অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব-৫

0
1103

অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-পাঁচ
নাফিসা নীলয়া।

-নীরা অলমোস্ট সব জিনিস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আমার যে কি আনন্দ লাগছে নীরা। আমাদের চেষ্টা সফল হচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এবার বেশি সফল হবো তাই না বল?

উচ্ছাসিত কন্ঠে নিজের আনন্দ প্রকাশ করে রুমা। প্রতিবছর তারা সবাই এনজিওর বাচ্চাদের জন্য এই কাজগুলো করে। গতবার এত বেশি লাভ হয়নি। এবার মনে হচ্ছে হবে। রুমার কথা শুনে নীরার মনটাও প্রশান্তিতে ভরে উঠে।

-ইনশাআল্লাহ, বাচ্চারা যখন জানতে পারবে কি খুশি হবে তাই না রুমা? ওরা কতো পরিশ্রম করেছে। পরিশ্রমের ফল পাবে ওরা। ওদের হাসিমুখ দেখতেই মনপ্রান ভরে উঠে। আচ্ছা সাইফ কই?

সাইফের কথা শুনেই রুমার উজ্জ্বল চেহারা নিভে যায় এক মুহূর্তে। একটু আগেই সে দেখে এসেছে। সাইফ একটা মেয়ের সাথে হাসিহাসি মুখ করে কথা বলছে। সাইফকে নিয়ে সে ওভার পজেসিভ। নীরা ছাড়া সাইফকে আর অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখতে পারে না রুমা।

-তুই ওই ছাগলটার কথা একদম বলবি না নীরা। আমি নিজের চোখে দেখেছি একটু আগে সে একটা মেয়ের সাথে হেসে হেসে হেলতে দুলতে কথা বলছে। আমি জাস্ট নিতে পারছি না নীরা। ওর না ব্রেকআপ হয়েছে। ও না বসে বসে শোক পালন করবে? সেখানে ও এসব কি করছে দেখেছিস তুই? তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে ওর পক্ষ নিবি না বলে দিচ্ছি।

রুমার রাগ দেখে মনে মনে হাসে নীরা। তাদের সব প্ল্যানিং হয়েই আছে। একটু বাদেই রুমার এসব রাগ উড়ে যাবে। তখন এই রুমাই আনন্দে খুশিতে কেঁদে ভাসাবে। এসব জানে নীরা। তার বান্ধবিই যে এমন। এই রাগ,এই হাসি,এই কান্না। কখন কি করে নিজেই জানে না রুমা।

-এই বেয়াদব ছেলে তুমি আমার গায়ে জুস ফেললে কেন? শয়তান ছেলে সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকা তাই না?

-আমি ইচ্ছে করে করিনি টিলা। তুমিই হুট করে আমার সামনে চলে এসেছো। এখন আমার দোষ দিলে তো হবে না।

ওদিকের চেঁচামেচি শুনে নীরার ভাবনা থেমে গেল। সে রুমার দিকে চাইলো। রুমাও তার দিকে চাইলো। দুজনের কেউই বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। এজন্য তারা নিজেরাই দেখতে গেল।

-আমি বুঝতে পারছি না কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তুমি এত শয়তান কেন রেহান? তোমার কাজই কি শয়তানি করা। সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকো তুমি!

নীরা আর রুমা এগিয়ে দেখলো মিলা আর রেহান রীতিমতো ঝগড়া করছে। মিলাই চেঁচাচ্ছে বেশি। মিলা ইতিমধ্যে রেহানের তিকে তেড়ে যাচ্ছে। তখনই মিলার বন্ধুরা ওকে টেনে ধরলো।

-দেখো আপু, তোমার বোনকে তুমি সামলাও। আমরা হাপিয়ে গেছি।

মিলার বন্ধু সোনিয়া আর রাকিব নীরার কাছে অভিযোগ করলো।

এবার নীরা বোনকে ধমক লাগালো।

-হচ্ছেটা কি মিলা? এটা ক্যাফে তোর বাড়ি না এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন তুই? দিনদিন কি ছোট হচ্ছিস তুই? সবাই দেখছে মিলা। এরকম করিস না।

নীরার কথায় মিলা চারদিকে তাকালো সত্যিই সবাই এদিকে তাকিয়ে আছে। এজন্য সে চুপ করে গেল।

-স্যরি এভরিওয়ান। এক্সট্রেমলি স্যরি। আপনারা সবাই কিছু মনে করবেন না।

সবার কাছে ক্ষমা চাইলো মিলা। সবাই আবার যার যার মতো জিনিস দেখতে লাগলো।

-তুমি আমাকে বকছো আপা? আর এই শয়তান ছেলেটা যে আমার গায়ে জুস ঢেলে দিয়েছে তার বেলায়?

