অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-বিশ
নাফিসা নীলয়া!
সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় দুইবোন বাড়ি ফিরলো। মিলা অনেক আনন্দ করেছে আজকে। নীরা মিলার সব ফেভারিট জায়গায় নিয়ে গেছে। শপিং ও করে দিয়েছে। এজন্য মিলা খুব খুশি আজকে। সকালে নীরার ধমক খাওয়ার পরে মন খারাপ হলেও এখন তার রেশটুকুও নেই। দুই-বোন বাড়িতে হাসিখুশি ঢুকলো। মালিহা ওদের অপেক্ষা করছিলেন।
-কি সারাদিন কেমন কাটলো দুই বোনের?
মালিহা হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন। মিলা শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে মালিহার পাশে বসলো।
-আম্মা দেখো আজকে আপা আমাকে কতকিছু কিনে দিয়েছে। উফ কওদিন পর শপিং করলাম। দেখো এইযে তোমার জন্যও শাড়ি এনেছি।
বলতে বলতেই মিলা মালিহাকে সব দেখানো শুরু করলো। বাইরে থেকে এসে ফ্রেসও হলো না সে। নীরা ও ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসেছে। মিলার কান্ড দেখছে বসে বসে। মালিহা বিরক্ত হলেন দুইবোনের ওপর।
-আহ্ মিলা বাইরে থেকে এসেছিস কোথায় ফ্রেস হবি তা না করে এখানে বসে পরেছিস। পরেও দেখাতে পারবি আগে ফ্রেস হ যা।নীরা দুইও যা ফ্রেস হয়ে আমার ঘরে আয় কথা আছে।
মালিহার কথা শুনে নীরা আর মিলা দুজনই উঠে ঘরে গেল। মালিহা রান্নাঘরে গেলেন সবার জন্য চা বানাতে।
শিহাব অফিস থেকে বাড়িতে এসে দেখলো সব শুনসান। তিতলি আজ তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছিলো অথচ তারই পাওা নেই। কারোই কোনো পাওা নেই। সে একটু অবাকই হলো। কারন প্রতিদিন বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে তিতলি এসে তার খোঁজ নেয়। তারপর সারাদিনের যতো কথা আছে সব বলে। রেহানও তখন এসে হাজির হয়। জহুরা খালাসহ চারজন একসাথে গল্প করে। অথচ আজ কারো কোনো সারাশব্দ নেই। ব্যপারটা বোধগম্য হলো না শিহাবের। সে তিতলি আর জহুরাকে দুইবার হাঁক ছেড়ে ডাকলো। কিন্তু তবুও কারো পাওা পাওয়া গেল না। সে নিচের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে করতেই এগোলো। আর তখনই তার সামনের মানুষটার উপস্থিতি টের পেল। টের পেয়ে মাথা তুলে তাকালো। এবং চরম বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল। তার সামনে দাড়িয়ে আছেন একজন মধ্যবয়সী সুশ্রী নারী। যার পরনে রয়েছে সাদা শাড়ি। যেই নারী শিহাবের মা হন। যে তাদের বাবাকে ছেড়ে তাদের তিন-ভাইবোনকে ছেড়ে অন্য আরেকজনের হাত ধরে চলে গেছে। শিহাব নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। সে ভাবতে থাকলো এতো বছর বাদে তার মা এখানে কি করছেন। আর এখন তার এক্স হাজবেন্ডের বাড়িতেই বা কি কাজ! শিহাবের দ্রুত তার বাবার কথা মনে পরলো। বাবা কই। এই মহিলাকে দেখে বাবা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবেন। প্রকাশ করবেন না। স্বাভাবিক আচরন করবেন। কিন্তু শিহাব জানে যে তার বাবা এখনো এই মহিলাটির জন্য কষ্ট পায়। সে সব জল্পনা কল্পনা শেষ করে তার মায়ের দিকে তাকালো।
-আপনি হঠাত এখানে কেন? আমাদের সাথে আপনার লাস্ট দুই বছর আগে দেখা হয়েছিলো কিছু কারনে। এরপর তো আর কোনো কারন নেই আমাদের সাথে দেখা করার।
শিহাবের এমন কথায় তার মা জায়মা অবাক হলেন না। কারন শিহাব তার সাথে সবসময় এভাবেই কথা বলে। তিনি ছোট্ট করে হাসলেন।
-তুমি তো জানো লাস্ট টু ইয়ার আমি এব্রডে ছিলাম তোমার ভাইয়ের কাছে।
-আমার কোনো ভাই তো এব্রডে থাকে না। কি দরকার সেটা বলুন।
জায়মা আবারও হাসলেন।
-আমি তোমাদের দেখতে এসেছি। কিন্তু তিতলি ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আমার কথা শুনেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। রেহান ও নাকি বাইরে আছে। তাই জহুরার সাথে বসে ছিলাম এতক্ষন।
শিহাব টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে বললো।
– তিতলি নিশ্চয়ই চাইছে না আপনার সাথে দেখা করতে তাহলে তো আর দরকার নেই দেখা করার। রেহান আসুক আপনি থাকুন। ওর সাথে দেখা করুন আপনি।
ততোক্ষনে জহুরা ও এসে হাজির হয়েছেন। শিহাব জহুরাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-খালা তুমি দেখো ওনার কি প্রয়োজন হয়।
জহুরা শিহাবের কথায় মাথা দোলালেন।
-তুমি কেমন আছো?
