অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব-১

0
4171

-প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে তোমার এত আদিক্ষেতা কেন বউমা? এই মেয়ে পড়ালেখা শিখে কি করবে না করতে পারবে চাকরি, আর না একে কোথাও বিয়ে দিতে পারবে। শুধু শুধু আমার ছেলের টাকা নষ্ট করছো!

শাশুড়ির কথা শুনে চোখে জল চলে আসলো মালিহার। নিজের নাতনিকে নিয়ে কেউ এমনভাবে বলতে পারে কিনা জানা ছিলো না তার। শত হোক নিজেরই তো রক্ত। জন্ম থেকে মালিহার মেয়ে নীরার বাম পা টা ডান পায়ের তুলনায় ছোট আর একটু বাঁকানো। প্রথমে বোঝা যায়নি যখন একটু বড় হলো হাটতে শিখলো তখন স্পষ্ট বোঝা গেলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে হয় মেয়েটার। সবাই যখন দেখলো তার মেয়েটার এই হাল। তখন থেকেই সবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শুরু। যেই স্বামী সে অন্তস্বওা হওয়ার পর এতো যত্ন নিতো এতো স্নেহ করতো, সেই স্বামীর রূপই বদলে যেতে দেখেছে সে। আর শাশুড়ি আত্নীয় স্বজন তো কোন ছাড়। সেই থেকে মালিহা একাই লড়াই করে আসছে নিজের মেয়ের জন্য।

-আম্মা,ও আম্মা আমাকে কি আর কলেজে ভর্তি করাবে না? দাদী যে এমন করে বললো। সত্যিই কি আমার জন্য আব্বার টাকা নষ্ট হয়?

মেয়ের কথা শুনে মালিহার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। তার মেয়েটা লেখাপড়ায় কত ভালো। এসএসসি তে কত ভালো রেজাল্ট করলো। কলেজে ভর্তির কথা তুলতেই তার শাশুড়ির এহেন কথা শুনতে হলো। সে তার মেয়েকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বললো।

-দাদী তো এমনি বলেছে আম্মা,আমার নীরা পড়াশোনায় কত ভালো। আমার নীরাকে পড়াশোনা করালে টাকা নষ্ট হবে কেন! কথা দে আম্মাকে সবসময় ভালো হয়ে চলবি,এমনভাবেই সবসময় ভালো ফলাফল করবি কথা দে আম্মাকে। আমার নীরা মা কত গুণী গুণ দিয়ে সবার মন জয় করবি আম্মা। মনে রাখবি ভেতরের সৌন্দর্যই সব বাহ্যিক সৌন্দর্য আর কয়দিন থাকে।

মায়ের কথা শুনে নীরা তার মাকে জড়িয়ে ধরলো।

-তোমায় কথা দিলাম আম্মা,তুমি পাশে থাকলে আমি সব জয় করতে পারবো। কখনো তোমার অবাধ্য হবো না। নিজ যোগ্যতায় সবাইকে দেখিয়ে দিবো আমিও পারি।

মেয়ের কথা শুনে খুশিতে মালিহা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস সমাজের এই ভ্রান্ত ধারণা তার মেয়ে ভেঙ্গে দিবে। সবাইকে দেখিয়ে দিবে প্রতিবন্ধী হওয়া স্বওেও সে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো সব করতে পারে।

-ওইই দেখ ওই দেখ ল্যাংড়া মাইয়া যায়।

কলেজে যাচ্ছিলো নীরা। বহু কষ্টে তাকে পড়ানোর জন্য তার বাবাকে রাজি করিয়েছেন তার মা। তার বাবা প্রথমে রাজিই হচ্ছিলেন না। পরবর্তীতে তার মায়ের কথায় করুনা করে রাজি হয়েছেন। তবে তিনি বেশি টাকা দিতে পারবেন না এও বলেছেন। নীরা ভালো ছাএী হওয়ায় কলেজ থেকে উপবৃওির টাকাতেই পড়তে পারছে। এখন সে রোজ কলেজে যাওয়া আসা করে। তবে প্রায় প্রতিদিনই পাড়ার ছেলেদের তিরস্কারের শিকার হতে হয় তাকে। প্রতিদিন মাথা নিচু করে সে চলে যায়। প্রতিবাদ করে না। তবে সে এতদিনে এটা বুঝে গেছে যে তাকে চুপ থাকলে চলবে না। প্রতিবাদ করতে হবে নইলে এরা মাথায় চড়ে বসবে। নীরা পাড়ার ছেলেগুলোকে আজ ক্রস করলো না বরং আজ ওদের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ছেলেগুলো এতক্ষন হাসি ঠাট্টা করছিলো। এবার ওকে ওদের সামনে দাড়াতে দেখে ভড়কে গিয়ে তাকিয়ে রইলো।

-আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন ভাইয়েরা?