-এই টিলা কতবার বলবো আমি ইচ্ছে করে তোমার গায়ে জুস ঢেলে দেইনি। তুমিই তো সারাদিন তিড়িং বিড়িং করো এখনো সেটাই করতে করতে হুট করে আমার সামনে চলে এসেছো। এখন সব আমার দোষ না?

রেহান এবার রেগে গেল। সে কখন থেকে বলছে সে ইচ্ছে করে করেনি। তবুও এই টিলা তাকেই ব্লেইম করছে।

-মিলা,রেহান চুপ করো দুজনই। এখানে দুজনেরই দোষ রযেছে। দুজনেরই একটু সাবধানে চলাফেরা করা উচিত ছিলো। দেখতেই পাচ্ছো এখানে একটু ভীড় আছে। সো নিজেদের খামখেয়ালির জন্যই এমন হয়েছে। একজন আরেকজনকে ব্লেম করা বন্ধ করো। এন্ড দুজনেই দুজনের কাছে স্যরি বলো। সে স্যরি।

নীরা দুজনের ঝামেলা মেটানোর জন্য বললো। এদিকে মিলা রেহান কেউ কাউকে স্যরি বলবে না বলে পণ করেছে। দুজনই দুজনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীরা দেখলো এরা কেউই স্যরি বলতে ইচ্ছুক না।

-মিলা আর রেহান সে স্যরি। একে তো দুজনেই ভুল করেছো। উপরন্ত চেঁচিয়েছো। তোমাদের দুজনের জন্য সবাই বিরক্ত হয়েছে। এবার দুজন দুজনকে স্যরি বলে সব মিটিয়ে নাও। আদারওয়াইজ আমি আরো রেগে যাবো। আর মিলা আমি রেগে গেলে কি হবে জানিস তো?

মিলা তার বোনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। তার বোন রেগে গেলে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আপার সাথে কথা না বলে তো সে থাকতে পারে না। কি আর করার আপার জন্য এই হারামিটাকে এখন স্যরি বলতে হবে। এদিকে রেহানও নীরার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো,নীরাকে সে খুব পছন্দ করে। এজন্য নীরার কথা ফেলতে পারলো না। আর আসলেই তাদের দুজনের জন্য সবাই বিরক্ত হয়েছে। স্যরি বলাই উচিত।

-স্যরি।

মিলা আর রেহান দুজন একসাথেই বলে ফেললো। এবং দুজনেই মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললো। ওদের কান্ড দেখে সবাই হেসে দিলো। শিহাবও হাসলো।

-তোমরা দুইজন কি বলো তো? বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছো। ছোট ভাই তুই এত ঝগড়ুটে কেন বল তো? দুজনই বাচ্চা।

তিতলির কথা শুনে পুনরায় সবাই হেসে ফেললো। এবার মিলাও হাসলো। এই পিচ্চিটাকে দারুন পছন্দ হয়েছে তার। সে ভাবতে পারে না শিহাব আর তিতলির মতো মানুষের ভাই কিভাবে ওই শয়তান রেহান হয়। সে একদম ভাবতে পারছে না।

-আহা পিচ্চি। নিজেই তো বাচ্চা। আমাদের বাচ্চা বলছো আবার! তবে একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছো তোমার ছোট ভাই আসলেই ঝগড়ুটে,আর ফাজিল।

শেষের কথাটা আড়চোখে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো মিলা। রেহান ও আড়চোখে তাকিয়ে ছিলো। তাকিয়ে বেহায়ার মতো একটা হাসি দিলো। তাতে মিলার গা জ্বলে গেল। সে ভেবেছিলো রেহানকে আবার জ্বালাবে। কিন্তু না রেহান তো আবার আগের ফরমে ফিরে গেল।

-ঠিক না মিলা আপু, একদম ঠিক না। আমি এতোটাও পিচ্চি নই। তুমি জানো আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আর আমি আমার ভাইদের খাবার বেড়ে খাওয়াই। আর ভাইদের শাসনও করি। আর তুমি আমাকে পিচ্চি বলছো। নট ফেয়ার।

গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করে তিতলি। তিতলির কথায় মিলা হেসে দেয়। মিষ্টি মেয়েটাকে গাল ফুলালে তো আরো মিষ্টি লাগে। আর তিতলির স্বভাবও প্রায় তার মতো। তিতলিও খুব চঞ্চল। মিলা মিষ্টি করে হেসে তিতলির গাল টেনে আদর করে দেয়।

-আচ্ছা আর বলবো না পিচ্চি। তুমি অনেক বড় ওকে?