শিহাব কথা শেষ করেই ওপরে চলে যাচ্ছিলো। জায়মার কথা শুনে থেমে গেল। তারপর জায়মার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
-ভালো আছি।
বলেই চলে গেল। জায়মা তাকিয়ে রইলেন শিহাবের যাওয়ার দিকে। জায়মার কষ্ট হয় নিজের ছেলে-মেয়েদের ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। তিনি জানেন তিনি স্বার্থপর কিন্তু মা তো। রেজা সাহেবের সাথে বিয়ের আগে তার একজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। পরিবার মেনে নেয়নি। জোর করে রেজা সাহেবের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। রেজা সাহেব অবশ্য জানতেন না। বিয়ের পর জায়মার আচরন দেখে বুঝেছিলেন। তারপর জায়মাও একসময় বুঝলো এভাবে হয় না তাকে মানিয়ে নিতে হবে। যার ফল স্বরূপ শিহাব,রেহান আর তিতলির জন্ম। তারপরও সবকিছু ভালো চলছিলো। রেজা সাহেব দায়িত্ববান স্বামী ছিলেন। ভালোবাসতেন অভিযোগ করার সুযোগ ছিলো না। তবে পুরনো প্রেম জায়মা ভুলতে পারেননি। তার প্রাক্তন সোহেলের সাথে হঠাত একদিন দেখা হওয়ার পর আবারও তারা পুরনো সম্পর্কে ফিরে গেলেন। সোহেলেরও বিয়ে হয়েছিলো। তবে সোহেলের স্ত্রী একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়। তারপরই সোহেল আর জায়মা ঠিক করে তারা আবার বিয়ে করবে। এবং পালিয়ে যায়। তার কয়েকদিন পর জায়মা রেজা সাহেবের থেকে ডিভোর্স নেয়। রেজা সাহেব বুঝেছিলেন। তাই নীরবে তিনিও ডিভোর্স দিয়ে দিলেন। সেদিন রেজা সাহেবের চোখে এক সমুদ্র দুঃখ দেখেছিলেন জায়মা। রেজা সাহেব সেদিন শুধু বলেছিলেন।
“আমাদের সন্তানদের কথা ভাবলে না। যাই হোক যেখানে তোমার শান্তি সেখানেই তোমার যাওয়া উচিত। তবে পালানোর প্রয়োজন ছিলো না। আমাকে বললেই হতো।”
কিন্তু তখন একবারো জায়মার রেজা সাহেবের কথা শুনে খারাপ লাগেনি। আজ খারাপ লাগে অনুশোচনা হয়। তার সন্তানদের কথাও সেসময় তিনি ভাবেননি। সোহেলের জন্য এতোই মও ছিলেন যে ছোট্ট তিতলিকে ফেলে চলে যেতেও দ্বিধাবোধ করেননি। সোহেলের কাছে যাওয়ার পর তাদের আর সন্তান হয়নি। সোহেলের আগের পক্ষের ছেলেকেই বড় করেছেন জায়মা আর সোহেল। তবু নিজের সন্তান তো নিজের সন্তানই। শিহাব,রেহান,তিতলির জন্য জায়মার কষ্ট হয়। তিনি যখন ওদের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখেন। তখন কিছু বলতে পারেন না। কারন তিনি তো এটারই যোগ্য। পুরনো সব কথা ভাবতে ভাবতেই কারো কন্ঠস্বর শুনে তার হুস ফেরে। রেজা সাহেব এসেছেন নিচে। জায়মাকে দেখে তিনি একদম স্বাভাবিক আচরনই করলেন। জায়মা অবাক হন রেজা সাহেবের ব্যবহার দেখে। ডিভোর্সের পর তাদের যতোবারই দেখা হয়েছে। রেজা সাহেব একদম স্বাভাবিক আচরন করতেন। শিহাব, রেহান তিতলিকে জায়মা মাঝেমাঝে দেখতে চাইতেন। তবে শিহাব আর তিতলি জায়মার সাথে অতটা কথা বলতো না। শুধু রেহান বলতো। রেহান এখনো বলে। তিন ভাইবোনের মধ্যে রেহানই এমন। কারো জন্য তার মনে ঘৃণা রাগ জন্মালেও সে হাসিমুখে কথা বলে।
-এতো দিন পর? ছেলে-মেয়েদের সাথে দেখা করতে এসেছো?