নীরার সালাম দেওয়া শুনে সবাই আরো ভড়কে গেলো।

-সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব জানেন তো? তাহলে জবাব দিন।

এবার ছেলেগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জবাব দিলো।

-আপনারা প্রতিদিন আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। মজা করেন। এটা করে কি কোনো লাভ হয় আপনাদের? আমাকে কে বানিয়েছেন বলেন তো! আমাকে নিশ্চয়ই আমি নিজ হাতে বানাইনি। আপনাদের মহান আল্লাহ তৈরি করেছেন আমাকেও তিনিই তৈরি করেছেন। তাহলে আমার দোষটা কেথায় বলতে পারেন? কেন আমাদের মতো মানুষদের আপনারা বাঁকা চোখে দেখেন? কেন আমাদের নিয়ে মজা করেন বলতে পারেন? এসব করে কি কোনো লাভ হচ্ছে! না হচ্ছে না। বনং আপনাদের কটুকথাই আমাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে যথেষ্ট। আপনাদের কথাই আমাদের এগোতে দেয় না। আপনারা যদি আমাদের মতো মানুষদের পাশে দাড়াতেন তবে আজ আমরাও আপনাতের মতো স্বাভাবিক ভাবেই বাঁচতাম। আমাদের প্রতিনিয়ত কটু কথা শুনতে হতো না। আমার একটা পা ছোট কিন্তু আমি তো এটা ইচ্ছে করে করিনি। কোনো মানুষ চায় না অসম্পূর্ণ হতে। সব আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা। আল্লাহর সৃষ্টি আমরা সকলেই। তাহলে কেন আপনারা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে মজা করবেন বলতে পারেন? জবাব আছে কারো কাছে?

নীরার কথা শুনে সবাই মাথা নিচু করে রইলো। কেউ কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। আসলেই তো এখানে নীরার দোষটা কই সে তো নিজেকে নিজে তৈরি করেনি।

-ভাইয়া, আপনাদের কি মনে হয়। আমাকে নিয়ে মজা করলে আল্লাহ আপনাদের ওপর খুব খুশি হন? নিশ্চয়ই না সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে কথা বলার অধিকার কারো নেই। আপনাদেরও না আমারও না। সবাইকে সম্মান করতে না পারলেও অসম্মান করার অধিকার নিশ্চয়ই আপনাদের নেই। ভালো থাকবেন আসি।

কথা শেষ করে নীরা চলে আসলো। তার চোখ দুটো জ্বলছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগুন বের হবে।
নীরার কথায় ওখানকার সবাই অনুতপ্ত হলো। জেনে বুঝে এতদিন একজনকে বিনা কারনে কষ্ট দিয়ে আসছিলো। অসম্মান করছিলো।

বাড়ি পৌছে নীরা দেখলো ঘরভর্তি মানুষজন। নীরা মনে করতে পারলো না আজ বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান আছে কিনা। সে দ্রুত তার ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর তার বাবা আসলেন তার ঘরে। নীরা অবাক হলো সচরাচর তার বাবা তার ঘরে আসেন না। নীরার সাথে তিনি পারতপক্ষে কথাই বলেন না তবে আজ হঠাৎ কি হলো।

-নীরা, আমি তোমার বাবা আমি নিশ্চয়ই তোমার ভালোই চাইবো। বাইরে পাএপক্ষ অপেক্ষা করছেন। ওরা তোমাকে দেখতে এসেছে। ছেলের আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো বউটা মারা গেছে। একটা বাচ্চাও আছে। তোমার মতো প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য নিশ্চয়ই এরচেয়ে ভালো প্রস্তাব আসবে না। তাই নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরি করে নাও। সব ঠিক থাকলে তোমার বিয়ে এখানেই হবে।

সবসময় শান্ত নীরা এবার শান্ত থাকতে পারছে না। সে সবকিছু মেনে নিয়েছে। মানুষের অবহেলা,বাবার অবহেলা,অনাদর কিন্তু আজ এটা কিছুতেই মানতে পারছে না। ইতিমধ্যে তার মা মালিহাও ঘরে প্রবেশ করেছেন। তিনি স্বামীর সম্মুখে দাড়িয়ে বললেন।

