অপেক্ষার প্রহর পর্ব-১

0
3770

অপেক্ষার প্রহর(পর্ব-১)
শিলা অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল দিচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা খুলছে না। বাবার কিছু হলনাতো। শিলার বাবা শওকত সাহেব হার্টের রোগী। ২ বার হার্ট এট্যাক করেছে। চিন্তায় পড়ে গেল শিলা।শিলার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি আছে তালার। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে শওকত সাহেব বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন। একদৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
“বাবা”শিলা ডাকল। শওকত সাহেব জবাব দিলেন না।শিলা বাবার কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ?কথা বলছ না কেন?”
“কি হয়েছে? আগে বল তোদের কি হয়েছে? দেশে এত ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তোরা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছিস না?”
“মানে? কোথায় আবার কি ঘটলো?”
“২ দিন পর পর এখানে সেখানে জঙ্গি হামলা হচ্ছে, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, মেয়েরা রেপড হচ্ছে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কোথায় কি ঘটলো।”
“তা তোমাকে এই মূল্যবান তথ্যগুলো কে দিল জানতে পারি কি? আর এসব জেনে তুমি কি করবে? কে কোথায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে,কার কোথায় রেপ হয়েছে তা দিয়ে তোমার দরকার কি?”
“অবশ্যই ভাল কেউ বলেছে। পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটে এসেছে। কি যেন নাম। ওহ মনে পড়েছে। শফিক নাম। অনেক ভদ্র ছেলে। আর আমি কি করব মানে? এই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছি- দেশের মানুষের খবর জানব না আমি? অনেক কথা জানালো শফিক, আবার চা ও করে খাওয়াল।”
“চা করে খাওয়াল মানে? কোথায় চা বানিয়েছে?”
“বোকার মত কথা বলিস কেন? ওর বাসা সব অগোছালো না? আমাদের বাসায় বানিয়েছে।” তার মানে রান্না ঘরের অবস্থা বারটা বাজিয়েছে।শিলার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অভদ্র প্রতিবেশী নিয়ে থাকতে হবে এখন।নিজের রুমে চলে গেল।
শফিক দরজা খুলে শিলাকে দেখে আবার দরজা বন্ধ করে দিল।শফিকের পরনে শুধু পায়জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি। শিলা অবাক হয়ে গেল। ৫ সেকেন্ডের মধ্যে আবার দরজা খুলল।পায়জামার উপর একটা সবুজ রঙের টিশার্ট।
“সরি, আমি ভেবেছিলাম দারোয়ান এসেছে। আসলে দারোয়ানকে বলেছিলাম ওর ফুলের ঝাড়ুটা দিতে। ঘরটা খুব নোংরা হয়ে আছে তো।”
“আপনি দারোয়ানের সামনে এভাবে বের হতেন?আর আপনার দরজায় তো লুকিং গ্লাস আছে। লুকিং গ্লাস দিয়েই তো দেখা যায় কে এসেছে?”
“দারোয়ান বলল ২ মিনিটের ভিতর আসছি, তাই আর দেখার প্রয়োজন মনে করিনি।”
“যেটাই হোক, আপনি শফিক সাহেব?”
“জি, মিজানুর রাহমান শফিক। বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা।”
“শুনুন মিস্টার মিজানুর রহমান শফিক সাহেব, আপনার বাড়ি কোন জেলার কোন থানার কোন গ্রামে সেটা জানার আমার কোন প্রয়োজন নেই, আমি শুধু জানতে চাই আপনি আজকে সকালবেলা আমার বাবার সাথে কি নিয়ে আলাপ করেছেন?”
“জি আপনার বাবা কে?”
“আপানার প্রতিবেশি পাশের ফ্ল্যাটের জনাব শওকত আলী।”
“ও উনি আপনার বাবা? এই দেশের বিষয়াদি নিয়ে একটু আলাপ আলোচনা করলাম আর কি? উনি মনে হয় অনেক কিছু জানেন না। দেশে জঙ্গি, ধর্ষণ এগুলো খুব ভয়ঙ্কর আকার ধারন করেছে কিনা….”