-হ্যা,বসো আরেকটা দরকারি কাজের জন্যও এসেছি।
জায়মার কথা শুনে রেজা সাহেব সামনের সোফায় বসলেন।
-বলো।
জায়মা গলা পরিষ্কার করে কথাগুলো সাজিয়ে নিলেন।
-বলছি শিহাবের তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কিছু ভেবেছো ওর জন্য?
রেজা সাহেব দুদন্ড ভাবলেন। তারপর বললেন।
-না, শিহাবের যখন ঠিক মনে হবে। তখন ও নিজেই বলবে।
-আরে ও বলবে কি! তুমি তো জানোই ওর স্বভাব কেমন। ও কি এসব বলবে নাকি। আমি শিহাবের জন্য কিছু ভেবেছি।
জায়মার কথায় রেজা সাহেব সরাসরি তাকালেন তার দিকে।
-কি ভেবেছো?
-শিহাবের জন্য আমি আমার বোনের মেয়ে তিশাকে ঠিক করেছি অনেক আগেই। তিশাকে তো দেখেছো। আমাদের সেপারেশনের পরও তো শিহাবদের ওদের সাথে যোগাযোগ ছিলো। তো তিশাও শিহাবকে পছন্দ করে। এখন তুমি শিহাবের সাথে কথা বলো।
জায়মা এমনভাবে বললেন যেনো তিনি শিহাবদের একজন দায়িত্বশীল মা।
-তুমি শিহাবের মা। আমি তো আর তোমাকে এসব বিষয়ে বাধা দিতে পারিনা। তোমার অধিকার আছে। আচ্ছা আমি তিতলি আর রেহানের সাথে কথা বলে দেখবো। তুমি নিজে শিহাবকে বললে আরো ভালো হয়।
রেজা সাহেবের কথা শুনে জায়মা একটু নিশ্চিন্ত হলেন। তার চোখে তিশা একজন চমৎকার মেয়ে। তিশার সাথে বিয়ে হলে নিশ্চয়ই শিহাব তার কাছে আবার আগের মতো ফিরে আসবে। একদম ছোট্টবেলার মতো আম্মু আম্মু করবে। ইশ! কতদিন শিহাবের মুখে মা ডাক শোনেন না তিনি।
রেহান বাড়িতে এসে তাদের মাকে দেখে একটা হাসি দিলো। জায়মাও হাসলেন।
-কেমন আছো মা?
-ভালো তুমি কেমন আছো?
-একদম বিন্দাস।
-আর বলো কেমন চলছে পড়াশোনা?
-সেটাও বিন্দাস! আর কয়েকদিন পরই তো গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে।
রেহানের সাথে গল্প করেই জায়মা বিদায় নিলেন
জায়মা চলে যাওয়ার পর তিতলি দরজা খুলেছে। রাতে খাওয়ার সময় ক্রোকারিজের সব জিনিস ডায়নিং টেবিলে জোরে জোরে শব্দ করে রেখেছে। পানি খেতে গিয়ে গ্লাস জোরে রেখেছে। তার কান্ড দেখে কেউ কিছু বলার সুযোগ পায়নি। তার সব রাগ জায়মার ওপর। মাকে সে ঘৃণা করে।
-কি হয়েছে তিতলি? এমন করছিস কেন?