এবার দুজন একসাথে হেসে দেয়।

-আচ্ছা তিতলি আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি তুমি বসো।

তিতলি মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। শিহাব তিতলির কাছে আসলো।

-কিরে আর কিছু নিবি তুই? আর কিছু নিতে চাইলে বল একটুপরই এক্সিবিশন শেষ হয়ে যাবে।

শিহাবের কথায় জোরে হেসে দিলো তিতলি। তার ভাইটা কত বোকা। আর কত জিনিস নিবে সে। আর নিলে তো গাড়িতে জায়গাই হবে না।

-না আর নিবো না আমি। তুই বল তোর কি এখানেও কিছু পছন্দ হচ্ছে না ভাই?

-হচ্ছে তো কিন্তু এখনই সেটা নিতে পারবো না।

বিড়বিড়িয়ে বলে শিহাব। শিহাবের বিড়বিড়ানো দেখে ভাইকে হালকা ধাক্কা মারে তিতলি।

-কি বললি ভাই? জোরে বল বিড়বিড়িয়ে বললে শুনবো কি করে?

তিতলির কথা শুনে একটু ভড়কে গেল শিহাব।

-না,কিছু না তুই ই তো নিয়ে নিলি আমাদের জন্য। আমি আর কি নিবো। তোর পছন্দই আমার পছন্দ।

শিহাবের এমন কথায় মিষ্টি করে হাসলো তিতলি। ভাইয়ের হাত ধরলো সে।

-রেহান কিছু মনে করো না। মিলার সাথে সাথে তখন তোমাকেও ধমক দিয়েছি। দোষ তো দুজনেরই ছিলো তাই না? তবুও তোমাকে ধমক দেওয়া উচিত হয়নি। আসলে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ওমনটা করতে হয়েছে।

নীরার কথা শুনে জোরে জোরে হেসে দেয় রেহান। সে তো কিছুই মনে করেনি। নীরার ধমক শুনে তার আরো ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে বড় বোনই তাকে বকা দিচ্ছে।

-একদম না আপু। কিছুই মনে করিনি আমি। কিন্তু এখন যদি তুমি গিল্ট ফিল করো তবে আমি অনেককিছু মনে করবো।

এবার নীরা হেসে ফেললো। রেহানও হাসলো।

-আচ্ছা তোমরা আছো তো আরো কিছুক্ষন? ডিনার করেই যাবে কিন্তু।

ইতিমধ্যে এক্সিবিশন শেষ হয়েছে। এখন নীরারা সবাই ডিনার করবে। আর তারপর সাইফ রুমাকে প্রপোজ করবে। এমনই প্ল্যান নীরার।

-হুম আছি। তিতলি তো যেতেই চাচ্ছে না।

হাসতে হাসতে বললো রেহান।

সবাই একসাথে ডিনার করতে বসলো। রুমা সাইফকে পাশ কাটিয়ে নীরার পাশে বসে পরলো। নীরার পাশে মিলাও বসলো। শিহাব নীরার সামনাসামনি বসেছে। তার এখন অতটা নার্ভাস না লাগলেও একটু অস্থির লাগছে। শিহাবের পাশে রেহান বসলো। তিতলি দাড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না সে কোথায় বসবে। সে তো নীরার সাথে বসতে চাইছিলো। একদিনেই সবাইকে আপন করে নেয় তিতলি। এজন্য নীরা আর মিলাকেও তার আপন লাগছে।

-ভাই,আমি কই বসবো? আমি তো নীরা আপুর পাশে বসতে চাইছিলাম।

শিহাব তখন একবার তিতলির দিকে তাকিয়ে নীরার দিকে তাকালো। তাকিয়েই রইলো। তিতলি ওকে ধাক্কা দিলে ওর সম্বিৎ ফিরলো।

