অপেক্ষার প্রহর (পর্ব- ১১)
এর মাঝে শফিক একদিন সুদীপ্ত আর ইয়াসমিনকে বাসায় দাওয়াত করে। শিলা আর শওকত সাহেবকেও দাওয়াত দেয়। শিলা প্রশ্ন করে, “রান্না কি আপনি করবেন?”
“জি।” শফিক সলজ্জ হেসে জবাব দেয়।
“আপনি রান্না- বান্না শিখে গেছেন?”
“না, মানে ঐভাবে না। আপনার কথামত সিদ্দিকা কবিরের বই কিনেছি। ঐটা দেখে রান্না করব।” শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।“আপনি কাটাকাটি করতে পারেন তো?” শিলা আবার জিজ্ঞেস করল।
“জি পারি।”
“ঠিক আছে। আপনি যান। আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি। আমিই রান্না করব।” শফিক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আসলে নিজের কাছেই ভয় লাগছিল কিভাবে রান্না করবে তা ভেবে।
“ইয়ে মানে আমার বন্ধু হিন্দু আর ওর স্ত্রী মুসলমান। আপনাদের কোন আপত্তি নেই তো?”শফিক জিজ্ঞেস করল।
“বন্ধু কার? আপনার না আমার?”
“জি আমার।”
“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে কেন? ”
রান্নার মাঝখানে সুদীপ্ত আর ইয়াসমিন চলে আসে।“কেমন আছ ইয়াসমিন? শরীর ভাল?” শফিক জিজ্ঞেশ করে।
“জি ভাল। আপনি ভাল আছেন ভাইজান?” ইয়াসমিন জবাব দেয়।
“হুম ভাল। তোমার কোন চিন্তা নেই। বাসায় ডাক্তার আছে। রান্না করছে। রান্না শেষে তোমার চেকআপ করে দিবে।”
“ডাক্তার?” সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে।
“আমাদের পাশের বাসায় থাকে। ডাক্তার শিলা। খুব ভাল ডাক্তার। বড় হাসপাতালে প্র্যাকটিস করে।”
“ডাক্তারের প্রয়োজন মনে হচ্ছে ইয়াসমিনের চাইতে তোরই বেশি” সুদীপ্ত বলল। শফিক আর ইয়াসমিন দুজনেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। “মানে?”শফিক জিজ্ঞেস করে।
“না মানে ডাক্তারবাড়ি থেকে তোমার জন্য পথ্য আসে, ডাক্তারের সাথে তুমি রান্নাবাটি খেল।এসবই চলছে আজকাল। তা মাসীমা জানে এসব?” ইয়াসমিন মুচকি হেসে ভিতরে চলে যায়।
“কি শুরু করলি এসব ইয়াসমিনের সামনে?” শফিক জিজ্ঞেস করল।
“ইয়াসমিনের জানা উচিত না ওর ভাইজান কি গুল খিলাচ্ছে একা ফ্ল্যাটে বসে বসে? কুমিরের চোখ কি করে পাখির নীড়ের মত চোখ হয়ে যায় জানা দরকার না?” কথা আর বেশি এগোয় না। শওকত সাহেব চলে আসেন।
সুদীপ্ত বার বার শফিককে বিনা কারনে বার বার রান্নাঘর থেকে ডেকে নিয়ে আসছে। “শফিক আঙ্কেল পানি খাবেন।”
“আমি পানি খাব না বাবা।” শওকত সাহেব বলেন।
“কেন পানি খাবেন না আঙ্কেল। এই বয়সে পানি বেশি করে খাওয়া ভাল। গ্যাস এর সমস্যা থাকবে না, কিডনি ভাল থাকবে।” শফিক ততক্ষণে চলে আসে। “পানি তো গ্লাসে আছেই।” শফিক বলে।
“এই বেকুব, দেখছিস না গ্লাসে ঢাকনা নেই। পানিতে ময়লা পরেছে না?”