রেহানের কথাটা তিতলির গায়ে আরো আগুন জ্বালিয়ে দিলো। সে রেহানের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো।
-কত বার বারন করেছি ওই বাজে মহিলাটার সাথে কথা না বলতে। তাও কথা বলেছিস। হেসে হেসে বলেছিস। আবার জিজ্ঞেস করছিস আমার কি হয়েছে?
তিতলির আচরন দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। রেহান জহুরার দিকে তাকালো। নিশ্চয়ই জহুরা তিতলির কাছে বলেছে।
-তিতলি এভাবে একদম কথা বলবি না। কেউ মায়ের সম্পর্কে এভাবে কথা বলে না। আরেকদিনও যেনো না শুনি।
শিহাবের গমগমে কন্ঠস্বরে তিতলি চুপসে গেল। আর কিছু বললো না। রেহান ভেজা বেড়ালের মতো রয়েছে। কারন তিতলির অগ্নিঝড়া দৃষ্টি এখন তার ওপর। রেহান বুঝলো শিহাব চলে যাওয়ার পর তিতলি তার ক্লাস নেবে।
-আপা চুল বেঁধে দাও।
নীরা বই পড়ছিলো। মিলার কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো।
-আয়। এতবড় মেয়ে এখনো ওকে আমার চুল বেঁধে দিতে হয়।
মিলা হেসে নীরার সামনে বসে পরলো।
-আপা সাইফ ভাইয়া আর রুমা আপা হানিমুনে যাবে না?
-যাবে তো বললো। কিন্তু এটা নিয়েও দুজনের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। রুমা বলছে পাহাড় সাইফ বলছে সমুদ্র। এই করে করেই তো রুমার ছুটির সময় যাওয়া হলো না।
-এই দুজন কিভাবে প্রেম করলো আপা? আমার তো প্রথমে তোমার মুখে শুনে বিশ্বাসই হয়নি।
মিলার কথা শুনে নীরা হাসলো।
-ভালোবাসা বলে কয়ে আসে না।
-আচ্ছা তবে আমিও বলে কয়ে আনাবো না। চুপিসারে প্রেম করবো। কেমন হবে বলো তো?
-তবে রে দাড়া দেখাচ্ছি মজা!!
নীরা মিলার কান টেনে ধরলো। মিলা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
-আচ্ছা আচ্ছা যাও করবো না। শুনো আপা আজ আমি তোমার কাছে ঘুমাবো।
-বলার কি আছে। ঘুমা। আর জলদি ঘুমাবি কাল না মর্নিং এ তোর ক্লাস আছে। সকালে আমি উঠিয়ে দিতে পারবো তাড়াতাড়ি।
-আচ্ছা। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।
বলতে বলতেই মিলা বিছানায় শুয়ে পরলো। নীরা মৃদু হেসে উঠে ড্রেসিংটেবিলে চিরুনি রাখলো। মিলার গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিলো। তারপর বসে মিলার মাথায় হাত বুলাতে থাকলো। দুই মিনিটের মাথায় মিলা ঘুমিয়ে গেল। নীরা ঘড়িতে সময় দেখলো সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। তারও ঘুমাতে হবে। ভেবে সে ও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তবে তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিলো। মিলা ঘুমাচ্ছে ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে তাই নাম না দেখেই তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করলো। তারপর বারান্দায় চলে আসলো।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুমুস সালাম।
নীরা কন্ঠস্বর শুনে ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখলো শিহাব কল করেছে। আগে নাম্বারটা দেখলে সে কল ধরতো না। ফোন সাইলেন্ট করে দিতো। খুব ভুল হয়ে গেছে। ভাবলো নীরা।
-কি জন্য কল করেছেন?