-মিস নীরা, নীরা মানে একটা কথা।

নীরা শিহাবের ডাক শুনে তাকালো।

-হ্যা বলুন।

-হু বলছি যে মানে।

আমতা আমতা করলো শিহাব। তিতলি অবাক হয়ে ভাইকে দেখছে। তার ভাই তো কখনো এমন আমতা আমতা করে না। কি হলো হঠাত। এরচেয়ে ভালো সে রেহানকেই বলতো। অথবা নিজেই বলতো।

-আপু আমিই বলছি মানে আমি তোমার পাশে বসতে চাই।

নিজেই বলে ফেললো তিতলি। তিতলির কথায় নীরা নিজের দুপাশে তাকালো। তার দুই পাশে মিলা আর রুমা। এই দুইজন তো সরতে চাইবে না। তাহলে কিভাবে কি। সে কি তিতলিকে না করবে। তখনই সে দেখলো সাইফ তাকে ইশারা করছে সে যেনো রুমাকে তার পাশে বসিয়ে দেয়। নীরাও ভাবলো তাই ই করা উচিত।

-রুমা তুই সাইফের পাশে বস ওখানটায় খালি আছে।

নীরার কথা শুনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো রুমা। এ তো ঘরের শএু বিভীষণ। সব জানার পরও সাইফের পাশে বসতে বলছে। পরক্ষনেই নীরা চোখের ভাষায় রিকুয়েষ্ট করলো। যে বাচ্চা মেয়েটাকে নিরাশ করা ঠিক হবে না। রুমা বাধ্য হয়ে উঠে গেল। সাইফের পাশে বসলে সাইফ রুমার হাত ধরলো। রুমা ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিলো। সাইফ মনে মনে বললো আর কিছুক্ষন পর আর এমন ঝাড়া মারবে না। তিতলি মহা উৎসাহে নীরার পাশে বসলো। নীরাও হাসলো। সবাই একসাথে খেতে লাগলো।

কিন্তু শিহাব খেতে পারছে না। উশখুশ করছে খাবার নাড়ছে। পানি খেতে গিয়ে বিষম উঠে গেল তার। সবার নজর তার দিকে। তিতলি উঠে গিয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলালো। পিঠে হাত বুলালো। নীরা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে।

-আপনি ঠিক আছেন?

নীরার কথায় শিহাবের কাশি কমার বদলে আরো বেড়ে গেল। তিতলি ক্রমাগত ভাইয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়েই যাচ্ছে।

-রেহান আমার মনে হয় উনি আজ অসুস্থ ছিলেন। বিকেলেও উনি অসুস্থ বোধ করছিলেন।

কথাটা বলেই ফেললো নীরা। শিহাব অবাক হয়ে গেল। এবার তার দুই ভাই বোনকে সে কি জবাব দিবে। দুজন মিলে তো তাকে পাগল করে দিবে।

-হোয়াট সিরিয়াসলি ভাই? কি হয়েছে তোমার? তুমি আগে কেন বলোনি?

-ভাই,তুই আমাকে কেন ডাকলি না? তুই তোর তিতলির কাছে এখন কথাও লুকাবি?

নীরা দেখলো এরা দুজনই কেমন উদ্বিগ্ন ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। তাই সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইলো।

-তেমন কিছু না ওনার মনে হয় একটু অস্বস্তি লাগছিলো নতুন জায়গা তো তাই। আমিই বোধ হয় ভুল ভেবেছিলাম।

কোনো মতে বললো নীরা।

-আই এম অলরাইট তিতলি। আমার কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি। কিছু হলে আমি অবশ্যই তোকে বলতাম। শুধু শুধু চিন্তা করিস না।

তিতলিও ভাবলো তার ভাই তো সব তাকে বলেই। অসুস্থ হলে নিশ্চয়ই বলতো। এজন্য সে আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেল।

-আর ইউ শিওর ভাই?