“দেখুন শফিক সাহেব আমার বাবার ২ বার হার্ট এট্যাক হয়েছে। কোন উত্তেজনাকর খবর তাকে শোনানো মানা।আমি নিজে তাকে সকালবেলা হাঁটাতে নিয়ে যাই।আমাদের বাসায় কোন পত্রিকা রাখা হয় না। এমনকি বাসার টিভিতে সমস্ত খবরের চ্যানেল লক করে রাখা হয়েছে যাতে বাবা কোন খারাপ খবর না শুনতে পারেন। আমি আপনাকে প্রথম এবং শেষবারের মত অনুরোধ করছি প্লিজ আপনি আমার বাবার সাথে দেশ- বিদেশের কোন রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক কোন বিষয় নিয়ে কোন কথা বলবেন না।”
“সরি, আমি আসলে এসব জানতাম না।”
“ঠিক আছে। আসছি।” এই বলে শিলা বেরোতে গেল। এমন সময় দারোয়ান ঝাড়ু নিয়ে আসল।
“লন ভাইজান।”
শফিক পকেট থেকে টাকা বের করে দারয়ানের হাতে দিয়ে বলল, “এই নাও টাকা। তুমি কাল আমার জন্য একটা শলার ঝাড়ু আর একটা ফুলের ঝাড়ু নিয়ে এসো।”
“যে আইচ্ছা। তয় আইজকাল প্ল্যাস্টিকের সুন্দর সুন্দর ঝাড়ু বাইর হইছে। অইগুলা ভালা কাম করে” তার মানে আরও কিছু টাকা দিন, আমি ভাল জিনিষটা আপনাকে এনে দিচ্ছি। “ঠিক আছে, তোমার যেটা ভাল মনে হয় সেটাই এনো, অতিরিক্ত লাগলে তোমার থেকে দিয়ে দিও। আমি তোমাকে পরে দিয়ে দিব।”
দারোয়ান রুষ্টচিত্তে ফিরে গেল।শিলা ও ফিরে যাচ্ছিল। “Excuse me miss…”
“শিলা। আমার নাম শিলা।”
“মিস নাকি মিসেস?” শিলা অবাক হয়ে গেল। রাগত স্বরে জবাব দিল, “মিস।”
“মিস শিলা আপনি কি বলতে পারবেন ডাল কিভাবে রান্না করতে হয়?পানি ফুটিয়ে ওঠার পর ডাল দিব নাকি ভাত রান্না করার মত?”
“আপনার বাসায় তো আর কাউকে দেখছি না, আপনি একা থাকার জন্য এত বড় বাসা ভাড়া নিয়েছেন?”
“না আসলে আমি মেসেই থাকতাম। আমার মা অসুস্থ তো। ওনাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনব আর আমার ছোট ভাই ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছে। ও ইউনিভার্সিটি ভর্তির কোচিং করবে তো। তাই এই বাসা নেয়া।”
“ও।” এই বলে শিলা চলে আসছিল।
“বললেন না, ডাল কিভাবে রান্না করব?”
“আপনি একা মানুষ। আপনার খাওয়ার জন্য আলাদা করে ভাত, ডাল, তরকারী রান্নার প্রয়োজন কি? একটা পাতিলে চাল, ডাল, আলু, লবন, হলুদ, কাঁচামরিচ, পানি দিয়ে বসিয়ে দিবেন। শেষের দিকে উপরে একটা ডিম ছেড়ে দিবেন। ব্যস। আর যদি আপানার এত রেস্টুরেন্ট এর মত করে খেতে ইচ্ছে করে তাহলে সিদ্দিকা কবিরের “রান্না ও পুষ্টি” বইটা কিনে নিবেন।আগে মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় তাদের অন্যান্য জামাকাপড়ের সাথে ব্যাগে করে এই বইটা নিয়ে যেত।এখন মোবাইলে ইন্টারনেট এর মাধ্যমে রান্না শেখা সহজ হওয়ার কারণে এত মোটা বই নেয়ার প্রয়োজন হয়না।”বলে শিলা ঘুরে বাসায় চলে আসল।
শওকত সাহেবের রাগ এখনও কমেনি। গুম হয়ে বসে আছেন।শিলা টেবিলে খাবারের আয়জন করছে।
“খেতে এসো।”
“খাব না। আমি কিছু খাব না। তোরা খা। মন দিয়ে খা। খেয়ে দেয়ে নাক ডেকে ঘুমা।দেশে থাকে অথচ দেশের জন্য কোন চিন্তা ভাবনা নেই। আবার আমাকে বলে, কে কোথায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তা দিয়ে তোমার দরকার কি? এসব কথা বলার জন্য তোকে ডাক্তার বানানো হয়েছে?”