-এমনিই কল করেছি।
-আচ্ছা যেহেতু কোনো কারন নেই। তবে আমি রাখছি।
-শুনো তুমি যদি এখন ফোন কেটে দাও তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
শিহাবের কথা নীরা আমলে নিলো না। সে ফোন কেটে দিলো। তারপর পেছন ফিরে মিলাকে দেখলো। মিলা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। যাক ভালোই হয়েছে। নীরা রাতের আকাশ দেখতে থাকলো। তারপর ভাবলো শিহাবের নাম্বারটা ব্লক করে দিলে কেমন হয়! ভাবতে ভাবতেই শিহাবের নাম্বার থেকে আবার কল আসলো। নীরা তাড়াতাড়ি ফোন সাইলেন্ট করলো। আবারও পেছন ফিরে মিলাকে দেখলো। নাহ্ মিলা ঘুমাচ্ছেই সে শিহাবের নাম্বারটাই ব্লক করে দিলো। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে সে।। এই বয়সে এসে এসব সহ্য করতে হচ্ছে বলে। শিহাবকে এতো করে বোঝানোর পরও এমন বিহেভ। সত্যিই মানা যায় না। নীরা মাথা থেকে এসব বের করে মিলার কাছে গেল। দেখলো মিলা গায়ের ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে ফেলেছে সে ব্ল্যাঙ্কেট ঠিক করে দিলো। তারপর নিজে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ঘুম আসলো না। তারপর আবার বারান্দায় গেল। আশে পাশে তাকাতে তাকাতে সে যখন নিচে তাকালো। তখন সে অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌছে গেছে।
শিহাব নিচে দাড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তাকে দেখা যাচ্ছে। নীরা ভুল দেখছে নাকি বুঝতে পারলো না। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো শিহাব সত্যিই এসেছে। শিহাব নিচে দাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে ইশারা করছে। নীরা বুঝলো শিহাব তাকে আনব্লক করতে বলছে। নীরার এখন নিজের কপাল নিজের চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। সে ঘরে গিয়ে ফোন নিয়ে আসলো। শিহাবের নাম্বার আনব্লক করলো। শিহাব সাথে সাথে ফোন দিলো। নীরা অনিচ্ছাসত্বেও ধরলো।
-নিচে আসো।
-কিহ্!!
-যা শুনেছো তাই নিচে আসো। রাইট নাও। আদারওয়াইজ।
নীরা থমথমে গলায় বললো।
-আদারওয়াইজ হোয়াট?
-আমি উপরে আসছি। তোমাদের বিল্ডিং এ আসছি।
নীরা ভাবলো শিহাব এটা করবে না। তাই সে তার কথায় অনড় রইলো। চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো ফোন কানে নিয়েই।
-তুমি বোধ হয় বিশ্বাস করছো না। ওকে আমি আসছি।
বলেই শিহাব আগাতে থাকলো। নীরা তবুও কিছু বলছে না। যখন দেখলো শিহাব গেটের কাছে যাচ্ছে তখন কথা বললো।
-আসছি।
-গুড। আসো।
নীরা আস্তে আস্তে ঘরে গিয়ে গায়ে শাল জড়ালো। তারপর মিলাকে দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। নিচে এসে দেখলো দারোয়ান বসে বসে ঘুমাচ্ছে। সে আস্তে করে গেট খুললো। দারোয়ান বুঝতেও পারলো না। নীরা ভাবলো আসার সময় দারোয়ানকে সতর্ক করা যাবে। সে দারোয়ানের গায়ের শাল আস্তে করে ভালোভাবে জড়িয়ে দিয়ে বের হলো। কারন লোকটার গায়ের শাল একপাশে পরে গেছিলো।
নীরার এমনিতেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আস্তে হাটতে হয়। আর আজ আরো আস্তে হাটতে হচ্ছে তাকে। শিহাব নীরাকে দেখে ছোট্ট একটা হাসি দিলো। নীরার গায়ে ছাইরঙা সালোয়ার কামিজ। গায়ে কালো রঙা শাল। মাথায় ছাইরঙা ওড়না। তবুও চুল যে এলোমেলো বোঝা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শিহাব মুগ্ধ হয়ে নীরাকে দেখে নিলো। নীরার দিকে তাকিয়ে থাকতে সে কখনো ক্লান্ত হবে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। সে চোখ বন্ধ করে খিঁচে আবার তাকালো। নীরা আস্তে আস্তে হেটে শিহাবের সামনে আসলো।
-তুমি যদি তখন আমার ফোন কেটে দিয়ে ব্লক না করতে। তবে আমি এখন আসতাম না। কি করার আছে আমি তো ওয়ার্ন করেছিলাম। বাট তুমি শোনোনি।
শিহাবের কথা শুনে নীরা চোখ গরম করে তাকালো।
-ওদিকে চলুন।
-চলো।
নীরা আর শিহাব বিল্ডিং এর সামনে থেকে আরেকটু দূরে চলে আসলো। একটা বেঞ্চিতে শিহাব ধপ করে বসে পরলো। নীরা দাড়িয়েই রইলো।
-এমন করার মানে কি শিহাব?