রেহানের প্রশ্নে বিরক্ত হলো শিহাব।

-শিওর। সবাই খাওয়া শেষ করো। আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে।
দ্রুত কথা শেষ করলো শিহাব।

সাইফ মাইক্রোফোন নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে ভীষণ নার্ভাস। ইতিমধ্যে সবার খাওয়া শেষ এবার সাইফের রুমাকে প্রপোজাল দেওয়ার পালা। নীরা আর মিলা সাইফকে খোঁচাচ্ছে। নীরা বুঝতে পারছে না নিজের প্রেমিকাকে বিয়ের প্রপোজাল দিতে কি কেউ এতটা ঘাবড়ে যায়! আজব ব্যপার। বহু কষ্টে সাইফ নিজেকে তৈরি করলো।

-শুভ সন্ধ্যা এখন যদিও রাত হয়ে গেছে। তবে আমি সবাইকে উইশ করার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না তাই এটাই বললাম।

সাইফের কথায় সবাই হেসে উঠলো। রুমা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না কিছু। সাইফ কি বলবে সব গুলিয়ে ফেলছে। তবুও মনে সাহস রেখে সে বলে চলেছে।

-আজ থেকে কয়েকবছর আগে আমি নীরা আর রুমা এক ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হই। তিনজন তিনজনের জান ছিলাম, এখনো আছি। প্রথম থেকেই আমি নীরাকে বোন হিসেবে দেখে এসেছি। কিন্তু রুমাকে বোনের নজরে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সেটা রুমা না বুঝলেও নীরা ঠিকই বুঝে ফেলেছিলো। রুমা তো খানিকটা বোকা তাই বুঝেনি।

সাইফের এরূপ কথা সবাই ইনজয় করছে। তবে রুমাকে বোকা বলায় সে বেজায় রেগে আছে।

-সো,রুমা আমাকে ভাই ডাকলে আমি রেগে যেতাম। কিন্তু রুমা তো অবুঝ সে আমাকে সাইফ ভাই বলেই ডাকতো। আই মিন ক্লাসমেটকে কে ভাই বলে ইয়ার!

সাইফের কথায় চারিদিকে আবার হাসির রোল পরে গেল। তিতলিরাও ব্যপারটা ইনজয় করা শুরু করেছে।

-তো এবার আসল কথায় আসি। রুমার প্রতি আমার অনুভূতি দিনকে দিন প্রগাঢ় হচ্ছিলো। যা আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু এতকিছুর পরও রুমা বুঝতো না। যদিও সে ও আমাকে পছন্দ করতো। কিন্তু এটা বুঝতো না আমি ওকে কতটা চাই! আমারও একই হাল ছিলো। আমাদের যখন এমন মিসআন্ডার্সট্যান্ডিং চলছিলো। তখন নীরা আমাদের দুজনকেই সত্যিটা বোঝালো। আর তারপর দুজনই বুঝতে পারলাম। আমরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারবো না। এখন আমাদের যতোই বনিবনা না হোক। এন্ড ফাইনালি আমি প্রপোজ করি রুমাকে। আর সে ও রাজি হয়। নীরা সেসময় না বোঝালে আমি হয়তো আজও রুমাকে মনের কথা বলতে পারতাম না। আর আজ আজও যখন ভয়ে আমি আমার বাবা-মাকে বিয়ের কথা বলতে পারছিলাম না তখনও নীরা সব সমস্যা সমাধান করে দিলো। বাবা-মাকে ও ই যা বলার বলে দিলো। নীরা তুই বোধ-হয় আমাদের জীবনের এঞ্জেল তাই না? নইলে কি করে এতো সুন্দর করে সমস্যা সমাধান করে দিলি! সেই প্রথম থেকে নীরা তুই সব সমাধান করে দিস। আমি যখন সেমিস্টার ফি দিতে পারতাম না কি করে যেনো সেই ফি পরিশোধ হয়ে যেতো। আমি জানতাম তুই রাতদিন টিউশনি করিয়েই দিয়ে দিতি। আমি যখন একা ফ্ল্যাটে অসুস্থ থাকতাম তুই এসে রান্না করে দিতি ওষুধ খাইয়ে দিতি। যখনই প্রয়োজন পরতো তুই নীরা তখনই হাজির হয়ে যেতি। রুমার আর আমার যতবারই সিরিয়াস ঝগড়া হতো তুই এসে সমাধান করে দিতি। নীরা তোর ওই একটা সমস্যা তোকে হীনম্মণ্যতায় ভোগাতো আমি জানি। তোকে অনেকের তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে এও জানি। কিন্তু তুই সব বাঁধা পেরিয়ে আজ সফল নীরা। তুই সত্যিই স্পেশাল। আই লাভ ইউ নীরা। আজ তুই ই বলেছিলি রুমাকে প্রপোজ করতে। আমিও রুমাকে বিয়ের জন্য আজই বলতাম। ইনফ্যাক্ট বলবোও। কিন্তু তার আগে আমার মনে হয়েছে যে আমাদের জন্য এতকিছু করলো তাকে নিয়ে তো দুই লাইন বলতেই হয়। লাভ ইউ ইয়ার। তুই আমার বোন,বান্ধবি গাইড সবকিছু। যার ঋন কখনো শোধ করা যাবে না।