“না এসব কথা বলার জন্য আমাকে ডাক্তার বানানো হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার জন্য অনেক বড় বড় মানুষ আছে।আমার চিন্তা না করলেও চলবে। এখন খেতে এসে তুমি কি আমাকে উদ্ধার করবে প্লিজ। তোমাকে খাওয়ানো ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে।” শওকত সাহেব কথা বললেন না।
“বেলে মাছের ঝোল রান্না করেছি”। শওকত সাহেবের খুব পছন্দের তরকারি।শওকত সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে খাবার টেবিলে আসলেন।“ধনেপাতা দিয়েছিস?”
“হুম, দিয়েছি।”
শওকত সাহেব তৃপ্তিভরে খাচ্ছেন। শিলার খুব ভাল লাগে দেখতে।“বাবা তুমি সবসময় তৃপ্তি সহকারে খাও কেন? আমি কি ভাল রান্না করি?”
“অবশ্যই তুই ভাল রান্না করিস।”
“আমার মনে হয় তা না। মা মারা যাওয়ার পর তোমার মধ্যে একটা আশঙ্কা ছিল তোমার পছন্দের খাবারগুলো তুমি আর খেতে পারবে না। আমি আমার পছন্দের খাবার গুলোই রান্না করে তোমাকে খাওয়াবো। কিন্তু তোমার ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে।তাই তুমি প্রচণ্ড তৃপ্তিভরে খাও আর আমি মুগ্ধ হয়ে তোমার খাওয়া দেখি।”শওকত সাহেব কিছু বললেন না। কথা সত্যি। স্ত্রী মারা যাবার পর প্রত্যেক পুরুষ মানুষই এক ধরণের একাকীত্ব অনুভব করে। সেটা সে যে সময়ে বিপত্নীক হোক না কেন।মহিলাদের ক্ষেত্রে এই জিনিষটা কম দেখা যায়। মহিলারা ছেলে- পুত্রবধু, মেয়ে-মেয়ের জামাই, নাতিনাতনি নিয়ে বেশ ভাল সময় কাটায়।পুরুষ মানুষ বৃদ্ধ হলে বাড়ির মানুষরাও সেবা করতে সংকোচ বোধ করে। শওকত সাহেব এই দিক দিয়ে যথেষ্ট ভাগ্যবান। শিলা তার অনেক যত্ন করে।
“তরকারী বেশি থাকলে পাশের বাসার ছেলেটাকে একটু দিস তো। বেচারা বাসা বদলিয়েছে। হয়তো খাবারের আয়োজন করতে পারেনি।”
“ওনাকে আমি খিচুড়ির রেসিপি বলে এসেছি। উনি হয়তোবা খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে দেয়ে ঘুমুচ্ছে।”
“তবু একবার দেখ। বাসা বদলানোর ঝামেলায় ছেলেটা রান্নাই হয়তো করতে পারেনি।”শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবার সাথে তর্ক করে লাভ নাই।
শিলা খাবার নিয়ে যখন শফিকের দরজার সামনে দাঁড়াল তখনি দরজা খুলে গেল।“আসলে রান্না করার জন্য গিয়েছিলাম তখন দেখি অনেক কিছু নেই। তাই লিস্ট করেছি। আপনাদের বাসায় কি এগুলো হবে?”শফিক শিলাকে লিস্ট দিতে যাচ্ছিল।এই এক ঝামেলা প্রতিবেশীর। আলু ভর্তা করতে যাচ্ছিলাম, দেখলাম আলু নেই, ২টা আলু হবে প্লিজ। এক কাপ চিনি হবে, লবন হবে। অনেক মশা, মশারি টাঙ্গানোর জন্য পেরেক ঠুকতে হবে, আপনাদের বাসায় হাতুড়ি হবে?শিলা বেশ বুজতে পারছে তাকেও এখন থেকে এই সমস্যা গুলোর মুখোমুখি হতে হবে।
“থাক, আপনাকে আর এত রাতে রান্না করতে হবে না।এই নিন। বাবা পাঠিয়েছে।”শিলা শফিকের হাতে খাবারের ট্রে দিয়ে চলে আসল।খাবারের পাশে একটা মশার কয়েলও ছিল।(চলবে)

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1361940640987626/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here