-আমি একটু ডিপ্রেস্ড ছিলাম। আর তোমার সাথে কথা বললে আমার ভালো লাগে। তাই ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো! যাক। বসো।
-আমি বসতে আসিনি। তাড়াতাড়ি যেতে হবে আমাকে।
শিহাব বসেই তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা বকুল ফুলের মালা বের করলো। নীরার সামনে ধরে বললো।
-নাও।
-কিহ্!
-বাংলা ভাষা বোঝো না নিতে বলেছি।
নীরা ভেতরে ভেতরে চিৎকার করে উঠলো। বিরক্ত হয়ে সে হাত বাড়িয়ে মালাটা নিলো। শিহাব খুশি হলো।
-বসো পনেরো মিনিট পরে যাবে।
নীরা বুঝলো এখন তাকে শিহাবের কথাই শুনতে হবে। সে বসে পরলো।
-এতো রাতে বকুল ফুল কোথায় পেলেন?
-বিকালে নিয়েছিলাম।
-ও!
-তুমি কি জানো নীরা তুমি কতোটা মূল্যবান আমার কাছে?
নীরা কিছু বললো না সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-আমি কখনো কারো জন্য এতো মরিয়া হইনি যতোটা তোমার জন্য হয়েছি। আমাদের মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি ভালোবাসতে ভয় পাই। তবে তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর সব বদলে গেল। যেই আমি সবার সামনে একজন গম্ভীর কাজের প্রতি ডেডিকেটেড মানুষ। সেই আমিই তোমার সামনে সম্পূর্ণ অন্যরকম। এটা কিভাবে হয়েছে আমি জানি না। তবে এক সন্ধ্যা রাতে তোমাকে দেখলাম। তারপর থেকেই আমার সব এলোমেলো। তুমি আমাকে রিজেক্ট করেছো নীরা! আমি কখনো ভাবিনি আমাকে কেউ রিজেক্ট করতে পারে। এজন্যই আমার খারাপ লেগেছিলো। আমাকে রিজেক্ট করার কারনটা কি?
-কারন আপনাকে আমার পছন্দ না।
নীরা সামনের দিকে তাকিয়েই কথাটা বললো। শিহাব জোরে হেসে ফেললো। হাসির আওয়াজ শুনে নীরার শিহাবের হাসিটা খুব দেখতে ইচ্ছে করলো। নিশ্চয়ই নীরা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর হাসিগুলোর একটি হাসি দেখার ইচ্ছে দমিয়ে রাখলো। তার কাছে প্রিয় মানুষদের হাসি সবসময় প্রিয় এবং সবচেয়ে সুন্দর। আর এই সুন্দর হাসির তালিকায় এখন শিহাবের হাসিও আছে। কেন কে জানে!
-আচ্ছা বাদ দেই। আজ আমার মা এসেছিলেন জানো!
শিহাবের এই কথা শুনে নীরা চট করে শিহাবের দিকে তাকালো। দেখলো শিহাবের মুখে বিষাদের ছায়া।
-আপনার মা?
-হ্যা। আনফরচুনেটলি আমার মা।
-এভাবে বলছেন কেন?
