কি তোর? কান্না করছি বুঝতে পারছিস না? কান্নার মধ্যেও তোর বিরক্ত করা লাগবে?
কানে ফোন নিয়েই ঝাঁঝালো গলায় বলে। কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ কান্না করেছে। সাদি মুচকি হাসে।
” কান্না কেনো করেছো?
শীতল গলায় জিজ্ঞেস করে সাদি। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে ছোঁয়ার। চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়। শুকনো ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে।
“আপনি কল করেছেন?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
” কেনো করতে পারি না?
সাদি পাল্টা জিজ্ঞেস করে।
ছোঁয়া লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।
“ভিডিও কল দেই?
সাদি বলে।
” এমবি নেই।
ছোঁয়া রিনরিনিয়ে বলে।
“আচ্ছা আমি এমবি দিচ্ছি। ততখনে তুমি চোখে মুখে পানি দিয়ে এসো।
সাদি কল কেটে দেয়। ছোঁয়া ফোনটা বুকে জড়িয়ে দুই মিনিট বসে থাকে। তারপর মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।
চলবে