শফিক রাগে গজগজ করতে করতে পানির জগ, গ্লাস দিয়ে যায়। গ্লাসের উপর ঢাকনাও দিয়ে যায়।
সবাই খেতে বসলে সুদীপ্ত শওকত সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, “আঙ্কেল আপনি তো মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের কোন একটা ঘটনা যদি আমাদের বলতেন।”
“যুদ্ধ নিয়ে নতুন করে কি বলব? প্রায় সবটুকুই তো জানা।”একটু চুপ থেকে বললেন, “ঠিক আছে, আজকে তোমাদের নিজের কিছু কথা বলি। জুন মাসের শেষের দিক। আমরা যুদ্ধ করতে করতে এগোচ্ছি। ৫ নং সেক্টর থেকে ট্রেনিং নিয়েছিলাম।১০ জন ছিলাম একসাথে। হাওরের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সাথে পিপাসাও। নৌকা করে যাচ্ছি কিন্তু নদীর পানিও খেতে পারছি না। নদীতে সব লাশ ভাসছে। নারী- পুরুষ- ছোট ছোট ছেলেমেয়ের লাশ। আমাদের সাথের একটা ছেলের প্রচণ্ড বমি পায় এগুলো দেখে। আমরা তাড়াতাড়ি নৌকো ভেড়াই। নদীতে বমি ফেলতেও কষ্ট লাগছিল। মনে হচ্ছিল নদীতে ভাসা এই লাশগুলোর উপর বমি করলে তাদেরকে অপমান করা হবে। নৌকো ভেড়ানোর সাথে সাথে ছেলেটা বমি করে। ঠিক হয় আমরা এখানে থেকে অপারেশন করব। কিন্তু এই গ্রাম সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা। আমদের সাথে দুইজন গ্রামের ভিতর গেল খবরাখবর নিয়ে আসার জন্য। প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছিল।
দুইজন ফিরে আসে একটা ১২-১৩ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে। ওর নাম ছিল জব্বার। জব্বার জানায় পাশের গ্রাম পর্যন্ত পাক বাহিনী চলে এসেছে। ওদের গ্রামেও হয়ত কাল-পরশুর মধ্যে চলে আসবে। জব্বার আমাদেরকে তাদের বাড়িতে খাবার খেতে বলে।
আমরা জব্বারদের বাড়িতে যাই। জব্বারের মা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে থাকেন। কি যে খুশি হলেন ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে কি বলব। সাথে সাথে মুরগি জবাই করে আমাদেরকে খাওয়ালেন। যাওয়ার সময় আমাদের সাথে গুড়-মুড়ি দিয়ে দিলেন সাথে খাওয়ার জন্য। এমনটাই ছিল যুদ্ধের সময়টুকু। কেউ কেউ নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে চাইতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।
হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে গেল। এত বছর পর এটাকে ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা বলতে ইচ্ছে করছে আজ। জব্বার জেদ ধরল আমাদের সাথে যাবার জন্য। এর আগে ওর মার কাছে অনুমতি চেয়েছিল যুদ্ধে যাবার জন্য। কিন্তু বিধবা মা একমাত্র সন্তানকে কাছছাড়া করতে চাননি। ছেলেকে অনুমতি দেননি যুদ্ধে যাবার। ছেলেরও জেদ হয়েছে মাকে না জানিয়ে যুদ্ধে যাবে না। আমাদের যাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরাই জব্বারের মাকে বলি জব্বারকে অনুমতি দিতে। যুদ্ধ না করলেও বিভিন্ন ছোটখাটো কাজে জব্বার সাহায্য করতে পারবে-হাতিয়ার বহন করা, আমরা না থাকলে হাতিয়ারগুলো পাহারা দেয়া, যুদ্ধশিবিরে কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে জব্বার আমাদের সাহায্য করতে পারবে। এছাড়া নতুন কোন জায়গায় গেলে সেই এলাকা সমন্ধে খবরাখবর নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই ভাবলাম জব্বারকে নিলে আমাদের জন্য সুবিধে হবে। ওর মাকে কিছুক্ষণ অনুরোধ করার পর ভদ্রমহিলা রাজি হলেন।