শিহাব নীরার দিকে তাকালো। শিহাবের চোখেও কষ্ট ফুটে উঠেছে। নীরা ভেবেছিলো শিহাবের মা মারা গেছেন। নীরা শিহাবের মায়ের ব্যাপারটা জানতো না।
-আমাদের মা এসেছিলেন আজ দেখা করতে।
-বুঝলাম না।
-তুমি খুব লাকি নীরা আন্টির মতো একজন তোমার মা। আমরা তিন ভাই বোন তো কখনো মায়ের ভালোবাসাই পাইনি। আমাদের ছোটবেলায় আর তিতলি যখন দুধের শিশু তখন তিনি তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমার এতো ভালো বাবাকে ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। আমার ছোট ছোট দুটো ভাই-বোনকে রেখে চলে গিয়েছিলেন। আমি আমার মাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম আর তাকেই এখন সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি।
শিহাবের কথা শুনে নীরা কিছু বলতে পারছে না। কোনো শান্তনামূলক বাক্যও না। এখানে সত্যিই বলার মতো কিছু নেই। তবুও সে বললো।
-যা হয়েছে তা হয়তো সবার ভালোর জন্যই হয়েছে।। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
-তুমি জানো নীরা মা চলে যাওয়ার পর আমাদের তিন ভাই বোনকে সবার তিরস্কারের স্বীকার হতে হয়েছে। স্কুলে গেলে শান্তি পেতাম না আমরা। রেহানকে সবাই বলতো তোর মা অন্য লোকের সাথে চলে গেছে। রেহান কাঁদতে কাঁদতে এসে সব আমার কাছে বলতো। তারপর থেকে আমরা তিন ভাই বোন নিজেদের সবসময় সামলেছি। একেঅপরের সব কিছু দেখে শুনে রেখেছি। আর আমাদের তিতলি বড় হওয়ার পর দুই ভাইয়ের কতো খেয়াল রাখে।
-শিহাব বাবা-মা আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। কিন্তু বাবা-মা ও ভুল করে। আন্টিও করেছেন। সেটার জন্য ওনার অনুশোচনা হবেই। অনুশোচনার চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু হয় না। আপনি সবসময় এটা ভাবুন যা হওয়ার তা সবার ভালোর জন্যই হয়েছে। আপনারা তিন ভাইবোন যেভাবে একে অপরের পাশে থেকেছেন আর আছেন এটাই বড় কথা। আমি বুঝতে পারছি অনেকদিন পর নিজের মাকে দেখে আপনার কষ্ট হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এতোগুলো বছরই তো নিজেকে সামলেছেন। আজও পারবেন। এখন কষ্ট পাওয়ার কারন নেই। এসব নিয়ে ভাববেন না। মায়ের সাথে দেখা হলে স্বাভাবিক আচরন করুন। যা হয়েছে তা তো বদলানো যাবে না। ভবিষ্যত নিয়ে ভাবুন। আংকেল, রেহান আর তিতলির কথা ভাবুন। ওরাই তো আপনার পাশে থেকেছে সবমসময়। তাই না?
নীরার কথা শুনে শিহাবের শান্তি লাগলো। সে জানতো নীরার কাছে আসলেই সে এসব কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। সে একটু হাসলো।
-তুমি কি জানো? তুমি একজন ম্যাজিশিয়ান।
এবার নীরাও হেসে ফেললো।
-হয়েছে। এবার আমার যেতে হবে পনেরো মিনিটের জায়গায় একঘন্টা হয়ে গেছে। মিলা আমাকে দেখতে না পেলে ঘাবড়ে যাবে। আপনি বাসায় যান এখন।
-আচ্ছা চলো।
শিহাবও নীরার সাথে উঠে দাড়ালো। নীরা চমকে শিহাবের দিকে তাকালো।
-আপনি কই যাচ্ছেন?
-তোমাকে এগিয়ে দিতে।
-আপনাকে যেতে হবে না। আমার বাড়ি সামনেই। আপনার গাড়ি কোথায়?
শিহাব আঙুলের ইশারায় দেখালো। নীরা দেখলো একটু দূরেই গাড়ি পার্ক করা।
-চলো এগিয়ে দেই। তুমি না বললেও আমি শুনছি না।
-আপনি যে একটা ঘাড়ত্যাড়া লোক তা আমি অনেক আগেই বুঝে গেছি।
শিহাব আর কিছু বললো না নীরাকে। শুনসান রাস্তায় দুজন আস্তে আস্তে হাটতে থাকলো। শিহাব পলক না ফেলে নীরার দিকে তাকিয়ে হাটতে থাকলো।
-আমার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হাটুন। নইলে হোচট খাবেন।
নীরা কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই শিহাব হোচট খেলো। নীরা মুখ চেপে হাসলো। শিহাবও হাসলো। বললো
-ইচ্ছে করছে তোমার হাত ধরি। কিন্তু তোমার হাত ধরলে নির্ঘাত তুমি একটা চড় মারবে।
শিহাবের কথায় নীরা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসলো। মাঝরাতে খালি রাস্তায় দুজনে হেটে চলেছে। একজনের চোখে মুগ্ধতা অন্যজনের চোখে চাপা আনন্দ। আকাশের চাঁদটাও বুঝি তাদের দেখে হাসছে।
চলবে!
(দেরি হয়েছে তাই আমার পাঠকদের জন্য বড় করে দিলাম।)