-মেহমান এসেছে, আমি তাদের যথাযথ আপ্যায়ন করবো। মেহমানদের এমনি এমনি বিদায় করবো না। তবে আমি আমার মেয়েকে এখানেও বিয়ে দেবো না। বাবা হিসেবে কোন দায়িত্ব পালন করেছো তুমি? যে এখন হঠাৎ মেয়ের বিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছো? তোমাদের সব অন্যায় আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু নীরার বিয়ে আমি ওর অমতে কখনোই দিবো না।

নীরার বাবা তার মায়ের কথা শুনে চটে গেলেন।

-তোমার প্রতিবন্ধী মেয়েকে যে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াচ্ছি এই ই তো ঢের। কে করবে তোমার প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে? কে করবে? কি করে তোমার মেয়ে আমার ঘরের অন্ন ধ্বংস ছাড়া তো কিছুই করে না।

নীরা তার বাবার কথা শুনে চোখের পানি ফেলছে বসে বসে। তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। বিধাতা কেন তাকে এভাবে তৈরি করলো। কখনো নিজের এুটি নিয়ে অভিযোগ করেনি নীরা। তবে আজ অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে। চোখের পানি বাঁধ মানছে না।

-শোনো বউমা তোমার মেয়েকে নিয়ে আদিক্ষেতা অনেক হয়েছে। আর না। এই ঘুঁটেকুড়ানি প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য কোনো রাজকুমার আসবে না। এই সম্বন্ধটা যে এসেছে এই ই তো বেশি। তারা তোমার মেয়ের পরিস্থিতি জানে তবুও তারা আগ্রহ করে এসেছে। তুমি কি মনে করো তোমার মেয়ের জন্য এরচেয়ে ভালো সম্বন্ধ আসবে!

বাবা আর দাদীর কথা সহ্য হচ্ছে না নীরার। চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিচ্ছু করতে পারছে না সে। তার জন্য তার মাকেও কথা শুনতে হচ্ছে।

-যাই হয়ে যাক আমি নীরার বিয়ে দিবো না এখন। বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না আম্মা। নাহলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো। আমার মেয়ে আমি বুঝবো। ও ওর বাবার টাকায়ও পড়াশোনা করছে না। এখন এত সমস্যা হলে নীরার পরীক্ষার পর ওকে আমি বাইরে পড়তে পাঠাবো। তাও আমি এখানে ওর বিয়ে দেবো না।

নীরার মায়ের কঠিন কথা শুনে নীরার বাবা আর দাদী দমে গেল। এ যাএায় পাএপক্ষ চলে গেল।
নীরা ওর মমতাময়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো দুনিয়া ওর বিপক্ষে গেলেও ওর মা ওর পাশে আছে। নীরার নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয় এমন নারীর গর্ভে ওর জন্ম হয়েছে ভেবে। তখন নিজেকে সেরা সুখী মনে হয়। নীরা ওর মাকে জড়িয়ে ধরলো।

-আম্মা,আমার আম্মা। তুমি আমার পাশে না থাকলে আমি কিছুই না আম্মা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

মায়ের বুখে মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছে নীরা। কাঁদার জন্য কিছু বলতেই পারছে না সে।

-ধুর পাগলি মেয়ে খালি কাঁদলে হবে! নিজেকে শক্ত কর মা। তুই নরম থাকলে সবাই তোকে পেয়ে বসবে। নিজেকে ছোট করে দেখিস না মা। তুই পারবি নিজেকে প্রমান করতে আমি জানি তুই পারবি। খালি মন শক্ত করে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। আর আমি সবসময় তোর পাশে আছি।

মায়ের কথা শুনে নীরা ভাবে আমাকে পারতেই হবে। আম্মার মান রাখার জন্য হলেও এগিয়ে যেতেই হবে।

-তোমরা কি কাঁদতেই থাকবে দুজনে? এবার একটু হাসো পাএরা চলে গেছে তো। আর আমি কিন্তু রাগ করেছি। আমাকে তো জড়িয়ে ধরছো না। দুজন দুজনকে কি সুন্দর জড়িয়ে ধরে আছো। কেউ ভালোবাসো না আমায়!

মুখ ফুলিয়ে কথাটা বললো নীরার ছোট বোন মিলা। সে তার বোনকে খুব ভালোবাসে। নীরাও জানে পৃথিবীতে এই দুজন মানুষই তাকে সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসে। সে তার বোনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো। মিলা মুখ ফুলিয়ে কাছে গেল। নীরা জড়িয়ে ধরতেই তার গোমড়ামুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। তিন মা-বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। জানালা দিয়ে গোধুলির আলো আসছে। তিনজনেরই মুখে হাসি চোখে জল। অপরূপ দৃশ্য।

অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-এক
নাফিসা নীলয়া!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here