জব্বার আমাদের সাথে ভালই ছিল। এর মধ্যে আমরা অনেকগুলো অপারেশান চালাই। সবাই জব্বারকে অনেক পছন্দ করতাম। মাঝে মাঝে ও আমাদের গান শুনাত, চরমপত্র নকল করে শুনাত। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে অস্ত্রগুলো নেড়ে চেড়ে দেখত। হাতের টিপটাও প্র্যাকটিস করত। সময়টাও অন্যরকম ছিল। হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটা ছোট বাচ্চাকে দিয়ে রাইফেল, সর্টগান প্র্যাকটিস করানো আমাদের জন্য ভুল ছিল। কিন্তু সময়টা ছিল যুদ্ধের সময়। তাই ব্যাপারটা আর কারো কাছে অস্বাভাবিক ঠেকল না। বরং মনে হল ওর নিজের আত্মরক্ষার জন্য হলেও ওর হাতিয়ার প্র্যাকটিস করা উচিত।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আমরা নারায়ণগঞ্জে একটা অপারেশান চালাই। আমাদের মধ্যকার আলম নামের একজন পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। জব্বার কেন জানি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারল না। ও আমাদের না জানিয়ে একটা শর্টগান নিয়ে চলে যায়। নজর রাখে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প এর উপর। ও জানত আলমকে ঐখানে রাখা হয়েছে। আসরের আজানের পর তিনজন পাকসেনা আর একজন রাজাকার আলমকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওকে মারার জন্য। জব্বার ওদের পিছু নেয়। নদীর পাড়ে পোঁছানোর কিছু মুহূর্ত আগে জব্বার শর্টগান দিয়ে শত্রুপক্ষের চারজনকেই হত্যা করে। কিন্তু নিজেও বাঁচতে পারেনি। ওদের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয় জব্বারকে।আলম বেঁচে যায়। আলম আমাদের কাছে এসে সবকিছু খুলে বলে। বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার খুশি ছিল কিন্তু জব্বারকে হারানর কষ্ট আমদের সবাইকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। প্ল্যান ছিল আমরা সেখান থেকে সরে যাব। কারন আমাদের সাথে অস্ত্র-শস্র কম ছিল। কিন্তু জব্বার মারা যাবার পর আমরা ঐ ক্যাম্পের সবাইকে মারার জন্য বদ্ধপরিকর হই। ১ ঘণ্টার ভিতর আমরা অপারেশান চালাই আর অপেরেশানটা সাকসেসফুল হয়।” এই পর্যন্ত বলে শওকত সাহেব একটু থামলেন। সবাই চুপ করে শুনছে। শফিক এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। শওকত সাহেব পানি খেয়ে বলতে লাগলেন, “যুদ্ধ শেষে আলম আর আমাদের আরেকজন জব্বারের মায়ের সাথে দেখা করতে যায়। জব্বারদের গ্রামের আরেকজন আমাদের সাথে একসাথে ছিল। তার কাছ থেকেই ভদ্রমহিলা ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে। তারপরই মহিলা জেদ ধরে যেখানে ছেলে মারা গেছে তিনিও সেখানে যাবেন। আর কখনও সেখান থেকে ফিরবেন না। আলমরা সেখানেও ভদ্রমহিলাকে খুঁজতে যায়। কিন্তু মহিলাকে আর খুঁজে পায় না।”
একটু চুপ থেকে শওকত সাহেব বললেন, “যুদ্ধ কিছু মানুষকে আপন করেছে, আবার কিছু মানুষকে পর করেছে। আর আমাদের মত কিছু মানুষকে করেছে অপরাধী। আমরা শুধু একজন মায়ের কাছ থেকে তার সন্তানকে দূর করিনি, একজন নারীকে গৃহহীন করেছি। যতদিন বেঁচে থাকব এই অপরাধবোধ আমাদের তাড়া করে বেড়াবে।” বাকি খাওয়াটা সবাই নীরবে শেষ করল।
খাওয়া শেষে শওকত সাহেব নিজের বাসায় চলে গেলেন। এই সময় তিনি একটু রেস্ট নেন। সফিক,শিলা, সুদীপ্ত, ইয়াসমিন চারজন মিলে গল্প করতে থাকে। সুদীপ্ত কবিতা আবৃত্রি করে। শিলা গেয়ে শোনায় “আমি কান পেতে রই” গানটি।
সুদীপ্ত শফিকের পাশে বসে বলে, “এত খুশি হওয়ার কিছু হয়নি। ডাক্তার শিলা গান গাচ্ছে। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা না।”
“ইয়াসমিন যদি তোর কাছে ঐশ্বরিয়া রাই হয় তাহলে ও আমার কাছে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা হলে কি সমস্যা?” শফিক বলল।
“ইয়াসমিন আমার কাছে মোটেই ঐশ্বরিয়া রাই না। আমার কাছে ইয়াসমিন ইয়াসমিনই আর ঐশ্বরিয়া রাই ঐশ্বরিয়া রাই। তর্কের খাতিরে মানলাম শিলা তোর কাছে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। কিন্তু উনি টা কিভাবে ও হয়ে গেল তাইতো বুজলাম না।” শফিক মুচকি হেসে অন্য দিকে মুখ সরিয়ে নিল।