সাইফের বক্তব্য শুনে উপস্থিত সবাই কড়তালি দিলো। বন্ধুদের এমন চমৎকার ভালোবাসায় অভিভূত হলো সবাই। রুমা তো কেঁদেই যাচ্ছে। নীরার চোখেও জল মুখে হাসি। অপরূপা লাগছে নীরাকে। আর সেই দৃশ্য একটু দূরেই দাড়িয়ে শিহাব মুগ্ধ হয়ে দেখলো।

– আমিও তোদের খুব ভালোবাসি। আমি যখন আমার অক্ষমতা নিয়ে আফসোস করতাম কষ্ট পেতাম, তখন তোরাই আমাকে সামলাতি। কখনো বুঝতে দিতি না আমি একটু আলাদা। যখনই আমি সমস্যায় পরতাম তখন তোদের বলতে হতো না। তার আগেই তোরা হাজির হতিস। কখনো আমাকে একা ফিল করার সুযোগ দিসনি। আমার লাইফের সেরা দুইজন এই তোরাই। আর তোদের জন্য আমি এটুকু করবো না? বরং যা করেছি তা খুবই সমান্য। এখন সাইফ আমার গুণগান শেষ হলে রুমাকে প্রপোজটা করা যাক।

নীরার কথা শুনে সবাই আবারও মুগ্ধ হলো। এত চমৎকার বন্ধুত্ব আজকাল দেখা যায় না।

-সাইফ ভাই প্লিজ এবার তো হয়ে যাক।

সাইফকে তাড়া দিলো মিলা। সাইফ রুমার সামনে হাটু গেড়ে বসলো।

-রুমা আমি জানি তুই রাগ করে আছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর তোকে ছাড়া আমি আমার অস্তিত্বও ভাবতে পারি না। সেই প্রথম থেকে তুই ছাড়া আমি কিছুই না। এতদিন ভয় ছিলো। কিন্তু আজ নেই। তুই কি আমার বউ হবি রুমা? কথা দিচ্ছি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোকে আগলে রাখবো। অনেক ভালোবাসি তোকে।

রুমা এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। আজকের দিনের শেষটা তার জীবনের সেরা মুহূর্ত যা সে কখনো ভুলবে না। তার কান্না দেখে তিতলি,মিলা,রেহান সবাই তাড়া দিচ্ছে ইয়েস বলার জন্য।

-নীরাকে নিয়ে এতো ভালো কনফেশন দেওয়ার জন্য তোকে ক্ষমা করলাম। আর একসেপ্ট করলাম। নইলে করতাম না। আমি হবো তোর বউ। ইয়েস!

কাঁদতে কাঁদতেই কথা গুলো বললো রুমা। সাইফ হেসে ফেললো। রেহান সিটি বাজাচ্ছে। তিতলি মিলা হাইফাইভ করলো। আবার রুমা নীরার কাছে গেল। জড়িয়ে ধরলো। নীরা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে রুমা তাকে জড়িয়ে ধরে গঙ্গা যমুনা বানাবে।।

-নো রুমা আর একদম কাঁদবি না। কাঁদলে আমার হাতের চড় খাবি।

রুমা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেললো। জড়িয়ে ধরে বললো

-তুই এত ভালো কেন নীরা? আই লাভ ইউ।

-আর কয়বার বলবি তোরা হয়েছে তো এবার।

সবাই একসাথে হেসে ফেললো। এবার সবার বাড়িতে যাওয়ার পালা। সুন্দর একটা সময় কাটিয়ে সবাই যে যার গন্তব্যে যাবে। ক্যাফে থেকে বেড়োতে বেড়োতে রাত এগারোটা বেজে গেল সবার। ক্যাফে থেকে একটু দূরে গাড়ি পার্ক করার জায়গা যেতে একটু সময় লাগে। সবাই ওদিকেই যাচ্ছে। তিতলি আর মিলা গল্প করতে করতে হাটছে। ইতমধ্যে তাদের দুজনের সুন্দর বন্ডিং হয়ে গেছে। আর তাদের পেছনে জ্বালাতন করার জন্য রেহান হাটছে। তিতলি আর মিলা দুইজনকে সে জ্বালাচ্ছে। আর ওরা দুইজন জোট বেঁধে রেহানকে খোঁচাচ্ছে। সাইফ আর রুমা হাতে হাত রেখে হাটছে। দুইজন দুইজনের মান অভিমান সব ভেঙ্গে প্ল্যানিং করছে বিয়েতে কি কি করবে।

সবাইকে আগে পাঠিয়ে নীরা ক্যাফে বন্ধ করলো। ক্যাফের কর্মচারীরাও আজ অনেক কাজ করেছে। এজন্য নীরা ওদের কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে চলে যেতে বলেছে। নীরা ক্যাফে বন্ধ করে পেছনে ফিরে দেখলো শিহাব দাড়িয়ে আছে। আর তার একটু দূরেই ওরা সবাই গল্প করতে করতে যাচ্ছে।

-আপনি এখনো এখানে? কোনো সমস্যা?

শিহাব কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে কি বলবে আমি আপনার জন্য দাড়িয়ে আছি নীরা। চলুন দুজন একসাথে গল্প করতে করতে হাটি। আমি নাহয় আপনার হাত ধরে থাকবো। নিজের এমন ভয়াবহ ভাবনায় নিজেই চমকে গেল শিহাব। এসব সে কি ভাবছে। আর কেন ভাবছে। জানে না সে!

-মানে একটা কল এসেছিলো জরুরি। এজন্য এখানে দাড়িয়েছি।

আমতা আমতা করলো শিহাব।

-ও তো শেষ?

-হ্যা কি শেষ?

হকচকালো শিহাব।

-কথা বলা ফোনে? আপনিই তো বললেন কল ধরতে এখানে দাড়িয়েছেন।

-ও হ্যা শেষ চলুন এবার যাই।

-হ্যা চলুন

দুজন পাশাপাশি হাটতে লাগলো। নীরা আস্তে আস্তে হাটছে যার কারনে শিহাবও আস্তে হাটতে লাগলো। সে কি নীরার হাত ধরে হাটতে সাহায্য করবে? নীরা কি এতে খুব মাইন্ড করবে। একবার জিজ্ঞেস করেই দেখুক শিহাব। একবার জিজ্ঞেস করলে তো আর কিছু হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে বলেই বসলো শিহাব।

– নীরা, ইয়ে মানে আমি আপনার হাতটা ধরতে পারি নীরা?

শিহাবের প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকালো নীরা। পরক্ষনেই নিজের অবাক ভাব কাটিয়ে ফেললো।

-আমি একাই চলতে পারি মিস্টার রেজা। আমার আম্মা আমাকে একা চলতে শিখিয়েছেন। অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে শেখাননি।

নীরার কথায় একটু গিল্ট ফিল হলো শিহাবের। আবার সে এও ভাবলো আমাকে হাত ধরতে দিলে আপনার কি সমস্যা নীরা। জানি কারো ওপর নির্ভর হতে হয় না। তবুও আপনার হাত ধরতে আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে। এই ইচ্ছে টা তো মন্দ না। তবে কেন আমাকে হাত ধরতে দিবেন না? মনের কথা মনেই রইলো শিহাবের। সে মুখে কিছু বলতে পারলো না।

-একটা কথা বলি?

অনুমতি চাইলো শিহাব।

-শিওর।

-আমাকে প্লিজ মিস্টার রেজা বলবেন না। আপনি আমাকে মিস্টার রেজা বললে আমার মনে হয় আমি আমার ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলছি। আমাকে শিহাবই বলবেন প্লিজ।

শিহাবের কথায় হেসে ফেললো নীরা।

-আচ্ছা শিহাব।

হাসতে হাসতে বললো নীরা। ধীরে ধীরে হেটে চললো দুজন। দুজনের মনে দুরকম ভাবনা। কেউ আর কোনো কথা বললো না। আকাশের চাঁদের আলোয় চারদিকে ঝলমল করছে। নীরা মুখে হাসি নিয়ে আস্তে আস্তে হাটছে। শিহাব আড়চোখে নীরাকে দেখছে। সেই দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here